কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
অভাব
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

আমাদের ছেলেটা কে বলব ভেবেছি,
আমার  যাবার পরে,
তোর বাপের মতন আমার ছবিটা আর
বাঁধাস না বাপি
কেন জানো!
তোমার বাঁধান ছবি ছোটো হতে হতে
ঠাকুরের আসনে এসেছে।
অভ্যাস মত আমি রোজ জল দিতে
আসি, ঠাকুরের সাথে সাথে তোমকে ও  
,হাসি পায় ভেবে,
তুমি এ-বাড়িতে পুরটা জুরে ছিলে একদিন।
তোমার যাবার পরে তোমার কথা ভেবে
নিজেই কেঁদেছি, সাথ কেউ দেয়নি আমায় –
দেয়ালে বিরাট বাঁধান ছবি থেকে তুমি চেয়ে থাকতে
সে দেয়ালে তোমার অভাব আজ, শোভা পায়
যামিনী রায়ের নকল  , মা ও ছেলে ।।
ছোটো একটা ছবি বাঁধিয়ে দিয়েছে বাপি –
জানেনা আমি কোনও দিনের জন্য ও তোমাকে
ঈশ্বরের আসন দিইনি- কারণ তুমি আমার
ভালবাসা, গর্বের, সোহাগের –
দোষে গুনে,  আমারই মতন ।
তোমার জায়গা আজও আমার বুক জুরে-
আমি গেলে আমাদের অভাব টাও
মুছে দিতে চাই আমাদের দুজনের বাপির
জগত থেকে ।।

.            ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
আমরা কবির কাছে কৃতজ্ঞ কারণ এই সব কবিতাই কবি নিজে আমাদের টাইপ করে পাঠিয়েছেন।
*
মেয়ে আমার
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

মনে হচ্ছে কিছুটা ছন্দে ফিরেছে মন,
শরীরের সাথে।
ফিস ফাস কৌতুকে হাসির হুল্লোড়
কান্নার ঝরনা ধারাটা
দুষ্টুমি করে ছোটো ছোটো পাথর ভেঙ্গে যায়
কোনও এক কল্পিত বনাঞ্চলে ,
সেখানে সবুজ দীপে নীল পাহাড়ের ছায়া
ঢেকে ফেলে ছোট্ট নদী টা।
অঞ্জলি ভরে জল ধরে, ফেলে দেয় নদীতে আবার,
তখনি ডাকে কেউ নাম ধরে,
শকুন্তলা ফিরে আয়।।
চকিত চাহনি যেন মায়া মাখা হরিণ ছানাটি,
ফিরে আয় লক্ষ্মীটি,
বসে আছি তোর অপেক্ষায়।
বেলা গেল চলে, সূর্য্যি নামে পাটে,
আয় ঘরে চলে আয় ছুটে
মাতা গৌতমী ডাক দেয় –
কাল আমার কোল খালি করে
চলে যাবি রাজ ঠিকানায়
শকুন্তলা মেয়ে আমার
আয় ঘরে আয়।।
বসে আছি তোর অপেক্ষায়।।

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
এক টুকরো বাসা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

চলেছি এক সাথে, দেখেছি এক স্বপ্ন
চেয়েছি একসাথে এক টুকরো বাসা।

পাশে আছ, তবু কেন মেলেনা ঠিকানা –
মাঝে মাঝে কেন মনে হয়,
ঘরটা আমার নয়;
চেনা গন্ধ, চেনা সুর, অকারণ খুশীতে ভরপুর
হৃদয়টা গেছে হারিয়ে ;জানি আমি, টের পাই
তোমার ও মাঝে মাঝে
মনে একই প্রশ্ন ভাসে-
তোমার ই অজান্তে পালটে গেছে একটা ঠিকানা,
তোমার অনিচ্ছায় ।
এখন বাসাটা বড়, পরিপূর্ণ মমতায়,
সাজিয়েছি নিজে।
তবু মন ফিরে ফিরে পেতে চায়
হারিয়ে যাওয়া ঠিকানা আমার,
আগল ভাঙ্গা হৃদয়ের দরজায়।।

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
অন্তহীন
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

ছেলেটা বলছিল গানে গানে
গিটারের তারে টান-
সূর্য নাকি আসেনি তার কাছে
গত কাল ।
ঘন কাল মেঘে ঝর ঝর কেঁদেছে আকাশ-
তার নরম উত্তাপ, মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
তাও সে পায়নি সারাদিন-
গান তার অন্তহীন না-পাওয়ার দীর্ঘ তালিকা।
মেয়েটা মনে মনে বলে- সূর্য কেন তুমি বলনা
বোঝাও না তাকে,
আমার ঘরের এক কোনে
সন্ধ্যা বাস করে,
এক বুক আশা নিয়ে
তারাদের অগুনতি যাত্রায় চোখ পেতে।
কাল তার যাত্রার শেষ দিনে
তোমার নরম উত্তাপ-ঢেকে দিয়েছিল তার  ক্ষত।
তার জীবনের যত অহংকার অন্ধকার গলিতে হয় শেষ।।
সূর্য তুমি তাকে দিয়েছ আলো দিয়েছ উত্তাপ,
দিয়েছ তোমার স্নেহ ঢেলে।
তবু অন্তহীন অভিমানে, ছেলেটা গান গায়-

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
কতটা দূরে আছ তুমি
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

কতটা দূরে আছ তুমি
কতটা দূরে আশা !
আঁধার যেন জীবন জুড়ে
মরন ছুঁয়ে আসা ।
তোমার নামে অস্ত্র ধরে ।
জীবন চিড়ে রেখে -
হাজার মানুষ খুন করে সে
আল্লা নামে ডাকে ।
দাও কি সাড়া তাদের ডাকে
ছুঁয়েছ তাদের মন ?
তুমি কি তবে মৃত্যুর দূত-
দাও না জীবন !
আমরা যে চাই শান্তি-
চাই জীবন তোমার কাছে-
জীবন শেষের নৌকো তো
এই ঘাটেই বাঁধা আছে ।
কেন তবে এই আয়োজন-
আগুন, ধোঁয়া কালো-
শয়তানের হাতে কেন
তোমার আশিস ঢালো ।
কোরান করে অপবিত্র-
খোদাকে বদনাম !
আর কতদিন থাকবে দূরে
এমন ম্রিয়মাণ ।

.      ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
যে দিন থাকব না
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়


যে দিন থাকবনা সেদিন ও মনে রেখ এমনি হাসি খুশি
যে রাতের শেষে ঘুম আর ভাঙ্গবে না
সে রাতেও জেন আমি স্বপ্ন দেখেছি ।

যে মুহূর্তে জীবন পেয়েছি
আমার যমজ ছিল সাথে
অন্ধকার মৃত্যুর ছায়াতে,
আলতে ছায়াতে মিলে গানে আর কবিতায়
বিছানা বালিশে মাখা মাখি

কে জেতে কে হারে
উদগ্রীব কবির মন
আলো নাকি ছায়া -

যারই হক জয়
আমার হবে না ক্ষয়
সেদিনে ও আমার ছায়া এমনি উদগ্রীব
গানে আর কবিতায় ।।

.      ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
অমর প্রেম
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

তখন ভর দুপুর শীতের আকাশে
ঝল মলে রোদ।
রাস্তায় কত লোকের ভীরের মাঝে
হেঁটে ছলেছি আমি –
পাথর চাপা বুকে ;
অন্ধকার মুখে ।

এত দিন যে কথাটা বলা হলনা
রক্তের কণায় কণায়
প্রতি রোমকূপে-
ঝন ঝন বাজে।
সে সব কথা যে শুধু চোখে চোখে
হৃদয়ে হৃদয়ে ।।

যে স্পর্শ দূরে থেকে যায়-
যে রজনী থাকে খালি-
যে প্রেম আধার পায় না খুঁজে –
তাকে যত্নে লালন করেছি আমি,
যেন কত যুগ যুগান্তর ।

না পাওয়া সেই মুহুর্তের প্রেম
নিবির আলিঙ্গনে ধরা দিত যদি-
মুছে যেত স্মৃতি থেকে
যেন মরা নদী।

কার জন্য ব্যাকুল ছিল এ মন-
কেমন সে আধার প্রেমের ;
মনে আছে ব্যাথা টুকু শুধু-
না-পাওয়ার বেদনার রেশ ।।
চার যুগ পার করে ফিরে ফিরে দেখি-
প্রেমের আহ্বান তার শরীরের ভাষা ,
মুকুলিত আকুলিত সৌরভ খানি-
অমর রয়েছে ভালবাসা-
নিভৃতে সুখের অনুভবে ।।

.      ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
ঋণ
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

সে দুটি চোখ ঘুম কেড়ে নিয়েছে আমার-
দুটি তারা আর নেই-
শুধু রেখে গেছে ক্ষত –
গোপনে একলা হলে, আবরণ
খুলে দেখি; যত দিন চলে গেল,
যত স্মৃতি ধুলায় ধুসর –
তার নিষ্প্রভ চোখ জেগে থাকে –
হতাশায় নিরাশায় নির্বিকার
পাষাণের মত , ধাক্কা মারে
বিবেকের দরজায়, অবিরত বিরাম বিহীন,
হীনমন্যতা সকলের চোখের আড়ালে-
ঘাঁটি গেড়ে বসেছে অন্তরে ।
যতদিন আমি আছি- শাস্তি দিয়ে
শান্তি কেড়ে নিল তোমার দু-চোখ –
তুমি জানলেনা ।
প্রথম দেখায় তারা জ্বলেছিল
ছাই চাপা আগুনের মত,
হয়ত আমার মাঝে মুক্তি দেখেছিল-
নরকের কারাগার থেকে –
আমি পারিনি- তার দুই হাত
ঠেলে দিয়ে – বাঁচলাম –চোরাবালি
গ্রাস করে- কি ভয়ানক, কি নিষ্ঠুর
পৃথিবীতে বেঁচে আছি আমি-
জন্ম-ভর, আমরণ গ্লানি বুকে নিয়ে-
তোমাকে মৃত্যুর হাতে ছেড়ে দিয়ে-
জীবন দিয়েছ দুবার- সে ঋণ আমি
একবারও পারিনি শোধ দিতে ।।

.      ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
অবেলায়
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

মাঝে মাঝে জেগে ওঠে ওরা ।
কখনো ঘাসের ডগায় শিশির হয়ে
ঘাস ফুলে মেশে । কখনো বা হলুদ
প্রজাপতি  –লাল , নীল ;–
কালো নয়,
তখন যে তাদের
ভোর বেলা – ভাল লাগা
যে দিকে তাকায় । তারা ফিরে আসে ,
গুটিসুটি লেপে কম্বলে , শীতের বেলায়
বড় ঘুম পায় ।।
বিমূর্ত ভাবনা দেখি সাগরের ঢেউয়ে
ঢেউয়ে আছড়ে পরে তীরে –
সুতীব্র কামনায় – যৌবনের প্রগলভতায়
ভালবাসা - যে দিকে তাকায় ।
সেই টান সে আবেগ –
আরও কাছে টানে, আরও আরও কাছে ,
তবু ফিরে আসে – দখিনা বাতাসে ,
স্পর্শ করে , ডাক দিয়ে যায় ,
আমি ডাকি ফিরে আয় , লেপে কম্বলে
শীতের বেলায়, বড় ঘুম পায় ।।

.      ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
ধুপ জ্বেলনা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

ধুপের গন্ধ ভাল লাগেনা আমার ,
পোড়া মাংসের গন্ধের সঙ্গে যেন বড্ড
মাখামাখি তার ।
ধাবার ধারে বসে চায়ের ভাঁড় হাতে
ঝেড়ে ফেলতে চাই মনের বিকার ।
আমি শিক কাবাব বড় ভালবাসি –
কারণ ধাবায় কোথাও কেউ ধুপ জ্বালায় না।

ধুপ আর  রজনীগন্ধার গন্ধে এখানে বাতাস ভীষণ ভারি-
যদিও তাদের এত ক্ষমতা নেই
পোড়া মাংসের গন্ধ ঢেকে দেবে ।
তাই তো ধুপের গন্ধের সংগে আমার
আড়ি- আড়ি আড়ি।
এখানে আমায় মুখে আগুন দেবে কেউ
কোনও একদিন – কিন্তু এখনই নয়।
আজ এখানে যত কান্নাকাটি তার চেয়ে
অনেক বেশী শান্তি বুকে
কারণ এখানে কেউ আজ আমার মুখে
আগুন দেবেনা ।।

এখানে  প্রতিবার-
মৃত্যুর এত কাছে এসে, তার ছায়ার তলায়
ভয় বুকে মারে ঘা-মৃত্যুর কোল ঘেঁসে
জীবন দাঁড়ায়–
কান্নার আড়ালে নিজের অজান্তে –
সুখ হামাগুড়ি দেয়-
এখনও জীবন্ত আমি –
এখানে আজ অন্য কেউ পুড়ে ছাই ,
হচ্ছে এবং হবে আমারও একদিন ।

আজ দিনটা আমার নয় ।।
আর স্থানটাও নয় উপযুক্ত ।
ধাবার বেঞ্চিতে গরম চায়ের ভাঁড় হাতে
ঝেড়ে ফেলতে চাই – বিকার, মনের বিকার ।
আগুনে ঝলসানো মাংসের কাবাব
খেতে বড় ভালবাসি তাই,
দয়া করে এখানে কেউ ধুপ জ্বেলো-না ভাই ।।

.      ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর