চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৪৯ এখনো যায়নি বেলা হাওয়া দেয় পশ্চিমা-তুফানী এ-বন্দর ছেড়ে গেলে বন্দর পাবে না বহুদিন গেলে কি জাহাজ ? ঘাট ছেড়ে গেলে এখনো তো জানি আমারে জানাবে, যাই | বেলা হলো চপলতাহীন | কোনোখানে বেলা যায়, কোনোখানে বেলা ফিরে আসে ছায়ায় কপোলতলে ভাগ্য খেলা করে মুহুর্মুহু কোমল বলের মতো শৈশব জড়িয়ে থাকে ঘাসে বন্দরে, জাহাজঘাটে মানবিক বিদায় মিহিন ! বন্দরের মাঝখানে ঘনবদ্ধ কাঠামো-বেষ্টিত দুর্দান্ত জাহাজ আছে কোনো এক—তোমার চেহারা এই জাহাজের মতো হয়ে গেছে | বহুদিন পরে আ-পরিপ্রেক্ষিত প্রেম কেঁপে ওঠো, হও রোমাঞ্চিত | বহুদিন পরে ব’লে মনে হয় তুমিই জাহাজ বন্দরে, জাহাজঘাটে প্রেত হয়ে বিচরণ করো !
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৬১ কখনো জাগিনি আগে ভোরবেলা ঘাসের মতন শিশিরে, চপেটাঘাতে, কিংবা ঝাউবন চূর্ণকরা হাওয়ায় জাগিনি আগে ভোরবেলা, কখনো এমন জাগিনি আমার চিত্ত চিরকাল ছিলো জয়করা বিকালবেলার | আমি মাঝরাতে ঘুরেছি বাগানে | এ কি স্বাভাবিকভাবে আজ তুমি জাগালে আমায়— জন্ম কি এমনই ভালো ? সন্ধ্যা হতে দেয় না সেখানে অহংকার আলো করে রেখে দেয় মলিন জামায় |
কখনো জাগিনি আগে ভোরবেলা, না জাগিলে আর কেমনে পেতাম ঘাসে শিশিরের নৈঃশব্দ্যে করুণা অবিরাম বুকে হেঁটে পার হওয়া – জীবনে পাহাড় বাঘেরও অসাধ্য, আমি বাঘ হতে বড়ো জন্তু কিনা ! এ কি স্বাভাবিকভাবে আজ তুমি জাগালে আমায় এ কি এ একাকী জন্ম ভোরবেলা উজ্জ্বল জামায় |
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৬২ আমার বেদনায় বাংলা ভাষা যদি বিদ্ধ করে নির্মলতা-হারা প্রাণ, তবে পূর্বে প্রণতি-স্বীকার | ভালো নির্মলতা, ভালো শান্তি – জানি সুখের কদরে আয়ু দীর্ঘতর হতো, হতো স্নিগ্ধ বারি দীর্ঘিকার | আমার বেদনাময় বাংলাভাষা যদি বিদ্ধ করে অজেয় অমর শ্বেতপাতার প্রচ্ছন্ন জাগরণ তা কি নয় স্বর্গচ্যূত মন্দার সহসা বুকে ধ’রে স্পর্শে প্রতারিত হওয়া ? তা কি নয় নিশ্চিন্তে মরণ ?
তবুও স্বর্গের মতো কিছু নেই, যা থেকে পতন হবে অধোভূমে, কিংবা পাতালের প্রচণ্ড গহ্বরে মর্ত্যের দণ্ডিত মর্ত্যে পড়ে থাকে অভ্যর্থনাহীন ; আমার বেদনাময় বাংলাভাষা তাকে বিদ্ধ করে | তোমাদের দরজা-জানালা ফুটোফাটা বন্ধ করে দাও ফুলের বাগানে ভূত মারাত্মক প্রস্রাব ছিটোয় |
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৬৩ ভালোবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো যেদিকে দুচোখ যায় – যেতে তার খুশি লাগে খুব | ভালোবাসা পেলে আমি কেন আর পায়সান্ন খাবো যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে | ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী আবরণ খুলে ফেলে দৌড়-ঝাঁপ করবো কড়া রোদে ‘উল্লুক’ আমায় বলবে – প্রসন্নতাপিয়াসী ভিখারী— চোয়ালে থাপ্পর যদি কম হয়, লাথি মারবো পোঁদে |
ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে | না পেলে তোমায় আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো ? চিত্কার করবো না, হৈ হৈ করবো না, শুধু বসে থাকবো, জব্দ অভিমানে ? ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার, বিমনা— আমি কি ভীষণভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে |
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৬৫ এমন দিনেই শুধু বলা যায় তোমাকে আমার বড়ো প্রয়োজন ছিলো | এমন দিনেই শুধু তুমি প্রতিজ্ঞার চেয়ে বড়ো করাহত কপালেরে চুমি আমারই নিমিত্ত ! যেন এতদিনে গভীরে নামায় পথ বলে দিলে, আমি নেমে গেলাম সংশয় না রেখে | এমন দিনেই শুধু বলা যায় তোমাকে আমার বড়ো প্রয়োজন ছিলো | মুখ ঢেকে আস্তিনে জামার চলছিলাম সমস্তক্ষণ, বিষণ্ণতা মানে না চিবুকে— স্বাভাবিকতাই ভালো | মূর্তি মম সর্বস্ব আঁধারে খেতে চায় এ-সামান্য ছায়ার সরিয়ে সুজ্ নিখানি স্থির রসাতলে, যেথা সাংঘাতিক শৈত্যে-হাহাকারে সব অন্ধকার, বন্ধ, রন্ধ্রে লোল পাপাত্মা সাবধানি | এমন দিনেই শুধু বলা যায় তোমাকে আমার বড়ো প্রয়োজন ছিলো- প্রয়োজন গভীরে নামার |
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৬৮ এ কি আলিঙ্গন ? এ যে ওতোপ্রোত গ্রাসের গঠন পদতল-মধ্যে-মাথা তাল করে ওষ্ঠ পেতে দেওয়া খেতে ও খাওয়াতে | এ কি তামসিক কলঙ্কমোক্ষণ নিষ্প্রভ প্রাণের, এ কি বদ্ধমূল স্ববিরোধী খেয়া ? এবার চুরমার করে দেবে দাও কান্তি-সভ্যতার প্রয়োগনৈপুণ্য, ধর্ম ; ধর্ম অনুসারে শিল্পরীতি বাক্ ও মুমুক্ষা – পরিপুষ্ট কোষে মূর্খ জ্ঞানভার সমস্ত চুরমার ক’রে দিতে বক্ষে খাক করো প্রীতি |
এ কি আলিঙ্গন ! এ কি সভ্যতার জড়ানো চণ্ডালে আশিরগোড়ালিখন ! এ কি আলিঙ্গন মানুষের ঘোরতর, ব্যবধান গ্রাসচ্ছলনার অন্তরালে অনৈসর্গিক কাম, এ কি জীবনের চেয়ে ঢের কাঙ্ক্ষিত শিল্পের কাছে ?শিল্প কি বিমূঢ় অনাসৃষ্টি আলিঙ্গন, সাংঘাতিক পুরুষে-পুরুষে ?
চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "চতুর্দশপদী কবিতাবলী” (১৯৭০) গ্রন্থের কবিতা।
৭৪ হাতে ধ’রে শিখায়েছো বালুকায় হাঁটিব কেমনে দয়াময় ! শেফালির ফুলে ও পাতায় ভ’রে আছো— কোমলতা দেখে দেখে চোখগুলি কঠোর হয়েছে যা ধরা দেবে না তারে ধরিব না, দেখিতে-থাকিব ফলের স্বকীয় রসে কেমন শৌখিন হয় বেলা নগ্ন নারী-পুরুষের মতো হয়ে যায় অকাতর দিতে কোনো শ্রদ্ধা নেই, নেবারও দীনতা যথাযথ— হাতে ধ’রে শিখায়েছো বালুকায় হাঁটিব কেমনে ?
হাঁটিতে শিখেছি সেই কবে থেকে, এখনো তোমার হাতখানি ধরা চাই, বুঝে নেওয়া চাই—বুঝিব না কিছুই ব্যতীত তুমি, এ কি অবলম্বনের ঘোর এ কি পিতৃপরিচয় ? ছিলো মোর নিযুক্ত বাসনা— একাকী বাসিব ভালো, একাকী মরিব, সে-ও ভালো তুমি আসি বামনেরে উপযুক্ততা তুলে ধরো |