কবি শাশ্বতী গাঙ্গুলীর কবিতা
*
পূজোর চিঠি
কবি শাশ্বতী গঙ্গোপাধ্যায়

সকালবেলার মেঘলা ভাঙা রোদটা হঠাৎ জানলা দিয়ে চুপি চুপি ঢুকে পড়লো এক্কেবারে আমার
ভেতরটাতে। সে কি কড়া নাড়ার শব্দ, দরজা খুলে দেখি চার দিকে শুধু আকাশ আর আকাশ।
নিঃশ্বাসে পেলাম পূজো পূজো গন্ধ, মনটা কেমন করে উঠল, ভাবলাম তোমাকে একটা চিঠি লিখি।
একটু দাঁড়াও কাগজ পেন নিয়ে আসি আগে, তারপর তো তোমার সঙ্গে গল্প জুড়বো।

কেমন আছো, আজ প্রায় দুই বছর চার মাস হয়ে গেল তুমি চলো গেছ। কেমন লাগছে ওখানে ?
অনেক কাজ তাইনা ? অনেক কাজ জানি, কিন্তু তবু যদি সময় পাও পূজোর আকাশটার দিকে
একবার তাকিয়ে দেখো, আমার কথা একটু নিশচয়ই মনে পড়বে। একবার তুমি পূজোয় কলকাতায়
এসেছিলে মনে আছে ? রাস্তার ধারে সরু ফুটপাথে অগুন্তি মানুষের নতুন জামার মিছিলের মধ্যে
আমরা দুজন, ভিড়ে হারাইনি, হারিয়ে গিয়েছিলাম নিজেদের মধ্যে। চলতে চলতে গন্তব্য একটাই,
দুজনের এক ঠিকানায় পৌঁছোনো। তুমি রাগ করতে, বলতে যখন তুমি আসবে, তখন সব ফেলে
তোমায সময় দিতে হবে, আর আমি, ঠাকুরের পূজোর কাজ ফেলে ঠাকুরের কাছে মনে মনে ক্ষমা
পেয়ে অনুমতি নিয়ে নিতাম তোমার কাছে যাবার জন্য। তারপরেই এক দৌড়ে পৌঁছে যেতাম
তোমার হৃদয়ের ঠিক মাঝখানটায়। যাই বলো কিন্তু, ওই জায়গাটাই আমার জন্য ভীষণ
নিশ্চিন্ত আর ভরসার ছিল। তোমার ঘামে ভেজা রুমালটা আর পুরনো একটা টি-শার্ট যাতে ডেনিম-
এর গন্ধের থেকে অনেক বেশী ছিল ‘তুমি তুমি’ গন্ধটা। হঠাৎ মনে পড়ল সমর সেনের কবিতার সেই
লাইনটা --- “ভুলে যাওয়া গন্ধর মতো তোমায় মনে পড়ে”।

জান এই তো দুদিন আগে একটানা বৃষ্টি, কি করছিলে তুমি বৃষ্টির মধ্যে ? শুধুই কাজ ? তোমাদের
শীততাপ নিয়ন্ত্রিত দফ্তরের জানলা দিয়ে প্রকৃতির অবস্থাই বোঝা যায় না, তাহলে আর মনের
অবস্থা কি করে বুঝবে ? এদিকে আমার তো আবার ক্লাসরুমের খোলা জানলা আর দরজার সামনে
সারাদিন অনন্ত আকাশ। কী অদ্ভূত দেখো, একই আকাশের নীচে দুজন অথচ মধ্যে অনন্ত ব্যবধান।
ভূগোলে নয় মনে। তুমি মন খারাপ করোনা, ওটা আমার জন্য রেখে দিও, তোমাকে মন খারাপ
করলে একটুও মানায় না। তুমি শরতের নীল আকাশে টুকরো টুকরো মেঘের মত অম্লান হাসি নিয়ে
ছুটোছুটি করো, আমি তোমার সব দুঃখকে আড়াল করে রাখবো, সব না পাওয়াটুকুকে নিজের করে
রাখবো। দেখেছো এমন বলছি, যেন এ জীবনে আর আমাদের দেখাই হবে না। দেখা তো হয়েই,
রোজ হয় শুধু কেউ কাইকে আর চিনতে পারি না। আমার মধ্যেকার খারাপটা আমার
ভালোগুলোকে এমনভাবে ঢেকে দিয়েছে যে তোমার আর মনেই পড়ে না। আমার মনে কিন্তু বৃষ্টি
ভেজা রাত, ভিজে লেবুপাতার গন্ধ আর আমার অসীম একাকীত্ব তোমার দিকে হাত
বাড়ানোর লোভ দেখায় আমায়, রোজ ইচ্ছে হয়, তোমাকে একটু ছুঁই, তোমার বুকে মুখ রেখে
আরেক বার শেষ বার বলি --- ‘ভালোবাসি’। অনাঘ্রাতা হাসনুহানার মত আমি শুকিয়ে গেলাম,
তোমার অবহেলায়, অনাদরে। তোমার আদরের, সোহাগের, ভালোলাগার দিনগুলো আমার দুঃখের
স্মৃতিতে মলিন করোনা। আমি আছি, ভীষণভাবে আমার মনের সঙ্গে শিয়ালদহের তিন নং
প্ল্যাটফর্মের লাল লেটার বক্সে, বালীঘাট স্টেশনে, হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে যাওয়া রাস্তার অন্ধকারে,
কফি হাউসের আবছায়ায়, প্যারামাইন্টের শর্বতে, আর তোমার অতীত কোন স্মৃতিচারণায় স্মৃতির
আবডালে। আড়াল পড়েছে তাতে কি হয়েছে, আমি আছি। তুমি চলে গেছ আর যত কিছু
আঁকাবাঁকা হিজিবিজি ব্লটিং-এর পরে।

.                                     ********************  


.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আমার এখন মন খারাপের সময় নেই
কবি শাশ্বতী গঙ্গোপাধ্যায়

আমার এখন সময় নেই মন খারাপের, মন উদাসের, মন কেমনের
ঠাণ্ডা হাওয়া মনে করায় যে দিনগুলো বড্ড বেশী সে দিনগুলো
আর এক জীবন ফেলে এসেছি। তারাও নেই, আমিও নেই
তুমিও নেই মন খারাপের। অনেক কাজে ক্লান্ত আমি, শ্রান্ত দেহ
গুছিয়ে নিয়ে পথ হাঁটতে রোজই চাই, হোঁচট খাই ফিরে তাকাই,
সময় কোথায় মন খারাপের ? টানটান দিন রোদে মাখা দাঁড়িয়ে আছে,
হঠাৎ কেন চোখের মাঝে মেঘের ছায়া ঝা
সা লাগে, আলগা
লাগে সকল বাঁধন, হাত বাড়ায়
ছেলে বেলা, স্বপ্ন ভরা দুটো চোখে
তাকিয়ে দেখি আত্মজদের। আমার এখন সময় কোথায় মন কেমন
আর মন খারাপের। বড্ড একা থেকে গেছে আমার আশা, অনুরাগের
রঙীন কাগজ ভালোবাসা। কেউ যেন নেই আজ সেখানে আঁচড় কাটার
ঝগড়া করার দায় নেই তার
, আমার রাগের, অভিমানের, মন খারাপের।
সকাল পরে দুপুর আসে, ঘুম আসা চোখ এড়িয়ে তাকাই বিকেলগুলোর
বুকের ওপর হাঁটতে থাকি, মাড়িয়ে চলি আবেগ আমার সন্ধ্যা নামে
নিঝুম রাতে তারার পানে তাকিয়ে দেখি কেউ যেন নেই মন খারাপের।
কারণ লাগে, কারণ ছিল, কারণগুলো গুছিয়ে নিয়ে, যুক্তি দিয়ে, তর্ক করে
প্রমাণ করা চাইনা তো আর, দুঃখ কিসের
? আমার এখন সময় তো
নেই মন খারাপের। বদলে গেছে ? বদলটা কার
, জানি না তা তোমার
আমার ভাবও নেই, আড়িও নেই, বাড়াবাড়ি সেটাও নেই, সব চুপচাপ
সবই এখন সময়ে গেছে, শৈত্য নাকি একেই বলে (বুঝতে নারি)
পাগলামিটার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকি পাগল আমি,বুঝতে নারি
বুঝবে না কেউ এত যে ঢেউ, ছোট বড় উপলরাশি, এবড়ো খেবড়ো
রাস্তা দিয়ে চলতে শেখা, বলতে শেখা ভালোবাসি, কি এসে যায়
যাক না চলে সব কিছু সেই, চাওয়াগুলো, দুঃখগুলো বড্ড কাছের
আমার এখন সময় তো নেই, মনটা বড় খারাপ লাগে যখন
ভাবি দরকারই নেই মন খারাপের। আমি নাকি এমন ছিলাম---
অবুঝ আমি ছোট্ট ছিলাম, বড় হলাম তোমার হলাম তোমায়
ছেড়ে একা হলাম, খুঁজলে না সেই অভিমানে চোখের জলও
শুকিয়ে গেল নির্বিবাদের
, সময় তো নেই মন খারাপের। আমার শরীর
ছুঁয়ে দেখো, মনের নাগাল নেই সেখানে পড়ে থাকে শরীর শুধু
অবসাদের। বিষন্নতার কান্না চাপি তোমার বুকে জায়গা তো নেই,
চাইনাও আর ফিরে যেতে, বাকিটুকু একাই আমি, নিজের মত, নিজেই
চলি, হঠাৎ করে কখনো বা চমকে উঠি কে যেন ফের ডাকছে
আমায়, কখ্খনো না ভুল হবে না বেলা শেষে সময় কোথায় মন খারাপের।

.                                     ********************  


.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর