কবি সরোজ দত্ত - ২১’শে ফাল্গুন ১৩২১ বঙ্গাব্দে বা ৫ মার্চ ১৯১৫ (এই ইংরেজী তারিখটি সম্বন্ধে
আমরা নিশ্চিত নই) জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলার নড়াইল গ্রামের এক সম্পন্ন জমিদার
বংশে। তাঁর বাবার নাম হৃদয়কৃষ্ণ দত্ত, মা কিরণবালা | নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রথম
বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর ১৯৩০ সালে কলকাতায় আসেন স্কটিশ চার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট
পড়তে। ওই কলেজ থেকেই ১৯৩৬ সালে ইংরাজি নিয়ে স্নাতক হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে ভর্তি হন।
সরোজ দত্তর কবিতা পড়তে গেলে তাঁর রাজনীতি কে বাদ দেওয়া সম্ভব নয় | কলেজে থাকতেই কম্যুনিস্ট
পার্টিতে যোগদান করেন এবং কিছুদিনের কারাবাস ভোগ করেন। ১৯৩৮ সালে এম.এ. পাস করেন এবং
প্রগতি লেখক সঙ্ঘে যোগ দেন। ১৯৩৯ সালে সহ-সম্পাদক হিসাবে যোগ দেন অমৃতবাজার পত্রিকাতে। পরে
তিনি যোগ দেন অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির (CPI)পশ্চিমবঙ্গ কমিটির মুখপত্র “দৈনিক স্বাধীনতা” পত্রিকায় |
১৯৬২ সালে আবার কারারুদ্ধ হন এবং সেখানেই তিনি ভবিষ্যতের "নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলন"-এর
নেতা চারু মজুমদারের সান্নিধ্যে আসেন | পার্টির ভেতর “দাঙ্গে-পন্থি” নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন
এবং ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হওয়ার সময় চলে আসেন মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে (CPIM) |
২৫ মে ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয় | সরোজ দত্ত তাঁর দলের অবস্থানের সমালোচনা করেন
এবং বহিষ্কৃত হন CPIM দল থেকে | ঐ বছরই All India Coordination Committee of Communist
Revolutionaries (AICCCR) সংগঠিত হয় এবং ১৯৬৯ এ জন্ম হয় Communist Party of India (Marxist-Leninist)
(CPI M-L) | সরোজ দত্ত দলের পত্রিকা “দেশব্রতী”-র সম্পাদক হন | সেই সাথে শুরু হয় বাংলার এক
ঐতিহাসিক অধ্যায় | সেই সময় তাদের দ্বারা কলকাতা শহরের মনিষিদের মূর্ত্তি ভাঙা হয় | সকালে উঠে
দেখা যেত যে মূর্তির গলা কেটে মাটিতে রাখা হয়েছে | যার মধ্যে কলেজ স্কোয়ারের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের
মূর্তিটিও ছিল | সরোজ দত্ত নাকি এই চিন্তাধারার জনক ছিলেন | এই ঘটনা অবশ্য বাংলার মানুষ মেনে নেন
নি এবং এটি এক ধরণের হঠকারিতা হিসেবেই তাঁরা দেখেছেন | ১৯৭০ সালে তিনি কলকাতা পুলিশের ও
প্রশাসনের মোস্ট ওয়ান্টেড এর তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন | ৫ অগাস্ট ১৯৭১ এর ভোর ৫ ~ ৫.৩০ এর মধ্যে
ময়দানের এরিয়ানস মাঠের কাছে তাঁকে জীপে করে এনে চুপিসাড়ে হত্যা করা হয় | গুলি করে মেরে তাঁর
মাথা কেটে নেয়া হয়েছিল | “বাংলাদেশ” পত্রিকায় পরে বের হয় যে বাংলা সিনেমার এক বিখ্যাত নায়ক
নাকি সেই সময় ময়দানে ভ্রমণ করতে গিয়ে এই ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছিলেন | এবং পরে নাকি তাঁকে বেশ
কিছু দিন বাংলার বাইরে গিয়ে থাকতে হয় | বাংলার ক্ষমতায় তখন সিদ্ধার্থ শংকর রায় |
জলার্ক পত্রিকাকে, কলকাতার ভবানীপুরে ১৯.১১.১৯৯৬ তে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে, অভিনেতা ও কবি
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন যে - “. . . উনি ( উত্তম কুমার ) এরকম একটা ঘটনা দেখেছিলেন --- মানে
ময়দানে পুলিশ একজনকে ভ্যান থেকে নামিয়ে গুলি করছে। কিন্তু সেটা যে সরোজ দত্তই---তা অন্যেরা
connect করছেন। উত্তমদার পক্ষে তিনি যে সরোজ দত্তই তা at all চেনা সম্ভব ছিল বলে আমার
মনে হয় না। ব্যক্তিগত পরিচয় তো ছিলই না. আর উত্তমদা এসব থেকে অনেক দূরে ছিলেন। সে সময় ভ্যান
থেকে নামিয়ে গুলি করার ঘটনা তো অনেকই ঘটেছে। . . . কেউ তাকে ফোর্স করেছিল তা কিন্তু নয় ; যা
হয়েছিল ওই ঘটনা যেদিন ঘটে ( এই ঘটনাও আমার শোনা---দেখিনি ) সেই দিনই টালিগঞ্জে কিছু ছেলে ওঁর
কাছে আসে এবং টাকা চায়। ওঁর সঙ্গে যারা থাকতো তাদের সাথে সেই ছেলেদের, যাদের কাছে
কিছু অস্ত্রো ছিল, বচসা হয়। সম্ভবত অস্ভ নিয়ে মেক-আপ রুমে ঢুকে ওঁকে ভয় দেখায়। আমার ক্ষেত্রেও
এই রকম ঘটনা ঘটেছিল।” থ্রেট সেই দিনই করা হয়েছিল কি না --- এই প্রশ্নের উত্তরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
বলেন, “বোধ হয় ঐ দিনই। এটা কো-ইন্সিডেন্স। এতে নার্ভাস হয়ে উনি বোম্বাই চলে যান। আমি হয়তো
ব্যক্তিগতভাবে সরোজ দত্তকে না চিনলেও সরোজ দত্ত কে তা জানতাম। কিন্তু উত্তমদা সরোজ দত্ত কে তা
জানতেনও না। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম --- কি ব্যাপার, তোমাকে এমন লাগছে? উনি বললেন যে --- দেখ্,
এভাবে ভয় দেখাচ্ছে, আবার এরকম একটা লোককে মারতে দেখলাম। আমার সাথে এই কথাবার্তা সেই
দিনই বা দু’একদিন পরে হয়। তার পরে উনি বোম্বাই চলে যান। ( স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত
সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী, দ্বিতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা-৩৯৮। )
নদীয়ার নকশালবাড়ী আন্দোলনের নেতা অজয় ভট্টাচার্যর স্ত্রী তথা আই.পি.টি.এ. ও নকশালবাড়ী
আন্দোলনের কর্মী শ্রীমতী জয়শ্রী ভট্টাচার্যের ৭ই নভেম্বর ১৯৯৬ সালে, স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত অধুনা
জলার্ক প্রকাশিত “সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী” গ্রন্থ, ১৯৯৮ তে দেওয়া স্মৃতিচারণা বা সাক্ষাত্কার থেকে
আরও জানা যায় যে ১৯৭৪ নাগাদ তিনি সি.পি.আই.এম.এল-এর মহাদেব মুখার্জীর টিমের সঙ্গে যুক্ত
হয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলেন। ধরা পড়লেন ধানবাদে। সেখানে তাঁর দাদাকেও ধরে আনা হয়েছিল।
জয়শ্রী দেবী তাঁর আসল পরিচয় যাতে কবুল করে নেন, তার জন্য তাঁর দাদার উপর অমানুষিক অত্যাচার
চালায় স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এস.বি.) অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার (এ.সি.) অমর মুখার্জী এবং ডি.ডি.-র সন্তোষ। এই
সন্তোষই অর্চনা গুহর উপরে অত্যাচার (টরচার) চালিয়েছিলেন। অমর মুখার্জী সেদিন জয়শ্রীকে তাঁর
রিভলভার দেখিয়ে বলেছিলেন - “জানিস, ওই রিভলভারটা দিয়ে আমি সরোজ দত্তকে মেরেছি”। ( স্বপন
দাসাধিকারী সম্পাদিত সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী গ্রন্থ, তৃতীয় পর্ব, পৃষ্ঠা ১৭০। )
কবি গণসঙ্গীতকার অজিত পাণ্ডে, জলার্ক পত্রিকাকে ( নুরুল তরাই : অজিত পাণ্ডের গান, স্বপন দাসাধিকারী
সম্পাদিত “এবং জলার্ক” থেকে ২.৬.১৯৯৭ তারিখে প্রকাশিত “যুদ্ধজয়ের গান”, গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৪৭২ ) দেওয়া এক
সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিলেন যে চারু মজুমদার সেই অর্থে অত্যন্ত সাংস্কৃতিক মানুষ ছিলেন এবং অত্যন্ত
ক্ষমাপরায়ন। সরোজ দত্ত ক্ষমাশীল ছিলেন না। উত্পল দত্ত, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার পরে, প্রফুল্ল ঘোষের
মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে, যখন রাতারাতি কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার করা শুরু হলো, তখন মিনার্ভা থিয়েটারে
তীর নাটক চলছিল। তিনি আণ্ডাগ্রাউণ্ডে চলে যাওয়া মনস্থির করে আসানসোল চলে গেলেন। কিছুদিন
পরেই তাঁকে বম্বে থেকে ধরা হয় আইভরী মার্চেন্টের একটি সিনেমার শুটিং করার সময়ে, একটি তানপুরা
নিয়ে! নকশালদের, আমেরিকানদের ছবি করা তখন ভাবাই যায়না! সেই ঘটনায় চারু মজুমদার, উত্পল
দত্তকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিহারের ঝরিয়াতে একবার অজিত পাণ্ডে, সরোজ দত্তর কাছে
প্রতিবাদ করেন রাজধানী এক্সপ্রেসকে উল্টে দেবার বিরুদ্ধে। সরোজ দত্ত জিজ্ঞেস করেন যে তিনি এসব
লিখিত দিয়েছেন কি না। তিনি “হ্যাঁ” জানিয়ে বলেন --- “রাজধানী এক্সপ্রেসকে উল্টে দেওয়া ঠিক নয়, ট্রেনে
দরিদ্র মানুষও থাকে ; ভিয়েতনামেও কেউ এইভাবে ট্রেন উড়িয়ে দেয়নি। এসব বলাতে এরা আমাকে
থাকতে দিচ্ছে না। গদ্দার বলছে। আণ্ডারগ্রাউণ্ড প্রেসে যে সে চলে আসছে---গোপনীয়তা নষ্ট হচ্ছে, কেউ
কারো কথা শুনছে না। আমার মনে হচ্ছে সেন্ট্রালিজম থাকাটাই জরুরী”। সেই সময়ে পাশ থেকে একজন
বললেন --- গদ্দারকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ হল বিপ্লবের ক্ষতি। সরোজ দত্ত বললেন, আপনার কাছে চারু
মজুমদারের কথোপকথনের যে টেপ আছে, দিন। চারু মজুমদারের সাক্ষাত্কারের টেপটি অজিত দত্ত নিজেই
টেপ করেছিলেন। সেটি তিনি খুব বাজাতেন। নকশালবাড়ী মুভমেন্ট কি করে গড়লেন --- জেলে থাকতে
থাকতে প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিনয় চৌধুরী, সুবোধ চৌধুরী আলোচনা করেছেন, জেলে বাইরে
এসে কিভাবে আর্মড স্ট্রাগল করলেন --- এই সব ছিল সেখানে। এই সব কথাবার্তা নিয়ে চারুবাবুর সঙ্গে
অজিতবাবুর দীর্ঘ বাদানুবাদও ধরা ছিল টেপে। তা ছাড়া উত্পল দত্ত, তীর নাটক, মিনার্ভা থিয়েটার ইত্যাদি
অনেক প্রসঙ্গ ছিল। সরোজ দত্তকে টেপটি দিয়ে দেবার পরে তিনি বললেন --- “আপনাকে এক্সপেল করছি”।
এই বলে সরোজবাবু বেরিয়ে গেলেন। এটাই ছিল অজিত পাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ! তিনি তখন কোনো
রকমে পালিয়ে বাঁচেন। তিন চার দিন পরে ধরা পরেন। তাঁর সঙ্গের ছেলেটিকে মেরে ফেলা হয়।
কবি সরোজ দত্ত স্বভাবকবি ছিলেন | জীবনের নানা ঘটনায় তিনি কবিতা লিখেছেন | চোদ্দ-পনেরো বছর
বয়স থেকে বাড়ির হাতে-লেখা পত্রিকা "মঞ্জরী"তে কবিতা লেখা শুরু করেন। ওই পত্রিকার সম্পাদকও
ছিলেন তিনিই। ১৯৪০-এ তাঁর লেখা দুটি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়, যার গায়ক ছিলেন সুধীন
চট্টোপাধ্যায়। তিনি লিখে গেছেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের কাগজে, ছেঁড়াখোড়া খাতায়, শ্মশানের
দেওয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে!
তাঁর কবিতায় ছেয়ে আছে বামপন্থী মতাদর্শ | এমন কি মহাকাব্য থেকে নেওয়া বিষয়ের উপর লেখা
কবিতাও তিনি লিখেছেন বামপন্থার বিচার ধারায় যেমন “শকুন্তলা” | মৌলিক কবিতা পর তিনি শুরু করেন
কবিতা অনুবাদ করা। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যায়ে তিনি প্রায় চব্বিশটি কবিতা অনুবাদ করেন।
"দৈনিক স্বাধীনতা" পত্রিকাতেই মূলতঃ এইসব অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর অনুবাদ কবিতা সাবলীল
এবং সহজবোধ্য যা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সহজেই বুঝতে পারেন | তাঁর অনুদিত কবিতার মধ্যে
স্মরণীয় মায়াকভস্কির "Our March(1917)" কবিতাটি।
তাঁর মতবাদ যাই থেকে থাকুক, বাংলা কবিতা যে তার লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে একথা তাঁর চিরশত্রুরাও
মানতে বাধ্য হবেন | আমরা মিলনসাগরে তাঁর কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে এই
প্রচেষ্টার সার্থকতা।
উত্স : শহীদ সরোজ দত্ত স্মৃতিরক্ষা কমিটির প্রকাশিত “সরোজ দত্ত’র কবিতা সংগ্রহ”
. স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত অধুনা জলার্ক প্রকাশিত “সত্তরের শহীদ লেখ শিল্পী” গ্রন্থ, ১৯৯৮
. বাঙ্গালনামায় বাসু আচার্য-এর প্রবন্ধ
. http://imp-personalities.blogspot.com/2007/09/immortal-martyr-comrade-saroj-dutta.html
কবি সরোজ দত্তর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক্ করুন।
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ২০০৮
পরিচিতির পাতার পরিবর্ধিত সংস্করণ - ৬.১১.২০১৫
পরিচিতির পাতার পরিবর্ধিত সংস্করণ - ১৭.১২.২০১৫
...
...