কালসাপ, কাঁচা বাঘছাল, চিতাভস্ম, গরল, কঙ্কাল, পরিত্যক্ত শ্মশানের প্রেত সঙ্গীদল----- মড়ক, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, বন্যা, আর ভূমিকম্প---- সৃষ্টি জাগে প্রলয় সম্বল | অর্থহীন অন্ধ হিংসা কদর্য করাল . এই মহাকাল |
এই বিনাশের স্ত্ততি ছন্দে-গানে, কাব্যে-শিল্পে, ইঙ্গিতে-আভাসে নৃশংস ধর্ষণ আর অতি-রতি সম্ভোগের অন্তিম উল্লাসে, ত্যাগের তুষার হতে তুলে-আনা শব যেথা ভোগানলে ভস্ম হযে আসে |
এর মাঝে কী ঐশ্বর্য, সৌন্দর্যের কোন রঙ্গশালা . উদ্ভাসিত হবে ? অসভ্যের মৃত্যুপূজা, হে সভ্যতা সাঙ্গ করো তবে | দেখো না কি চেয়ে, আসন্ন মৃত্যুর মুখে মহাকাল আতঙ্কে নিষ্ঠুর, অক্ষমের দুর্বলের নারীর শিশুর . অন্ধ ক্রোধে প্রাণ উত্পাটিছে |
তবুও তাহারই আগে পিছে সংগ্রামে হাসিয়া উঠে মৃত্যুমারী প্রাণপ্রেম নিঃসংশয়ে বিজয়ের অগ্রিম উত্সবে | মহাকাল মন্দিরের কাঁপিয়ে পাষাণ ভিৎ বিভীষিকা-বিগ্রহের অবলুপ্তি হবে, মুমূর্ষ ও নির্লিঙ্গের মৃত্যু আর লিঙ্গপূজা হে সভ্যতা, সাঙ্গ করো তবে |
পশুর বৈকুন্ঠ হতে মানুষের কুন্ঠিত জগতে মুক্তির শৃঙ্খল হতে শৃঙ্খলায় মুক্তি মাগি আমি, স্বেচ্ছাচারী নীহারিকা স্থান মাগি সৌর পরিবারে, গ্রহের মর্যাদা মাগি, হতে চাই কক্ষ অনুগামী |
আমার সহে না আর আত্মঘাতী এই অভিসার, নির্বোধ শিশুর মতো দুর্লভের এই অপচয়,---- সহে না এ শূন্য ঘর, সর্বনাশা পাশার নেশায় শকুনির পরিহাসে প্রেয়সীরে করেছি বিক্রয় |
আমার রক্তিম মুখে এ শুধু রক্তের মরীচিকা, এ পূর্ণতা পূর্বাভাস সমাসন্ন মহাশূন্যতার, এই দীপ্তি, এই দাহ স্বাস্হ্য নহে, এ শুধু সহসা যক্ষার পূণির্মা রাত্রে মরা দেহে জ্বরের জোয়ার |
নিজের মাথার খুলি নিজ হাতে ভরিয়া সুরায় নিজেই করেছি পান জনহীন শ্মশানে দাঁড়ায়ে, ভাঙ্গিয়া সুধার ভান্ড ক্ষুধা নিয়ে করেছি বিলাস দু’মুঠো কঠিন অন্ন মাগি আজ দুহাত বাড়ায়ে |
অন্ন চাই, জল চাই, সুপ্তি চাই, শান্তি চাই আমি, শক্তির ভিখারী আমি জীবনের শূন্য ভান্ড হাতে, রূপ নহে রস চাই, ফুল নহে ফল চাই আমি বাঁচিয়া থাকিতে চাই বহুরূপে আঘ্রাণে আস্বাদে |
দীপ্তি নিয়ে ভুলে ছিনু বস্তুরে করি অবহেলা, করেছি সাধ্যেরে ভুলি অসাধ্যের উন্মাদ সাধনা, যতই দিয়েছি শান্ ক্ষয় তত হয়েছে কৃপাণ, এবার করিতে হবে অঙ্গে তার ইস্পাত ঘোষণা |
যন্ত্রণার রাজপথে জনতার জাগ্রত জগতে দাঁড়ায়ে নির্দেশ মাগ, হে আমার বুদ্ধির অশ্বিনী, অরণ্যের মৃঢ় মুক্তি ব্যর্থ হোক আকর্ষণ তার,----- বিপন্ন যাত্রার মুখে হতে হবে বল্গায় বন্দিনী |
অতীতের অপচ্ছায়া অবলুপ্ত হোক তবে আজ, গতির দুর্গতি হতে জন্ম নিক পরমা প্রগতি, সুদীর্ঘ কৌমার্যক্লান্ত বর্ণহীনা কল্পনা আমার, সংকল্পের সহবাসে হোক তবে শতপুত্রবতী |
ফসল বুনিতে মোরে একদিন ডেকেছিল যারা----- শুনিনি তাদের কথা ; গালি দিনু ইতর ভাষায় | ফসল বুনিয়া তারা ক্লান্তিতে ঝরিয়া পড়ে আজ হাসিয়া প্রস্তুত আমি সে ফসল তোলার আশায় |
কেন এ যক্ষার রক্ত যৌবনের উত্সব বাসরে--- গানের আসরে কেন কানে আসে শ্মশানের স্তব,---- প্রাণের আনন্দযজ্ঞে এল কোন অঘোর তান্ত্রিক, মিলনের মধু লগ্নে কেন এ ক্লীবের কলরব ?
সুধার সমুদ্রকূলে কেন জাগে লুরার পিপাসা ? উত্সবে মিশিতে চাই, কে আমার পথ করে রোধ ? কোন প্রেত বারে বারে পাশে এসে ফেলে দীর্ঘশ্বাস, আজীবন বঞ্চনার নিতে চায় পূর্ণ প্রতিশোধ ? পশ্চাতে টেনো না আর, হে আমার বিষাক্ত অতীত ! আমার দূষিত রক্তে রুগ্ন কাম জাগায়ো না আর | প্রাপ্তির পূর্ণিমা রাত্রে ব্যর্থতার অন্ধকার হতে সম্মুখে এসো না আর, হে মোহিনী কঙ্কাল আমার |
ছাপা ভুল, ভাষা ভুল, সর্বাঙ্গে ভুলের নামাবলী বিচ্যুতি বিরতিহীন অক্ষমতা হরফে হরফে, হাতে নিয়ে জ্বলে উঠি----বলে উঠি --- এ লজ্জার বোঝা, প্রত্যহের এই পঙ্ক দূর করে ফেলে দাও তবে |
যেমনই একথাকটি তপ্ত লৌহশলাকার মত মুখ থেকে খসে পড়ে পশে গিয়ে আপনার কানে, শিহরি মুদিয়া আঁখি মনে মনে বলি বার বার মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা, যা বলেছি তিক্ত অভিমানে |
কীর্তি ও কলঙ্ক এ যে, এ আমার গ্লানি ও গৌরব ব্যর্থতার তীব্র জ্বালা, সাফল্যের দুর্বিসহ সুখ, এ আমার দীন লজ্জা, এ আমার উগ্র অহঙ্কার নাস্তির নিঃসীম শূন্যে জীবনের উদ্ধত কৌতুক |
এ পঙ্কতিলক জ্বলে আমার ললাটে জয়টীকা, লঙ্কার ললাটে যেন রাবণের চিতাগ্নির শিখা |
আমি গলা জলে ডোবা কলা বৌ . আমি তলা খসে যাওয়া বালতি যে আমার করে উপকার . তার বাবা তুলে আমি গাল দি |
আমি ঠুন ঠুন করে পেয়ালা বাজাই . গুন গুন করে ভাঁজি সুর আর খুন চেপে গেলে দেরাদুন থেকে . সিধে চলে যাই গাজীপুর |
সেথা বিনি চুণে আমি সাঁচি পান খাই . বিনি নুনে খাই আন্ডা আর কানমলা খেয়ে রাগে জ্বলে উঠি . লাথি খেয়ে হই ঠান্ডা |
আমি ঘোলা গঙ্গার তোলা জল খেয়ে . ওলাওঠা হয়ে খাবি খাই ঘর আছে মোর, দোর আছে মোর . তালা আছে মোর, চাবি নাই |
গাড়ি চেপে যাই শুঁড়ি বাড়ি আমি . তাড়িখোর, মহা তাড়িখোর মিশরে আমার ন’মাসীরা থাকে . যশোর জেলায় বাড়ি মোর |
আমি যারে দেখি তারে কাছে ডেকে বলি . ওরে, আয় দেখি নাড়ি তোর আমি কদম গাছের মগডালে বসে . মুরলী বাজাই শাড়ি চোর . আমি গোপললনার শাড়ি চোর |
আমি শক্তের কাছে জোড় হাত . আর নরমেরে বলি কড়া বাত | পিসিমার মিশি চুরি করে আমি . নিশিদিন মাজি নড়া দাঁত |
. ২
আমি ন্যাপাল বাবার ক্ষ্যাপা যাঁড় . আমি কুমারী দেখিলে ঢুঁমারি আর পড়ে গেলে তার দুই পা জড়ায়ে . বলি, “ওগো আমি তুমারি” |
. ৩
খিচুড়িরে আমি হালুয়া বানাই . হালুয়ারে করি কোপ্তা | আর খুশি হলে আমি ভুষি খাই শুধু . ঘুষি মারি চোরাগোপ্তা |
. ৪
আমি বাস করি খাস তালুকে,----- হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরে বেঁধে রাখি পোষা ভালুকে | আমি কারো পরোয়ানা পরোয়া করি না ঘরোয়ানা ভাজি মেজাজে আমি তখনি সে কাজ ভন্ডুল করি যখনি লাগাও যে কাজে | আমি কালু বলে ডাকি ভুলুকে এবং ভুলু বলে ডাকি কালুকে | আমার যেদিনই ইচ্ছে সেদিনই মেদিনীপুরের জঙ্গল থেকে ধরে এনে বুনো ভালুকে, আমি উপহার দেই লালুকে | আমি সমতল করি ঢালুকে আমি বানচাল করি চালুকে আমি রাঙ্গা মাসীমার খাসিকে খাওয়াতে টম্যাটো বানাই আলুকে |
আমি নিজ হাতে লিখি নিজ নাম আমি টাঙায়ে দিয়াছি দুয়ারে একফালি লাল শালুকে | আমি ন্যাপাল বাবার ক্ষ্যাপা যাঁড় আমি মজা সুপারীর ব্যাপারী জনগণ আমি তোমারই, আমি তোমারই এ যুগের আমি গোপাল ঠাকুর . আমিই চিনেছি শালুকে |
কি আশ্চর্য ! অর্ধশতাব্দীর এই সীমানায় এসে দেখি সেই হাবাগোবা ছেলেটা ঠিক তেমনই বসে আছে যেমনি ছিল সে একদিন উনিশশো তেত্রিশ সালে ঐ পাথরের টিলাটির ওপর বসে |
মামা তার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেছিল একটা, তার জন্যে সে এখন মরমে মরে আছে ; অমন হাবাগোবার মতো কখনোই দেখাতে চায়নি সে নিজেকে এখন রাগ হয় তার মামার ওপরেই |
রাগ হয় তার সমস্ত দুনিয়ার ওপরেও, কেন না কেউ তাকে কোনদিন ‘চালাক’ বলল না বলে | সামনে একটা আরশি, সেখানেও দেখে সেই হাবাগোবা ছেলেটা ঠিক তেমনি ভাবেই আজও বসে আছে, তখন রাগ হয় তার নিজেরই ওপর |
রাজনীতি বুঝি না আমি, বুঝি না তোমাদের সমাজবিপ্লবের জটিল তত্ত্ব কথা | ঐতিহাসিক পরম লগ্নের প্রতীক্ষায় দিন-গোনার ধৈর্য্য আমার নেই | তোমাদের কুটিল যুক্তির সূক্ষাস্ত্র অঙ্কুশের হাজার আঘাতেও বিচলিত হবে না আমার বিবেকরূপিনী গজেন্দ্রানী | . আমি পুরুষ, আমি এই আমার একমাত্র পরিচয় | আমি দেখেছি আমার প্রেয়সীর বিষন্ন বিদ্রোহের রক্তাক্ত পরিণতি বস্তিতে, বন্দরে, ক্ষেতে, খামারে, সহরের রাজপথে | দেকেছি আমার ব্যথিত রুদ্রাণীর ললাটে অপমান যন্ত্রণার রুষ্ট নক্ষত্রের জ্বালা | তাই, তত্ত্বের আকাশে তর্কের শরজাল রচনা করো তোমরা, আমাকে মুক্তি দাও | সময় নেই আমার,---- আভিমানিনী যাজ্ঞসেনীর বেণী বাঁধতে হবে আমাকে দুঃশাসনের রক্তমাখা হাতে |
শেষ অঙ্কে যখন যবনিকা উঠ্ ল মড়া-খেকো তান্ত্রিকটাকে দেখা গেল না | দৃশ্যটা যদিও মহাশ্মশানের, তবু খুশি হ’য়ে উঠল সবাই ভাব্ লে, ভাঙাঘট সরিয়ে পোড়া কয়লার দাগের উপর এবার ঘর তুলব, ঘর সাজাব, বধূকে আন্ ব ঘরে | খোঁজ পড়ল গাঁইতি কোদাল শাবলের, কোমরে কাপড় জড়াল মানুষ |
কিন্তু কতে যেন রোজ রাতে অন্ধকারে চুপি চুপি আসে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় চালে উঠোনে ছড়িয়ে যায় মড়ার মাথার খুলি, আর ভাঙা ঘটের কানা | বাঁশঝাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে চাপা গলায় নাম ধরে ডাকে, শুনে ঘুমন্ত মানুষ ঘুমচোখে বেরিয়ে আসে পথে ; ঘুম যখন ভাঙে, দেখে গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে |
দিশাহারা বিহ্বল মানুষ ভাবে এ কোন্ অভাবিত সর্বনাশ, কে এই নিশাচর !
সজারুর জন্মদিনের পার্টিতে . খরগোশের হল নিমন্ত্রণ সেজেগুজে চললেন বাবু . খুশিতে রঙ্গীন হলো মন | আড্ডা সেথায় জমল ভালই . গল্প গুজব . ঠাট্টা মস্করা . খাদ্য ছিল চমৎকার . মদ্য ছিল মেজাজ গরম করা | প্রচুর মদ্য গিলল খরগোশ . গিলল প্রাণপণে এত গিলল যে আদবকায়দা . রইল না আর মনে | ক্রমে যখন হলো বারটা রাত পা দুটো তার টলছে তখন আর চীৎকারে তার কাঁপছে বাড়ির ছাদ |
. ২
এবার আমি বাড়ি চললুম . খুব হয়েছে পান ও ভোজন গৃহকর্ত্রী বললেন তখন, . দোহাই আপনার একটু শান্ত হোন | বসুন আপনি | পড়ে যাবেন | . ওমা আপনার হয়েছে একি ছিরি আজ রাতটা থাকুন হেথায় . সকাল বেলায় বাড়ি যাবেন ফিরি | এ অবস্থায় নিশ্চয়ই আপনি . হারিয়ে ফেলবেন পথ, শুনেছি বনে সিংহ আছে . ঘটবে যে বিপদ |
. ৩
কি বললেন ? সিংহ ! আরে ছোঃ ! আমার কাছে . সিংহ ব্যাটা কী ! সিংহটাকে টিট্ করতে . আমার লাগবে কী ? এক ঘুষিতে উল্টে ফেলে . গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নেব তার টুক্ রো টুক্ রো করে ছিঁড়ে . ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলব পগার পার | বনের মধ্য দিয়ে চলল খরগোশ . নেশায় টলতে লাগল দু’চরণ চীৎকারে তার উঠল জেগে . বনের যত প্রাণী |
. ৪
সিংহ ! আরে ছোঃ ! বড়ো করে . দিলে একটা হাঁচি, টিট করেছি অমন কত গন্ডা গন্ডা দেখলুম আমি----- . হারামজাদা কত অমন পাজি এইসব কথা বলে খরগোশ . জুড়ল এমন চীৎকার গুহার মধ্যে সিংহমশা’র . ব্যাঘাত ঘটল নিদ্রার | ধীরে ধীরে বাইরে এসে শশকমশা’র . ধরে থুতনিটিরে, বল্লেন, “দেখি এত রাত্রে ভদ্দরলোকদের . ঘুম ভাঙ্গাচ্ছেন কে ? আরে এ যে শশক মশাই ! . মাতাল দেখছি ! দাঁড়ান দেখি তবে, . লটকে দিচ্ছি এই গাছটাতে . দেখতে খাসা হবে” |
. ৫
সিংহ দেখে শশকমশা’র . নেশা গেল এক্কেবারে ছুটে, প্রাণ বাঁচাতে পশুরাজের পায়ের . উপর, পড়ল গিয়ে লুটে | ‘ কী বলতে কী বকেছি, কথায় . আমার কান দেবেন না প্রভু, প্রভুর অনিষ্ট চিন্তা . করবো না কো মরে গেলেও তবু | আপনার মতম মহান রাজা . এ জীবনে দেখি নি তো আর----- দেখুন কর্তা এইমাত্র গিয়েছিলাম . একটি নিমন্ত্রণে | সেথায় একটু পান করেছি . পান করেছে অন্য সকলেই আমি কিন্তু পান করেছি, সত্যি বলছি . আপনার জন্যই |
. ৬
পান করেছি আপনার স্বাস্থ্য . পান করেছি স্বাস্থ্য গিন্নীমার, সত্যি বলছি খোকাখুকুর . স্বাস্থ্য পান করেছি বারবার | সিংহ তখন থাবার ভিতর নখগুলি তার . গুটিয়ে নিলেন ধীরে, খরগোশকে ছেড়ে দিলেন . দিলেন তাকে যেতে ঘরে ফিরে | কেন দিলেন ছেড়ে, কারণ অতি সোজা খোসামুদির পরম ভক্ত . ছিলেন বনে রাজা |