কবি সরলাবালা সরকারের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।  www.milansagar.com
*
নির্ঝরের আত্মসমর্পণ
(প্রবাহ কাব্য থেকে নেওয়া)
সরলাবালা সরকার

অতি দূর পর্বত-শিখরে,
গিরি যেথা ঢাকে মেঘজালে,
নিভৃত আঁধার গুহা কোলে
নির্ঝরিণী ছিল শিশুকালে,
দিন যত যায় দিনে দিনে,
কি যে চিন্তা উঠে তার মনে,
একা একা কুলু কুলু স্বরে,
গান গাহে কারে মন করে,
গুহা আর ভাল নাহি লাগে,
না জানি সে যেতে চায় কোথা,
কে বুঝুবে নির্ঝরের ভাষা
কে বুঝিবে তার মর্ম-ব্যথা,
যৌবনেপ প্রবল উচ্ছ্বাসে,
নির্ঝরিণী ছুটে চলে আসে,
কোথা শিলা বাধা দেয় পথে,
ভুরু-ক্ষেপ নাহি তার তা’তে,
অনন্তের অজানা পথেতে
ক্ষুদ্র-প্রাণা এক নির্ঝরিণী
কোথা যেতে চায় নাহি জানি।
পর্বতের শিখর হইতে
ছুটে এসে শিলাময় পথে
ক্ষীণ স্রোতা নির্ঝরিণী এক
ঝাঁপায়ে পড়িল হ্রদ-স্রোতে।
চাহি দেখিল না আগু পিছু,
একবার ভাবিল না কিছু,
দূর হতে ছুটিয়া আসিয়ে,
একেবারে পড়িল ঝাঁপায়ে ;
যৌবনের প্রবল উচ্ছ্বাস,
যৌবনের মধুর ভালবাসা,
যৌবনেক গভীর আকাঙ্ক্ষা,
যৌবনের সুখ দুঃখ আশা,
সকলই মিশাইল, সে যে
হ্রদ-স্রোতে ঢালি তনিখানি,
সরলা সে ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী!

.               ***************  
.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
জীবন
(প্রদীপ-পত্র, ফাল্গুন ১৩০৫ সংখ্যা থেকে নেওয়া)
সরলাবালা সরকার

বসিয়া নদী তীরে,
চাহিয়া অপলকে,
বালুকা গণি আমি শুধুরে।
তটিনী কুলুকুলে
বহিছে কূলে কূলে,
শ্রবণে বাজে আসি মধুরে!
উপরে নীল মেঘে
তপন আছে জেগে,
দহিছে শির খর কিরণে।
খসিয়া পাতাগুলি
মাখিছে বন ধূলি,
লুটায়ে পড়ে তরু চরণে।
কুসুম অবশিত
কোকিল শ্রান্তচিত,
ভ্রমর আর নাহি গুঞ্জরে।
রয়েছে বন-ছায়ে
বিহগ লুকাইয়ে,
বকুল আর নাহি মুঞ্জরে!

ফুরায়ে যায় বেলা,
ভাঙ্গিছে খেলামেলা,
লুকায় পাখী নিজ আবাসে।
আকাশে রাঙ্গা রাঙ্গা
নীরদ ভাঙ্গা ভাঙ্গা
শতেক রঙ্গে কত শোভা সে।
বনের ছায়া মাঝে
আঁধার ভীম সাজে
প্রকাশে ক্রমে নিজ মূরতি।
সে আলো কোথা গেল,
আঁধার দেখা দিল,
না জানি ধরণীর কি রীতি।
জগত এলোকেশে
ঢাকিয়া ভীম-বেশে
রহিলা নিশা তম-বরণী।
কেহ না আসে কাছে,
কোথায় কেবা আছে,
সবারে ডাকি আয় আয় না।
আঁধার ঘোর এসে
পড়েছে তট দেশে,
বালুকা দেখা আর যায় না।
গভীর অন্ধকারে
রহিনু নদী তীরে,
বালুকা গণা মোর হল না!

