কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
তবে তাই হোক
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
দেশ পত্রিকার ৭৫ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত কবিতা সংকলন থেকে নেওয়া

ঘাস কাটা হয়ে গেছে আমার বাগানে |
চারিদিকে মুগ্ধ ফুল,
চারিদিকে বকুল ঝরেছে,
শান্ত বিকেলের আলো সামনের সড়কে |
সন্ধ্যা খুবই ঈশ্বর-চেতন—
ঠাকুরঘরের ঘন্টা বাজে দিকে দিকে,
তারই মধ্যে আসে মালবিকা---
ঘরে নিয়ে গিয়ে তাকে সুদীর্ঘ চুম্বন করে আসি ;
স্থির হয়ে বসো তুমি আমার সম্মুখে,
তুলিতে পড়েছে টান বিশ্বস্ত আঙুলে---
লেখার বদলে আঁকা, তবে তাই হোক |

.               *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
ফিরে এসো মালবিকা
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
নিতাই জানা সম্পাদিত “পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা” থেকে নেওয়া

মালবিকা অইখানে যেওনাকো তুমি,
কথা কয়োনাকো অই যুবকের সাথে,
কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে?
মালবিকা জানো তুমি ঘাসে কি লবণ ?
সামনে দেওদার বন, আমি বসে আছি |
ফিরে এসো মালবিকা কী সুস্বাদ এখানে, জীবনে—
ফিরে এসো মালবিকা যুবকের সাথে তুমি যেওনাকো আর,
শান্তিনিকেতনে আমি দেখেছি পলাশ—
ফিরে এসো মালবিকা,
ও-পলাশে তোমাকে সাজাবো ;
রাঙা ধুলো দিয়ে আমি তোমাকে সাজাবো ;
ভালোবাসা দিয়ে আমি তোমাকে সাজাবো |
ফিরে এসো মালবিকা,
যুবকের সাথে তুমি যেওনাকো আর |
এখানে মন্দিরে-মেঘে আশ্চর্য ঝংকার—
ফিরে এসো মালবিকা, ইচ্ছে করো, এখনই এসো !

.               *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
আকাশে চিক্কুর দিচ্ছে
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
নিতাই জানা সম্পাদিত “পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা” থেকে নেওয়া

আকাশে চিক্কুর দিচ্ছে থেকে থেকে, মেঘে ধরেছে ফাট
ঘরদোরের চৌকাট মাড়িয়ে, টলোমলো, মানুষ ফিরছে অন্দরে
বাইরের ঘাস পাতা, জুতোর নিচের কাদা বারান্দার পেট মোটা
জোঁকের মতন রক্ত ঢালছে, ঝোপের নীচে ঘুমকাতর সেন্ট্রি
রেনট্রির ঝোড়ো চুলে অন্ধকার ঝড়—
তারপর? তারপর গল্পটা খুবই ছোটো
একটু ওঠো | জেগে-জেগেই ঘুমোবে ! ওঠো, উঠে বসো
অনেকদিন রাগ করোনি, অভিমানে অভিমানে ভেঙে পড়োনি
অনেকদিন, বাতির গায়ে লেগে থাকতো মোমের ফোঁটা
আজ নেই, কিচ্ছু করার নেই আজ, দেয়াল থেকে আছড়ে
মাটিতে পড়ছে এঁটেল মাটির টিকটিকি, লম্বা লম্বা ছায়া
দুলছে কেবল, ডাঁই-করা ছাড়া-কাপড়ে ভ্যাপ্ সা গন্ধ
কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে, পাথর পাথর
সবখানেই পাথর, সবখানেই ভাঙা জোড়ার শব্দ-- বাইরে,
ভেতরে নয়, ভেতরে কলে জল পড়ার আওয়াজ হচ্ছে
বাসনপত্তরে, কয়েকটা পোড়া শুকনো রুটি আর ডাল জল
বরফের চেয়ে ঠাণ্ডা --- লোনা, না মিষ্টি ? টেবিলের ওপর
ন্যাংটো হয়ে পড়ে--- ফুরফুর করে উঠছে আরশুলা
দুধ গরমের পোড়া কাগজ উড়ে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়—চমত্কার !
আকাশে চিক্কুর দিচ্ছে থেকে-থেকে, মেঘে ধরছে ফাট
ঘরদোরের চৌকাট মাড়িয়ে আবার কে এসে ঢুকলো--- ঘরে,
তারপরে ? লোকটা মাথা পর্যন্ত চাদর টেনে তার ভেতরেই
একা-একা তৎক্ষণাৎ ঘুমোতে লাগলো ||

.               *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
তবে চলো ভাঁটিখানায় যাই
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
নিতাই জানা সম্পাদিত “পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা” থেকে নেওয়া

কৌলিন্যপ্রবাদরুচি রামধনু উত্তরাধিকার লাম্পট্য তবে চলো ভাঁটিখানায় যাই কলমি
থানকুনির দাম মাড়িয়ে মাড়িয়ে, ভাঙা শামুকে পায়ের পাতা রক্তাক্ত করে, ভাগাড় পাশে
রেখে গাভী মহিষের চলো ভাঁটিখানায় নিয়ে | ডোমপাড়ার স্থূল রক্তচক্ষু কুকুরগুলো
চিৎকার করতে করতে বাঁশঝাড় পেরিয়ে নেমে আসবে কালো নষ্ট হাঁড়ি তিজেল ফেলা
খানার গভীরে, বৃদ্ধা ডোমনি পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কাপড় ছুঁড়ে দিয়েছে জলে, পথের উপর
থেকে তার যৌবনের স্থবির রেখাগুলি স্পষ্ট হলো না, আর পিছু পিছু হাড়িপাড়ার
কুকুরের দল মাংসলিপ্সায় আসছে, অনেকদূরে হেঁটে, কাটাখালের পাড় থেকে হাঁসা হাঁসী
ঝুপঝাপ করে নামল জলে, বাবলার শাখা পীতপরাগে ছেয়েছে, তার গোপনে কাজলকৃষ্ণ
দুই ফিঙে বসে বসে গান গাইছে গান, গোবর নিকোনো উঠোনের পর উলঙ্গ কালো
ডোমের ছেলেটা চড়ুই, গোলাপায়রা, ছাতার পাখি তাড়িয়ে নাচছে, আর অপর ছোটটা
দুহাতে মুখে দৃঢ় করে ধরে আছে এক কালো কোমল মাটির স্তন |

তবে চলো ভাঁটিখানায় যাই, জিরেনের রসে ভিজিয়ে নিই কন্ঠ, স্বর, হৃদয়, প্রেম | তবে
চলো ভাঁটিখানায় যাই, শিশুর মতো মুখে স্তন দংশন করি, এক কালো কোমল মাটির
স্তন | একবারের জন্য মাতাল হয়ে অস্বীকার কর, দেখি মাকে বধূকে সন্তানকে |
তারপর অস্বীকার করি কোনো নগরগৃহে গোলামির ইতিবৃত্ত, ঈশ্বর, সাম্যতন্ত্র,
পিতামহের ভবিষ্যৎ, বিধবা অবিধবা ভগ্নীর দায়িত্ব | কৌলিন্য প্রবাদ রুচি রামধনু
উত্তরাধিকার লাম্পট্য তবে চলো এখন ভাঁটিখানায় যাই |

.               *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
ভালোবাসা যায় না
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
নিতাই জানা সম্পাদিত “পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা” থেকে নেওয়া

একদা লিখেছিলুম, একটি ত্রিভুজকে অপর একটি ত্রিভুজের উপর এমনভাবে স্থাপিত
করো, ইহার সন্নিহিত কোণগুলি সমান হইলে, ত্রিভুজদ্বয় সর্বসম হইবে | আজ মনে
হয়, বিপরীতভাবে, ত্রিভুজ দুইটি সর্বসম হইলে ইহার সন্নিহিত কোণগুলি পরস্পরের
উপর উপস্থাপিত হয় কিনা অনুভব করিবার দিন আসিয়াছে | বত্সর বত্সরের উপর
স্থাপিত হইয়াছে ; তথাপি বসন্তের পদচ্যুতি ঘোরতর প্রকট হইয়া আমাদিগকে পীড়া
দিতেছে, অনুভব করলাম | বিনয় বলিয়াছিল, অমুক, তোমার তেমন চেহারা কোথায়
গেল ? আছো | কিন্তু তেমনভাবে আছো না | বলিয়াছিলাম, কেমনভাবে দেখিতে চাও ?     
নিরুত্তর বিনয় চলিয়া গিয়া দূরে, খুবই দূরে নয়, পাহাড় তলের ছায়ায়, ঝর্ণাকুণ্ডলীকৃত
শোভার মধ্যে নিবন্ধ হইয়া মনশ্চক্ষে ফুটাইতেছিল, তাহারে আমি অনুভব করিলাম |
কিন্তু অনুভব করিয়াও কোনো ফল হইল না | ফল হইতেই সকল কিছু জাগ্রত হয়
এতচ্চিন্তার পরেও ফলগুলি ফুলের প্রকৃতির মধ্যেই শূন্যবিষয়ক তন্ময়তা ধেয়াইতে       
লাগিল | জাগিল না | তখন সন্ধ্যা হয় নাই, বিকাল হইয়াছিল | সহসা সন্ধ্যা হইবে না,
ধারণা করিয়া আমি বাংলোর বহিরাঙ্গণে চমকিয়া উঠিলাম | দূরে, ধূলেরে পাক
দিতেছিল বেগবান হাওয়া | জৈতপুর হইয়া উড়িষ্যাসীমাভাগী কেঁওঞ্ঝর-ময়ূরভঞ্জের
দিকে একটি ঘনকৃষ্ণ বাস ছুটিয়া যায় | মনে হয় কোলহন অশ্বের দিবাস্বপ্নমুখর মাদার
পলাশের ক্রোড়ে ভূনিম্নে এই কোলহন-জনপদেরই বর্তমান আলস্যরুচির মতোই
অবস্থান করিতেছি | এই অপ্রীতিকর নির্লিপ্ততার বিষয়ে বলিয়া বিনয় দূরের পাহাড়ের
দিকে ফিরিয়া গেল | বিনয় বড়ো অচেনা ঠেকিতে শুরু হইয়াছে | বাসিলে হইত,
ভালো, বাসিলে হইত | এই গানখানি শুনিলে আমার ইহাকে সাধুভাষাময় করিয়া দিতে
যে ইচ্ছা হয় তাহাকে বিনয়ের অপ্রকাশিত কথায় ন্যাংটার ঘুনসি বলে | বিনয় পুরাতন
কবিতা লিখিয়াছিল, মনে পড়ে, পদ্মপাতায় কাহাদের চুম্বনের ঠোঁটগুলি | আবার
লিখিয়াছিল চুম্বনের ঠোঁটগুলি কাহার মুখমণ্ডলে অতিকাল্পনিকভাবে পরিস্ফুট হইয়া
গিয়াছে সহসা | বিনয় চুম্বন ভালোবাসিত, অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে পরিস্ফুট হইয়া
গিয়াছে সহসা | বিনয় চুম্বন ভালোবাসিত, অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে নয়, বিপদমূলক
ভালোবাসা | তাহার ইহা ছিলো |

.                                *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
একেকটি দিন আসে
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
নিতাই জানা সম্পাদিত “পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা” থেকে নেওয়া

একেকটি দিন আসে যাদের সঙ্গে কিছুতেই এঁটে ওঠা যায় না
হাঁটতে হাঁটতে চলকে পড়ে
কখনো নিঁভাজ ফিঙেটি হয়ে বসে থাকে টেলিগ্রাফ-তারের ওপর
দূরে, মাঠের পরপারে দাঁড়িয়ে আছে গোরুর পালের মতো
শাদা-কালো মেঘ
এ মেঘে বৃষ্টি হয় না
এ মেঘ যেন আমাদেরই দেখাদেখি পৃথিবীর দামাল দিনটুকু
পোহাতে এসেছে

অমন দিনের গোটাকতক ছবি তুলেছিলুম আমি একসময়
তিনমহলা বাড়ি ধসে গেলে জনশূন্য ছায়ায় আতাগাছের পাশে দাঁড় করিয়ে
তার ছবি তুলেছিলুম আমি
তিজেল-ভাসানো বিলের গায়ে মাছরাঙা-মাছরাঙা ছবি তার—
দড়ি লাফাতে-লাফাতে মেয়েটি বারান্দা পার হয়ে গেলে
মনে হলো--- এবার বুঝি দিনটা ভাঁড়ারঘরের আঁধারে গিয়ে
মুখ থুবড়ে পড়বে |

ভেবেছিলুম, আমার ছায়া আমাকে ছাড়িয়ে যাবে একদিন---
যেমন যায় গাছ গাছকে ছাড়িয়ে
বাড়িকে ছাড়িয়ে যায় বাড়ি
তেমন করে ভেবেছিলুম আমার ছায়া আমাকে ছাড়িয়ে যাবে একদিন
ভেবেছিলুম আমার চেয়ে বড়ো কিছু আমার চেয়ে সতর্ক কিছু
টেনে নিয়ে যাবে আমাকে
খানাখন্দ পার হয়ে চলনবিল ছাড়িয়ে অন্ধকার ছমছম-করা
সৈকতে কোনো
যেখানে ঐ দামাল দিনগুলোকে কিছুক্ষণ আগেই সমাধিস্থ করা হয়েছে |

.                                *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
সামনে জল অথৈ আর পিছনে আছে জ্বালা
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
ছাত্রসংগ্রাম প্রকাশনী প্রকাশিত “প্রতিবাদী বাংলা কবিতা সংকলন” থেকে নেওয়া

সামনে জল অথৈ
আর পিছনে আছে জ্বালা,
ভিন দেশের শিশুর কান
বোমায় করে কালা !
চোখের কাছে আঁধার,
প্রাণ বাঁধার মন বাঁধার
কাজ কি শেষ এই দেশে ?

আমরা মাটি বৃথাই চাটি,
শান্তি আর সংযমের
কথাও কই চমত্কার
দুয়ারে দিই খিল
যখন ডাকাত ছেঁচে বিল,
তখন রায় বেঁশে
নাচ দেখিয়ে ভড়কি দেখাই,
সড়কি বুকে আছড়ে পড়ি
এই দেশে |

সামনে জল অথৈ
আর পিছনে আছে জ্বালা,
ভিন দেশের শিশুর কান
বোমায় করে কালা !
চোখের কাছে আঁধার,
প্রাণ বাঁধার মন বাঁধার
কাজ কি শেষ এই দেশে ?

.           *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
ভাত নেই, পাথর রয়েছে
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
ছাত্রসংগ্রাম প্রকাশনী প্রকাশিত “প্রতিবাদী বাংলা কবিতা সংকলন” থেকে নেওয়া

বছর-বিয়োনী মেঘ বৃষ্টি দেয়, বজ্রপাত দেয়—
ডোবা-র রহস্য বাড়ে, পদ্মপাতা দিঘিতে তছনছ |
শিকড়, কেঁচোর মতো, জীবনের অনুগ্রহ পায়,
পায় না মাথায় ছাতা, এক হাতা ভাতের মানুষও !

মানুষ বারুদ খুবই ভালোবাসে, ধূপগন্ধ যেন

আকাশপিদিম গেঁথে মন্ত্রী যায় সানাই বাজাতে,
পুলিস-মেথর যায় ঝাঁটা হাতে জানাতে বিদায়—
দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়ালই, লাগে ভালো |

সমস্যার সমাধান পায় ভূয়োদর্শী রাজবাড়ি—
অত্যন্ত সহজে, শুধু মানুষ পাথর নয় ব’লে
পরিত্রাণ পেয়ে যায় | অথচ পাথরে যদি মারো,
ঘা দাও, অমনি বগা ফোঁস করে, ঐতিহ্যমণ্ডিত
দেশের পাথর যদি ছেদ্ রে যায়, বিদেশ কী কবে !
ছাত নেই, ভাত নেই--- কোন্ কাম পাথরে, মচ্ছবে---
তোমাদের ?

.                  *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
সেনেট
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
ছাত্রসংগ্রাম প্রকাশনী প্রকাশিত “প্রতিবাদী বাংলা কবিতা সংকলন” থেকে নেওয়া

তোমাদের শেষ নেই, যবে শুরু ফসলক্ষেতের
বুক ভরে গর্ত খোঁড়া, একপ্রান্ত মেলানো পল্লীতে |
মরাই, গুদোম কিংবা আট-চালা অতিপ্রাদেশিক ;
ইঁদুর, বিহগশ্রেষ্ঠ গান করো কাতারে, সিঁড়িতে |

হেম্ লিনের বাঁশিঅলা, এ-সশব্দ কলকাতা আমার
সানাইয়ে সংগীতে যন্ত্রে ট্রিস্টানের নবম সিম্ফনি
কতদূর যাবে, এ-যে ঢের বড়ো সমুচ্চ বিহার
সেনেটের শতপ্রান্তে মেথি খোঁজে ইঁদুরের শ্রেণী |

তোমার সারা গা বড়ো ধুলো-মাখা, বড়ো কষ্টকর
তোমার আলাদা করে দেখা স্তব্ধ অন্ধকার থেকে ;
অথচ তীরের চেয়ে স্বচ্ছগতি, চেতনা তোমার
আধুনিক, নিষ্ঠুরতা যত জানো, কেবা তত জানে ?

রাজবাড়ি দেখা যায়, রাজা ঐ সিংহের আড়ালে
রয়ে গেছে, বহমান, পারায় ধাতুতে স্তব্ধ-থাবা
সেনেটের, হে পাণ্ডিত্য, তুমি ক্ষিপ্র ইঁদুরের গালে
গ্রন্থের বদলে দিচ্ছো, দীর্ঘ শক্ত দুর্গের কাঠামো

পাণ্ডিত্য এমনই, শুধু ব্রাহ্মণের উদ্বৃত্ত-উদ্বেল
বাংলাদেশের মতো, এত বড়ো, সুস্নিগ্ধ গড়ন |
আজ সূক্ষ্মতর তৃষ্ণা তুলে ফেলেছে স্ট্রিম্ লাইন্ ড বাড়ি
কুপিয়ে বুকের মাটি সাধ্য করে সংযোগ স্থাপন |

তোমাদের শেষ নেই, তৎপর কর্নিক নিয়ে হাতে
সংস্কারপান্থ, হে বন্ধু, ভেঙে যাচ্ছো পুরোনো কলকাতা |
সেনেটের ষাট সাল বুকে তুলবে তুলসীধারা রাতে
সহসা ঝড়ের মাঝে আশ্রয়ার্থে দেখবো না তোমায় |

আজ বড়ো দুঃখ হলো হয়তো তুমি মনেও পড়বে না
সেনেট, মাথার পরে শুধু কিছু সংবাদ-কাগজ
উড়বে কিছুদিন, ভুলবো, সন্ধ্যা থেকে রাতের ঠিকানা
জপে ফিরবো নিজবাড়ি, চার বন্ধু ছিন্ন চতুর্দিকে |

.                  *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
জরাসন্ধ         
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
উত্তম দাশ ও মৃত্যুঞ্জয় সেন সম্পাদিত আধুনিক প্রজন্মের কবিতা থেকে নেওয়া

আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে |

যে-মুখ অন্ধকারের মতো শীতল,  চোখদুটি রিক্ত হৃদের মতো কৃপণ, তাকে
তোর মায়ের হাতে ছুঁয়ে ফিরিয়ে নিতে বলি | এ-মাঠ আর নয়, ধানের নাড়ায়
বিঁধে কাতর হ’লো পা | সেবন্নে শাকের শরীর মাড়িয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে আমাকে
তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে |

পচা ধানের গন্ধ, শ্যাওলার গন্ধ, ডুবো জলে তেচোকা মাছের আঁশগন্ধ সব আমার
অন্ধকার অনুভবের ঘরে সারি-সারি তোর ভাঁড়ারের নুনমশলার পাত্র
হ’লো, মা |  আমি যখন অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না, তখন
তোর জরায় ভর করে এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি |  আমি কখনো অনঙ্গ
অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না |
      
কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র | তুই তোর জরার হাতে কঠিন
বাঁধন দিস | অর্থ হয়, আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে
নামলে সমুদ্র স’রে যাবে      শীতল স’রে যাবে    মৃত্যু স’রে যাবে |

তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে | | অন্ধকার আছি, অন্ধকার
থাকবো, বা অন্ধকার হবো |

আমাকে তুই আনালি কেন, ফিরিয়ে নে |

.                  *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর