তোমার মুখ দেখলে মনে হয় কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে কপালে সন্ন্যাসের নীচে কেমন দীঘির মত চোখ ছিল তোমার দীঘির পাড়ে তালপাতার বাড়িটি বড় খেটেখুটে তৈরি করা অদূর্ বিলাসী অথচ সুকুমার তালধ্বজ এই ঠুনকো জীবনচারিতায় কোন যোগ ছিল না তোমার
তুমি বজ্রকণ্ঠে ঘুরে দাঁড়াতে মেঘের দিকে : আমাদের খরায় তোমার নিমন্ত্রাণ নিতেই হবে! জীবনকে ভারি ভালোবেসে সাপটে ধরেছিলে তুমি ভালোবাসার বেদনায় চিড় ধরেছিলো কোনো কোনো পাথরে, কঠিন তর্জনি তুলে শাসিয়ে বলেছিলে : হ্যাঁ এই ফাটা পাঠরেও চাষ হবে ভালোবাসার ফুল ফুটবে থোকা থোকা, পাতাও আমার চাই গভীর বিহ্বল সবুজ পাতার পাহাড় থাকবে বাগান ভর্তি তুমি বলেছিলে।
তোমাকে দেখা আমরা একটা অন্য ধরনের ভালোবাসা বাসতে শিখেছিলুম দুই বাহু আলিঙ্গনে দামাল ঝড়কে বেঁধে ফেলতে তোমাকেই দেখেছি কেবল আমরা ভয় পেতুম, তুমি সহজেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতে।
আজ চোখ বুজলেই দেখতে পাই, ঐ শয্যায় তোমায় আঁটে না গভীর তাত্পর্যময় হাসি হেসে তুমি জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর গাঁটছড়া বেঁধে দিলে কেমন অনায়াসে প্রয়োজন ছিল ? এ অনুষ্ঠানের কোনো দরকার ছিল কি ? প্রয়োজন ছিল এ শান্ত নাটকীয়তার আমাদের কাছ থেকে একটা ধুমকেতুর প্রখর বিস্ময় এইভাবে সরে গেলে অকস্মাৎ তুমি রাতের গাঢ়তায় দিনের মতন স্বচ্ছ সুন্দর ছিলে তোমার সুখে থাকার গল্প আমার কোনোদিনই ভালো লাগেনি অনিবার্যবাবেই তুমি কাঁটাতার লাফিয়ে গেছো, একজীবন যুদ্ধ করেছ জয় ক্ষতবিক্ষত হয়েও তুমি সিংহের মতো পরিহাস করতে ধিক সেই প্রাণবান বাতাসকে, যা তোমার দেহ ফাঁকা করে বেরিয়ে এসেছে আজ।
কুয়াশায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় দেশ পত্রিকার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত কবিতা সংকলন থেকে নেওয়া
ছিল টিলা, হয়ে ওঠে মেঘ | যদি নামি, যদি আমি ভূপৃষ্ঠে দাঁড়াই তার মানে টিলা থেকে নীচে আছে আকড়া খোয়াই— মাঠ, আলপথ, জল, আলপথ, জল মাঝেমধ্যে গম-নাড়া, মাঝেমধ্যে ওঁড়াও বসতি, তার মধ্যে দিয়ে শুধু যেতে হবে কুয়াশা তাড়িয়ে কুয়াশার মধ্যে আছে সাদা ছুঁচ, পিতলের মতো কখন সে পূর্বদিকে উঠে এসে দাঁড়াবে উঠোন |
সে-কথা এখন নয়, এখন শীতের বুড়ো মুখ দেখে-দেখে ক্লান্ত হয়ে, ক্লান্ত হয়ে মাঠের ভিতরে দরজার সামনে এসে দাঁড়ানো.. কখন রক্ত পড়ে ! ভিতরে সবুজ কন্ঠ বলে যায় অন্য ইতিহাস কন্ঠের ভিতরে আজ বলে যায় অন্য ইতিহাস ভিতরে কে কড়া নাড়ে, দরজার ওপাশে --- ‘কেন আসো, এত ভোরবেলা ?’ ‘নিশ্চিত জানি না কেন, চলে আসি, অতি গূঢ় মাঠ পার হয়ে, টিলা থেকে সমতলে, যখন-যেভাবে আসতে ইচ্ছে হয়, আসি | উত্তর দেবার সময় নয়তো এই ভোরবেলা, তুমি কাজ করো তোমার কী যেন কাজ ছিল সন্ধে-রাতে তোমার কী কাজ ছিল বিখ্যাত প্রভাতে তুমি কাজ করো পাথরে ছিল না জল, আমি এসে গেছি পাথর মাড়িয়ে, জল ছিল না পাথরে |’
‘দু-হাত ভরেই জল, তাই ঠাণ্ডা লাগো--- দস্তানা তোমার নেই, আমি বুনে দেব | কিছুতে বলবে না কাউকে, গালে হাত রাখো যতই জলের হাত, গ্রীষ্মের খরতা তুমি সঙ্গে নিয়ে এলে, চা, কফি বানাব ?’ ‘কিন্তু, তা এখন নয়, উল্টোদিকে বসো পা দু’খানি স্পষ্ট করো, হাতে রাখো হাত তুমি কাজ করো |’ ‘কাজ করা সম্ভব এখন ?’ ‘কেনই বা নয়, কাজ, কাজ ছিল পাথরের নদী কেমন বহতা শীতে, এত নয় বৃষ্টি সর্বজয়া গ্রীষ্মের সন্ন্যাস নয়, এত শীতে দু’খানি চরণ আমার হাতের মধ্যে নিয়ে নেওয়া পৌষী প্রভাতে |’
অর্জুনের ছাল কারা ছড়িয়ে রেখেছে, রেশমের গুটি ছেড়ে পালিয়েছে কীট, বৃষ্টি পড়ে এ-সময়ে শালের জঙ্গলে | বাঘের মাঘের শীত গায়ে আমাদের বৃষ্টি পড়ে, এ-সময়ে আমাদের গানে বৃষ্টি পড়ে, দূরে থাক শালের মঞ্জরী লুপংগুটু ঝর্ণা নয়, আর্টিজীয় কূপ--- সেই ভোরবেলা উঠে দু’জনে চলেছি দু’জন একজন হতে পারিনি এখনো | অর্জুনের নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, পথে পড়েছিল রোরো, পার হয়ে এসেছি, হেঁটেছি মাইল দুই, কুয়াশা-কানিতে সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে এসে পৌঁচেছি কূপের উনুনের মতো টিলা, সে-টিলা মাড়িয়ে, অর্জুনের শিরা ছিল তার উপর বসে একটি হাত দিয়ে ওর কাঁধটি জড়িয়ে একা একা বসে আছি, দু’প্রান্তে দু’জন— দু’জন একজন হতে পারিনি এখনো !
ভোরবেলা চুম্বনের শীত ওষ্ঠে লাগে দুটি করতলে করে সে-মুখ স্থাপন আবার চুম্বন করি সেই ওষ্ঠাধারে, তখন উষ্ণতা পাই, শরীরে উন্মুখ হয়ে পড়ে ইন্দ্রিয়েরা তখনি শালের ভিতরে বুকের মধ্যে দুটি হাত রাখি | ও কিছু বলে না, শুধু অন্ধের মতন চোখ বুজে স্থির থাকে পাথরের মতো | ‘আমি তো পাথর হতে চাইনি কখনো কেন যে এমন হয়, কিছুতে বুঝি না !’ ‘তুমি বড় ভয় পাও, সেজন্যে ঘরের বাহিরে এনেছি আজ কিছু পাব বলে---‘ ‘এই কি যথেষ্ট পাওয়া, এর বেশি নয় ?’ ‘সে-পাওয়া পরের, আমি এর বেশি নয় ?’ ‘সে-পাওয়া পরের, আমি তুলে রেখে দেব যেদিন বিবাহ হবে একসঙ্গে পাব তোমার সমগ্র’ ‘যদি বিবাহ না হয় !’ তাহলেও যা পেয়েছি, তাও তো অনেক কুয়াশায় যা পেয়েছি তাও তো অনেক যথেষ্ট, যথেষ্ট ||’
এখানে জন্মের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় দেশ পত্রিকার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত কবিতা সংকলন থেকে নেওয়া
এখানে জন্মের কিছু দাগ রয়ে গেছে অত্যন্ত সহজে জলে, রেললাইনে আর পেয়ারাবনের ফাঁকে, সবেদার গাছে এখানে জন্মের কিছু দাগ রয়ে গেছে | কীভাবে উঠেছে সিঁড়ি ? এপাশে আঁতুড় অন্যদিকে সিঁড়িঘর সটান উঠেছে তন্নিষ্ঠ ছাদের গায়ে নতুন আলিশ যে গ্যাছে সে কিছুই দ্যাখেনি দ্যাখেনি বলেই গ্যাছে, গ্যাছে বলে সুসন্তান সব একযোগে বাড়িঘর ধুয়ে-মুছে, সাফ করে রেখেছে সে এমন ছিল, সে তো নগদে বিক্রয় করত ঢিল--- গ্যাছে বলে বাঁচা গেছে, এ-প্রজন্ম ক্ষমা ভিক্ষা করে |
বয়ঃসন্ধি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় দেশ পত্রিকার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত কবিতা সংকলন থেকে নেওয়া
বয়ঃসন্ধি, কাপড় ছিঁড়ত ভোরবেলাতেই--- এ তো এমন বয়ঃসন্ধি, কাপড় ছিঁড়ত ভোরবেলাতেই ! না যদি সে পোহাত রাত, দু’হাতে তার আগলে ব’সে আল্ সে বা ছাদ যেখানে থাক্, দু’হাতে এক নখের জব্দ ক’রে মারতাম আধকপালে, কুমারী সেই ভোরবেলাতেই--- তখন ? সে তো বয়ঃসন্ধি, দু’হাতে দুই কঠোর মিনার ভাঙতে-ভাঙতে, শায়া-সেমিজ টুকরো হতো দশ নখরে | আসলে এক বয়ঃসন্ধি, থাকত বলে তাকে মানায়, এই উড়ন্তচণ্ডিপর্ণা, আসলে সেই বয়ঃসন্ধি !
দেখা হলে বজ্রপাত! কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় দেশ পত্রিকার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত কবিতা সংকলন থেকে নেওয়া
লক্ষণীয় এই বজ্রপাত ! ছিলে তো কটকে তাই হয়ে উঠলে ঋণী--- ঘনিষ্ঠ, আপন হয়ে ছিলে তো জঠরে অর্থাৎ পাশের খাটে | নিলাম তোমাকে, শুধু বলবে ওর কথা— কেমন প্রশান্তি তার সাগরবন্ধনে, শুধু বলবে ওর কথা, প্রকৃত কী ক্ষীণ হয়েছে হৃদয়রোগে এ-বুড্ ডি বয়েসে ? শুধু বলবে ওর কথা, কেমন প্রাকৃত রয়ে গেছে সে-যেমন কিশোর-বয়েসে ! কিছুই বললে না, শুধু বললে তুমি এসো নির্জন মন্দিরে এক দেবীকে দেখাব, দেবীর পুজারী নই, আমি নিরঞ্জন, দেবীমূর্তি আমি তার কল্পনা করিনি, অদ্ভুত কিশোরী মূর্তি ছিল তার এক নদী বিভাজনে নয়, ছিল শীর্ণা নদী | জলপ্রপাতের তলে স্নানার্থী একজন | নদীকে বেসেছে ভাল, তা ব’লে সে নদী কখনো থামেনি. তার খরস্রোত গিয়েছিল বয়ে স্নানার্থী গোপনে তাকে প্রণিপাত করে !
গোলচক্র বসেছিল পোর্টিকোর পাশে ঘাসের উপর, যার একদিকে দেয়াল | তুমি এসেছিলে যেন হঠাৎ তমসা নদীর প্রাগুক্ত কূলে বাল্মীকির মতো, যদিও তরুণী, তবু বাল্মীকির মতো ! তমসা নদীর কূলে কে যে এসেছিল ? যাবার সময় শুধু ছুঁয়েছিলে হাত হাতের অঙ্গুলিগুলি, কেন ছুঁয়েছিলে ? করে গেলে বিদ্যুতচালিত তোমার অঙ্গুলি স্পর্শে ! আমি যেন বাজ-পড়া গাছ, দাঁড়িয়ে রয়েছি স্থাণু , সর্বত্র জ্বলেছে | খসে গেছে মাথা বুক সর্বত্র জ্বলেছে, হাতে-পায়ে শক্তি নেই, চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, দাঁড়িয়ে আছি তোমার সম্মুখে | --- এখনো এতটা পোড়ো ! পোড়া-ও কমেনি ? --- চিরদিন সঙ্গ পেলে এতটা পুড়ত না, কোথায় কীভাবে আছি, মন শুধু জানে | মোটেই খারাপ নেই, কিন্তু, দেখা পেলে ভূমণ্ডল তছনছ, সাজানো বাগান--- মুহূর্তে শুকিয়ে যায় না-পাওয়া ক্রন্দনে ! --- এত ভালবাসতে তবু মুখ ফুটে বলোনি বললে কিছু করা যেত, তখনি নিশ্চিত | --- ছিল না উপায় কিছু, সেজন্যে বলোনি বললে কিছু করা যেত, তখনি নিশ্চিত | --- ছিল না উপায় কিছু, সেজন্যে বলিনি তা ছাড়া, বলার বেশি বুঝতে পেরেছিলে, ছিলে অসমর্থ, তাই অফলা সুযোগে পালিয়েছিলাম দূরে, নিকটে আসিনি, নিকটে যাবার কষ্ট, সে তুমি বুঝবে না ! ---বয়েস কাঁচাই ছিল, সে জন্যে বুঝিনি, আজ তো সঠিক বুঝি, কিন্তু নিরুপায় দু’জনে দু’পারে, শুধু মাঝে নদী আছে | নদী একমাত্র আছে দুই পার ছুঁয়ে--- এও তো যথেষ্ট, বলো তুমি মামবে কিনা ? ---মানি আমি বারবার, হবার যা নয় তাই হয়নি কিছুতেই, এ তো ভাল থাকা দু’জন দু’প্রান্তে দুই খেলাঘরে আছি লক্ষণীয়, দেখা হলে হয় বজ্রপাত !
বদলে গেছি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় দেশ পত্রিকার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত কবিতা সংকলন থেকে নেওয়া
জঙ্গল পাহাড় ডাকে, স্থির হয়ে আছি | নদী ও সমুদ্র ডাকে, স্থির হয়ে আছি || মনে হয়, এই বিছ্ না ছেড়ে আমি কোথাও যাব না, জঙ্গল পাহাড় নদী নিয়ে আসব আমার বাগানে— জান্ লা দিয়ে দেখব রোরো, শ্বেতপলাশ সেগুনমঞ্জরী, টিলার মাথায় চড়ে ত্রস্ত দেখব সম্বার হরিণ, বিছানায় বসে থেকে একদিন কাঠ হয়ে যাব, বিছানায় বসে থেকে ত্রস্ত দেখব সম্বার হরিণ ! জঙ্গল পাহাড় ডাকে, স্থির হয়ে আছি | নদী ও সমুদ্র ডাকে, স্থির হয়ে আছি || পুরনো পুঁটুলি খুলে দেখি আগোছালো ঘোরাফেরা— এখন সন্দেহ হয়, বস্তুত, আমি কি ঘুরেছিলাম ! একা কিংবা সবান্ধব এইসব দুরূহ প্রকৃতি— নদী নালা ঠিকই আছে, সেদিন যেমনটি ছিল, আজও--- মাঝে থেকে আমি বদলে গেছি !
দায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় দেশ পত্রিকার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত কবিতা সংকলন থেকে নেওয়া
মানুষের বৃদ্ধি তাকে বৃদ্ধ করে রাখে | ও সময় অলস সময়--- বাগানে বসেই বয়ে যায় | তৎপরতা কিছুতে জাগে না, শুধু যদি ঘুম হত, হিমঘুম একদিন হবেই | এখন তা আসতে বাকি, ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনি হয়, একদিন হবে না | একদিন একা ধ্বনি ফিরে আসবে হরিধ্বনি হয়ে— তোমার শোনার দায় নেই !