একেকটি দিন আসে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিতাই জানা সম্পাদিত “পোস্টমর্ডান বাংলা কবিতা” থেকে নেওয়া
একেকটি দিন আসে যাদের সঙ্গে কিছুতেই এঁটে ওঠা যায় না হাঁটতে হাঁটতে চলকে পড়ে কখনো নিঁভাজ ফিঙেটি হয়ে বসে থাকে টেলিগ্রাফ-তারের ওপর দূরে, মাঠের পরপারে দাঁড়িয়ে আছে গোরুর পালের মতো শাদা-কালো মেঘ এ মেঘে বৃষ্টি হয় না এ মেঘ যেন আমাদেরই দেখাদেখি পৃথিবীর দামাল দিনটুকু পোহাতে এসেছে
অমন দিনের গোটাকতক ছবি তুলেছিলুম আমি একসময় তিনমহলা বাড়ি ধসে গেলে জনশূন্য ছায়ায় আতাগাছের পাশে দাঁড় করিয়ে তার ছবি তুলেছিলুম আমি তিজেল-ভাসানো বিলের গায়ে মাছরাঙা-মাছরাঙা ছবি তার— দড়ি লাফাতে-লাফাতে মেয়েটি বারান্দা পার হয়ে গেলে মনে হলো--- এবার বুঝি দিনটা ভাঁড়ারঘরের আঁধারে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে |
ভেবেছিলুম, আমার ছায়া আমাকে ছাড়িয়ে যাবে একদিন--- যেমন যায় গাছ গাছকে ছাড়িয়ে বাড়িকে ছাড়িয়ে যায় বাড়ি তেমন করে ভেবেছিলুম আমার ছায়া আমাকে ছাড়িয়ে যাবে একদিন ভেবেছিলুম আমার চেয়ে বড়ো কিছু আমার চেয়ে সতর্ক কিছু টেনে নিয়ে যাবে আমাকে খানাখন্দ পার হয়ে চলনবিল ছাড়িয়ে অন্ধকার ছমছম-করা সৈকতে কোনো যেখানে ঐ দামাল দিনগুলোকে কিছুক্ষণ আগেই সমাধিস্থ করা হয়েছে |
তোমার সারা গা বড়ো ধুলো-মাখা, বড়ো কষ্টকর তোমার আলাদা করে দেখা স্তব্ধ অন্ধকার থেকে ; অথচ তীরের চেয়ে স্বচ্ছগতি, চেতনা তোমার আধুনিক, নিষ্ঠুরতা যত জানো, কেবা তত জানে ?
রাজবাড়ি দেখা যায়, রাজা ঐ সিংহের আড়ালে রয়ে গেছে, বহমান, পারায় ধাতুতে স্তব্ধ-থাবা সেনেটের, হে পাণ্ডিত্য, তুমি ক্ষিপ্র ইঁদুরের গালে গ্রন্থের বদলে দিচ্ছো, দীর্ঘ শক্ত দুর্গের কাঠামো
পাণ্ডিত্য এমনই, শুধু ব্রাহ্মণের উদ্বৃত্ত-উদ্বেল বাংলাদেশের মতো, এত বড়ো, সুস্নিগ্ধ গড়ন | আজ সূক্ষ্মতর তৃষ্ণা তুলে ফেলেছে স্ট্রিম্ লাইন্ ড বাড়ি কুপিয়ে বুকের মাটি সাধ্য করে সংযোগ স্থাপন |
তোমাদের শেষ নেই, তৎপর কর্নিক নিয়ে হাতে সংস্কারপান্থ, হে বন্ধু, ভেঙে যাচ্ছো পুরোনো কলকাতা | সেনেটের ষাট সাল বুকে তুলবে তুলসীধারা রাতে সহসা ঝড়ের মাঝে আশ্রয়ার্থে দেখবো না তোমায় |
আজ বড়ো দুঃখ হলো হয়তো তুমি মনেও পড়বে না সেনেট, মাথার পরে শুধু কিছু সংবাদ-কাগজ উড়বে কিছুদিন, ভুলবো, সন্ধ্যা থেকে রাতের ঠিকানা জপে ফিরবো নিজবাড়ি, চার বন্ধু ছিন্ন চতুর্দিকে |
জরাসন্ধ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় উত্তম দাশ ও মৃত্যুঞ্জয় সেন সম্পাদিত আধুনিক প্রজন্মের কবিতা থেকে নেওয়া
আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে |
যে-মুখ অন্ধকারের মতো শীতল, চোখদুটি রিক্ত হৃদের মতো কৃপণ, তাকে তোর মায়ের হাতে ছুঁয়ে ফিরিয়ে নিতে বলি | এ-মাঠ আর নয়, ধানের নাড়ায় বিঁধে কাতর হ’লো পা | সেবন্নে শাকের শরীর মাড়িয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে |
পচা ধানের গন্ধ, শ্যাওলার গন্ধ, ডুবো জলে তেচোকা মাছের আঁশগন্ধ সব আমার অন্ধকার অনুভবের ঘরে সারি-সারি তোর ভাঁড়ারের নুনমশলার পাত্র হ’লো, মা | আমি যখন অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না, তখন তোর জরায় ভর করে এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি | আমি কখনো অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখি না, পা দেখি না |
কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র | তুই তোর জরার হাতে কঠিন বাঁধন দিস | অর্থ হয়, আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে সমুদ্র স’রে যাবে শীতল স’রে যাবে মৃত্যু স’রে যাবে |
তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে | | অন্ধকার আছি, অন্ধকার থাকবো, বা অন্ধকার হবো |