.               ***************             
.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বঙ্গবালা
সরলাবালা সরকার

পুরুষের হৃদয় মন্দিরে,                আছে সেই কোমল অন্তর
সে মন্দিরে অধিষ্ঠাতা তুমি,           সো অন্তর আসন তোমার।
বঙ্গবালা পরাধীনা তুমি ?            নহ সখি, পরাধীনা নহ,
অন্তঃপুর কারাগার নহে,              অন্তর তোমার চির গৃহ।
বন্দিনী হয়েছে সখি নিজে,            আপনারে হারায়ে বিহ্বল,
সাধ করে পরিয়াছ পায়ে,            ভালবাসা কুসুম-শৃঙ্খল।
কে বলে তোমায় পরাধীনা,           সর্ব্বময়ী বঙ্গবালা তুমি,
দেবী ব’লে প্রতিষ্ঠা করেছে           অন্তরেতে পিতা ভ্রাতা স্বামী।
হৃদয় ত ক্ষুদ্র গৃহ নয়,                বিশ্বের সবার বাস এ যে,
সকলে তোমায় হৃদয়েতে            তুমি সখি সকলের মাঝে।

.                       ***************  
.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
প্রভাতের কবি
সরলাবালা সরকার

আমি এক প্রভাতের কবি
এ জীবন শিশিরের মত,
প্রভাত ফুরায়ে গেছে হায়,
তাই বড় হয়েছি বিব্রত!
শিশির শুকায়ে গেছে বনে
প্রভাতের বিদায়ের সনে,
শুখায়েছি, তবু বেঁচে আছি
দগ্ধ হয়ে তপন-কিরণে।
শিশির শুকায়ে গেলে বনে,
প্রভাত ফুরায়ে গেল হায়,
আমি এক প্রভাতের কবি
এ জীবন কেন না ফুরায়!

ফুল ফোটে কেমন করিয়া
তা’ তো গেয়েছিনু একদিন,
গেয়েছিনু ঊষায় কেমনে
আঁধার আলোকে হয় লীন,
গেয়েছিনু বসে নিরজনে,
নদী বহে যায় কোথা বেগে,
রবি ওঠে পূরব গগনে,
পশ্চিমেতে শশী হয় ক্ষীণ।
এই কোলাহলে কি করিয়া,
কি গাহিব বোঝে না ত হিয়া,
তার যত তুলে বাঁধি আমি,
ক্ষীণ সুর তত পড়ে নামি,
কোথা সেই আলো-অন্ধকার
আধ-ঘুমে মগ্ন বিশ্ব ছবি,
এ তরঙ্গে কোথা যাব ভাসি,
ক্ষুদ্র আমি প্রভাতের কবি!

অচেনা এ মধ্যাহ্ন-জগৎ
অচেনা এ জগতের জন,
প্রভাতের কবি তাই খুঁজে
কোথা তুমি মধুর মরণ!

.       ***************  
.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নিবেদন
সরলাবালা সরকার

আমারে হরণ করিয়া লও’হে
.                নিখিল-চিত্ত-চোর!
নিগূঢ়-কমল-ভুজ-বন্ধনে
.                বাঁধ হে চিত্ত মোর।
.        আমার আকাশ আমার তারা
.        আমার স্বর্গ আমার ধরা
.        আমার হরষ আমার সুখ
.                দিবস রজনী মোর ;
সকল ব্যাপিয়া সর্ব্বময় হে
.                নিখুল-চিত্ত-চোর ;
.        বেড়িয়া কমল-ভুজ-বন্ধনে
.        মোরে অধিকার করি লওহে---
.                রাজার রাজা মোর,
.        বিদ্রোহী চিত করিয়া দমন,
.        প্রেম শৃঙ্খলে কর বন্ধন
নিজ অধিকার করহে প্রচার
.                দমি অশান্তি ঘোর!
হে মহারাজা! হৃদয়-রাজা!
.                রাজার রাজা মোর!


চরণ-সেবিকা করহে---
.                স্বামী মোর! প্রভু মোর!
ব্যর্থ জীবন সফল করহে---
.                স্বামী মোর! প্রভু মোর!
.        বহু দিন হতে আছি এই আসে
.        তোমার রাতুল চরণ পরশে
.        অনল হইবে তুষার-শীতল
.                বিভাবরী হবে ভোর ;
কোরনা বঞ্চনা জীবন-ঈশ্বর!
.                স্বামী মোর, প্রভু মোর!

.               ***************  
.                                                                                      
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর