কবি সরোজ দত্ত-র কবিতা
www.milansagar.com
লেনিন       
সরোজ দত্ত, অগ্রণী  প্রথম বর্ষ, দশম সংখ্যা অক্টোবর, ১৯৩৯

মরণে মেলেনি ছুটি, মৃত্যু তার হল অর্থহীন,-----
মরিয়া জীবন্ত হাতে আজো সে গড়িছে ইতিহাস,
কায়াহীন ছায়া তার কালো হয়ে গাঢ় হয়ে আসে,
নাস্তিকের আত্মা ফেরে দেহহীন,---- এ কি পরিহাস !
অশরীরী নায়কের অর্থগূঢ় বিশাল ইসারা.
মরালের রক্ত হতে যোদ্ধৃবেশী রক্তবীজ আনে,----
কালের কুটিল কন্ঠে ডাকিল সে হলবাহকেরে,
বিজ্ঞানীরে ডাক দিল অপজ্ঞান-হত্যা-অভিযানে,
ধার্মিকের স্বর্ণস্বর্গে হানা দিল নাস্তিকের প্রেত,
স্পর্শিল অশুচি হাতে শতাব্দীর পবিত্র সঞ্চয়,-----
যে বুদ্ধি অসূর্যস্পশ্যা তারে আনি জনাকীর্ণ পথে,
কদর্য বাস্তব সাথে হাসিয়া ঘটালো পরিণয় |
বিধৌত বলির রক্তে শৃঙ্খলার পাষাণ চত্বরে,
বলিদ্বেষী পাষন্ডের ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে সঞ্চারে |

                                        

.               *************************                                            
সূচিতে     


মিলনসাগর
*
রম্যাঁ রল্যাঁ
সরোজ দত্ত, অগ্রণী, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা , জানুয়ারী ১৯৩৯

অসিদ্বেষী অহঙ্কার অভিমানী মসী মানবের
.        একদা ধ্যানের বিঘ্নে কেঁদেছিল ক্লীব অসন্তোষে,-----
কুঠার গড়িতে গিয়া নিকষিত নিখাদ সোনায়
.        পাষাণে কুটেছে মাথা বহুবার নিষ্ফল আক্রোশে |
সমষ্টির প্রাণপুষ্পে আলো হতে আবরিতে চায়
.        স্বর্ণ-স্বার্থ-সংহতির সংকীর্ণ বেষ্টনী,
মৃত্যুর দুঃস্বপ্ন হতে জাগিয়া প্রাণের পুরোভাগে,
.        সোনার কুঠার ফেলি’ ধরিয়াছ লোহার লেখনী |

                                 

.               *************************                                               
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
ডি এইচ লরেন্স
সরোজ দত্ত, অগ্রণী জুন, ১৯৩৯


দেখেছিলে শুধু সুকুমার অভিলাষ
কাঁচা আঘাতের ব্যথায় কাঁদিয়া মরে,
দেখেছ তাহার তাজা রক্তের ধারা,
দেখনি কাহারা কিসের আঘাত করে |
নেভা আগুনের দেখেছিলে বিভীষিকা,
নিভাল যাহারা চাহনি তাদের পানে,
তোমার আগুনে তুমিই পুড়েছ তাই,
তোমার আগুন লাগিল না কোনখানে |
তাইতো তাহারা তোমায় করেনি ভয়,
মহা পরিহাসে হেসেছে ক্লীবের দল,
কেহ করুণায় অশ্রু এনেছে চোখে
কেহ বা চিতায় ঢেলেছে গঙ্গাজল |
তবুও চিতার পোড়া কয়লার দাগে
নূতন পৃথিবী চুম্বিবে অনুরাগে |

  
.           *************************                                                    
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
ফিনল্যান্ড
সরোজ দত্ত, অগ্রণী , জুন ১৯৪০
( কবিতাটি রুশ-ফিনিশ সংঘর্ষের সময় লিখিত )


সত্যের সুধার ভান্ড সঙ্গোপনে রাখিয়া তাহারা
সংবাদপত্রের পাত্রে মিথ্যার মদিরা নিত্য ঢালে,
উত্কন্ঠিত পিপাসার আমাদের কন্ঠাগত প্রাণ,
আমরা আকন্ঠ গিলি সে গরল প্রত্যহ সকালে |

মলিন মাটির ভান্ডে নির্জলা সে মিথ্যার নির্যাস
নির্বিচারে করে পান সত্যের সৌখীন উপাসক ,------
কুযুক্তি কুলটা ডাকে লুদ্ধমন মন্ত্রমুগ্ধ চলে
যেথায় সংশয় প্রেত আগুলিছে মানস নরক |

অলকা অলীক স্বপ্ন ---- ক্লীব যক্ষ কহে অশ্রুজলে-----
বুদ্ধিজীবী ম্রিয়মান, অধ্যাপক শিরে হানে হাত,
নিশ্চিন্ত প্রগতিবাদী দুশ্চিন্তায় কালো হয়ে ওঠে
নিরক্ত নির্জীব শান্তি লক্ষ্যকরি নেমেছে আঘাত |

শূদ্রের দক্ষিণরূপে জাগে যবে রুদ্রের আভাস,
আতঙ্কে অশ্লীল কন্ঠে চীত্কারে বৈশ্যের ক্রীতদাস |

                                          
.           *************************                                                   
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
মুমূর্ষু-মহাকাল
সরোজ দত্ত, অগ্রণী  মার্চ ১৯৩৯


“ Life will assert itself”------ Lenin

কালসাপ, কাঁচা বাঘছাল,
চিতাভস্ম,  গরল, কঙ্কাল,
পরিত্যক্ত শ্মশানের প্রেত সঙ্গীদল-----
মড়ক, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, বন্যা, আর ভূমিকম্প----
সৃষ্টি জাগে প্রলয় সম্বল |
অর্থহীন অন্ধ হিংসা কদর্য করাল
.                        এই মহাকাল  |
         

এই বিনাশের স্ত্ততি ছন্দে-গানে, কাব্যে-শিল্পে, ইঙ্গিতে-আভাসে
নৃশংস ধর্ষণ আর অতি-রতি সম্ভোগের অন্তিম উল্লাসে,
ত্যাগের তুষার হতে তুলে-আনা শব যেথা
ভোগানলে ভস্ম হযে আসে |


এর মাঝে কী ঐশ্বর্য,  সৌন্দর্যের কোন রঙ্গশালা
.                        উদ্ভাসিত হবে ?
অসভ্যের মৃত্যুপূজা, হে সভ্যতা
সাঙ্গ করো তবে |
দেখো না কি চেয়ে,
আসন্ন মৃত্যুর মুখে মহাকাল আতঙ্কে নিষ্ঠুর,
অক্ষমের দুর্বলের নারীর শিশুর
.          অন্ধ ক্রোধে প্রাণ উত্পাটিছে |


তবুও তাহারই আগে পিছে
সংগ্রামে হাসিয়া উঠে মৃত্যুমারী প্রাণপ্রেম
নিঃসংশয়ে বিজয়ের অগ্রিম উত্সবে |
মহাকাল মন্দিরের কাঁপিয়ে পাষাণ ভিৎ
বিভীষিকা-বিগ্রহের অবলুপ্তি হবে,
মুমূর্ষ ও নির্লিঙ্গের মৃত্যু আর লিঙ্গপূজা
হে সভ্যতা, সাঙ্গ করো তবে |

                 
                                      
.           *************************                                                  
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
ঘোষণা
সরোজ দত্ত

পশুর বৈকুন্ঠ হতে মানুষের কুন্ঠিত জগতে
মুক্তির শৃঙ্খল হতে শৃঙ্খলায় মুক্তি মাগি আমি,
স্বেচ্ছাচারী নীহারিকা স্থান মাগি সৌর পরিবারে,
গ্রহের মর্যাদা মাগি, হতে চাই কক্ষ অনুগামী |


আমার সহে না আর আত্মঘাতী এই অভিসার,
নির্বোধ শিশুর মতো দুর্লভের এই অপচয়,----
সহে না এ শূন্য ঘর, সর্বনাশা পাশার নেশায়
শকুনির পরিহাসে প্রেয়সীরে করেছি বিক্রয় |


আমার রক্তিম মুখে এ শুধু রক্তের মরীচিকা,
এ পূর্ণতা পূর্বাভাস সমাসন্ন মহাশূন্যতার,
এই দীপ্তি, এই দাহ স্বাস্হ্য নহে, এ শুধু সহসা
যক্ষার পূণির্মা রাত্রে মরা দেহে জ্বরের জোয়ার |


নিজের মাথার খুলি নিজ হাতে ভরিয়া সুরায়
নিজেই করেছি পান জনহীন শ্মশানে দাঁড়ায়ে,
ভাঙ্গিয়া সুধার ভান্ড ক্ষুধা নিয়ে করেছি বিলাস
দু’মুঠো কঠিন অন্ন মাগি আজ দুহাত বাড়ায়ে |


অন্ন চাই, জল চাই, সুপ্তি চাই, শান্তি চাই আমি,
শক্তির ভিখারী আমি জীবনের শূন্য ভান্ড হাতে,
রূপ নহে রস চাই, ফুল নহে ফল চাই আমি
বাঁচিয়া থাকিতে চাই বহুরূপে আঘ্রাণে আস্বাদে |


দীপ্তি নিয়ে ভুলে ছিনু বস্তুরে করি অবহেলা,
করেছি সাধ্যেরে ভুলি অসাধ্যের উন্মাদ সাধনা,
যতই দিয়েছি শান্ ক্ষয় তত হয়েছে কৃপাণ,
এবার করিতে হবে অঙ্গে তার ইস্পাত ঘোষণা |


যন্ত্রণার রাজপথে জনতার জাগ্রত জগতে
দাঁড়ায়ে নির্দেশ মাগ, হে আমার বুদ্ধির অশ্বিনী,
অরণ্যের মৃঢ় মুক্তি ব্যর্থ হোক আকর্ষণ তার,-----
বিপন্ন যাত্রার মুখে হতে হবে বল্গায় বন্দিনী |


অতীতের অপচ্ছায়া অবলুপ্ত হোক তবে আজ,
গতির দুর্গতি হতে জন্ম নিক পরমা প্রগতি,
সুদীর্ঘ কৌমার্যক্লান্ত বর্ণহীনা কল্পনা আমার,
সংকল্পের সহবাসে হোক তবে শতপুত্রবতী |
                                   
.           *************************                                                 
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
ঘুমভাঙা
সরোজ দত্ত

এক ঢেউ তাজা রক্ত আঘাতের কাঁচা ক্ষতমুখ
ঠেলিয়া বাহিরে এল, গড়ায়ে নামিল গাঢ় স্রোতে,
অসাড় নেশার ঘুমে মগ্ন ছিনু মাদক আরামে,
কাঁদিয়া উঠিনু জাগি জর্জরিত ব্যথার জগতে |
দীর্ঘ দিন সুপ্তিলীন অনাহত স্নায়ুর সেতারে
ঝড়ের ঝঙ্কারে ওঠে, যন্ত্রণায় জাগে জীবকোষ
পশুর প্রশান্তি হতে অশান্তির অসীম আকাশে
ঘুমভাঙা রাঙা চোখে জেগে ওঠে রুদ্র অসন্তোষ |
কে যেন নবনীশুভ্র নগ্নতনু তামসী তৃপ্তিরে
চিরিয়া চিরিয়া কাটে চেতনার চাবুকে চাবুকে,
তারপর কি আবেগে বুকে টানে মুখে রাখে মুখ
জীবন হাসিয়া ওঠে নির্বিকার নিলাজ কৌতুকে |


চুম্বনের নোনা  ছোঁয়া ক্ষতমুখে লাগে যতবার
জ্বালায় বিদ্যুৎ খেলে, কেঁপে ওঠে পেশীর পাহাড় |
                   
.           *************************                                                 
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
ফসল
সরোজ দত্ত


ফসল বুনিতে মোরে একদিন ডেকেছিল যারা-----
শুনিনি তাদের কথা ;  গালি দিনু ইতর ভাষায় |
ফসল বুনিয়া তারা ক্লান্তিতে ঝরিয়া পড়ে আজ
হাসিয়া প্রস্তুত আমি সে ফসল তোলার আশায় |
              
.           *************************                                                  
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
ছায়া
সরোজ দত্ত

কেন এ যক্ষার রক্ত যৌবনের উত্সব বাসরে---
গানের আসরে কেন কানে আসে শ্মশানের স্তব,----
প্রাণের আনন্দযজ্ঞে  এল কোন অঘোর তান্ত্রিক,
মিলনের মধু লগ্নে কেন এ ক্লীবের কলরব ?


সুধার সমুদ্রকূলে কেন জাগে লুরার পিপাসা ?
উত্সবে মিশিতে চাই, কে আমার পথ করে রোধ ?
কোন প্রেত বারে বারে পাশে এসে ফেলে দীর্ঘশ্বাস,
আজীবন বঞ্চনার নিতে চায় পূর্ণ প্রতিশোধ ?
পশ্চাতে টেনো না আর, হে আমার বিষাক্ত অতীত !
আমার দূষিত রক্তে রুগ্ন কাম জাগায়ো না আর |
প্রাপ্তির পূর্ণিমা রাত্রে ব্যর্থতার অন্ধকার হতে
সম্মুখে এসো না আর, হে মোহিনী কঙ্কাল আমার |


আলোকে আচ্ছন্ন দিন নবজন্ম নূতন সঙ্গিনী,
আঁচলে বাঁধিয়া বিষ তবু কেন আসো মায়াবিনী ?
            
.           *************************                                                   
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
স্বাধীনতা
সরোজ দত্ত, ( জন্মদিবস উপলক্ষ্যে )

ছাপা ভুল, ভাষা ভুল, সর্বাঙ্গে ভুলের নামাবলী
বিচ্যুতি  বিরতিহীন অক্ষমতা হরফে হরফে,
হাতে নিয়ে জ্বলে উঠি----বলে উঠি --- এ লজ্জার বোঝা,
প্রত্যহের এই পঙ্ক দূর করে ফেলে দাও তবে |


যেমনই একথাকটি তপ্ত লৌহশলাকার মত
মুখ থেকে খসে পড়ে পশে গিয়ে আপনার কানে,
শিহরি মুদিয়া আঁখি মনে মনে বলি বার বার
মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা, যা বলেছি তিক্ত অভিমানে |


কীর্তি  ও কলঙ্ক এ যে, এ আমার গ্লানি ও গৌরব
ব্যর্থতার তীব্র জ্বালা, সাফল্যের দুর্বিসহ সুখ,
এ আমার দীন লজ্জা, এ আমার উগ্র অহঙ্কার
নাস্তির নিঃসীম শূন্যে জীবনের উদ্ধত কৌতুক |


এ পঙ্কতিলক জ্বলে আমার ললাটে জয়টীকা,
লঙ্কার ললাটে যেন রাবণের চিতাগ্নির শিখা |
      
.           *************************                                                 
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
ফাঁদ
সরোজ দত্ত

মানুষের মাংসলোভী দয়াহীন শিকারীর দল
ফাঁদ পেতে বসে থাকে রাত্রিদিন শিকার সন্ধানে
নিপীড়িত দুর্ভাগার বুকের পাঁজরে অবিরল
ছদ্মবেশী বেইমানেরা সুকৌশলে মৃত্যুবাণ হানে |
স্বার্থপর শিকারীর চক্ষে মায়া, বক্ষ বিষে ভরা
পৈশাচিক ছলনায় রক্ত শোষে নির্বিকার মনে ;
ধূর্তবুদ্ধি জল্লাদের পদতলে আর্তা বসুন্ধরা !
খুনী হাত ঢেকে  রাখে কুচক্রীরা শুভ্র আবরণে |

শিকার জেগেছে তাই দিকে দিকে শিকারীর ফাঁদে
বন্ধনের গ্রন্থী ছিঁড়ে গোষ্ঠীবদ্ধ শক্তিতে অটল
যুগান্তের পুঞ্জীভূত সুপ্তি ভাঙে ক্রুদ্ধ সিংহনাদে
কেঁপে ওঠে জনারণ্য প্রতিশোধে বিক্ষুব্ধ চঞ্চল,
ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় শিকারীর কৌশলের ফাঁদ,
যুগান্ত তৃষিত বক্ষে খুঁজে ফেরে মুক্তির আস্বাদ |
  
.           *************************                                                 
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
আমি
সরোজ দত্ত

.                  ১

আমি গলা জলে ডোবা কলা বৌ
.        আমি তলা খসে যাওয়া বালতি
যে আমার করে উপকার
.        তার বাবা তুলে আমি গাল দি |


আমি ঠুন ঠুন করে পেয়ালা বাজাই
.        গুন গুন করে ভাঁজি সুর
আর খুন চেপে গেলে দেরাদুন থেকে
.        সিধে চলে যাই গাজীপুর |


সেথা বিনি চুণে আমি সাঁচি পান খাই
.        বিনি নুনে খাই আন্ডা
আর কানমলা খেয়ে রাগে জ্বলে উঠি
.        লাথি খেয়ে হই ঠান্ডা |


আমি ঘোলা গঙ্গার তোলা জল খেয়ে
.        ওলাওঠা হয়ে খাবি খাই
ঘর আছে মোর, দোর আছে মোর
.        তালা আছে মোর, চাবি নাই |


গাড়ি চেপে যাই শুঁড়ি বাড়ি আমি
.               তাড়িখোর, মহা তাড়িখোর
মিশরে আমার ন’মাসীরা থাকে
.        যশোর জেলায় বাড়ি মোর |


আমি যারে দেখি তারে কাছে ডেকে বলি
.        ওরে, আয় দেখি নাড়ি তোর
আমি কদম গাছের মগডালে বসে
.        মুরলী বাজাই শাড়ি চোর
.              আমি গোপললনার শাড়ি চোর |


আমি শক্তের কাছে জোড় হাত
.        আর নরমেরে বলি কড়া বাত |
পিসিমার মিশি চুরি করে আমি
.        নিশিদিন মাজি নড়া দাঁত |
                  

.                ২

আমি ন্যাপাল বাবার ক্ষ্যাপা যাঁড়
.             আমি কুমারী দেখিলে ঢুঁমারি
আর পড়ে গেলে তার দুই পা জড়ায়ে
.             বলি, “ওগো আমি তুমারি” |


.                ৩

খিচুড়িরে আমি হালুয়া বানাই
.              হালুয়ারে করি কোপ্তা  |
আর খুশি হলে আমি ভুষি খাই শুধু
.              ঘুষি মারি চোরাগোপ্তা |


.                 ৪

আমি বাস করি খাস তালুকে,-----
হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরে বেঁধে রাখি পোষা ভালুকে |
আমি কারো পরোয়ানা পরোয়া করি না
ঘরোয়ানা ভাজি মেজাজে
আমি তখনি সে কাজ ভন্ডুল করি
যখনি লাগাও যে কাজে |
আমি কালু বলে ডাকি ভুলুকে এবং
ভুলু বলে ডাকি কালুকে |
আমার যেদিনই ইচ্ছে সেদিনই
মেদিনীপুরের জঙ্গল থেকে ধরে এনে বুনো ভালুকে,
আমি উপহার দেই লালুকে |
আমি সমতল করি ঢালুকে
আমি বানচাল করি চালুকে
আমি রাঙ্গা মাসীমার খাসিকে খাওয়াতে
টম্যাটো বানাই আলুকে |


.                ৫

আমি পোলা পায়রার বকম্ বকম্
.              ভোলা ময়রার কবিগান,
মম ফোলা গাল বাজে ববম্ ববম্
.              ভেতরে আস্ত খিলি পান,
তবু টকাস্ টকাস্ টক্ কার তুলি
.               জিব দিয়ে ছুঁয়ে তালুকে |


.                ৬

আমি নিজ হাতে লিখি নিজ নাম
আমি টাঙায়ে দিয়াছি দুয়ারে
একফালি লাল শালুকে |
আমি ন্যাপাল বাবার ক্ষ্যাপা যাঁড়
আমি মজা সুপারীর ব্যাপারী
জনগণ আমি তোমারই, আমি তোমারই
এ যুগের আমি গোপাল ঠাকুর
.             আমিই চিনেছি শালুকে |



.           *************************                                                 
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
পূর্ণিমার চূর্ণ চতুর্দশী
সরোজ দত্ত

এসেছে দোলের রাত্রি আবিরে মদির নিশীথিনী
পলাশে পলাশে করে মধুপান ক্লান্ত বিস্রবিনী ?
রাত্রিরে জড়ায়ে বুকে লজ্জাহীন জাগে নগ্ন শশী
পূর্ণিমার পদপ্রান্তে অকস্মাৎ চূর্ণ চতুর্দশী |
এরাত্রে মিনতি মিথ্যা কুন্ঠা মৃত্যু লজ্জা মহাপাপ
এরাত্রে অর্জুন শিরে উদ্যত নটীর অভিশাপ
এরাত্রে উর্বশী তার হাসিয়া খুলেছে বক্ষবাস
চরণে ক্লীবের কান্না, কে কাঁদে ? নীতির ক্রীতদাস |
ও কাকুতি ও কান্নায় কামনার বন্যা রুধিবে না  |
তোমার রক্তের ঋণ তুমি ছাড়া কেহ শুধিবে না |
এ রাত্রে মরিয়া গেছে কণালোভী ভীরু বিহঙ্গেরা
এ রাত্রে আকাশে কাঁপে গরুরের ক্ষুধিত চেহারা |


এসেছে দোলের রাত্রি ব্যথা লাগা পাখিজাগা দোল
ঘৃণার মৃদঙ্গ সাথে বিদ্বেষের বাজিছে শ্রীখোল |
ঘৃণার মৃদঙ্গ বাজে, সংঘাতের বাজে করতাল
সর্বাঙ্গে মাখিয়া রক্ত হোলি খেলে ব্রজের রাখাল |
শতাব্দীর শুষ্ক রক্তে পরিপূর্ণ আবিরের থালি |
মুঠো মুঠো সেই রক্ত ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারে বনমালী |
অসম্বৃতা গোপিনীরা কী নেশায় টলিতে টলিতে
সহসা পিচকারী তুলে মেতে ওঠে রক্তের হোলিতে |


রক্ত আবির শুষ্ক রক্ত শুষে খেয়ে তৃষিত পিচকারী,
সহিতে না পেরে তত্ক্ষণাৎ সে রক্ত উদ্ গারী |
খেলার মাতন লাগে বৃষভানু নন্দিনীর মুখে,
হাসিয়া রাখাল রাজা তাজা রক্ত মাখালো কৌতুকে |
এসেছে দোলের রাত্রি নিয়ে তার ক্ষুধা আর ক্ষোভ
নিঃস্বের শিরায় জ্বলে সর্বস্বের সর্বনাশা লোভ |

.           *************************                                                 
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
কালসাপ নিয়ে খেলায় মেতেছ ওস্তাদ
সরোজ দত্ত

কালসাপ নিয়ে খেলায় মেতেছো ওস্তাদ,
.      বলিহারী ওস্তাদ, বাহাদুর তুমি !
.      তুমি যখন রাঁশী বাজাও
.              হাঁটু নাচাও
.      মুঠি ঘোরাও নানান ছাঁদে
আমি কখনও বোবা রাগে গর্জে উঠি, কখনও মুগ্ধ হয়ে বাঁশী শুনি
কখনও ক্লান্ত হয়ে ফিরতে চাই
.      ঝাঁপির অন্ধকারে
জয় জয়কার ওঠে তোমার,
সবাই বলে, ‘বলিহারী ওস্তাদ, বাহাদুর তুমি !’
.      কিন্তু এ কী হলো আমার আজ,
এ কোন ব্যাথার জ্বর এসেছে আজ আমার সারা দেহে |
.      পুরানো খোলসের পর্দা সরিয়ে
.      বেরিয়ে এলাম এ কোন নতুন আমি |
.         মমতার মোম মাখানো ফাঁসির রশির মত মসৃণ,
.      বারুণীর বিজনঘাটে ভরা বসন্তে
.      বিধবা বিষকন্যার বেণীর মতো ভয়ংকর |
এ কোথায় এলাম আমি ?
নির্বিষ প্রতিবাদের নিষ্প্রাণ প্রেতলোক হতে
এ কোন পূর্ণশশীর গরলোদ্বেল প্রাণলোকে ?
মরাচাঁদের চৌদ্দ সিঁড়ি পেরিয়ে
এ কোন ভরা চাঁদের রাঙা আলোর দেশে ?
.          যতই থাক তোমার বাঁশীর জোর,
.       মন্ত্রের জোর শিকড়ের জোর,
মনে রেখো ওস্তাদ, বিষের থলি আজ পূর্ণ হয়েছে
.       আমার কানায় কানায়
.                মনে রেখো আজ পূর্ণিমা |

.                *************************                                                    
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
সমীক্ষা
সরোজ দত্ত

কি আশ্চর্য !  অর্ধশতাব্দীর এই সীমানায় এসে দেখি
সেই হাবাগোবা ছেলেটা ঠিক তেমনই বসে আছে
যেমনি ছিল সে একদিন উনিশশো তেত্রিশ সালে
ঐ পাথরের টিলাটির ওপর বসে |

মামা তার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেছিল একটা,
তার জন্যে সে এখন মরমে মরে আছে ;
অমন হাবাগোবার মতো
কখনোই দেখাতে চায়নি সে নিজেকে
এখন রাগ হয় তার মামার ওপরেই |

রাগ হয় তার সমস্ত দুনিয়ার ওপরেও, কেন না
কেউ তাকে কোনদিন ‘চালাক’  বলল না বলে |
সামনে একটা আরশি,
সেখানেও দেখে সেই হাবাগোবা ছেলেটা
ঠিক তেমনি ভাবেই আজও বসে আছে,
তখন রাগ হয় তার নিজেরই ওপর |

.                *************************                                                    
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
দীনু পাগলার গান
সরোজ দত্ত

জানিস আমি রাখাল রাজা
.        তোদের করি কেয়ার থোড়াই !
দুধেলা গাই বিলিয়ে দিয়ে
.        সারাটা দিন ছাগল চরাই |


.       বসন্ত না ঘোড়ার আন্ডা
.       হাড় কাঁপানো মাঘের ঠান্ডা
.       তাই, ননী মাখন শিকেয় তুলে
.                প্রেমানন্দে গাঁজা ধরাই  |


.                গোপীদের গোঁপ ওঠেনি
.                ভালো করে বোল ফোটেনি
.                তাদের ফষ্টিনষ্টি কি ভাই
.                          এই বয়সে আমি ডরাই ?


.        আমি, মা যশোদার খোদার খাসি
.                আছে বাঁশ নেইকো বাঁশী
.                মাঝে মাঝে বন্--বনা--বন
.                মাথার ওপর সে বাঁশ ঘোরাই
.        আমি, রাধার প্রেমে পাগল হয়ে
.                মাঠে মাঠে ছাগল চরাই |

.                *************************                                                    
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
শপথ
সরোজ দত্ত

রাজনীতি বুঝি না আমি,
বুঝি না তোমাদের সমাজবিপ্লবের জটিল তত্ত্ব কথা |
ঐতিহাসিক পরম লগ্নের প্রতীক্ষায় দিন-গোনার
ধৈর্য্য আমার নেই |
তোমাদের কুটিল যুক্তির সূক্ষাস্ত্র অঙ্কুশের
হাজার আঘাতেও বিচলিত হবে না আমার
বিবেকরূপিনী গজেন্দ্রানী |
.        আমি পুরুষ,
আমি এই আমার একমাত্র পরিচয় |
আমি দেখেছি আমার প্রেয়সীর
বিষন্ন বিদ্রোহের রক্তাক্ত পরিণতি
বস্তিতে, বন্দরে, ক্ষেতে, খামারে,
সহরের রাজপথে |
দেকেছি আমার ব্যথিত রুদ্রাণীর ললাটে
অপমান যন্ত্রণার রুষ্ট নক্ষত্রের জ্বালা |
তাই, তত্ত্বের আকাশে তর্কের শরজাল
রচনা করো তোমরা, আমাকে মুক্তি দাও |
সময় নেই আমার,----
আভিমানিনী যাজ্ঞসেনীর বেণী বাঁধতে হবে আমাকে
দুঃশাসনের রক্তমাখা হাতে |

.                *************************                                                    
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
রাতের অতিথি
সরোজ দত্ত

শেষ অঙ্কে যখন যবনিকা উঠ্ ল
মড়া-খেকো তান্ত্রিকটাকে দেখা গেল না |
দৃশ্যটা যদিও মহাশ্মশানের,
তবু খুশি হ’য়ে উঠল সবাই
ভাব্ লে, ভাঙাঘট সরিয়ে
পোড়া কয়লার দাগের উপর এবার
ঘর তুলব, ঘর সাজাব, বধূকে আন্ ব ঘরে |
খোঁজ পড়ল গাঁইতি কোদাল শাবলের,
কোমরে কাপড় জড়াল মানুষ |

কিন্তু কতে যেন রোজ রাতে অন্ধকারে চুপি চুপি আসে
আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় চালে
উঠোনে ছড়িয়ে যায় মড়ার মাথার খুলি,
আর ভাঙা ঘটের কানা |
বাঁশঝাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে
চাপা গলায় নাম ধরে ডাকে,
শুনে ঘুমন্ত মানুষ ঘুমচোখে বেরিয়ে আসে পথে ;
ঘুম যখন ভাঙে, দেখে গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে |

দিশাহারা বিহ্বল মানুষ ভাবে
এ কোন্ অভাবিত সর্বনাশ,
কে এই নিশাচর !

.                *************************                                                     
সূচিতে   


মিলনসাগর
*
মাতাল খরগোশ
সরোজ দত্ত

.               ১

সজারুর জন্মদিনের পার্টিতে
.        খরগোশের হল নিমন্ত্রণ
সেজেগুজে চললেন বাবু
.        খুশিতে রঙ্গীন হলো মন |
আড্ডা সেথায়
জমল ভালই
.       গল্প গুজব
.       ঠাট্টা মস্করা
.       খাদ্য ছিল চমৎকার
.       মদ্য ছিল মেজাজ গরম করা |
প্রচুর মদ্য গিলল খরগোশ
.       গিলল প্রাণপণে
এত গিলল যে আদবকায়দা
.       রইল না আর মনে |
ক্রমে যখন হলো বারটা রাত
পা দুটো তার টলছে তখন
আর চীৎকারে তার কাঁপছে বাড়ির ছাদ |


.                ২

এবার আমি বাড়ি চললুম
.       খুব হয়েছে পান ও ভোজন
গৃহকর্ত্রী বললেন তখন,
.       দোহাই আপনার একটু শান্ত হোন |
বসুন আপনি |  পড়ে যাবেন |
.       ওমা আপনার হয়েছে একি ছিরি
আজ রাতটা থাকুন হেথায়
.       সকাল বেলায় বাড়ি যাবেন ফিরি |
এ অবস্থায় নিশ্চয়ই আপনি
.       হারিয়ে ফেলবেন পথ,
শুনেছি বনে সিংহ আছে
.               ঘটবে যে বিপদ |


.                 ৩

কি বললেন ? সিংহ !  আরে ছোঃ !  আমার কাছে
.                  সিংহ ব্যাটা কী !
সিংহটাকে টিট্ করতে
.            আমার লাগবে কী ?
এক ঘুষিতে উল্টে ফেলে
.        গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নেব তার
টুক্ রো টুক্ রো করে ছিঁড়ে
.        ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলব পগার পার |
বনের মধ্য দিয়ে চলল খরগোশ
.        নেশায় টলতে লাগল দু’চরণ
চীৎকারে তার উঠল জেগে
.        বনের যত প্রাণী |


.                 ৪

সিংহ !   আরে ছোঃ !    বড়ো করে
.        দিলে একটা হাঁচি,
টিট করেছি অমন কত
গন্ডা গন্ডা দেখলুম আমি-----
.        হারামজাদা কত অমন পাজি
এইসব কথা বলে খরগোশ
.        জুড়ল এমন চীৎকার
গুহার মধ্যে সিংহমশা’র
.        ব্যাঘাত ঘটল নিদ্রার |
ধীরে ধীরে বাইরে এসে শশকমশা’র
.        ধরে থুতনিটিরে,
বল্লেন, “দেখি এত রাত্রে ভদ্দরলোকদের
.        ঘুম ভাঙ্গাচ্ছেন কে ?
আরে এ যে শশক মশাই !
.        মাতাল দেখছি !  দাঁড়ান দেখি তবে,
.        লটকে দিচ্ছি এই গাছটাতে
.                 দেখতে খাসা হবে” |


.                ৫

সিংহ দেখে শশকমশা’র
.       নেশা গেল এক্কেবারে ছুটে,
প্রাণ বাঁচাতে পশুরাজের পায়ের
.       উপর, পড়ল গিয়ে লুটে |
‘ কী বলতে কী বকেছি, কথায়
.       আমার কান দেবেন না প্রভু,
প্রভুর অনিষ্ট চিন্তা
.        করবো না কো মরে গেলেও তবু |
আপনার মতম মহান রাজা
.        এ জীবনে দেখি নি তো আর-----
দেখুন কর্তা এইমাত্র গিয়েছিলাম
.        একটি নিমন্ত্রণে |
সেথায় একটু পান করেছি
.        পান করেছে অন্য সকলেই
আমি কিন্তু পান করেছি, সত্যি বলছি
.        আপনার জন্যই |


.               ৬

পান করেছি আপনার স্বাস্থ্য
.      পান করেছি স্বাস্থ্য গিন্নীমার,
সত্যি বলছি খোকাখুকুর
.      স্বাস্থ্য পান করেছি বারবার |
সিংহ তখন থাবার ভিতর নখগুলি তার
.      গুটিয়ে নিলেন ধীরে,
খরগোশকে ছেড়ে দিলেন
.      দিলেন তাকে যেতে ঘরে ফিরে |
কেন দিলেন ছেড়ে, কারণ অতি সোজা
খোসামুদির পরম ভক্ত
.      ছিলেন বনে রাজা |


.      *************************                                                         
সূচিতে     


মিলনসাগর
*
সরোজ দত্তর কবিতা


হাঁটু কাঁপা টাটু চেপে হাটে যায় কার চাটুকার,
যেকথা জানে না কেউ, সেকথার কিবা প্রয়োজন ?
যে আলুর দম খেয়ে দামী ঘোড়া দম ফেটে মরে
সে আলুর ইতিকথা আজ বন্ধু থাকুক গোপন |

.      *************************                                                         
সূচিতে     


মিলনসাগর
*
সরোজ দত্তর কবিতা


দক্ষিণে টানে যমের চাকর
বামে টানে বামাচারী  |


.      ****************                                                               
সূচিতে     


মিলনসাগর
*
সরোজ দত্তর কবিতা



যাঁহাতক সাহস করে
মেরেছি একটি শিস্,
ঘা’কতক পড়ল পিঠে
গা’গতর ব্যথায় বিষ |


.      ****************                                                               
সূচিতে     


মিলনসাগর
*
সরোজ দত্তর কবিতা




খাসির চর্বি দিয়ে যখন ছোটমাসী ভাজে বড়া
গন্ধেতে তার খাটের উপর ওঠে বাসি মড়া



.      ****************                                                               
সূচিতে     


মিলনসাগর
*
সরোজ দত্তর কবিতা




রাত্তিরে করেন ভীম দুঃশাসন -- বক্ষোরক্তপান
সকালে ঠোঁটের রঙ তুলিবারে জোটে না সাবান |




.      ****************                                                               
সূচিতে     


মিলনসাগর
*