কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
|
কাগজের কম্বল
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
কাগজের কম্বলে ঢাকা শহুরে মানুষ,
এক পা বাড়ায় এক পা পেছায় ,
শীতের দিনেও গরম তাদের
অহংকারের ওম মাখা গায় ।
মেঘের পালকে ঢাকা তাদের আকাশ,
খুশির ডানায় উড়ে চলে ।
বড় বেশী পেয়ে গেছে জীবনের কাছে,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে ।।
কাগজের বিনিময়ে খুশী কিনে আনে,
মাটির সাথে নেই যোগ ;
পাহাড়, জংগল, নদী , নালা !
বই এর পাতায় করে খোঁজ ।
মেঘের সাথে মন ফেরারি হয়না আর ,
কবিতায় ওড়েনা আঁচল ,
দোকানে , দোকানে ঘোরে ফেরে,
চোখে মাখে রূপালী কাজল ।।
কাশফুল দোল খায় আপন খেয়ালে ,
দোয়েল পাখিটা গান গায় ।
বড় বড় ঢেউ উঠে আছড়ে পড়তে দেখি
একা আমি বালুকা বেলায় ।
বাবা-মা, ভাই-বোন,মাসী পিসি যত,
সমাজের উঁচু-নিচু ধাপে ।
সমানে সমানে হয় আদান প্রদান ,
মেলাতে হয় যে খাপে খাপে ।।
বুড়ি ছুঁয়ে চলে যায় শহুরে মানুষ –
ধার করা সময়ের গুনে ।
সেখানে সবার আগে ব্যবসায়ী মন ,
বসে থাকি আমি কাল গুনে ।।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আমরা কবির কাছে কৃতজ্ঞ কারণ এই সব কবিতাই কবি নিজে আমাদের টাইপ করে পাঠিয়েছেন।
শেষের আকাশ
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
আমি আসি আমি যাই,
আমি থাকি কিছুক্ষণ,
জীবন- তুমি আসা যাওয়ার
মাঝখানে, কমা বা সেমিকোলন;
পূর্ণচ্ছেদ নও ।
না ডাকলেও আসে সে,
শোনেনা বারণ ।
নিয়ে যায় সাথে যাকে মন চায়,
মরণ সে, এখন তখন ,
চাও নাই চাও ।।
ফুল ফোটে ঝরে যায় ,
তার ছোট্ট জীবন ;
তবু দেখো খুশী খুশী হাসে।
জীবন মরণ দেখি আমার বাগানে
রোজ আসে যায় ।
সেখানে আমার এই মন যে হারায়
ছোট ছোট বেলা ভাগ করে,
সকালের ফুল আমি
যত্নে ভরে রাখি ,
আমার মনের খাতায়
রূপ, রস , গন্ধ সব থাকে ,
যেমনটি ছিল । তারা সব একে একে
উঁকি মেরে যায় ।
শেষের বেলায় , মরণ কে দিয়ে ফাঁকি
নতুন আকাশ ঘিরে তারার মালায় ।।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ছায়া
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
তার তীব্র দৃষ্টি আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে
শীতল প্রস্তর রেখে গেল ।
তার ভার বয়ে বয়ে ফিরি।
জনতার ভীরে দেখি তার জ্বালাময়ী চোখ-
যেন ডেকে বলতে চায় শেষ হোক শেষ হোক ।
শেষের সুরু তো সেই জন্মের প্রথম লগনে
শুরু হয়ে ছিল । শৈশবে পড়েনি মনে,
যৌবনও চলে গেল ।।
কি তীব্র আকর্ষণ, নির্মম নিষ্ঠুর ঠেলে ফেলা –
এখনি এসোনা কাছে, এখনো রয়েছে বেলা ।
আমার দুচোখ দেখে আমারই আয়না –
চেয়ে আছে নির্নিমেষ, চোখ ফেরাতে চায়না।।
তার কালো মসলিন চোখে ,
ঝকে ঝকে তারা ,
আমায় করেছে দিশা হারা ।।
একা হলে আসেনা কাছে দূর থেকে দেখে –
বিদ্রূপ ভরা চোখ হাসি ঢেকে রাখে ।।
কে গো তুমি রাত্রিবাসী মায়াময়ী ছায়া ,
আমার স্বপ্ন নিলে কেড়ে ,
যেতে যদি হয় ছেড়ে
আমার জীবন-
এস কাছে বেঁধে ফেল
আগুনের সাত ফেরে ।।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
