কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
ছন্দপতন
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

পদ্য লেখা শেখাব আজ, বানিয়ে লেখ ছড়া,
ছেলেরা সব দেখাও খাতা ছন্দে ছন্দে ভরা।
দেখি অয়ন কি লিখেছ- আরে, এ আবার কি!
“অঙ্কস্যার ক্লাসে বসে কেবল মারেন ফাঁকি”
মারব কোষে গাঁট্টা মাথায়, এই লিখেছ বসে!
তা নয়তো কি, ঠিক কিনা ভুল বলুন দেখে এসে
এ্যালজ্যাবরা, জিওমেট্রি, ট্রিগনোমেট্রির গুঁতো,
শেখান নাতো কিছুই ক্লাসে কেবল করেন ছুতো
ছুটির পরে স্যারের ঘরে ছেলেরা সব গিয়ে
শিখে আসে অঙ্ক কষা নগদ টাকা দিয়ে।
পদ্য লেখা যায়না শেখা না থাকলে ঐ নেশা -
অঙ্ক ফিজিক্স, কেমিস্ট্রিটা শিখতে স্কুলে আসা।
অঙ্কস্যারকে বলুন ক্লাসে পড়াতে মন দিয়ে,
হেডস্যারকে দেখান আমার এই কবিতা নিয়ে।
পদ্য লিখে কি হবে স্যার শব্দেতে মিল করা!
অঙ্ক খাতায় ছন্দপতন কেবল ভুলে ভরা।
আমাদের স্যার একটা দাবী অন্য কিছু নয়,
এবার থেকে স্কুলের পড়া ক্লাসেই যেন হয়।

.              ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
রমজান
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

রশিদ-মিঞা রিক্সা চালায় সকাল দুপুর রাত
তাইতে তাদের জোটে কাপড় তাইতে জোটে ভাত।
রশিদ-মিঞার ছোট্ট ছেলে রমজান তার নাম
বায়না ধরে পড়বে সে যে করবে না এই কাম।
রশিদ গিয়ে বললে বাবু পড়বে আমার ছেলে,
ভর্তি করে নেবে বল কত রূপয় দিলে ?
হেডমাস্টার বলে কিছুই দিতে হবে নাকো
ডোনেশনের বাক্সে কেবল হাজার-খানেক রাখো।
বই খাতা ব্যাগ নিয়ে যখন রমজান যায় স্কুলে,
গরীব বাপের সিনা তখন গর্বে ওঠে ফুলে।
বর্ষাকালের এক দুপুরে হঠাত্ ভাঙ্গন ধরে
স্কুলঘরটার একটা দেয়াল পড়ল ভেঙ্গে ঝরে।
পাঁচটি শিশু পড়ল চাপা গেল তাদের প্রাণ,
তাদের মাঝে একটি শিশু রশিদের রমজান।
স্তব্ধ রশিদ বসে আছে পাথরচাপা বুকে ,
হেডমাষ্টার হেঁকে বলেন নসীব বলে একে।
কানাকড়ি ছিলনারে যার জীবনের দাম,
দশটি হাজার ক্ষতিপূরণ করবে রাজ্য দান।
রূপয় আমি চাইনা বাবু দাও ফিরিয়ে জান-
ডুকরে কাঁদে রশিদ-মিঞা -আয় ফিরে রমজান॥

.              ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
দুলুর সাইকেল
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

রেল লাইনের ধারটি ধরে
বুনো গন্ধে ভরা
হলুদ ফুলের ঝাড় ।
বুক ভরে বাতাস নিয়ে
দৌরে দৌরে চলে দুলু
দিনে হাজার বার ।
লাল মাটির পথ ,
ধুল ধুল ঝড় ।
দুলুকে কেউ ডাকে না যে –
আপন কিম্বা পর ।
দুলুয়ারে ঘরকে আয় ,
বাপ আমার মানিক ,
কে ডাকে কে চমকে
দুলু দাঁড়িয়ে থাকে খানিক ।
না কেউ নয় বাতাস বুঝি
সন সন সন ঝড় ।
টাপুর টুপুর বৃষ্টি শুরু হল ।
তবু দুলু ছুটছে জোরে –
বাপটা যদি ফেরে ।
ট্রেনের সময় হল ।
বাপ গেছিল ভিন গাঁয়েতে
আনতে সাইকেল ।
প্রাণের ব্যাটা চরতে চায় গাড়ি ।
বছর গেল মাস গড়াল ,
ছুটছে দুলু রোজ ,
বাপ যে তার ফিরল না আর বাড়ি।

.          ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
অদ্ভুতুড়ে
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

মামদো বলে শাঁকচুন্নি এ তোর কেমন ঢঙ,
শণের নুড়ি চুলেতে তোর ঘোর কমলা রঙ।
বেগুন ঠোঁটে ফাগুন হাসি গন্ধ মাখিস পচা বাসী
খ্যাংরা-কাঠি চেহারা তে সাদা খড়ির টান।
তোকে দেখে শাঁকচুন্নি নাচে আমার প্রাণ।
আয়না আমার তেঁতুল গাছে,
ভোজ হবে আজ পচা মাছে
মন করে আনচান,
ধরনা রে ও শাঁকচুন্নি ক্যানক্যানে তোর গান ।
আমি থাকি শ্যাওড়া গাছে, শাঁকচুন্নি নাম
মামদোবাজি করিস কেন এইবারে তুই থাম।
বেম্ভদোত্তি জাতের ভুত সে, বাঁশ বাগানে বাসা
পচাপচা ইঁদুর ছানায় বাসাটি তার ঠাসা।
কিম্ভুত তার ভূতুরে রূপ, অদ্ভুত তার স্বর
শুনতে পেলে তোর এ কথা মটকাবে তোর ঘাড়।
তুই মামদো অজাত কুজাত,
আমার তরে পাতিস না ফাঁদ
পেত্নীকে ডাক কাছে,
বেম্ভদত্তি করবে বিয়ে যাবে আমায় সঙ্গে নিয়ে
বাঁশ বাগানের গাছে।

.          ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
মিনিবাস
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

ইশকুলেতে গিয়ে তুই কি করিসরে খোকা ?
চুপ করতো ভাল্লাগেনা কথা বোকা বোকা .
একিরে তুই কেমন ছেলে বোকা বলিস মাকে !
তা নয়তো কি, জান তুমি, সবাই আমায় খোকা বলে ডাকে !
অনেক বড় হয়ে গেছি একাই পারি যেতে
এবার থেকে আমায় তুমি আসবেনা আর নিতে I
চারটে বাজে খোকা আমার ফিরল-নাতো ঘরে
ওগো শুনছ, জাওনা একটু , দেখনা খোঁজ করে
দুটো মিনিবাসের সাথে খুব হল লড়াই
দুটোই যে চায় আগে যেতে , রেস চলে সাঁইসাঁই.
পাদানিতে ভ্যাবাচ্যাকা পড়ল খসে খোকা
বাস চলেছে ভীষণ বেগে , যায়নি তাকে রোকা.
ঘুরলো চাকা- রক্ত-ধুলোয় মাখামাখি দেহ,
আহা কেমন কচি মুখটা, জান নাকি কে ও?
ও তো খোকা বনানী-দির যাও নিয়ে'স ডেকে ,
মা পড়ল বেহুঁশ হয়ে খোকার রক্ত দেখে ।

.               ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
বিধান বাবু
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

একটা দুটো চারটে ছটা
শীল পরেছে গোটা গোটা
সঙ্গে বৃষ্টি ফোঁটা ফোঁটা ;
গরম তবু গিয়েও যেন যাচ্ছে না।

বন-বন-বন ঘুরছে পাখা,
জানলা দরজা পরদা ঢাকা
জলের গ্লাসে বরফ রাখা ;
তৃষ্ণা তবু মিটেও যেন মিটছে না।

গোল গোল পাকিয়ে চোখ,
বিধানবাবু করেন রোখ,
অঙ্কগুলো খাতায় টোক,
বিশুখোকার মাথায় কিছু ঢুকছে না।

সোঁদা গন্ধ ঢুকছে নাকে,
বাইরে আকাশ ডাকছে তাকে,
আজ কি পড়ায় মনটা থাকে ;
বিধানবাবু কেন যে ছাই বুঝছে না।

এমন সময় এলেন মা,
হাতে নিয়ে গরম চা,
সঙ্গে আবার সরভাজা ;
বিশুর বুকে বাজছে ছুটির গান।

চায়ের কাপে চুমুক মেরে,
সরভাজাটা মুখে পুরে,
অঙ্ক খাতা হাতে ধরে ;
বিধান-বাবু টানেন বিশুর কান।

লক্ষ্মীছাড়া দুষ্টু বাঁদর ,
মনটা কোথায় থাকে রে তোর,
অঙ্কগুলো মন দিয়ে কর ;
বিধানবাবু ছাড়েন সিংহনাদ।

বিশুর কুকুর দুষ্টু ভুলো,
খাটের তলায় ঘুমিয়ে ছিল ,
চমকে উঠে লম্ফ দিল ;
বিধানবাবু হলেন কুপোকাত॥

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
হ্যাপি নিউ ইয়ার
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

হ্যাপি নিউ ইয়ার আসছে শুনছি-
সেটা কি ভাবে আসে রে দাদা-
এলেই বা কি হয় !
ওমা সেত প্রতি শীতেই আসে ,
দেখিস না কত আলো, গান ,
কত খাবারের বাক্স ফেলা হয়,
এইখানে , এই ফুটপাথে -
সে সব বাক্সের গন্ধ চেটে খেলি গতবার ।
কি মজারে দাদা
এবারেও সে আসবে আবার !

গেলবার আমার বাক্সে, দাদা এক টুকর কেক ছিল,
বলিনি কারুকে; এত লোভ হল,
দাদা, ভাগ দিই নি রে তোকে ।
তবে বলি শোন প্রায় প্রতি বাক্সেই
কিছু কিছু খাবার ফেলা যায় ,
কেউ কিছু বলিনা আমরা ,
যে পায় সে খায় ।
কেন রে দাদা, এরা খাবার দেয় ফেলে ,
আমাদের ডেকে দিলেই তো পারে,
খিদে না পেলে ।
খিদে, তেষ্টার ওরা কি বুঝবে বোকা ,
ওরা সখ করে খায় ।
শুনেছি সব টুকু খেয়ে নিলে ওদের নাকি
সম্মান চলে যায়।
সম্মান মানে কি রে দাদা,
সে কেন চলে যায় ?
তাকে তো কোনও দিন ও দেখিনি রে চোখে ,
তোকে কি করে বোঝাই ।

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
খুকির শপথ
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

আমাদের খোকা সে,
ভেবনাকো বোকা সে,
যদিও সে পারেনাকো গুনতে,
যত বলি স্কুলে চল,
সে কেবল খেলে বল,
কথা যেন পায়না সে শুনতে।
বয়সটা বেড়ে যায়,
বন্ধুরা ছেড়ে যায়,
তবু দেখ নেই তার লজ্জা।
রকমটা দেখে তার,
গায়ে জ্বর মা-বাবার,
দাদু দিদা নিয়েছেন শয্যা
খুকি তার ছোট বোন,
করেছে একটা পণ,
দাদাকে সে করবেই জব্দ।
একা একা বসে ঘরে ,
চুপিচুপি বই পড়ে ,
লিখেছে সে এই বড় পদ্য।
তার লেখা ছড়াতে,
দাদা চড়ে ঘোরাতে,
ধোবি ঘাটে যায় জামা কাচতে।
বিদ্বান বোন তার,
হয়ে গেছে ডাক্তার,
রোগী আসে তার কাছে বাঁচতে।
খোকা বলে এইবার,
বেড়ে গেছে বড় বার,
জানেনা কি খুকিদের নেই দর।
যদি হই মুখ্যু, নেই কোন দুঃখু,
বাংলায় খোকাদের ই দরকার।
খুকিগুলো বড় হলে,
বাবা-মা রা পরে ঝুলে ,
বড়-সর খোকা দেখে গলাতে।
সোনা-দানা, টাকা যত,
এমনি ই আসে সে তো,
হয় নাতো ডাক্তারি ফলাতে।

খুকি বলে তাই বটে ,
বুদ্ধি-তো নেই ঘটে ,
সম্মান কাকে বলে জানেনা ।
গাধা আর ঘোরাকে ,
ছাঁদনার তলা তে ,
ঘোরালেও তারা বাঁধা পড়েনা ।

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
নিরুদ্দেশ যাত্রা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

আজ সারাদিন বৃষ্টি বৃষ্টি   মেঘলা আকাশ ভারি  
দূর সাগরে ঝড়ের সাথে মেঘের বাড়াবাড়ি।
লম্বা যত গাছেরা সব উঠছে ঝড়ে কেঁপে
পাখীর ছানা প্রবল ত্রাসে লুকায় মায়ের বুকে।
সাগর জলে জেলের নৌকো নাচছে ঢেউয়ের মাথায় মাথায়,
সেই ছবিটা আঁকতে যে চাই আমার মনের সবুজ খাতায়।
মস্ত উঁচু ঢেউ যেন পাহাড় আসছে তেড়ে
বালির বুকে লুটিয়ে পরতে আসছে ফিরে ফিরে।
মনের সবুজ খাতা এখন সাগর দিয়ে ঘেরা
তার সাথে ঢেউ বৃষ্টি আর মেঘলা ঘরে ফেরা।
মনের খোলা জানলা দিয়ে মেঘ ঢুকেছে ঘরে,
মেঘের ভেলায় সাওয়ার হয়ে মন বেড়িয়ে পরে  
কোথায় যাবি কোথায় যাবি মনকে ডাকি আমি,
মন যে এখন বাঁধনছাড়া ভীষণ দ্রুতগামী।
পেড়িয়ে আকাশ পেড়িয়ে পাহাড় মন চলেছে ভেসে।
কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইছ, যাচ্ছি নিরুদ্দেশে॥

.                ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
হিংসুটে
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

ফুটকি কেমন লালা সিল্কের জামা দেছে গায়
অমনি একটা লাল জামা আমার ও মা চাই।
ফুটকি কানে দুল পরেছে, সোনার দুটো ফুল-
আমার কেন লম্বামতন আমার ও চাই ফুল ।
দেখোতো ওর জুতোমোজা, ম্যাচিং জামার সাথে,
আমার জুতো বিশ্রী কেমন মোজা ও নেই সাথে।
এবার ভালো বেশ হয়েছে এক ই রকম জামা,
এক ই রকম জুতোমোজা, বেশ হয় না মা ?

শোনরে খুকি বলছি তোকে হিংসা কেন মনে?
যত-ই সাজো এক ই রকম, তফাৎ লোকে জানে
তুই তো মাথায় খাটো, তায় রংটা একটু চাপা
বড়ির মতন নাকটা যেন ভীম বাহাদুর থাপা
ফুলিয়ে গলা ঝগড়া করিস, লেখা পড়ায় ফাঁকি
ফুটকি কেন প্রিয় সবার জানিস না তুই তাকি ?
শরীরটা তোর মনের আয়না ফাঁকি দিস তুই কাকে!
মনের শোভা বাড়াস যদি বাসবে ভালো লোকে।

.                ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
আমরা কবির কাছে কৃতজ্ঞ কারণ এই সব কবিতাই কবি নিজে আমাদের টাইপ করে পাঠিয়েছেন।