কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
উত্তম দাশ ও মৃত্যুঞ্জয় সেন সম্পাদিত আধুনিক প্রজন্মের কবিতা থেকে নেওয়া।


পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ,
.                                                          ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে
বাড়ি ফেরার সময়, বাড়ির ভিতর বাড়ি, পায়ের ভিতর পা,
.                                                           বুকের ভিতর বুক
আর কিছু নয়--- ( আরো অনেক কিছু ? ) --- তারও আগে
পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ
.                                                           ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে
বাড়ি ফেরার সময়, বাড়ির ভিতর বাড়ি, পায়ের ভিতর পা, বুকের ভিতরে বুক
আর কিছু নয় |
‘হ্যান্ডস্ আপ’---হাত তুলে ধরো – যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ
.                                                           তোমাকে তুলে নিয়ে যায়
কালো গাড়ির ভিতরে আবার কালো গাড়ি, তার ভিতরে আবার কালো গাড়ি
সারবন্দী জানলা,  দরজা,  গোরস্থান –- ওলোট পালট কঙ্কাল    
কঙ্কালের ভিতরে শাদা ঘুণ ভিতরে জীবন, জীবনের ভিতরে
.                                                           মৃত্যু---সুতরাং
মৃত্যুর ভিতরে মৃত্যু
আর কিছু নয় !
‘হ্যান্ডস্ আপ’—হাত তুলে ধরো--- যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ
.                                                            তোমাকে তুলে নিয়ে যায়
তুলে ছুঁড়ে ফেলে গাড়ির বাইরে, কিন্তু অন্য গাড়ির ভিতর
যেখানে সব সময় কেউ অপেক্ষা করে থাকে—পলেস্তারা মুঠো করে বটচারার মতন
কেউ না কেউ, যাকে তুমি চেনো না
অপেক্ষা করে থাকে পাকার আড়ালে শক্ত কুঁড়ির মতন
মাকড়সার সোনালি ফাঁস হাতে, মালা
তোমাকে পরিয়ে দেবে--- তোমার বিবাহ মধ্যরাতে, যখন ফুটপাত বদল হয়  
.                                                ---পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে
দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ
মনে করো, গাড়ি রেখে ইস্টিশান দৌড়চ্ছে, নিবন্ত ডুমের পাশে তারার আলো
মনে করো জুতো হাঁটছে, পা রয়েছে স্থির – আকাশ-পাতাল এতোল-বেতোল
মনে করো, শিশুর কাঁধে মড়ার পাল্কি ছুটছে নিমতলা – পরপারে
বুড়োদের লম্বালম্বি বাসরঘরী নাচ---
সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়
তখনই
পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ,
.                                                 ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে
বাড়ি ফেরার সময়, বাড়ির ভিতর বাড়ি. পায়ের ভিতরে পাপ, বুকের ভিতর বুক
আর কিছু  নয় ||

.                                  *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
আমি স্বেচ্ছাচারি
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
উত্তম দাশ ও মৃত্যুঞ্জয় সেন সম্পাদিত আধুনিক প্রজন্মের কবিতা থেকে নেওয়া।

তীরে কি প্রচন্ড কলরব
‘জলে ভেসে যায় কার শব
কোথা ছিল বাড়ি  ?’
রাতের কল্লোল শুধু বলে যায় ---‘আমি স্বেচ্ছাচারী  |’

সমুদ্র কি জীবিত ও মৃতে
এভাবে সম্পূর্ণ অকর্কিতে
সমাদরণীয় ?
কে জানে গরল কিনা প্রকৃত পানীয়
অমৃতেই বিষ !
মেধার ভিতর শ্রান্তি বাড়ে অহর্নিশ

তীরে কি প্রচন্ড কলবর
‘জলে ভেসে যায় কার শব
কোথা ছিলো বাড়ি ?’
রাতের কল্লোল শুধু বলে যায় --- ‘আমি স্বেচ্ছাচারী |’

.                      *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
ও চিরপ্রণম্য অগ্নি
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
উত্তম দাশ ও মৃত্যুঞ্জয় সেন সম্পাদিত আধুনিক প্রজন্মের কবিতা থেকে নেওয়া।

ও চিরপ্রণম্য অগ্নি
আমাকে পোড়াও |
প্রথমে পোড়াও ঐ দুটি পা দুটি যা চলচ্ছক্তিহীন,
তারপর যে-হাতে আজ প্রেম পরিচ্ছন্নতা কিছু নেই |
এখন বাহুর ফাঁদে ফুলের বরফ,
এখন কাঁধের ‘পরে দায়িত্বহীনতা,
ওদের পুড়িয়ে এসে জীবনের কাছে,
দাঁড়াও লহমা, তারপর ধ্বংস করো
সত্যমিথ্যা রঙে-শ্বেতে স্তব্ধ জ্ঞানপীঠ |
রক্ষা করো দুটি চোখ |
হয়তো তাদের
এখনো দেখার কিছু কিছু বাকী আছে |
অশ্রুপাত শেষ হলে নষ্ট করো আঁখি,
পুড়িও না ফুলমালা স্তবক সুগন্ধে আলুথালু ,
প্রিয় করস্পর্শ ওর গায়ে লেগে আছে |
গঙ্গাজলে ভেসে যেতে দিও ওকে মুক্ত, স্বেচ্ছাচারী –
ও চিরপ্রণম্য অগ্নি
আমাকে পোড়াও |

.                      *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
পড়ন্ত বিকেলে
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
উত্তম দাশ ও মৃত্যুঞ্জয় সেন সম্পাদিত আধুনিক প্রজন্মের কবিতা থেকে নেওয়া।
                                                                                 
ও বোধিবৃক্ষের পাতা রয়েছো লুকায়ে ?

কীভাবে সন্ধান ক’রে সর্বশক্তিমান
পাতার উপর লিখি শূন্যতার কথা !
কীভাবে নিকটে এসে উঁকি মারো সর্বশক্তিমান
ও বোধিবৃক্ষের পাতা পড়ন্ত বিকেলে !

প্রকৃত কে ধরা দিল তা নিশ্চিত নয়,
খুঁজে পাওয়া গেলো কিনা তা নিশ্চিত নয়,
কিন্তু, এসে গেলো, দেখা একে অপরের
পড়ন্ত বিকেলে –
মাথার ভিতর ছিলো এক একটি কবিতার মতন শূন্যতা |

.                      *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
জন্মদিনে
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
উত্তম দাশ ও মৃত্যুঞ্জয় সেন সম্পাদিত আধুনিক প্রজন্মের কবিতা থেকে নেওয়া।

জন্মদিনে কিছু ফুল পাওয়া গিয়েছিলো |
অসম্ভব খুশি হাসি গানের ভিতরে
একটি বিড়াল এক বাহান্নটি থাবা গুনে গুনে
উঠে গেলো সিঁড়ির উপরে
লোহার ঘোরানো সিঁড়ি, সিঁড়ির উপরে
সবার অলক্ষ্যে কালো সিঁড়ির উপরে
শুধু আমিই দেখেছি
তার দ্বিধান্বিত ভঙ্গি
তার বিষণ্ণতা |

জন্মদিনে কিছু ফুল পাওয়া গিয়েছিলো
এখন শুকিয়ে গেছে |

.              *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
রহস্যের চাবি
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
মারুফ হোসেন সম্পাদিত নয় দশকের কবিতা থেকে নেওয়া।

রহস্যের চাবিখানি দাও,
তুলে রাখি |
হারিয়ে যায় না যেন ঝর্ণার জঙ্গলে—

রহস্যের চাবি দিয়ে পদ্যের দরোজা
খুলতে হবে |
যে-মানুষ রহস্য বোঝে না—
তার কাছে এ-পৃথিবী,
শুকনো বাদাম-খোসা যেন !
সুতরাং চাবি দাও,
আমি তাকে সাবধানে রাখি |

.              *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
দুঃখ
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
অনুপ কুমার মহাপাত্র সম্পাদিত সহজ পাঠের কবিতা থেকে নেওয়া।

কবি যদি দুঃখ পায়, কলকাতাও দুঃখ পেতে থাকে |
অথচ সকলে বলে, তার মতো নিষ্ঠুর দেখিনি---
খল, শঠ, প্রবঞ্চক, হৃদয়বিহীন বৃদ্ধা লোল
এবং কখনো টেনে গৃহ থেকে শিশুকে চাকায়
থ্যাঁতলায়, নিহত করে ; ফেলে দেয় নর্দমার ধারে
গরীব দুঃখীকে, হায় কলকাতা কি দুঃখ পেতে পারে ?

আমি জানি দুঃখ পায়, কেঁদে হয় কলকাতা আকুল
মনের ভিতরে তুমি একবার কান পেতে শোনো
মধ্যরাত্রে ফাঁকা রাস্তা, কান পাতো রাস্তার উপরে---
শুনবে, কে যেন কাঁদছে, মনে মনে দুঃখের নিশ্বাস
পড়ছে, যেন মেঘ ডাকছে নিচের গহ্বর থেকে রোজ
রোজই যাকে কাঁদতে হয়, সে কি আর দুঃখ পেতে জানে ?

.                      *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
সোনার বরন কন্যে
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা সমৃদ্ধ ও পৃথ্বীরাজ সেন সম্পাদিত “দশ দিগন্তের বাংলা
কবিতা” থেকে নেওয়া।

একটু বলার জন্যে
আমার কাছে বসল এসে সোনার বরন কন্যে
পরনে তার বাংলা দেশের
নকশি কাঁথার মায়া
একটুখানি আলো এবং একটুখানি ছায়া |

সম্মুখে যার ফরসা উঠোন
একটি ফোঁটা পুকুর
বাংলাদেশের ভালোবাসায়
ঘর ভরেছে খুকুর—

এইটে বলার জন্যে
আমার কাছে বসল এসে
সোনার বরন কন্যে |

.        *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
ভালর জন্যে
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও কবি সরল দে সম্পাদিত “পাঁচশো বছরের কিশোর কবিতা”
থেকে নেওয়া।

আমি যদি ইচ্ছা করে দুষ্টু বাবুই হয়ে থাকি
তার কী চিকিচ্ছে আছে ?
যতই কেন মিষ্টুনি নাম দিক না হলদে বড় বাড়ি
ভাবছ আমি ভাল হব ?
বয়েই গেছে ভাল হতে |

এই বাড়িটার বড়দি-মণি আলেমানের পুতুল দিতে
ওরা দেবে কচু-কলা |
দেখছ না মা শ-র ষ-র ফলার মতন ওদের পাটকাঠিভাব---
চশমাখানা বদল করো
তবেই তো ঠিক দেখতে পারো |

হোক না ছোট মাঠকোঠা এই স্কুল বাড়িটা
কী করে যে ছড়া শেখায়, বাংলা ছড়া
ভায়ের মতন ইনজিরি না, ম্লেচ্ছভাষা
কী লাভ শিখে, স্বপ্ন কি ইনজিরিতে হয় !

তবেই বলো
দুষ্টু থাকতে চাইলে কি চিকিচ্ছে আছে ?
উপরন্তু জানাশোনা
সে-সম্পর্ক উড়িয়ে দেওয়া যায় নাকি মা এক কথাতে ?
তুমিই বলো |

ঐ ছোট ইস্কুলে চলো
দ্যাখো কী হয়
---একটি বছর, তার বেশি নয়
ভাল হব, ভাল হব, ভাল হবই !

.        *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
রাখো তোমার উদ্যত পা        
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও কবি দীপক রায় সম্পাদিত “এই শতাব্দীর প্রেমের কবিতা”
থেকে নেওয়া।                         

তুমি একটু থামো, তোমার দু’ পায় আমি নূপুর পরাই
তুমি থামো, এক পা তুলে রাখো আমার হাতের উপর
রেখার উপর, তালুর উপর, রাখো তোমার উদ্যত পা
ছুটন্ত এক নবীন ঘোড়া হঠাৎ যেমন থমকে দাঁড়ায়
তেমনভাবে চোখের উপর, চিত্রকরের মাথার উপর
আকাশ জুড়ে থমকে দাঁড়াও স্থির যেন হিম পাথর তুমি
এক এক রেখায় তোমায় ফোটাই, ফাটাই তোমার দাপট নখে
চোখ দুটোতে কাজল ঢেলে, করমচা ফল করবো গুঁড়ো
উড়াল দু’ পথ---আমার মায়ার দণ্ড ছুটবে পাহাড় চূড়োয় |

তুমি একটু থামো, দাঁড়াও, যেভাবে কাল দাঁড়িয়ে পড়ে
যেন শকট, সামনে বাধা নদী কিংবা সমদ্দুরের
যেন বিপুল বাঘের মাথা তাঁদরিখেকো আলোক গিলে
জবুস্থবু, তেমনি দাঁড়াও, রাখো তোমার প্রতিশ্রুতি –
তুমি থামো, রাখো আমার হাতের উপর প্রতিশ্রুতি
রেখার উপর, তালুর উপর, রাখো তোমার উদ্যত পা |

.                       *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর