কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
রজনীগন্ধা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

আমার ঘরের কাঁচের ফুলদানীতে রেখেছি তোমায় রজনীগন্ধা ,
তোমার মিষ্টি গন্ধ লাভা ছড়ায় না ধমনীতে ।
এখন বাইরে ঘন অন্ধকারের বুক চিরে চিরে
চমকে উঠছে বিদ্যুৎ,
হাসনুহানার গন্ধে মাতাল
সরীসৃপের মত উন্মত্ত আমিও ।
প্রবল বর্ষণের পর
ক্লান্ত রিক্ত দেহ,
পঙ্কিল ক্লেদাক্ত পথ অতিক্রম করে এসে দেখি
মনের ভুলে জানালা করিনি বন্ধ ,
চূর্ণ হয়েছে কাঁচ,
তাজা রজনীগন্ধা ধুলায় লুটায়, অসহায় ।
তোমার সবুজ দেহ বুকে নিয়ে নিলাম ঘ্রাণ ।
আঃ কি সুন্দর তুমি রজনীগন্ধা ।
তোমাকে দেখে মনে পড়ে সানাই এর সুর
আর কিছু অঙ্গিকার ।
তুমি হতে পারনা বন্য ।
তোমাকে সাজিয়ে রেখে আমি যাই হাসনুহানার কাছে ,
স্নিগ্ধ সুরভী নিয়ে তুমি থাক প্রতীক্ষায় - আর
আমি খুঁজে ফিরি অরণ্য ।

. ****************  
.                                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
আমরা কবির কাছে কৃতজ্ঞ কারণ এই সব কবিতাই কবি নিজে আমাদের টাইপ করে পাঠিয়েছেন।
*
মহাকালের স্রোতে
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

তুমি কি জানতে তাকে ,
একশ বছর পরে ,
যে মেয়েটি তোমার লেখা বুকে করে ,
থাকবে বসে আনমনা ,
পথভোলা ,
আকাশ পথে দৃষ্টি মেলে দিয়ে ।
তার খোলা চুল অথবা তার বেণি ,
সারির আঁচল অথবা ওড়নি -
হাওয়ায় দোলায় দুলছিল কি -
দিচ্ছিল হাতছানি ;
ফিরে ফিরে তোমার গভীর চোখে ,
ঘিরে ঘিরে তোমার প্রেমিক বুকে -
অদেখা এক অজানা সেই মেয়ে ,
ছড়িয়ে ছিল কোন সে মায়াজালে !
তুমি মধুর হেসে ,
তার উদ্দেশে ,
ভাসিয়ে দিলে তোমার অনুভব ,
মহাকালের স্রোতে ,
তার ছোঁয়াতে রঙিন হয়ে উঠল মেয়ের মন ;
বুঝতে তুমি পেরেছিলে নাকি ,
কেমন হবে সে মাহেন্দ্রক্ষণ ।

. ****************  
.                                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
স্টিফেন হাউস
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

ছেলে আমার চাকরি পেয়েছিল,
ফুটপাথে বসে আছি তার অপেক্ষায় ।
দূরে ঐ গাছের উপর শকুন বসেছে ,
কি তীব্র ব্যগ্রতায় ।

দুদিন পাইনি দেখা,
কি জানি কেমন আছে একা একা ,
আমার চোখের মনি, প্রাণের স্পন্দন ।
দুরাত ফেরেনি ঘরে ,
বসে আছি তার অপেক্ষায় ।

ছেলে আমার বলেছিল,
মাগো তুমি চিন্তা কোরোনাকো ,
ফিরে এসে খেয়ে নেব যা রেঁধেছ তাই ।
জন্মদিনের পরে দুটো দিন চলে গেছে ,
বসে আছি তার অপেক্ষায় ।

আগুনে ঝলসান কালো মাংসের তাল ,
প্লাসটিকে মুরে রেখেছিল কাছে ,
সে নাকি আমার ছেলে ।
এত দুঃখেও হাসি পায় ।
তোমরা কি চোখের মাথা খেলে ,
আমার খোকার ছবি এই দেখ ,
ঠিক যেন দেবদূত হেসে চেয়ে আছে ,
খোকা ওরে আয় কোলে আয় ,
বসে আছি তোর অপেক্ষায় ।

. ****************  
.                                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
আমরা কেউ বুদ্ধ নই
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

ফুটপাথে মানুষের বসতি দেখেও
না দেখেই চলে যাই, চলে যাও তুমিও
নিজেদের সাজানো সংসারে ।
কারণ আমরা তো কেউ বুদ্ধ নই ।
তবু হৃদয়ের তন্ত্রীতে শির শিরে ব্যথা ,
তবু বুকে সমুদ্র-মন্থন শেষে
যে গরল উঠে আসে ,
সে কালিতে মূর্ত হয় তোমার কবিতা ।
আর আমি সে কাজলে দু-চোখ সাজাই ।

তোমার লেখনী বেয়ে পত্রিকায় উঠে আসে
দরিদ্র পরিবার ।
আর তুমি জায়গা করে নাও
পাঠকের হৃদয় মন্দিরে ।

আমার দু-চোখে কেন জল ছল ছল ,
আমার বুকের মাঝে নীল বিষ ব্যথা ।
ফুটপাথে সংসার আমিও দেখেছি ,
তবু কেন কবিতায় লিখিনি সে কথা ।

এতদিনে শীতরাতে, গনগনে রোদে ,
কুঁকড়ে , ঝলসে গেছে ,
দু-চারটে জীবন।
কে তাদের নিয়ে ভাবে ।
তুমি আছে তোমার কাব্য জগতে ,
আমি মরি ঈর্ষায় ডুবে ।

. ****************  
.                                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
বৃদ্ধাশ্রমে মা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

ফুটপাথে তোমার দেখে চমকে উঠেছিলাম ।
মাগো তোমার কাপড় কেন ছেঁড়া !
যে হাত পেতেছ – কত শীর্ণ ,
ফুলে আছে নীল নীল শিরা ।

দু-চার আনা দয়া করে, কেউ বা দুটাকা দেয়,
আমি দেব দশ ।
আহারে, খাওনি বুঝি সারা দিন,
দোকানী বুড়ি-মাকে দাও তো রুটি
আরও কিছু মিষ্টির রস ।

বিস্ময়ে হতবাক তুমি খাও পেট ভরে –
আমি বিব্রত ! প্রণাম করোনা করে জোরে।

প্রতিদিন নানা পথে দান করি –
সে কি শুধু পুণ্য সঞ্চয় –
হয়ত তাই, হয়ত বা নয় ।

পথে যত ভিখারিনী বুড়ি
তাদের কষ্ট দেখে বুক ফেটে যায় ।
বৃদ্ধাশ্রমে মা আমার থাকে কেন –
উত্তর পাবেনা তবু –সে জিগ্যাসার !

. ****************  
.                                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
জীবন গাড়ির শেষ কামরায়
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

দাক্ষিনাপণের বেঞ্চে বসে কফি খেলাম আমরা দু-জন
বুড়-বুড়ি ;
সময় বদলে যায়, মানুষ বদলায় না ।
সামনের বেঞ্চিতে চায়ের কাপে ধুঁয়া উড়িয়ে
কথার ফুলঝুরি জ্বালাচ্ছিল যে ক্-জনা
তরুণ-তরুণী, তাদের হাসির তাপে
স্মৃতি সেঁকে নিলাম ।শরীর বদলেছে ,
মন তো বদলায়নি একটুকু ।
বসন্ত-কেবিনের মোগলাই -কলেজ কেটে ম্যাটি-নি
সবি আছে আগের মতন- শুধু নেই পুরানো মানুষ ।
চায়ের কাপের উপর- চুরি করে দৃষ্টি বিনিময়
এক চিলতে হাসি -বুকের মধ্যে বেজে ওঠে বাঁশি
ফেলে আসা দিনের সুরে । চাও কি ফিরে তে ,
কফির ধোঁয়ার উপর দু-জোরা চোখ মিলে যায় ,
না না কখনো নয় ।
তোমাকে ফেলে যাওয়া নেই কোথাও ।
মাঝে মাঝে ফিরে ফিরে দেখা ,
সেই সব সবুজ-কোমল, মাধুরী মেশান
নেশা ধরান দিন গুলো , আর কিছু নয় ।
পাকা চুলে, কোঁচকান চামড়ায়, বেশ আছি
আমরা দু-জন বুড়-বুড়ি ,
জীবন গাড়ির শেষ কামরায় ।

. ****************  
.                                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
অবৈধ
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

অবৈধ,
তাই এত আকর্ষণ,
শুধু দূর থেকে দেখ ,
তাই চাও বন্ধন ,
আমার প্রতি প্রেম নেই ,
প্রেম আছে অন্তরে তোমার
কল্পনার সাথে ,
যদি কাছে পাও
চাইবেনা আমাকে আর ,
সে দুঃখ অপার- তোমার আমার ,
তার চেয়ে এই ভাল
আশার প্রদীপ জ্বাল ,
কর তপস্যা ,
ভিক্ষা চেয়ে ফিরনা আমার কাছে ,
বিরহ-বেদনা ভার লাগে ভাল ,
যতদিন আছে দূরে ,
যদি আস অন্তঃপূরে ,
পাবেনা আমায়
বাহির থেকে দেখো আমায় ,
স্পর্শ কোরো সুরে ।।

. ****************  
.                                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
প্রতারক
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

তোমাকে বিদায় করে এসে দেখি ,
অশ্রু হয় ঘিরেছ আমায় ।
সানাইয়ের সুরে সুরে রক্ত ঝরে পরে ,
বুকের রক্ত মেশে লাল চেলি-জোড়ে ।
গোধুলিএর রঙে রাঙা গোলাপি আকাশ ,
প্রতিচ্ছবি ফেলেনি এখানে ,
এই বুকের ভিতর ।
নীল বিষ ব্যাথা ঠেলে ঠেলে ওঠে ,
চোখে, মুখে, ঠোটে ,
কুমকুম চন্দন ফোঁটার আড়ালে ,
রঙ মাখা মুখে আর গালে ।
বেনারসী সারী গায়ে বউ হয়ে বসি ।

জীবনের নতুন প্রভাতে ,
প্রতারক আমি ,
উপহার দিতে তাকে ,
এ হৃদয় বাসী ।

. ****************  
.                                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
চাই অসভ্য বিচার
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

আধুনিক মাটি, আনবিক ব্যাধি ভরা,
জরার্জীন গাটি, আঁকা বাঁকা শিরা,
কালেরে লন্ডভন্ড, করেছে এ কি কান্ড
কঙ্কাল করেছে মানুষ,
ভাল ছিল গান্ডীব ধণুষ ।
আত্মীয় কাকে বলি, আত্মা নেই আর ।
আছে শুধু বুভুক্ষুর আর্ত হাহাকার ।
অরে মহাকাল তোর ললুপ রসনা
ফেলে রেখে গেছে কেন জীর্ন বাসনা !
চিতা জ্বলে দূরে আমি সমুখে দাঁড়ায়ে,
চেয়ে চেয়ে দেখি বিশ্ব কি ভাবে হাড়ায়
দয়া, মায়া, ক্ষমা , প্রেম, বিশ্বাস সততা,
দূষণে ঘিরেছে প্রাণ, শুধু চাই যে ক্ষমতা ।
মার, কাটো , শেষ কর, কর বলাতকার ,
কন্যাসম ! তাতে বল যায় আসে কার !
মিথ্যা বোঝার ভার নিয়ে দেহ ঘিরে
নগ্ন অন্তরে দেখ পশু বাস করে ।
ফিরে নাও ফিরে নাও ফিরে নাও এরে,
অট্টহাস্য বিদ্রূপের আছে শুধু ঘিরে ।
বিচার কে করে, কাকে নালিশ বা করে,
পশুর অধম জীব পুলিশের ঘরে ।
এই যদি সভ্যতা, চাই না তা আর,
টেনে আন পথে ওকে
চাই অসভ্য বিচার ।।

. ****************  
.                                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
মা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

তুমি নগ্ন অসহায়, ফুটপাথে বসতি বানাও,
বিগবাজার, সাউথ সিটি মল,
ফুটপাথে এক হাঁটু জল।
কিছু টাকা পেয়েছ হয়তো তুমি
আমার করুণায় ।
আমি স্বর্গের সিঁড়ি তৈরী করি
ছোটো ছোট দানে ।
জর্জেট সারী, জরি-বুটি, রুবির রক্ত ঝরে কানে ।
অনেক পেয়েছি আমি,
বাড়ি, গারি, সোনা,
তবু আমি স্বর্গের সিঁড়ি খুঁজে ফিরি।
স্বর্গের সিঁড়ি বুঝি এই কটা,
তাকে হাতে যায় গোনা !
তোমার শুকনো বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে মরে মেয়ে,
আমার সিক্ত বুকে টন টনে ব্যাথা-
কি করে বোঝাই আমি,
ফেলে গেছি একরাতে তোমার পায়ের কাছে
আমার সদ্যোজাত মেয়ে ।

. ****************  
.                                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর