কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর কবিতা
|
পাল্ কীর গান কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই গানটি সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সংগীত প্রেমী বাঙালীর বুকে অমর হয়ে বিরাজ করছে।
|
তামার টাটে !
তপ্ত তামা,--
যায় না থামা,--
উঠ্ ছে আলে
নাম্ ছে গাড়ায়,--
পাল্ কী দোলে
ঢেউয়ের নাড়ায় !
ঢেউয়ের দোলে
অঙ্গ দোলে !
মেঠো জাহাজ
সাম্ নে বাড়ে,--
ছয় বেহারার
চরণ-দাঁড়ে !
কাজ্ লা সবুজ
কাজল প'রে
পাটের জমি
ঝিমায় দূরে !
ধানের জমি
প্রায় সে নেড়া,
মাঠের বাটে
কাঁটার বেড়া |
'সামাল' হেঁকে
চল্ ল বেঁকে
ছয় বেহারা,--
মর্দ তারা !
জোর হাঁটুনি
খাট্ নি ভারি;
মাঠের শেষে
তালের সারি |
তাকাই দূরে,
শূন্যে ঘুরে
চিল্ ফুকারে
মাঠের পারে |
গরুর বাথান--
গোয়াল-থানা,--
ওই গো ! গাঁয়ের
ওই সীমানা !
বৈরাগী সে,--
কণ্ঠী বাঁধা,--
ঘরের কাঁথে
লেপছে কাদা;
মট্ কা থেকে
চাষার ছেলে
দেখ্ ছে,--ডাগর
চক্ষু মেলে !
দিচ্ছে চালে
পোয়াল গুছি;
বৈরাগীটির
মূর্তি শুচি |
পের্ জাপতি
হলুদ বরণ,--
শশার ফুলে
রাখছে চরণ !
কার বহুরি
বাসন মাজে ?
পুকুর ঘাটে
ব্যস্ত কাজে;--
এঁটো হাতেই
হাতের পোঁছায়
গায়ে মাথার
কাপড় গোছায় !
পাল্ কী দেখে
আস্ ছে ছুটে
ন্যাংটা খোকা,--
মাথায় পুঁটে !
পোড়োর আওয়াজ
যাচ্ছে শোনা,--
খোড়ো ঘরে
চাঁদের কোণা !
পাঠশালাটি
দোকান-ঘরে,
গুরু মশাই
দোকান করে !
পোড়ো ভিটের
পোতার 'পরে
শালিক নাচে,
ছগল চরে |
গ্রামের শেষে
অশথ-তলে
বুনোর ডেরায়
চুল্লী জ্বলে;
টাট্ কা কাঁচা
শাল-পাতাতে
উড়ছে ধোঁয়া
ফ্যান্ সা ভাতে |
গ্রামের সীমা
ছাড়িয়ে, ফিরে
পাল্ কী মাঠে
নাম্ ল ধীরে;
আবার মাঠে,--
তামার টাটে,--
কেউ ছোটে, কেউ
কষ্টে হাঁটে;
মাঠের মাটি
রৌদ্রে ফাটে,
পাল্ কী মাতে
আপন নাটে !
শঙ্খ-চিলের
সঙ্গে, যেচে--
পাল্লা দিয়ে
মেঘ চলেছে !
তাতারসির
তপ্ত রসে
বাতাস সাঁতার
দেয় হরষে !
গঙ্গা ফড়িং
লাফিয় চলে
বাঁধের দিকে
সূর্য ঢলে |
পাল্ কী চলে রে !
অঙ্গ ঢলে রে !
আর দেরী কত ?
আরো কত দূর ?
"আর দূর কি গো ?
বুড়ো-শিবপুর
ওই আমাদের;
ওই হাটতলা
ওরি পেছুখানে
ঘোষেদের গোলা |"
পাল্ কী চলে রে,
অঙ্গ টলে রে;
সূর্য ঢলে,
পাল্ কী চলে !
. **************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ধূলা-ভরা দ্যায় ধরা তোর লাগি ধর্ণা !
ঝর্ণা !
এস তৃষার দেশে এস কলহাস্যে--
গিরি-দরী-বিহীরিনী হরিনীর লাস্যে,
ধূসরের ঊষরের কর তুমি অন্ত,
শ্যামলিয়া ও পরশে কর গো শ্রীমন্ত;
ভরা ঘট এস নিয়ে ভরসায় ভর্ণা;
ঝর্ণা !
শৈলের পৈঠৈয় এস তনুগত্রী !
পাহাড়ে বুক-চেরা এস প্রেমদাত্রী !
পান্নার অঞ্জলি দিতে দিতে আয় গো,
হরিচরণ-চ্যুতা গঙ্গার প্রায় গো,
স্বর্গের সুধা আনো মর্ত্যে সুপর্ণা !
ঝর্ণা !
মঞ্জুল ও-হাসির বেলোয়ারি আওয়াজে
ওলো চঞ্চলা ! তোর পথ হল ছাওয়া যে !
মোতিয়া মোতির কুঁড়ি মূরছে ও-অলকে;
মেখলায়, মরি মরি, রামধনু ঝলকে
তুমি স্বপ্নের সখী বিদ্যুত্পর্ণা
ঝর্ণা !
. *************************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ছায়া-জোনাক আলিঙ্গিতে
জলে জোনাক দিশে হারায় |
দিশে হারায় যায় ভেসে যায়
স্রোতের টানে কোন্ দেশে রে ?
মরা গাঙ আর সুর-সরিত্
এক হয়ে যেথায় মেশে রে !
কোথায় তারা ফুরিয়েছে, আর
জোনাক কোথা হয় সুরু যে
নেই কিছুরই ঠিক ঠিকানা
চোখ যে আলা রতন উঁছে |
আলেয়াগুলো দপদপিয়ে
জ্বলছে নিবে, নিবছে জ্বলে',
উল্কোমুখী জিব মেলিয়ে
চাটছে বাতাশ আকাশ-কোলে !
আলেয়া-হেন ডাক-পেয়াদা
আলেয়া হতে ধায় জেয়াদা
একলা ছোটে বন বাদাড়ে
ল্যাম্পো-হাতে লক্ ড়ি ঘাড়ে;
সাপ মানে না, ভাঘ জানে না,
ভূতগুলো তার সবাই চেনা,
ছুটছে চিঠি পত্র নিয়ে
রণরণিয়ে হনহনিয়ে |
বাঁশের ঝোপে জাগছে সাড়া,
কোল্-কুঁজো বাঁশ হচ্ছে খাড়া,
জাগছে হাওয়া জলের ধারে,
চাঁদ ওঠেনি আজ আঁধারে !
শুকতারাটি আজ নিশীথে
দিচ্ছে আলো পিচকিরিতে,
রাস্তা এঁকে সেই আলোতে
ছিপ চলেছে নিঝুম স্রোতে |
ফিরছে হাওয়া গায় ফুঁ-দেওয়া,
মাল্লা মাঝি পড়ছে থকে;
রাঙা আলোর লোভ দেখিয়ে
ধরছে কারা মাছগুলোকে !
চলছে তরী চলছে তরী--
আর কত পথ ? আর ক'ঘড়ি ?
এই যে ভিড়াই, ওই যে বাড়ী,
ওই যে অন্ধকারের কাঁড়ি--
ওই বাঁধা-বট ওর পিছন্
দেখছ আলো ? ঐতো কুঠি
ঐখানেতে পৌঁছে দিলেই
রাতের মতন আজকে ছুটি |
ঝপ ঝপ তিনখান
দাঁড় জোর চলছে,
তিনজন মাল্লার
হাত সব জ্বলছে;
গুরগুর মেঘ সব
গায় মেঘ মল্লার,
দূর-পাল্লার শেষ
হাল্লাক্ মাল্লার !
. *************************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
যার পুষ্কর-মেঘ পুষ্কর্ণীর দশ ক্রোশ ঠিক বেড়।
ওই ফাল্গুন আর দক্ষিণ বায় --- সিংহল তার ঘর
হায় লুব্ধের প্রায় সিংহল ধায় বঙ্গের অন্তর ;
ছিল সিংহল এই বঙ্গের, হায়, পণ্যের বন্দর,
ওগো বঙ্গের বীর সিংহল-রাজ-কন্যার হয় বর।
ওই সিংহল দ্বীপ সুন্দর, শ্যাম, --- নির্ম্মল তার রূপ,
তার কণ্ঠের হার ল’ঙ্গর ফুল, কর্পূর কেশ-ধূপ ;
আর কাঞ্চন তার গৌরব আর মৌক্তিক তার প্রাণ,
আর সম্বল তার বুদ্ধের নাম সম্পদ নির্ব্বাণ।
. *************************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
‘তুমি কেন বাবা ছেড়ে দিলে তারে ?
. তোমার কি নেই দাঁত!’
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল
. ‘তুই রে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়
. দংশি কেমন করে ?
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে
. কামড় দিয়েছে পায়,
তা ব’লে কুকুরে কামড়ানো কী রে
. মানুষের শোভা পায়।’
. *************************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
এইদেশে সৃষ্টি,
ধুপছায়া যার শাড়ী
তার হাসি মিষ্টি |
মুখখানি মিষ্টিরে
চোখদুটি ভোমরা
ভাব-কদমের--ভরা
রূপ দেখ তোমরা !
ময়নামতীর জুটি
ওর নামই টগরী,
ওর পায়ে ঢেউ ভেঙে
জল হোলো গোখরী !
ডাক পাখী ওর লাগি'
ডাক ডেকে হদ্দ,
ওর তরে সোঁত-জলে
ফুল ফোটে পদ্ম |
ওর তরে মন্থরে
নদ হেথা চলছে,
জলপিপি ওর মৃদু
বোল বুঝি বোলছে |
দুইতীরে গ্রামগুলি
ওর জয়ই গাইছে,
গঞ্জে যে নৌকা সে
ওর মুখই চাইছে |
আটকেছে যেই ডিঙা
চাইছে সে পর্শ,
সঙ্কটে শক্তি ও
সংসারে হর্ষ |
পান বিনে ঠোঁট রাঙা
চোখ কালো ভোমরা,
রূপশালী-ধান-ভানা
রূপ দেখ তোমরা
পান সুপারি ! পান সুপারি !
এইখানেতে শঙ্কা ভারি,
পাঁচ পীরেরই শীর্ণি মেনে
চলরে টেনে বৈঠা হেনে ;
বাঁক সমুখে, সামনে ঝুঁকে
বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে
বুক দে টানো, বইটা হানো--
সাত সতেরো কোপ কোপানো |
হাড়-বেরুনো খেজুরগুলো
ডাইনী যেন ঝামর-চুলো
নাচতে ছিল সন্ধ্যাগমে
লোক দেখে কি থম্ কে গেল |
জমজমাটে জাঁকিয়ে ক্রমে
রাত্রি এল রাত্রি এল |
ঝাপসা আলোয় চরের ভিতে
ফিরছে কারা মাছের পাছে,
পীর বদরের কুদরতিতে
নৌকা বাঁধা হিজল-গাছে |
আর জোর দেড় ক্রোশ--
জোর দের ঘন্টা,
টান ভাই টান সব--
নেই উত্কণ্ঠা |
চাপ চাপ শ্যাওলার
দ্বীপ সব সার সার,
বৈঠৈর ঘায়ে সেই
দ্বীপ সব নড়ছে,
ভিল্ ভিলে হাঁস তায়
জল-গায় চড়্ ছে |
ওই মেঘ জমছে,
চল্ ভাই সমঝে,
গান গাও দাও শিশ,
বকশিশ ! বকশিশ !
খুব জোর ডুব-জল
বয় স্রোত ঝিরঝির,
নেই ঢেউ কল্লোল,
নয় দুর নয় তীর |
নেই নেই শঙ্কা,
চল্ সব ফুর্তি,
বকশিশ টঙ্কা,
বকশিশ ফুর্তি |
ঘোর-ঘোর সন্ধ্যায়,
ঝাউ-গাছ দুলছে,
ঢোল-কলমীর ফুল
তন্দ্রায় ঢুলছে |
লকলক শর-বন
বক তায় মগ্ন,
চুপচাপ চারদিক--
সন্ধ্যার লগ্ন |
চারদিক নিঃসাড়,
ঘোর-ঘোর রাত্রি,
ছিপ-খান তিন-দাঁড়,
চারজন যাত্রি |
জড়ায় ঝাঁঝি দাঁড়ের মুখে
ঝউয়ের বীথি হাওয়ায় ঝুঁকে
ঝিমায় বুঝি ঝিঁঝিঁর গানে--
স্বপন পানে পরাণ টানে|
তারায় ভরা আকাশ ওকি
ভুলোয় পেয়ে ধূলোর পরে
লুটিয়ে পল আচম্বিতে
কুহক-মোহ-মন্ত্র-ভরে !
কেবল তারা ! কেবল তারা !
শেষের শিরে মানিক পারা,
হিসাব নাহি সংখ্যা নাহি
কেবল তারা যেথায় চাহি |