কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
|
ভাবুক
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
ভেবে ভেবে ভাবুক হল ভবতোষের ভাই
ভাবের ঘরে গিয়ে বলে ভাবনা কিছু চাই।
ভাবের ঘরের দ্বারি বলে চলবেনা ও চালাকি
ভাব মুলুকে আসতে চাও যে খুলতে পারবে তালা কি?
ভাবুক তুমি প্রমান কোথায় , কি ভেবেছ এদ্দিনে।
খাতার পাতায় লিখে লিখেও শেষ হবেনা সাতদ্দিনে
এমন যদি লিখতে পারো, তবেই পাবে ভাব দেনা
নিলে তো ভাই নকল ভাবুক, ভাবের দ্বারি ভুলছেনা
এই বলে সেই আজব দ্বারি হাসলো এত হা করে
যত ছিল ভয়ের ভাবনা ঢুকল মুখে ধাঁ করে।
খানিক কেঁপে খানিক ঝেঁপে বল্লে দ্বারি সেলাম ঠুকে
হুজুর বড় ভুল হল লাগবেনাকো প্রমান আর।
ভাই বল্লে ভবতোষের -এবার দ্বারি খোলরে দ্বার।
যেইনা বলা হঠাত্ চোখে দেখল যেন আঁধার ভাই
কানটি ধরে দাড়িয়ে দাদা পড়ার ঘরে ঘুম কে যায়!
সেই জন্যেই বলছি তোমায়,
ভাবুক হওয়া তাকেই মানায়
ভাবনাটি যার মাথায় রয়।
ভাবের ঘরে করলে চুরি,
এমন হাল যে সবার হয়।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আমরা কবির কাছে কৃতজ্ঞ কারণ এই সব কবিতাই কবি নিজে আমাদের টাইপ করে পাঠিয়েছেন।
নগ্ন প্রেম
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
এতদিন ছিল ভালো
বনে বনে গোপনে প্রেম
নদীর নিথর বুকে ছায়া ফেলে।
মাতাল হাওয়ার সাথে ওড়েনি আঁচল,
ছিল স্তব্ধ অচঞ্চল
লাজুক ফুলের মত ।
কোথা হতে এল ঝড়
বন নেই হোয়েছে শহর।
আঁচল খসেছে শুধু দৃষ্টিতে।
আয়নায় কি দেখেছে মানুষের চোখে
অরন্য ছিল ভালো
শহর করেছে নগ্ন ওকে ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
মোহো-ভুল-ভ্রান্তি
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
আমি তোমার কাছে যেতে চাই
কোথায় আছ তুমি
আকাশে, বাতাসে, নদীতে, সাগরে !
নাকি আগুনে পুড়ে হয়েছ ছাই ।
আমি তোমার কাছে যেতে চাই-
আর্তনাদের মত শুনি
প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে আসে
ধাক্কা খেয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে,
যে কথা আমি শুণ্যে ওড়াতে চাই ।
আমি তোমার কাছে যেতে চাই-
যে প্রেম দেয়নি ধরা,
রয়েছে গোপন
আমার অন্তরে, তোমার দেহঘরে,
আমি তাকে কাছে পেতে চাই,
আমি তোমার কাছে যেতে চাই ।
*************************
সে কৌতুক করেছিল,
আমি তখন ঠিক বুঝিনি,
তবু ভাল লেগেছিল।
কৌতুক তার নেশা,
নদীতে ফেলেছিল ছিপ
আর জাল ছড়িয়েছিল সরোবরে,
অমি খুব ভোরে উঠে
মাছ হয়ে ছিপটাকে নিয়েছিলাম গলায়
আর বোয়ালমাছের মতন জাল জড়িয়ে
নিছিলাম সারা গায় সেদিন সন্ধায় ।
সে কৌতুক করেছিল।
কৌতুক তার পেশা,
ছিপ রেখে, জাল ছেড়ে
সে যখন ফিরে গেল তার ঘরে
তখন গভীর রাত।
আমার মনে তখন মুক্তির আশা ।
কিন্তু আমি অনেক খুঁজেও পাইনি আমার হাত ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
পুবের জানলা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
ছোটো একটা জানালা পুবের
খোলা রাখি।
আলো আসে দেখি যেন
বন্যা - সে নিয়ে যায় সকল আঁধার
আমার ঘরের, ছোট্ট একটা জানালা শুধু
রাখি খোলা । মনে আশা হাওয়ায় ভাসা
তোমার দেশের তরঙ্গ সে
যদি আসে। আমার আকাশ বাতাস
যদি যায় ছুঁয়ে সে ।
পুবের একটা জানলা,
আমি বন্ধ হতে দিইনা তাকে,
ঝড়রের রাতে বৃষ্টি ভেজা হয়েও তবু
সেই জানলায় দাড়িয়ে দেখি
আসছ নাকি
মনেও আমার পড়ে নাযে
জান কিনা তুমি আমার সেই ঠিকানা
পুবের জানলা খানা॥
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ফুলে ভরা আমার জঙ্গল
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
কতবার, কত জত্নে বাগানের কোনে
ছোটো ছোটো গাছ আমি করেছি রোপোণ।
কত আশা নিয়ে কুড়িটির ঘ্রাণ
আমি করেছি গ্রহণ ।
ঝড় নেই, জল নেই,
নেই বজ্রপাত ।
তবু কার হাত-
চুরি করে নেয় ঠিক
ফোটে যেই ফুল
আমার বকুল ।
অভিমানে তাই আর
যাইনা বাগানে ।
দিইনা তো জল-
আমার বাগান নেই-
সেটা হয়েছে জঙ্গল ।
তুমি আজ ডেকে গেলে ফুল চাই বলে।
মনে ভাবি, যাই তবে সব রাগ ভুলে ।
এসে দেখি একি কান্ড
এ কার বাগান!
এত রূপ, এত রঙ
কে দিল যোগান !
এতো চেষ্টা, এত আশা হয়েছে বিফল ।
আজ দেখি ফুলে ভরা আমার জঙ্গল ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ভাগ্যলেখা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
সে এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায় সারাটি দিন ,
বসে থাকি একা একা ।
কি জানি কি লিখেছে যে ভাগ্যলেখা ।
বোঝালেও কি বুঝবে নাকি
সে যে ভীষণ বোকা ।
শূণ্য ঘরের দরজা জানলা হা হা খোলা ,
কখন যে কোন আসবে ডাকাত যায়না বলা ।
কোনো কথায় কান দেবে না ছুটছে খালি ।
পার হয়ে যায় বড় রাস্তা চোরা গলি ।
কাগজের টাকার পাহাড় করছে জরো ।
ধনী তাকে হতেই হবে আরো আরো ।
ছিঁচকে চোর আর বড় ডাকাত
ঘুরছে কেবল তাকে তাকে ,
কখন সুযোগ মিলবে তারা লুঠবে কাকে ।
আমি কেবল ঘরের ভিতর বসে বসে
তাকাই মুখে , আর কতদিন সময় গেলে
মন দেবে সে আমার দিকে ।
কবে সে যে খুঁজে পাবে সেই মুলধন ,
হৃদয় জুরে আছে যা
তার পায়না নাগাল কোন চোরে -
বিলিয়ে দিলেও সে ঘর খুলে।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
দুষ্টু মিষ্টি
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
এক যে ছিল ছোট্ট মেয়ে নামটা যে তার মিষ্টি
দেখতে যেন মোমের পুতুল গ্রীষ্মকালের বৃষ্টি ।
দুষ্টু ছিল তারই যমজ –দেখতে নয় কো ভাল
বুদ্ধিটাও যে বোকার মতন রঙ টা আবার কালো ।
বাবা-মায়ের আদরের ধন চোখের মনি মিষ্টি
আর একটি মেয়ে এমন কেন একি অনাসৃষ্টি
ভাল জিনিস মিষ্টি পাবে মিষ্টি খাবে আগেতে
আর যা থাকার বেঁচে-বর্তে দুষ্টু পাবে ভাগেতে ।
বাবা-মা তে বেড়াতে যায় মিষ্টি চলে সাথেতে
দুষ্টু যদি বায়না ধরে গাঁট্টা পরে মাথাতে ।
এমনি করে দুই বোনেতে বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে
দুষ্টুর মন বিঁধে থাকে অনাদরের তিরে তিরে ।
বর্ষাকালের এক দুপুরে বাড়ির চাকর রাজকুমার
আছাড় খেলো এমন জোরে ভাঙ্গল যে তার পায়ের হাড়।
পরের দিনে মায়ের গায়ে কোথা থেকে এলো জ্বর
বিপদ দেখে মিষ্টি যেন দেখল চোখে অন্ধকার ।
কেই বা দেবে ভাতটা বেড়ে কেই বা করে রান্না
মামার বাড়ি যাবে বলে মিষ্টি ধরে কান্না ।
কাছে এসে আদর করে দুষ্টু বলে করুণ স্বরে-
মাগো তোমার কোথায় কষ্ট- কেমন করে ধরল জ্বরে !
ডাক্তার রোজ বসেন যে ঐ পাশের বাড়ির দোকান ঘরে
যাব কি মা ছুট্টে আমি, আনব কি মা তাকে ধরে ?
মা ভাবেন কেমন করে এমন পাষাণ ছিলাম আমি –
কত দুঃখ দিয়েছি যে জানেন কেবল অন্তর্যামী।
বুকে ধরে বলেন মানিক তুই যে আমার রত্ন
কোনোদিনই তোকে আমি করিনি তো যত্ন ।
পাশের ঘরে বসে বাবা শোনেন সব ই নিজের কানে
ভগবান আছেন ঠিকই ভাবেন তিনি মনে মনে ।
বাবা মায়ের স্নেহের ধারা সমান ভাগে করে
দুটি মেয়ের ছোট্ট জীবন আদরে দেন ভরে।
দুষ্টু মিষ্টি দুই বোনেতে ঘর করেছে আলো
বাইরের রূপ নাই বা থাকুক- মনের আলো জ্বাল ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আড়ি
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
কতদিন দেখা নেই গণেশের সাথে,
ভাবে খুকু কথা সেই মাথা রেখে হাতে ।
খুকু খুকু ডেকে আজ সারা হল সব ,
খুকু কেন চুপ চাপ নেই কলরব ।
খুকুর বন্ধু সব শোনো বলি তবে ,
গণেশটা এলে ফিরে, খুকু কথা কবে ।
এত দিন হয়ে গেল আসে নাসে কেন ,
আর কেউ দেশে আর যায় নাকো যেন ।
সে না এলে কার সাথে খুকু করে আড়ি ,
গণেশকে বল যেন আসে তাড়াতাড়ি ।
কত কথা খুকুটার পেটে আছে জমে ,
বলছেনা বলে দেখ খিদে গেছে কমে ।
গণেশকে ‘বোকা’ বলে হেসেছিল খুকু!
সে তো শুধু ঠাট্টা গো বোঝে না এটুকু?
হেরো বলে দুয়ো দিয়ে নেচেছিল নাকি,
গণেশ যে মহা-পাজি ভুলে গেছ তাকি ।
পেটুক বলে ও নাকি ডেকেছিল কবে-
গোপন কথাটা আজ শোনো বলি তবে ,
মামা-মাসি যত টফি, চকলেট দিল ,
টিনের বাক্সে এক রেখেছে সেগুলো ।
গণেশটা ফিরে এলে খাবে এক সাথে ।
তোমর তো দোষ ধর খালি সব তাতে ।
ছুটি তো হয়েছে শেষ স্কুল ঘুলে গেল,
গণেশ কে তাড়া তাড়ি চিঠি লেখে ফেল ।
দেরি যেন করে না সে আর,
পথ চেয়ে খুকু শুধু করে ঘরবার ।
দেমাকিটা এলে ফিরে পরে ,
দেখো ঠিক খুকুমণি দেবে আড়ি করে ।।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আমার ভাষা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
আমার ভাষা আমার জন্য, তোমার জন্য নয়ত।
আমার মত ছোট্ট ছেলে আছে কোথাও হয়ত।
আমি যখন বলব ‘চ যাই নীল পাহাড়ের দেশে’ ।
আমার সঙ্গে চলবে সে ঠিক কল্পরথে ভেসে।
আমি বলি ‘ভুতের দেশে মামদো ভুতের বাড়ি যাই’।
ছোট্ট বন্ধু বলবে ‘এমা, এটাই তো ঠিক আমি চাই’।
তুমি বলবে ‘ভেল্কি নাকি এসব তোমার চালাকি’।
কী করেই বা বুঝবে তুমি, ছোট্ট হবার জ্বালা কি!
ভাব মুলুকে ভাবের দেশের ভাবের ভাষা বোঝে যেই
আমার ভাষা তারই জন্য আর তো কারো এনট্রি নেই।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
হারিয়ে গেছে মা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
হারিয়ে গেছে মা।
এদিকে যাই ওদিকে যাই
এঘরে যাই, ওঘরে যাই।
কোথাও যে পাইনা।
হারিয়ে গেল কোথায় আমার মা ।
ভোরের রাতে ঘুমের ঘোরে
শুনতে পেলাম আদর করে
মা যেন ঐ ডাকে।
ওরে আমার সোনা মেয়ে
সকাল হল দ্যাখরে চেয়ে
ভোরের আলো কাটছে আঁধারটাকে।
তাকিয়ে দেখি সূন্য ঘরে-
দাইমা শুয়ে মেঝের পরে-
আর তোরে কেউ নেইকো কোনোখানে।
এদিকে চাই ওদিকে চাই
এঘরে যাই, ওঘরে যাই
মার গলা যে শুনতে পেলাম কানে ।
বারান্দাতে গিয়ে দেখি
বাবা আছে দাঁড়িয়ে একি
মায়ের ছবি জড়িয়ে নিয়ে বুকে।
উদাস চোখে আছে চেয়ে-
ঝরছে যে জল দুচোখ বেয়ে
কেমন করে বোঝাই এখন এঁকে।
কাছে গিয়ে বলি ডেকে -
মায়ের ছবি পাশে রেখে
লক্ষ্মী বাবা এবার শুয়ে পড়ো।
আর করোনা চিন্তা কোনো
একটা কথা বলি শোনো-
আজকে থেকে আমি হলাম বড়।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর