কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব

ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভাল
এত কালো মেখেছি দু হাতে
এত কাল ধরে।
কখনো তোমার করে, তোমাকে ভাবিনি।

এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ্ ডাকে আয়, আয়, আয়।
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতা কাঠ ডাকে আয়, আয়, আয়।

যেতে পারি,
যেকোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?

সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো
যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো
একাকী যাবো না অসময়ে।

.           *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
অবনী বাড়ি আছো

অবনী বাড়ি আছো
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
'অবনী বাড়ি আছো?'

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে--
'অবনী বাড়ি আছো?'

আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
'অবনী বাড়ি আছো?'

.       *****************             

.                                                                                       
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
দিন যায়

সুখের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শীতের বারান্দা জুড়ে রোদ পড়ে আছে
অর্ধেক কপাল জুড়ে রোদ পড়ে আছে
শুধু ঝড় থমকে আছে গাছের মাথায়
আকাশমনির |

ঝড় মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদ্ লা  হাওয়া নয়
ক্রন্দনরঙের মত নয় ফুলগুলি
চন্দ্রমল্লিকার |

জয়দেবের মেলা থেকে গান ভেসে আসে
সঙ্গে ওড়ে ধুলোবালি, পায়ের নূপুর
সুখের চট্ কা  ভাঙে গৈরিক আবাসে
দিন যায় রে বিষাদে, মিছে দিন যায় ...

.           *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
আতাচোরা

আতাচোরা পাখিরে
কোন তুলিতে আঁকি রে
---হলুদ ?
বাঁশ বাগানে যইনে
ফুল তুলিতে পাইনে
   কলুদ
হলুদ বনের কলুদ ফুল
বটের শিরা জবার মূল
   পাইতে
দুধের পাহাড় কুলের বন
পেরিয়ে গিরি গোবর্ধন
   নাইতে
ঝুমরি তিলাইয়ার কাছে
যে নদিটি থমকে আছে
  তাইতে
আতাচোরা পাখিরে
কোন তুলিতে আঁকি রে
---হলুদ ?

.     *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
পাবো প্রেম কান পেতে রেখে

বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে ব'সে আছো, দেবতা আমার |
শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
সম্ভ্রমের মূল কোথা এ-মাটির নিথর বিস্তারে ;
সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনে পড়ে ?

যেখানে শুইয়ে গেলে ধিরে-ধিরে কত দূরে আজ !
স্মারক বাগানখনি গাছ হ'য়ে আমার ভিতরে
শুধু স্বপ্ন দীর্ঘকায়, তার ফুল-পাতা-ফল-শাখা
তোমাদের খোঁডা-বাসা শূন্য ক'রে পলাতক হলো |

আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার
পুরানো স্পর্শের মগ্ন কোথা আছো ? বুঝি ভুলে গেলে |
নীলিমা ঔদাস্তে মনে পড়ে নাকো গোষ্ঠের সংকেত ;
দেবতা সুদূর বৃক্ষে, পাবো প্রেম কান পেতে রেখে |

.                   *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
এক অসুখে দুজন অন্ধ

আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ
দীর্ঘ দাঁতের করাত ও ঢেউ নীল দিগন্ত সমান করে
বালিতে আধ-কোমর বন্ধ
                এই আনন্দময় কবরে
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ |

হাত দুখানি জড়ায় গলা, সাঁড়াশি সেই সোনার অধিক
উজ্জ্বলতায় প্রখর কিন্তু উষ্ণ এবং রোমাঞ্চকর
আলিঙ্গনের মধেযে আমার হৃদয় কি পায় পুচ্ছে শিকড়
আঁকড়ে ধরে মাটির মতন চিবুক থেকে নখ অবধি ?

সঙ্গে আছেই
রুপোর গুঁড়ো, উড়ন্ত নুন, হল্লা হাওয়ার মধ্যে, কাছে
সঙ্গে আছে
 হয়নি পাগল
এই বাতাসে পাল্লা আগল
                 বন্ধ ক'রে
                            সঙ্গে আছে ...
এক অসুখে দুজন অন্ধ !
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ |

.                   *****************             

.                                                                                        
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
একবার তুমি

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা কর --
দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভাল বাসতে চেষ্টা কর |

বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল - ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার, যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সলমা-চুমকি-জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটেনক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি |

বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল
চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই - পাথরের ফাঁক-ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল -
অনেক সময় তো ঘর গড়তেও মন চায় |

মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার | আমরা ঘরবাড়ি গড়বো - সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো |

রূপোলি মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভালবাসতে চেষ্টা করো |

.           *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
সীমান্ত প্রস্তাব ১ - মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি নিবেদন     
হাংরি জেনারেশন (১৯৬১ ~ ১৯৬৫) এর বুলেটিনে প্রকাশিত এই কবিতাটি কবি মলয় রায়চৌধুরী-র সৌজন্যে পাওয়া |


একটি ভিখারি ছেলে ভালোবেসে দেখেছিল ভাত
আর পরখ করেছিল
জ্যোত্স্নায় ছড়ানো ধানগাছগুলি, ধানের গোড়ায়
শুদ্ধ জলভরা মাখনের মতো
মাটির সাবলিলতার চিকণ-ফাঁপানো ধান,
ধানগুলি ভাত হতে পারে ?
নির্বাক দেবতা কথা বলতে পারে
লোহা গলতে পারে
কাঠের ভূভাগ পারে চিৎ হতে নারীদের মতো ?
তবু সে ভিখারি ছেলে ভালোবেসে দেখেছিল ভাত |
ভালোবেসে দেখেছিল বহুতর দর্শন জীবনে
জীবন ছেড়েও কতো গাঁজায় আক্রান্ত হয়ে কতো
জীবনেও ধান ছাড়া, নারী ছাড়া, জ্যোত্স্নাটুকু ছাড়া
ওপরে কি যেন আছে |
সবারই ওপরে আছেন ভগবান পান্থ-নির্যাতনে
সবারই ওপরে আছেন ভগবান পরিব্রজাতার
সবারই ওপরে আছেন ভগবান মানুষের হয়ে
ভিখারি ছেলেটিকে দুটি ভাত দেবার ব্যস্ততায়
বাসের মতো সমসাময়িক, বাসের চেয়েও মত্ত
পৌঁছে দিতে সৎ |

ভিখারির ভালো ছেলে ছাড়া ছিল বহু মন্দ ছেলে
তারা ভালোবাসা নিয়ে মাখামাখি করেনি কখনো
তারাও তো বেঁচে আছে তারাও তো আছে অনাবিল
আমলকির মতো কত ভলো ধরণের ফলই
পৃথিবীতে আছে
ভিখারির ভালো ছেলে মন্দ ছেলে ঝরে গেছে

.               *********************   


.                                                          
হাংরি জেনারেশনের কবিতার পাতায়    
.                                                              
কবির পরিচিতির পাতায় যেতে....    
.                                                                                        
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর