কবি সরোজ দত্ত-র কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।  www.milansagar.com
*
রত্নাকর         
চতুষ্কোণ, পূজা সংখ্যা, ১৩৫৯

নির্মল নদীর জলে রক্তমাখা স্খলিত পালক
আকাশ চিবিয়া যায়, বিচ্ছেদের বুকভাঙা ডাকে ;
সম্মুখে দাঁড়ায়ে হাসে নির্বিকার নিলাজ নিষাদ
অহিংসার নেশা হাতে রাঙা চোখে রত্নাকর জাগে |
করুণ জিজ্ঞাসা নিয়ে জেগে রয় বিস্মিত ব্যথায়
চরণে মরণাহত মরালের মরা দুটি চোখ---
লজ্জায় নির্বাক ঋষি, বেদ মন্ত্রে মেলে না জবাব
বিজয়ী ব্যাধের চোখে প্রতিষ্ঠার স্বর্ণ স্বপ্নলোক |
বিস্মৃতির ভস্ম হতে জেগে ওঠে আগ্নেয় অতীত,
ঋষির শিরায় জ্বলে তীব্র দাহ তিক্ত বঞ্চনার |
--- আজও কি জাগিয়া আছে নিরান্দ নিরন্ন কুটিরে
শিশুর কঙ্কাল কোলে চর্ম-স্তনী প্রেয়সী তাহার ?
হেসে ওঠে দস্যু কবি অক্রোধের ক্লীবলজ্জা ছেড়ে
তামসীর তৃপ্তির দিন সাঙ্গ হলো তমসার তীরে |


.               *************************                                               
উপরে   



মিলনসাগর
*
বঙ্গরঙ্গ    

কার্জন তর্জন করে, ভঙ্গ বঙ্গ তবু লাগে জোড়া
কঞ্জুষ অর্জুন চাপে ভীমের বর্জন করা ঘোড়া |
গগনে গর্জায় মেঘ লোক জমে তর্জার আসরে |
বর্জাইসে পদ্য ছাপি বিলি করে বিবাহ বাসরে |
দুর্জয় শীতের রাত্রে দার্জিলিঙে মার্জিত সমাজে
"বিসর্জন" নাটকে রিহার্সালে জগঝম্প বাজে |
দর্জিরা অর্জিত বিদ্যা বিবর্জিয়া মর্জিমত হায়
মের্জাই বানায় যত, একটিও নাহি লাগে গায় |
সায়াহ্নে খর্জুর কুঞ্জে ভুর্জপত্রে তাম্বুলের পিক
ভর্জিত মাংসের গন্ধে বিচলিত গির্জার মুষিক |
সমগ্র গুর্জর দেশ ছেয়ে গেল মার্জারে মার্জারে
ব্যথায় জর্জর দেহ প্রতিদিন ভার্যার প্রহারে |
তাইতো দুর্জন সঙ্গ পরিহারি বসিয়া নির্জনে
পর্যাপ্ত আহার করি তর্জমা বানাই একমনে |
উপার্জনে মন নাই, কিছু টাকা কর্জ যদি দাও,
চরণে মার্জনা মাগি দরজা দিয়া হইব উধাও |


.               *************************                                               
উপরে   


মিলনসাগর
*
সংশয়         
অরণি, তৃতীয় বর্ষ, ৪৬ সংখ্যা, শুক্রবার, ২১ জুলাই ১৯৪৪

মাঝে মাঝে মনে হয় আশা নেই, আশা নেই কোন,---
যে রাত্রি এসেছে নেমে সেই রাত্রি রবে চিরকাল,
ওপারে উঠিবে সূর্য মেঘমুক্ত রক্তিম অম্বরে,---
এপারে অনন্তকাল অন্ধকারে কাঁদিবে কঙ্কাল |
মাঝে মাঝে মনে হয়, এ আমার আফিমের ঘুম,---
এ যেন ভুলিতে ব্যথা সেজেছি নেশার ক্রীতদাস,
এ যেন সত্যের ভয়ে চেতনারে করিয়া আবিল,
শিশুর সন্তোষ নিয়ে নির্বোধের স্বপ্নস্বর্গবাস |
মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যেন রাত্রি দ্বিপ্রহরে
চলেছি নিশির ডাকে অন্ধকারে সাংঘাতিক পথে,---
আঘাতে জাগিব যবে শিহরি করিব অনুভব,
আমার ভ্রমণসঙ্গী কেহ নাই নিদ্রিত জগতে |
আমার অলস দিন কেটে যায় দুরাশা বিলাসে,
তাই তো আমার স্বর্গে সংশয়ের কালসাপ আসে |


.               *************************                                               
উপরে   



মিলনসাগর
*
কোন বিপ্লবী কবির মর্মকথা         
অরণি, প্রথম বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা, শুক্রবার, অগাস্ট ১৯৩৯

আমার কবিতা কভু কহিবে না আমার কাহিনী,
অসতর্ক কোন ছত্রে ধ্বনিবে না ক্রন্দন আমার,
আমার কবিতা নহে দুর্বলের দুঃখের বেসাতি,
নহে এ অপূর্ণকাম অক্ষমের মর্মব্যভিচার |
এ নহে সমষ্টি প্রেম স্বার্থপর স্বতন্ত্রবাদীর,
আনিনি শক্তির পায়ে অশক্তের শঙ্কিত প্রণামী,
গনগগনের পথে অগ্নিরথ জনমানবের
যাহারা টানিয়া আনে, তাহাদের সহকর্মী আমি |
আমার পাবে না দেখা আমার কাব্যের পৃষ্ঠপটে,
সেথায় আমার সীমা অসংখ্যের অসীমে বিলীন,
বিষপঙ্কে তন্দ্রাহত রুদ্ধস্রোত শৈবাল দীঘিরে,
বাহিরে বন্যাজলে করিয়াছি দিকচিহ্নহীন |
কবরে প্রেতিনী হয়ে কাঁদিবেনা আমার বেদনা,
দুঃসাহসী বিন্দু আমি, বুকে বহি সিন্ধুর চেতনা |


.               *************************                                               
উপরে   


মিলনসাগর
*
মধ্যবিত্তের বিপ্লব-বিলাস         
অগ্রণী, প্রথম বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা, অগাস্ট ১৯৩৯



বৈশাখের মধ্যদিনে অগ্নিদাহে মূর্ছাতুর আমি,
চাহি জল, চাহি ছায়া, চাহি বৃষ্টিধারা,
সকলি আনিবে যবে মহামেঘ কালবৈশাখীর,
পাতার কুটিরে আমি উত্কণ্ঠায় হব দিশাহারা |


.               *************************                                               
উপরে   


মিলনসাগর
*
বর্তমান বুদ্ধিজীবির প্রতি         
অগ্রণী, প্রথম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা, মে ১৯৩৯


তোমার বুদ্ধির সুধা সুরা হল আঁধারে পচিয়া
সে অগ্নি-পানীয়ে নিত্য জ্বলে তব ঘৃণ্য পাকস্থলী
কৌমার্য করিতে রক্ষা আত্মরতি সম্বল তোমার,
তোমার দুর্বল কণ্ঠে স্বেচ্ছাবন্দী পাখীর কাকলি |
প্রাণশক্তি প্রাণহীন, ধরিয়াছ প্রাণঘাতী নেশা ;
চরণে কাঁদিয়ে কায়া, ছায়া ভাবি হাসো উপহাসে---
করেছ গতির রক্তে পঙ্গুতার প্রশস্তি রচনা,
বিচ্ছেদ ভুলিতে চাহ বিরহের নির্বীর্য বিলাসে |
প্রসবের ব্যর্থতায় অভিমানী সৌখীন শাখার
স্বার্থপর আত্মনাশ বনস্পতি করিবে না ক্ষমা,---
তৃষায় শ্বসিছে তবু শিকড়ের শূণ্যভাণ্ড হাতে,
সংবর এ ক্লীব কান্না, দেখনি কি মৃত্তিকা নির্মমা |
রাজদণ্ড বহি শিরে, শ্লথছন্দে রচিয়া বিলাপ
যে চাহে অলকা, তার নির্বাসন যোগ্য অভিশাপ |


.               *************************                                               
উপরে    


মিলনসাগর
*
রবীন্দ্রনাথ
অরণি, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ২২ অগাস্ট ১৯৪১


তোমার কাব্যের বীজ               পাথরে পড়িয়া যদি
ফুলে-ফলে না হয় সফল,
পড়িতে পথের পরে                   পথিক দলিয়া যায়
খেয়ে যায় খুঁটে খাওয়া পাখী,
হাজার আগাছা সাথে                মহামূল্য কোন চারা
দূর করে ফেলে দেয় কেহ,---
সে দোষ তাদের, যারা              দাঁড়ায়ে মাটির পরে
মাটিরেই দিতে চাহে ফাঁকি |


দু'বেলা তাদেরি সাথে              দুমুঠো অন্নের লাগি,
আমাদের অশ্লীল সংগ্রামে,
কদর্য কলহে মাতি                 অন্ধকারে হাতাহাতি,
দীর্ণ দেহ, ছিন্ন বহির্বাস |
তোমার কায়ারে তাই             ছায়া ভেবে হেসে উঠি,
তোমার সুধারে বলি সুরা,
জ্বরের বিকারে ঘোরে            তোমারে চিনিতে নারি
গালি দিই করি উপহাস |


তুমি হেসে ঢেলে দাও            বলো "পার ফেলে দাও
মোর কাজ আমি করে যাই,
গানহীন এই দেশে                     এনেছি গানের গঙ্গা
মানি নাই জহ্নুর শাসন,---
রোগের দুঃস্বপ্ন আর                   যন্ত্রণার গর্ভ হতে
আরোগ্যের প্রসন্ন-প্রভাতে
যেদিন জাগিবে তুমি                 জ্বর-দগ্ধ হে দুর্ভাগা,
পোড়ো তুমি আমার ভাষণ" |


অনাগত মানুষের                     মগ্ন চেতনার মাঝে
সংখ্যাতীত ভগ্নাংশ তোমার
কি সৌরভে কি গৌরবে            কিভাবে বাঁচিয়া রবে
কোন্ ফুলে হবে কোন্ ফল
সে কথা জানি না আজ           সে কথায় কিবা কাজ,
সিদ্ধ হবে কোন প্রয়োজন!
"তোমারে বাঁচাতে হবে"---              এই শুধু বুঝিয়াছি
এইটুকু করেছি সম্বল |


.                                           *************************                                  
উপরে    


মিলনসাগর
*
অসি ও মসী
অগ্রণী, প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, ফেব্রয়ারী ১৯৩৯
(প্রগতি সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষ্যে)


মৃত্যুরে যে প্রাণ বলে                ধ্বংস আনে সৃষ্টিচ্ছলে
তারি প্রাণ বিনাশের লাগি,
প্রাণের পরিখাদ্বারে                     নিশীথের অন্ধকারে
যারা রহে প্রহরায় জাগি---
তাদের অসির আলো                 ঘুচালো মসীর কালো
অসি মসী এক হয়ে মেশে,---
গাণ্ডীবী র'বে না আর                    রাজকন্যা উত্তরার
ক্লীব-সখী বৃহন্নলা-বেশে |


.                                           *************************                                  
উপরে    


মিলনসাগর
*
পূর্ণিমা         
মুখপত্র, শারদীয়া সংখ্যা, আশ্বিন-কার্তিক ১৩৫৯


বাঁশীতে শিকড়ে মন্ত্রে আমারে বাঁধিতে চায় যারা,
ঝাঁপির গুমোটে রেখে মাঝে মাঝে ভাঙ্গে বিষদাঁত,
গলায় জড়াতে চায়, চুমু খায় সোহাগে গলিয়া,
তাদের জানায়ে দিয়ো এসে গেছে পূর্ণিমার রাত |


ওদের বাঁশীর সাথে মুগ্ধ ফণা দোলায়েছি কত,
ক্লান্ত হয়ে কতবার বিবর খুঁজেছি নতমুখে,
কতবার বোবা রাগে গর্জে উঠে নিষ্ফল ছোবলে
মাটিতে ভেঙেছি মাথা --- ওরা শুধু হেসেছে কৌতুকে |


মজ্জায় মজ্জায় আজ এ আমার কী নিবিড় ব্যথা,
স্পর্ষাতুর পুচ্ছলতা সারাদেহে যন্ত্রণার জ্বর,
নিস্পলক দুই চোখ --- দুই ফোঁটা হিংসার নির্যাস ---
স্খলিত নির্মোক তনু --- নবীন মসৃণ ভয়ঙ্কর |


খেলার নেশায় মেতে ওরা কি ভুলিয়া গেল হায়,
আমার বিষের থলি পূর্ণ আজ কানায় কানায় |


.               *************************                                               
উপরে   


মিলনসাগর
*
যৌবন         
মুখপত্র, শারদীয়া সংখ্যা, ১৩৬০


নিশ্চিহ্নের শেষ চিহ্নে চিহ্নিত শ্মশানে
নির্বাপিত চিতাচুল্লী হতে
কুড়ায়ে অঙ্গার-কণা ফুত্কারে উড়ায়ে ভস্ম তার
জীবনচণ্ডাল আমি, আমি সাজি মৌতাত আমার |


সে নেশা জমিয়া ওঠে দুর্বিসহ শীতে,
কবোষ্ণ আরাম জাগে নগ্ন দেহে, অসাড় পেশীতে |
জ্বলে গলা, জ্বলে যায় বুক
কী নিবিড় সুখ!


জবারক্ত আঁখি মেলে চেয়ে দেখি সম্মুখে আমার
খোলা বুকে ঘোলা গঙ্গা দোলা দিয়ে দুই কূলে তার
চলে নির্বিকার |
চেয়ে দেখি দুপাশে আমার
পুড়ে যায় চন্দন-চিতায়
সুরভিত স্থবিরের লাশ |
শিখার রসনা চাটে শ্মশানের আবিল আকাশ |


ভাঙা ঘট, কানাকড়ি, পোড়া কাঠ
একমুঠো ছাই,---
যে ছিল সে নাই |
শুধু আমি আছি,
মৌতাতের অভিমানে চিরদিন আমি বেঁচে আছি |


আমি আদি, আমি অন্ত, আমি শেষ, আমিই প্রথম,---
জরার শ্মশানে আমি নিশাচর যৌবনের ডোম |



.               *************************                                               
উপরে    


মিলনসাগর
*
বসেছে রাজর্ষি চোর         
মুখপত্র, শারদীয়া সংখ্যা, ১৩৫৯




বসেছে রাজর্ষি-চোর রিলিফের স্বর্ণ-সিংহাসনে
উদ্বাস্তু শিবিরে চলে নারীমাংসে পরমান্ন পাক,
দূর হতে দুই নাকে ভেসে আসে শবের সৌরভ ---
কেকার মেখলা পরে নটীনৃত্যে নাচে দাঁড়কাক |



.               *************************                                               
উপরে    


মিলনসাগর
*
এইখানে আজ ইতি         


গিলিয়া দুবেলা আফিঙের দলা
বুঁদ হয়ে মোর কাল কাটে
পাশে শোয় এসে পথের কুকুর
আরশোলা এসে গাল চাটে |
সহসা রাত্রে কিসের শব্দে
নেশার ঘুমের তাল কাটে
চেয়ে দেখি কারা মহাউল্লাসে
কুমীর আনিতে খাল কাটে |
ছুটে গেল ঘুম
টুটে গেল নেশা
সেই থেকে পেশা রাজনীতি
মিটিঙে চলেছি ; বড্ড ব্যস্ত
এইখানে তবে আজ ইতি |


.      *************************                                                        
উপরে    


মিলনসাগর
*
শকুন্তলা         
অগ্রণী, দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জানুয়ারী ১৯৪০


দুর্বাসার অভিশাপ, অভিজ্ঞান অঙ্গুরী কাহিনী
স্বর্গ মিলনের দৃশ্য, মিথ্যাকথা হীন প্রবঞ্চনা ---
রাজার লালসা-যূপে অসংখ্যের এক নারীমেধ
দৈবের চক্রান্ত বলি রাজকবি করেছে রটনা |
গৃহস্বামী দেশান্তরে, অরক্ষিত দরীদ্রের ঘরে
নারীমাংস লোভে রাজা মৃগমাংস এল পরিহরি ---
অরুচি হয়েছে যার অবিশ্রাম নাগরীবিহারে
তাহার কথার ফাঁদে ধরা দিল অরণ্য-কিশোরী |
স্তব্ধ আজি নাট্যশালা, নান্দীমুখ আতঙ্কে নির্বাক
বিদীর্ণ কাব্যের মেঘ, সত্যসূর্য উঠেছে অম্বরে---
দর্শক শিহরী করে নাটিকার মর্মকথা পাঠ,
"বালিকা গর্ভিণী হল লম্পটের কপট আদরে"---
রাজার প্রসাদভোজী রাজকবি রচে নাট্যকলা,
অন্ধকার রঙ্গভূমি, ভূলুণ্ঠিতা কাঁদে শকুন্তলা |


.               *************************                                               
উপরে   


মিলনসাগর
*
সংকেত         
মুখপত্র, শারদীয়া সংখ্যা, ১৩৫৯




রাজার ভাগ্যের পাশা খুশিমতো মুশিকে নাচায়,
ধর্মের জুয়াড়ী পুত্র বাঁধা রাখে প্রিয়ার যৌবন,---
কৃষ্ণার কবরী কাঁপে লম্পটের রক্তের তৃষ্ণায়,
মধ্যরাতে কাক ডাকে, শোনে না বধির দুর্যোধন |



.               *************************                                               
উপরে   


মিলনসাগর
*
পাশা         
অরণী, দ্বিতীয় বর্ষ, শারদীয়া সংখ্যা, ১৯৪২


পাশায় মেতেছ রাজা! যত হার তত মার দান
প্রিয়ারে রেখেছ পণ --- শেষ পণ, ধিক্! রাজা ধিক্---
এ জুয়ায় জয় হবে ? অন্ধ রাজা এখনো দেখনি
আসরে গোপনে ফেরে শকুনির পালিত মুষিক |
পাশায় খোয়ানো ধন পাশায় ফিরিয়া পেতে চাও!
শেষ দানে বাজিমাৎ --- হায় রাজা, হায়রে দুরাশা,
এ পাশার ইতিহাস এখনো পড় নি তুমি রাজা,
মানুষের হাড়ে গড়া এ পাশায় প্রেতের পিপাসা |
এখনো ফিরিতে পার, এখনো সময় আছে রাজা,
যা গিয়াছে যাক্, তবু যাহা আছে সেউটুকু লাভ,
নিঃস্ব তবু রাজা তুমি, নিঃসহায় কে বলে তোমারে!
আশার আগুনে রাজা, দগ্ধ কর দুরাশার পাপ |
সম্পদ কামনা যদি, চাও যদি জীবনের জয়,---
হে রাজা সঞ্চয় কর! বন্ধ কর অন্ধ অপচয় |



.               *************************                                               
উপরে   


মিলনসাগর
*
উত্তর-কাণ্ড         


রাঘবের রাজসভা জমে ওঠে, শুধু মাঝে মাঝে
গলিত মাংসের গন্ধে মরে যায় চন্দন সুবাস ---
যমুনার শীর্ণ স্রোতে কোথা হতে এসেছে ভাসিয়া
রাজার স্নানের ঘাটে ছিন্নশির চণ্ডালের লাশ |
অন্ধকার গৃহকোণে দন্তহীন স্খলিত চোয়ালে
স্মৃতির জাবর কাটে জরায় স্থবির মহাবীর---
চকিতে স্ফটিক স্তম্ভে ছায়া ফেলে দ্রুত সরে যায়
প্রতিহিংসা-তৃষাতুর ছায়ামূর্তি প্রেতাত্মা বলির!
অজেয় শত্রুর চিতা সিন্ধুকূলে দাউ দাউ জ্বলে
বানরের রক্তমূল্যে প্রতিষ্ঠিত নরের শাসন |
সর্বাঙ্গে ঘৃণার থুথু, চোখে ভয়, মুখে ভরা হাসি
গুপ্তচর আলো করে শ্মশানের স্বর্ণ সিংহাসন |
জঠরে বহন করি পিতৃঘাতী যমজের ভার,
বন্দিনী গর্ভিণী ভাবে প্রসবের দেরী কত আর!


.               *************************                                               
উপরে      
মিলনসাগর
*
অক্টোবর ১৯১৭         
অনুবাদ কবিতা, ভ্লাডিমির মায়কোভস্কি


কাঁপে রাজপথ বিদ্রোহী পদভরে
চরণে দলিত দম্ভের চূড়া যত---
আমরা চলেছি উদ্দাম জলধারা
মহাপ্রলয়ের মহাবন্যার মত |

অশ্বের মত ছুটে চলে দিনগুলি
বছর বিলীন বিষাদ আঁধার মাঝে,---
গতির দেবতা চাবুকে চালায় রথ,
আমাদের বুক দামামার মত বাজে |

কার পতাকায় আছে এত গাঢ় লাল ?
কে পারে বিঁধিতে বুলেটে মোদের প্রাণ ?
নেই আমাদের রাইফেল, নেই সোনা ;
কী বা আসে যায় ? কণ্ঠে রয়েছে গান |

সবুজ আগুনে প্রান্তর জ্বলে ওঠে,
ফেটে পড়ে দিন আলোর আঘাত লেগে,---
রামধনু, তুমি বাঁকাও তোমার ধনু
তরঙ্গদল উধাও ঝড়ের বেগে |

লক্ষ তারায় বিক্ষত নভোপট,
কিবা আসে যায় ? কে থামায় এই গান ?
জানি একদিন আকাশ নেবো জিনে,
নরজীবনেই স্বর্গে জিনিব স্থান |

গাও গান গাও, পান কর প্রাণভরে,
রক্তে নাচুক বহ্নি চমত্কার,---
তুমুল ছন্দে স্পন্দিত হোক বুক,
কঠিন বর্মে উঠুক ঝনত্কার |


.       ******************                                                           
উপরে   


মিলনসাগর
*
সাঁতার         
অনুবাদ কবিতা, মাও জে ডং


[ সুই তিয়াওকে তাউ-এর সুরে ]
এইতো খেলাম চাংসা নদীর জল
আর উচাং-এর মাছ :
এখন আমি সাঁতরে পার হচ্ছি হাজার মাইল দীর্ঘ নদী,
দু'চোখের ছবি আমার আটকে রয়েছে দূরে,
.                            চু-এর মুক্ত আকাশে |
উঠুক তুফান, ভাঙুক ঢেউ,
.                            পরোয়া করিনা |
গৃহপ্রাঙ্গনে অলস পদচারণের চেয়ে
.                            এইতো ভাল |
এই নদী দেখেই তো একদিন ঋষি
* বলেছিল,
এ যেন সারা প্রকৃতি বয়ে চলেছে,
ফুলে ফুলে উঠছে জল, দুলে দুলে উঠছে মাস্তুলের দল,
কূর্ম আর সর্প দাঁড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে |
তৈরী হচ্ছে বড় বড় যোজনা,
উত্তর আর দক্ষিণকে যুক্ত করে চলে এক সেতু |
আজকের গভীর খাদ কাল হবে রাজপথে পরিণত,
পশ্চিম স্রোতের মুখে মাথা তুলে দাঁড়াবে পাষাণ প্রাচীর,
রুখবে উসানের বর্ষামেঘের ফৌজকে |
ছোটোখাটো খানাখন্দ ভরাট হয়ে
.                        জেগে উঠবে এক সমতল হ্রদ |
আর যদি এখনো সেখানে থেকে থাকেন
.                        পাহাড়ের দেবী,
তাহলে চমকে উঠবেন তিনি,
একী ? এত পাল্টে গেছে তাঁর দুনিয়া |


.       ******************                                                           
উপরে   

* কনফুসিয়াসের কাহিনীতে আছে, ঋষি এই নদীর তীরে বলেছিলেন, ---
"সারা প্রকৃতি অহোরাত্র এই ভাবে বয়ে চলেছে |"

মিলনসাগর
*
১৪ বছর বয়সে দাদার বিয়েতে লেখা প্রথম কবিতা --- বৌদির উদ্দেশে


সুদূর হতে মিলন বাঁশী
বাজল তোমার কানে
হাতে নিলে কুসুম ধনুর্বানে
পরান বঁধুর সাথে
মিলন বেশে দাঁড়ালে আজ
নত আঁখি পাতে |

বক্ষে তব বাজল শত আশা
দীপ্ত হয়ে উঠলো শত বাতি
পুরাঙ্গনার উলুধ্বনি সনে
উজল হয়ে উঠলো মিলন রাতি |


.       ******************                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
কোনও আত্মীয়ার বিবাহ উপলক্ষে রচিত


চপলতা বাজত পায়ে পায়ে,
বনের হরিণ তুই তো ছিলি সখি,
শুকনো পাতায় কার পদধ্বনি
শুনতে পেয়ে থমকে গেলি ওকি!

আজ ওরে তোর বনপথের বাঁকে,
পড়ল হঠাৎ কোন পথিকের ছায়া |
( তোর ) চোখের কোণে নামল ধীরে ধীরে,
বাদল দিনের কাজল কালো মায়া |

যার হাতে তুই আপনি ধরা দিলি,
যে তোরে আজ বাঁধল অকারণ
দুঃখ রাতের সেই ওরে তোর রাজা
( তোর ) হাতের কাঁকন বাজুক আমরণ |


.       ******************                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
ভরা পূর্ণিমায়

ভরা পূর্ণিমায় কালনাগিনীর
.       পুচ্ছলতার মত ব্যথিত ছিল তোমার মন |
হঠাৎ কখন ছোঁয়া লেগেছিল
.       বুঝতে পারিনি |

বোবা রাগে গর্জে উঠে ছোবল
,       মেরেছিলে তুমি,
তারপর বিষ ঢালার অপরিমেয় ক্লান্তিতে
.       মাথা গুঁজে খুঁজেছিলে
নিঃসঙ্গ বিবরের শীতল আশ্রয় |
.       পেছনে পড়েছিল আমার নীল লাশ |

.       ******************                                                           
উপরে   

মিলনসাগর
*
নির্জলা হিংসায়

নির্জলা হিংসায় নীলিম নির্যাসের
নিটোল দুটি মুক্তাবিন্দুর মতো
ইস্পাতি নীলিমায়
স্থির হয়ে আছে আমার দুটি
পলকহীন চোখ |

.       ******************                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
তুমি আজ আমার বিশ্বাসকে আঘাত হেনেছো


তুমি আজ আমার বিশ্বাসকে আঘাত হেনেছো
যে বিশ্বাস আমার কাছে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতই সহজ
.                নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতই অপরিহার্য,
তোমার এই রুগ্ন উন্মত্ততা দেখে
.                আমি স্তম্ভিত হয়েছি,
বুঝেছি তোমার দিন ফুরিয়ে এসেছে |

.           ******************                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
দেখেছি যক্ষার রূপ

দেখেছি যক্ষার রূপ সায়াহ্নের আগ্নেয় আকাশে,
দেখেছি বমির রক্তে পশ্চিমের ছেঁড়া মেঘ লাল,------
দেখেছি সূর্যের চোখে অপরূপ বিকারের জ্বালা,
জ্বরের জোয়ারে কাঁপে নিভে আসা দিনের কপাল |

.           ******************                                                           
উপরে   



মিলনসাগর
*
ধূলার পরে তোমার আসন

[ ফুটপাতে অনশনরত শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে --- ১৩৬১ ]

শেখানো তোমার পেশা
.       তাই কিছুতে শেখে না যারা
তাদেরই শেখাতে
.       পথের ধূলায় নিলে ঠাঁই |

.           ******************                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
[ শিরোনামহীন, কুমারেশ ভট্টাচার্যের সৌজন্যে প্রাপ্ত. ১৯৩৬-৩৭ সালে লেখা ]

কথা যে কহিতে পারে
.        সে যদি না কহে কথা
.        মৌন রহে মূঢ় অহঙ্কারে
তাহার বুকের মাঝে
.        পচিয়া কথার মড়া
.        বীজাণু ছড়ায় চারিধারে |

.           ******************                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
বসেছে রাজর্ষি চোর

বসেছে রাজর্ষি-চোর রিলিফের স্বর্ণ-সিংহাসনে
উদ্বাস্তু শিবিরে চলে নারীমাংসে পরমান্ন পাক,
দূর হতে দুই নাকে ভেসে আসে শবের সৌরভ-------
কেকার মেখলা পরে নটীনৃত্যে নাচে দাঁড়কাক |

.           ******************                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
ত্রিভুবন

উর্বশী ও সোমরসে সুসম্পূর্ণ ঊর্ধ্ব স্বর্গলোকে
নেশায় নিমীল হল রক্ত আঁখি নগ্ন অপ্সরার,
দলিত ফুলের গন্ধে, কটুগন্ধে উদ্ গীর্ণ ভোজ্যের,
উত্সবের শেষ রাত্রে রতি শ্রান্ত দেবতা অসাড় |
নিম্নে অন্ধ রসাতলে আক্রোশে শ্বসিছে নাগলোক,
সিন্ধু হতে সুধা তুলি----সুধা কৈ ? --- বাসুকি শুধায়,
সে সুধার অতিতৃপ্তি সুরলোকে এনেছে অরুচি,
স্বর্গের চক্রান্তে বন্দী গর্জে নাগ অসহ্য ক্ষুধায় |
মর্ত্যে অন্ধকারে জ্বলে ম্লান আলো মাটির প্রদীপে,
আধো আলো, আধো কালো, আধো আশা, আধেক সংশয়,
সন্তর্পণে ভালবাসা, সন্তর্পণে বসা পাশাপাশি,
সন্তর্পণে আগুলিয়া দেবতার উচ্ছিষ্ট সঞ্চয় |
স্বর্গের নেশার নিদ্রা দুর্যোগের দুঃস্বপ্নে মলিন,
পাতালে বিদ্রোহী ক্ষুধা, মর্ত্য রহে দিবাস্বপ্নলীন |

.              ******************         
.                                                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
ভীমসেন ছিল সূপকার

ভীমসেন ছিল সূপকার,
তাতে কার কি হয়েছে উপকার ?
যদি বিরাট রাজার গো শালায়
কাজ করা কারও না পোষায়
তবে ইস্তাফা দিয়ে চলে যাও,
শুধু যাবার সময় বলে যাও,
শ্মশানের কাছে শমী গাছে
যেথা ভূত-পেত্নী ও দানো নাচে
সেথা রেখে গেছে যারা হাতিয়ার
তারা নাতি কার, ওগো নাতি কার |

.        ******************         
.                                                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
অরণ্যে গর্ভিণী কাঁদে


অরণ্যে গর্ভিণী কাঁদে
.        অন্ধকারে চূর্ণ স্বর্ণসীতা
সিন্ধুকূলে অনির্বাণ
.        জ্বলে যায় রাবণের চিতা |

.        ******************         
.                                                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
[ ১৪ বছর বয়সের কবিতা ----- দাদার বিয়েতে, দাদার উদ্দেশ্যে ]


.                       সতীপ্রভা তব পদে আজি
.                       সঁপি দিল প্রেম, ভক্তি অর্ঘরাজি
.                       ধ্যান মগন সন্ন্যাসীরাজ
.                       দেব ধূর্জটিরে,
.                       পার্বতী আজ প্রণয়-বাঁধে
.                       কঠিন ভাবে ফেলল ঘিরে |

.                                   কদম কেয়া করবী আজ
.                       আপনা ভুলে হেসে,
.                       বলল, তোমায় সাজাই রাজার বেশে
.                       হাসলে অনুকূলে
.                       সেই হাসিতে বিশ্বভুবন
.                       মিলন দোলায় উঠবে দুলে  |

.                               ******************         
.                                                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
.             [ ১৫ বছর বয়সে লেখা  ]

.            মৌনমুখর সান্ধ্য আলেয়া
.            ওগো মোর কৌতুকি
.            সারা দিনমান ফাঁকি
.            দিয়ে দিলে গোধূলিতে দেখা একি !


.                  ভেদি আঁধারের কালো যবনিকা
.            হাতে প্রদীপ্ত অনলের শিখা,
.            নাশি পুঞ্জিত আঁধারের রাশি
.            কোথা হতে এলে নামি |

.                   ******************         
.                                                                                           
উপরে    



মিলনসাগর
*
[ হাতে লেখা ম্যাগাজিন ‘মঞ্জরী’--র জন্য ১৫ বছর বয়সে লেখা  ]


.                একদিন এসেছিল
যেদিন নিত্য                     চপল চরণে তোমার
.               মঞ্জির বেজেছিল |

.                 ******************         
.                                                                                           
উপরে    





মিলনসাগর