চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
১৭ সকল কবিতা ছোটে তোমা প্রতি | তোমার বিনাশ খুব দূরে নয়—কাছে, বরং বিনষ্ট হয়ে গেলে ইতিমধ্যে, হে করুণা, আমার নির্ভুল শরক্ষেপ কবিতার | কোথা যাবে ? কোথায় আশ্রয় পাবে খুঁজে ? রন্ধ্রহীন বন্ধ, শুধু কৃত্রিম উপায়ে অনচল কোথায় আশ্রয় পাবে, না ফুলে না গন্ধে, কোনোদিন ! কেননা, সকল প্রাণ, সব মৃত্যু আমাকে তাদের বুকের ভিতরে রেখে বাড়ায়েছে | আমি কি বিমান নভোস্থলে পাখিদের, ময়ূরের দৌত্যে নিমজ্জিত— মেঘে ও বাদলে ? আমি মৃত্যুর আপন বক্ষতল তোমারে জীবিত-মৃত সর্বক্ষণ, বক্ষে ধরে রাখি | কোথা যাবে ? ঝরে ফুল মৃত্তিকায় আসিতে হবে না ? কোথা যাবে ? ঝরে ফল মৃত্তিকায় আসিতে হবে না ? সুগন্ধির পার আছে ? সে-ও মম বক্ষে ঝরে পড়ে |
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
২৫ চামেলির দুইখানি বাড়ি ছিলো – এখন আঁধারে ও দুটি ব্যাপকভাবে হয়ে যায় অরণ্য বাড়ির | হৃদয়ের দুই অর্ধ চামেলির অনেক হৃদয় হয়ে যায় অতর্কিত, স্বতন্ত্র, শস্যের সমাহারে | আমি চামেলির কোন বাড়িতে ছিলাম মনে নাই— সেখানে চামেলি ছিলো ? চামেলি কি এমনই তত্পর সরে গেছে আঁধারের অসম্বব মশারি সাঁতারি – কিংবা সমুখেই আছে, দেখি নাই হিন্দুর ঈশ্বর চামেলির মতো আমি মানসিক বাস্তু-বিভাজন মানুষে তাবত্কাল দেখিয়াছি—জন্তুতে ক্কচিৎ ওরা স্পষ্টতার মানে বোঝে প্রাণ, কোনো আলোড়ন চিন্তায় ও সত্যে নাই | ওদের দুয়ারে যতক্ষণ থাকি, মনে হয় আছি প্রাসাদের পালঙ্ক শয়ান— হে প্রাণ, হে ধিক প্রাণ—বিফলতা, চামেলির প্রতি !
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
২৬ সারারাত আমাদের পিছু পিছু ছুটছে পুলিশ কেননা, বিকেলে মজা গঙ্গাতীরে সূর্যের হত্যার একমাত্র সাক্ষী এই আমরা তিন উল্বুক কাঁহাকা কলকাতার প্রকৃতির অশ্লীল তদন্তে চমত্কার পোদের জ্বালায় হু-হু করতে-করতে দিক্ বিদিকহারা --তব নাকি কলকাতায় নিরঙ্কুশ প্রাণিহত্যা হবে ? শিল্প হবে ? তেজারতি কারবার খাওয়াবে ভিখিরিরে ? মাঙ্গল্য বিদেশ থেকে আনা হবে, হে শিক্ষানবিশ ন্যূনতম টেলিফোন পোঁতা হবে পাহাড়ের শিরে— পাহাড়বিজয় হবে, যদিবা অজেয় থাকে কেউ ! মানুষ, মানুষ করে একদল কবি তোলে ঢেউ পুকুরেই --- আহাম্মক, চোর, বদমাস লক্ষ্মীছাড়া সম্ভ্রম জানলি না, শুধু লিখে গেসি পদ্য পাতপাত ! আমরা তিনজন কবি কারে লক্ষ্য করেছি দৈবাৎ ?
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৩১ অনেক শেফালি আমি দেখিয়াছি, এ-জীবনে আর দেখিতে চাহি না কোনো শেফালিরে, শেফালি দেখুক ঝরিতে-ঝরিতে পারে দেখে নিক্ অপাঙ্গে আমার আমি কোনোদিন কিছু দেখিব না, ডুবিয়া মরিব | অনেক জেব্রার খেলা দেখিয়াছি – ম্যুজিয়ম-লুন্ঠিত জেব্রার খেলা দেখি নাই, তার অলৌকিক গায়ের বুরুশ ঝরে গিয়েছলো জানি ; মৃত্যু ও স্মৃতির অবধেয় রূপ ও মুখশ্রী নাই, জীবিতেরই কায়ক্লেশ আছে | তাই আমি শেফালির, কিছুতেই বকুলের নয় ; শেফালির ঘড়িতে ঝরে গত মুহূর্তের স্তব্ধ কাঁটা হলুদ বোঁটার জোরে করে দেয় চলচ্ছক্তিময় তাই আমি শেফালির, সৌজন্যের, অতিরিক্ততার— তাই আমি শেফালির, আপাদমস্তক শেফালিরই চাহি কোনোদিকে কিছু দেখিব না, ডুবিয়া মরিব |
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৩৭ মহীনের ঘোড়াগুলি মহীনের ঘরে ফেরে নাই উহারা জেব্রার পার্শ্বে চরিতেছে | বাইশ জেব্রায়, ঘোড়াগুলি অন্ধকার উতরোল সমুদ্রে দুলিছে কালের কাঁটার মতো, ওই ঘোড়াগুলি জেব্রাগুলি অনন্ত জ্যোত্স্নার মাঝে বশবর্তী ভূতের মতন চড়িয়া বেড়ায় ওরা – কথা কয়—কী কথা কে জানে ? মানুষের কাছে আর ফিরিবে না এ তো মনে হয় আরো বহু কথা মনে হয়, শুধু বলিতে পারি না | বাইশটি জেব্রা কি তবে জেব্রা নয় ? ময়ূরপঙ্খীও হতে পারে এই ভৌত সামুদ্রিক জ্যোত্স্নার ভিতরে ? বামনের বিষণ্ণতা বহে নেয় ও কি নারিকেল ও কি চলচ্ছবিগুলি লাফায়ে-লাফায়ে যাবে চলে ? ও কি মহীনের ঘোড়া ? ও কি জেব্রা নয় আমাদের ? অলৌকিকতার কাছে সবার আকৃতি ঝরে যায় |
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৪০ যেবার ওদের সঙ্গে যেতে হলো বেড়াতে পশ্চিমে--- মানুষ বেড়ায় ! তাই বহুদিন সাহাবাবুদের কালো ছেলেটির কাছে ছিলে তুমি, মোটে ফর্সা নয় আমার মতন, আহা প্লাতেরো, তোমরাই কষ্ট হলো ! পশ্চিমের থেকে কিছু ঘাস আমি তোমাকে পাঠাই খামের ভিতর, তুমি পোস্টাপিস থেকে চেয়ে নিও খামটা খেয়ো না, ওতে আঠা আছে, কালিতেও বিষ--- পেটের অসুখ হলে কে তোমারে দেখবে প্লাতেরো ? মনে আছে, কিছুদিন আমাদের বাড়ির উঠানে তোমার চারিটি পায়ে জুতোমোজা পরিয়ে বলতাম : প্লাতেরো, অঙ্কের ক্লাশে এইভাবে ফাঁকি দিতে হবে--- এইভাবে খেতে হবে কড়াইশুঁটির প্রস্রবণ | মনে আছে, মনে আছে, মনে আছে প্লাতেরো আমাকে ? --সাহাবাবুদের কালো ছেলেটি আমার চেয়ে কালো !
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৪১ প্লাতেরো আমারে ভালোবাসিয়াছে, আমি বাসিয়াছি আমাদের দিনগুলি রাত্রি নয়, রাত্রি নয় দিন যথাযথভাবে সূর্য পূর্ব হতে পশ্চিমে গড়ান তাঁর লাল বল হতে আল্ তা ও পায়ের মতো ঝরে আমাদের – প্লাতেরোর, আমার, নিঃশব্দ ভালোবাসা প্লাতেরো তুমিও চলো সঙ্গে, আমি একাকী প্রস্রাব ফিরিতে পারি না, কারা ভয় দেখায়, রহস্যও করে ! ছেলেবেলা থেকে কিছু ভীরু হতে পারা বেশ ভালো |
আমায় অনেক ভালোবেসেছিলো –ফুল দিয়েছিলো টুপি কিনে দিয়েছিলো, পুরী থেকে মুরলি মাছের লেজের শাসন এনে দিয়েছিলো—কতো উপহার ! আমি ছেলেমানুষের মতন ওদেরও ভুলিনি তো ? প্লাতেরো আমার আর আমিও প্লাতেরো ছাড়া নই --- আমাদের দেবতা কি পা ঝুলিয়ে বসেন পশ্চিমে ?
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৪৩ দুর্বলতা ছাড়া কোনো দোষ নাই | যখন ডালিম সবুজ পাতার চাপে ফুলে ওঠে, লাল হয়—জলে তখন আক্রোশভরে চাদর টানিয়া দিই খুব মাথার ওপরে, তুমি ডেস্কভরা চিঠি লেখো যতো | অরফ্যান্ ছেলের দল এবারেও ক্যাম্প পেতেছিলো জানুয়ারী মাসে তারা রেখে গেল শক্তিশালী ঘড়ি অথচ উত্পল একা পুরীর মন্দির সারাবার হাতচিঠি পেয়েছিলো – তবু হাত হতাশ হয়েছে ! তোমার পাগল তুমি বেঁধে রাখো, একদল যাবে নারীদের সাথে করে আগোছালো গোধূলিবেলায় ক্যারম খেলার ছলে মারাত্মক দুঃখ বিনিময় ঘটে গেলো—চিরদিন কে আর ক্যারম খেলে বলো ? অথচ অভ্যাস নয়, দুর্বলতা ছাড়া বোঝাবার হয়তো মাধ্যম আছে—তুমি জানো, ডালিমেও জানে |