যারা চলে গেল
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
নিথর শরীর একে একে ঢুকে যায়
লাশকাটা ঘরে ।
মুনাফা-লোভীর বিষাক্ত কালো জিভ
কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরে ঘুরে
শ্বাসরোধ করেছে এদের ।
অসহায়, অসুস্থ মানুষ এরা ছিল
খাটে শোয়া ।মৃত্যুর কবলে ছটফটিয়ে
ডেকেছিল – রক্ষা কর, ডাক্তার, নার্স –
সে সব আর্তনাদ বুকের ভিতর থেকে গেল
পায়নি খুঁজে গলা । আহা কত যন্ত্রণায়,
সবার অলক্ষ্যে চলে গেল এরা ।
হাসপাতাল সেবা-প্রতিষ্ঠান মুমূর্ষু
রোগীর কাছে ডাক্তার যেন ভগবান ।
এই তার রূপ । হাসপাতাল তো নয়
যেন অন্ধকূপ । ঢলে পড়ল অকালে
মৃত্যুর কোলে, মা , ভাই, পরিবার
পরিজন , কার পাপে ।
টেনে এনে ফেল রাস্তায়, মুনাফা-লোভীর দল
এদের কাছে মানুষের প্রাণ
বিক্রি হয়ে যায় –নিরাময় হবার আশায়
আসে যারা- এরা বেঁধে ফেলে
লোভের নাগপাশে, ছেড়ে দেয় জরাজীর্ণ ।
তাতেও মেটেনি খিদে, আরও আরও আরও
লাভ চাই।
জতুগৃহ তৈরি করে ছেড়েছে বাজারে –
মরছে, পুড়ছে কত রোগী –
নিশ্চিন্ত, বেখেয়ালে /এরা সিন্দুকে টাকা ভরে ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আমি ফিরে যাই
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
আমি ফিরে যাই ,
তুমি ও থাকবেনা দাঁড়িয়ে ।
মাঝ খানে শূন্য হাহাকার ,
এক বুক দীর্ঘশ্বাস ,
কত কিছু গেল হারিয়ে ।
সময় চলে যাবে তার মত ,
আজকের ভাঙ্গা-হাটে ,
কাল নতুন বাজার ।
আজ তোমার দৃষ্টিতে
স্নান করে ,
বৃষ্টি পরেছে হাজার ,
যার বুকে ;
কাল সেকি ভিন্ন দুটি
চোখের ছায়ায় ,
থাকতে পারবে সুখে !
আমি ফিরে চাই –
যে পথে বিষণ্ণতা ছেয়ে আছে
মেঘের মতন ।
সে পথ কবির লেখা শেষের কবিতা ,
সেখানে প্রেমের হয় শুরু ,
দিন শেষ হয়ে গেলে আকাশে
মেঘের দল বেদনায় বাজে গুরু গুরু ।
এ পথের শুরু কই, শেষ কোন-খানে ,
কেউ কি তা জানে !
তবু মাঝে-মধ্যে ফিরে আসি –
এপথে ছড়ান আছে হাসি ,
এ পথে হৃদয়ের যৌবন ধরা পরে ।
হৃদয় মাতাল হলে , সে মদিরা হাতে,
ফিরে যাই ঘরে ।।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
তুমি এলে
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
তুমি আসবে তাই-
প্রস্তুত করেছি মাটি,
রোদে, জলে, পাহাড়ে, জঙ্গলে ।
তুমি আসবে বলে –
আকাশ-মাটিকে এক করে
যুদ্ধে সেজেছি ;
নরম, লাজুক হাতে অস্ত্র ধরেছি ;
ভুলেছি সংসার ।
ভুলেও দেখিনি ফিরে –
মরে কত চেনা-জন, করে হাহাকার ।
শুধুই গুনেছি ক্ষণ –
ঐ আসে ঐ বুঝি ঝড়ের মতন ,
উড়িয়ে পথের কাঁটা-
ভীষণ ভৈরব ।
প্লাবনের মত অনিবার্যতায় ।
সেই তুমি এলে –জঙ্গল থেকে দূরে
নীরবে নিভৃতে, এলে মৃদু পায় ।
আমার যত আড়ম্বর মিছে করে
রাত ভোরে ফিরে গেলে
কোন অস্তাচলে –মাটি আজ আকাশ কে চায় ।
আকাশে ,বাতাসে, পাহাড়ে, জঙ্গলে ,
তোমার পরশ রেখে গেলে ।
তবু কেন যুদ্ধসাজ,
তবু কেন রক্তপাত,
তবু কেন রাজনীতি,
চেনেনা তোমায় ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
পারিনা মুক্তি খুঁজে নিতে
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
আমি তাকিয়ে ছিলাম,
সাদা দেয়ালের মতন তোমার মন থেকে,
ফিরে আসা আমার ব্যথাগুলো
কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছে ।
সেটা কি শুধু –
কষ্ট নাকি অনুতাপে, ধিক্কারে
অপমানে ।
প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ নয়,
আমি শিশু যেন এক অবোধ
মানসিকতায় , আঁকড়ে ধরতে
চাই না-পাওয়া স্বপ্নকে ।
ফিরে ফিরে দেখছিলাম
উদাসীনতা কি চরম শান্তি এনে
মুক্ত করেছে তোমায় ।
কেন আমি নয়, কেন আমি
পারিনা মুক্তি খুঁজে নিতে ।
অন্ধকার মনের আনাচে কানাচে
এখনো লুকিয়ে বাস করে -
মুগ্ধ সে তোমার আশায়,
তার হাতে-পায়ে জরিয়ে ধরতে
চায়- শ্বাসরোধী অনুভূতি ;
আমি বুঝি, খুব বুঝি,
তবু পারিনা মুক্তি খুঁজে নিতে ।
আমি ডেকেছি তো নাম ধরে,
ধাক্কা খেয়ে তোমার দেয়ালে
সে আসেনি ফিরে ।
সে ডাক পাখনা মেলে উড়ে গেছে
অসীম নির্বিকল্পে অনন্ত জিজ্ঞাসায় ;
আমি তবু প্রজাপতি হয়ে
বসে আছি মাধবীলতায় ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ফরিয়াদি গান
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
কার মিষ্টি কথার ঝাঁঝ
কার চোখের জলের আঁচ,
মন ফেরারী করল । ।
ঢেলে ভালবাসায় জল ,
বুনে মিথ্যা কথার জাল ,
মন গরলে ভরল ।
তোমার ফরিয়াদি গান –
বন্ধু বিঁধবে না তার প্রাণ -
মন তার আকাশ হল আজ ;
সেতারে কত না ঝঙ্কার ,
তবুও সে ফিরবে না তো আর,
মনে তার ভ্রমর করে রাজ ।
সে ভ্রমর পদ্ম-ঝিলের ধারে ,
সে ভ্রমর মানস সরবরে –
সে এক দিব্য নেশায় চুর ।
তাকে ডেকনা আর গানে ;
তীর বিঁধবে না তার প্রাণে ।
সে দেশ মাটির থেকে দূর –
অনেক দূর ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আশা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
জোনাক জ্বলা রাতের মতন
অন্ধকারে তোমার দুটো চোখ
স্বপ্ন কে দেয় ডাক ;
জোনাক জ্বলা রাতের মতন
অন্ধকারে তোমার দুটো চোখ
স্বপ্ন কে দেয় ডাক ;
আশা
তোমার ভালবাসা,
থাক না তলানিতে ,
তবুও জানি দেব না তো মিলিয়ে যেতে
মরীচিকার মতন ।
মনের ভিতর গুরু গুরু ,
বুকের ভিতর দুরু দুরু
আশায় নিরাশায় -
জীবন স্বপ্ন দেখে যায় ।
পরিযায়ী পাখির মতন
আসতে থাকে তারা –
সুখের স্বপ্ন যারা ,
মনের জলাশয় ।
ভুস ভুসিয়ে উঠে আস তুমি ,
আশা ,
জীবন স্বপ্ন দেখে যায় ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
রাত জাগা দুটি পাখি
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
সকালে উঠেই দেখি –
রাত জাগা দুটি পাখি কথা বলে ছিল ;
তাতে কি বা এল গেল !!
যায়নি হয়ত কিছু, আসেনিও কিছু ।
তবু দেখ দুলাইনে গান হয়ে গেল ।
গান তো গেয়েছে পাখি, তোমার কি লাভ !
ছি ছি , বলেনা অমন করে বলাটাও পাপ ।
আমি যে কবিতা আমি অনুভবে চলি ,
যে কথা বলেনা পাখি সে কথাটা বলি ।
পাখি থাকে কবিতার ডানায় ডানায় ,
অনুভুতি ভরা মন কানায় কানায় ।
এদিকে সেদিকে মারে উঁকি –
কোথাও ভাবের কোনো সুযোগ আছে কি !
সকালে পাখির ডাক, দোলা দেয় মনে –
কবিতা ছোট্ট করে লেখে সে গোপনে ।।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর