টিলার উপর সেই বাড়িটির কথা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের “শুধু আবৃত্তির জন্য” থেকে নেওয়া।
টিলার উপরে সেই বাড়িটির কথা মনে পড়ে ? সামনে ঘোড়ানিমগাছ, পিছনে ইঁদারা একপাশে নাবাল মাঠ, অন্যপাশে টেবিল পাহাড় তাতে বাগিচার ফুল ছোটখাট ওঁরাও-পল্লীর ঠাস-চাপা ছবি ভেঙে সূর্য ডুবে যায় লাল রবারের বল হারানোর মতো | দূরে রোরো, বাব্ লার ঘনচ্ছায়ে কাচপোকা টিপ তারা ও নক্ষত্রে সেই আকাশ-ভাসানো হাওয়ায়, হাঁড়িয়াগন্ধে, বনফুলবাসে--- মনে পড়ে? টিলার উপরে সেই বাড়িটির কথা, অবিনাশ ? তোমরা দুজনে মিলে ঘোররাতে ভাঙো হ্যারিকেন যতো কিছু কাচপাত্র, ভঙ্গুর, ঠুনকো গ্লাসবাটি— কোন্ শিখা থেকে লাগে মাদুরে আগুন, মনে নেই ? আগুন নিজস্ব রূপে পোড়ায় কম্বল, বুকে লাগে রোম পোড়ে, চামে ঠেকে—মনে হয় জীবন তখনি উত্ক্ষিপ্ত ছিলার মতো লাফ মারে ঘর থেকে মাঠে— অবিনাশ, মনে পড়ে ? চেতনার নিয়ম অমনি |
মনে পড়ে অবিনাশ, সেইরাতে দুজন পায়রার ভীরু পায়ে ঘরে ঢোকা—দুজন পায়রানি ছেড়ে এসে সোহাগ যতন চুমাখেয়ে এসে ওরা দুইজন ভাঙা কাচ, পোড়া শয্যা দেখে গন্ধ শুঁকে ইঁদুরের মতো ক্ষিপ্র পায়ে ওরা ফিরে গিয়েছিলো ফিরে গিয়েছিলো পথে, ঘরে নয়, ঘরের বাহিরে রয়ে গিয়েছিলো ওরা ভয় পেয়ে – সেদিন ঢোকেনি আসেনি নিকটে, কাছে, গাছে-গাছে পাখির মতন শব্দহারা অন্ধ ওরা বসেছিলো পাতার আড়ালে নিজেকে ঢাকার জন্যে ? হবেও বা | চুম্বন-সোয়াদ ভোলার জন্যেও হবে | তোমরা চুম্বন ছাড়া ছিলে ! কিন্তু বনগন্ধ ছিলো ঘর ভরে ধূপের ধোঁয়ার মতন সংলগ্ন -- মনে পড়ে ? টিলার উপরে সেই বাড়িটির কথা, অবিনাশ ? দূরে রোরো, অর্থবহ, চুনাভাটি থেকে চিতার কাঠের কয়লা নিয়ে আসে মনুষ্য-পরশ, মড়ার পোড়ানো ছাই--- এইসব অন্তরঙ্গভাবে | পাথরে আছাড় খায় জল চৈতবাতাসের হাতে পায়ে লাগে ছিটেফোঁটা, ঘন্টার আওয়াজে পিছনের নির্জন মন্দির কথা কয়, বলে বালক-বালিকা তোমাদের দুঃখসুখ বেদনা ব্যথার জন্যে কেউ বসে নেই, ব্যথা পাও, দুঃখ পাও--- পেতে হবে বলে মানুষের মতো হতে হবে বলে কাছাকাছি থেকো | পাথরে পাথর লেগে পোড়ে হিজলের পটভূমি ডালে-ডালে লেগে ওঠে আগুন, আক্ষেপ বেনো জল কাছাকাছি থেকো, কোনো ভয় নেই, কাছাকাছি থোকো— আমি আছি |
টিলার উপরে সেই বাড়িটির কথা, মনে পড়ে ? নাবাল জমিটি ছিলো সিঁথির রেখার মতো আলপথে ভরা দুপুরে ঈথার কাঁপে, পাতা খসে হঠাৎ হাওয়ায়, যতদূর চোখ যায় পড়ো বাদা মনসার ঝোপ শুকনো খটখটে মাঠ তৃণহীন চাষের বশ্যতা স্বীকার করার মতো সাধ্বী নয়, হেটো বেটো মেয়ে নছোলায় বাঁয়ে-ডাইনে যখন সেইদিকে খুশি চলে যায় গোঁজ হয়ে বসে থাকে সেগুন হেলান দিয়ে কাঠুরের মতো, পাতাকুড়ানির মতো নয়, হাতে কুঠার রয়েছে নির্দিষ্ট অমোঘ ধার কুঠারের, রোদ্দুরের মতো ব্রাহ্মণ রোদের মতো, রূপের নারান--- তোর মতো | টিলার উপরে সেই বাড়িটির কথা, অবিনাশ মনে পড়ে তোমাদের ?
জানলা দিয়ে বাঁকাচোরা চোখে চেয়ে কতোদিন হলো--- বিকেল হয়েছে সন্ধে হয়ে এলো, গেলো বিকেলের ঝিঁঝি মেহেদি পাতার ঝোপে, হলুদ ফলের থোকায় বসার জন্যে, সন্ধে হয়ে এলে রাতের গভীরে ঝিঁ ঝি চলে যায় ফলের থোকায় শুয়ে-বসে থাকবে বলে, স্বপ্ন দেখবে বলে পাথরের ! টিলার সানুর বাদা পার হলে পীচকালো পথ পথের দুপাশে জাকারাণ্ডা আর শিরীষের সারি--- মাথার ছায়াটি ফেলা পথের উপরে | দূরে অর্থবহ রোরো, নাভির গর্তের মতো রোরো ওপারের পথ গেছে লুপুংগুটু ছাড়িয়ে দূরের বড়বিল--- সারাণ্ডার পাহাড় জঙ্গল থাকে-থাকে শ্বাপদ ভরিয়ে রাখে, ডাকবাংলো, অর্জুনমাদার এইসব |
মনে পড়ে অবিনাশ থলকোবাদের সেই বাংলোটির কথা আমরা সবাই মিলে সেখানে নির্জন হতে গেছি কিন্তু ভয়ংকর শব্দে নির্জনতা ছিন্নভিন্ন হলো | মানুষ পশুর চেয়ে হিংস্র হতে দেখেছি সেদিনই মনে পড়ে অবিনাশ ? তুমি ছিলে, হীমানীশ ছিলো ঘাইহরিণীর কান্না বাংলোর দেয়ালে ঢাকা আছে পলেস্তারা খসে গেলে তার বার্তা মানুষেও পাবে কুয়োর ভিতরে থেকে কোনোদিন ঠাণ্ডা কালো জল মানুষের পচা মাংস হাড় নিয়ে প্রকাশ্যে বেরোবে--- তখন কোথায় তুমি অবিনাশ ? কোথায় জ্যোত্স্নায় মোড়া সেই হিংস্র রাত, হাতির চিৎকার, তক্ষকের হেঁচকির মতন ডাক, বাংলোর সামনের ফাঁকা মাঠে নাইটজারের চোখ জ্বলে ওঠে, ছায়া অশরীরী জ্যোত্স্নায় ভীষণ লাগে বনাঞ্চল, আকাশ হোয়ে-র জলের মতন পেঁজা শাদা মেঘে থই থই করেছে--- মনে পড়ে, অবিনাশ, সেদিনের কুচ্ছিত রজনী ? জীবনের সেই রাত শতানের মতো ক্ষিপ্র পিছু নিয়েছে আমার, আমি কোনভাবে পরিত্রাণ চাই--- কোথায় আমার দোষ ? দ্রষ্টা আমি সঞ্জয়ের মতো, কখনো কথক নই, আলাপচারিতা মুছে গেছে | সেই থেকে পাথরের মতো আমি সন্ত্রাসজড়িত সব সময় ভয় হয়, ভয় থেকে মৃত্যুবোধ আসে যদি মরি বেঁচে যাই, স্মৃতির অসহ্য খেলাঘরে সমস্ত খেলাতে কষ্ট পেতে থাকি, ভিন্ন অভিমানে প্রেমের বন্ধন করি ছিন্ন সেই অকারণ শোকে | শোকের বিস্ময় রক্তে নাড়া দেয় এলোমেলোভাবে কী যে তার দোষ ? কিছু আছে নাকি ? ভালোবাসা ছাড়া ভোরে তার ভালোবাসা, ভালোবাসা দুপুরে ও রাতে ভালোবাসা সর্বক্ষণ, তার ছোট ঘরের কানাচে ক্ষয়া, পলেস্তরা-খসা দেওয়ালের পাশে বসে থাকা, চাঁদ দেখা, টেলিগ্রাফ-তারে ঘুঘুর ছিটের রঙ, প্রকৃত পাহাড়ি বাতাস যেভাবে এসে চাইবাসা ভাসায় সেইভাবে প্রেম আসে পাগলের মতো প্রগল্ ভ স্খলিত পায়ে পাগলের মতো মধ্যবর্তী হ্যারিকেন, দুটি রাঙা মুখ একটি এগিয়ে আসে, অন্যটি পিছোয় দর্প এসে কামনার ওড়ায় বালুকা সমুদ্র নদীর তীরে, ঝর্ণার নিকটে সেই বালি, নির্জনতা, সেই ধূ ধূ মুখ বালিকার, নেমে আসে, বুকে গর্ত খোঁড়ে স্থগিত সে দৃশ্য দেখে মন কেমন হয় কিছুই করার নেই, অশক্ত অক্ষম যৌবন আমার, আমি বৃদ্ধ, অগোছাল--- সংসার আমার নেই, উড়োপুড়ো মেঘ আমার আকাশ জুড়ে শুধু খেলা করে উড়ে যায়, খুঁড়ে যায় মাটির উঠোন প্রাণপণে, সজিনার ডাল ভেঙে পড়ে | ভেঙে খসে পড়ে প্রাণ গভীর গাভীর যেভাবে সন্তান হয়, চোখে-চোখে কথা বিনিময় হয়, মধ্যবর্তী হ্যারিকেনে— শিখার আগুন নেভে, ভবিষ্যৎ-ভরা কবিতার খাতাখানি ছিঁড়ে-খুঁড়ে যায় পতনের শব্দ ওঠে টিলার উপরে--- কে পড়ে, কী পড়ে যায়, ঘরবাড়ি চালা ? আঁধির দাপট লাগে মানুষের মুখে মুখ পোড়ে, বুক পোড়ে---জঙ্গলের সানু আগুনের মালা রাখে—কীসের বিবাহ ? কাদের বিবাহ রাতে, জানো অবিনাশ ? টিলার উপরে সেই বাড়িটি দেখার আজ বড়ো ইচ্ছা হয়, হয় অবিনাশ তোমাদেরও ?--- শুনেছি, ভেঙেছে বাড়ি টিলার উপরে একদার সেই বাড়ি জানো, অবিনাশ !
কারনেশন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হে প্রেম হে নৈশব্দ্য” (১৯৬১) গ্রন্থের কবিতা।
প্রভেদ জটিল, অবগুন্ঠিত সড়কে চাঁদের আলো তাকে দিয়ো অই ফুলটি কারনেশন | কতদিন তার মুখও দেখিনি, চেনা পদপাত পিছল অলক কালো ও-ফুলের কথা ব’লো না কাউকে বুড়া মালঞ্চ, মায়াবী সকাল ফিরে এনেছে কে, কে মঞ্জরীর অস্বচ্ছ আলোছায়ে বাগানে ঘুরছে স্খলিত নিদ্রা, কেই-বা দুপুরে ঘুমায় উষ্ণ বায়ুর বিলাসে ঝাঁ ঝাঁ গায়ে গায়ে ফুরোয় দুপুর ফুরোয় সন্ধ্যা শুধু জলরেখা শুধু জলরেখা |
২ হাওয়া খোলে মাটি নীহার অরব পুকুরে শব্দ | সারারাত ম্লান মেছো বক ছিলো পুকুরের পাশে আমার মতন আয়নায় দেখে মুখ আর মন যার কথা ভাবে সে কিসের রেখা জলরেখা নয় ! হয়তো সড়ক জমাট অন্ধ, কেন আলো ফেলো | কেন আলো ফেলো অকারণ মৃদু চমকায় মন ; সাম্প্রতিক যা দেবার আছে, নাও কেশে পরো সে কারনেশন শাদা আর লাল, সে কারনেশন |
পরস্ত্রী কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হে প্রেম হে নৈশব্দ্য” (১৯৬১) গ্রন্থের কবিতা।
যাবো না আর ঘরের মধ্যে অই কপালে কী পরেছো . যাবো না আর ঘরে সব শেষের তারা মিলালো আকাশ খুঁজে তাকে পাবে না ধঁরে-বেঁধে নিতেও পারো তবু সে-মন ঘরে যাবে না বালক আজও বকুল কুড়ায় তুমি কপালে কী পরেছো . কখন যেন পরে ? সবার বয়স হয় আমার বালক-বয়স বাড়ে না কেন চতুর্দিক সহজ শান্ত হৃদয় কেন স্রোতসফেন মুখচ্ছবি সুশ্রী অমন, কপাল জুড়ে কী পরেছো . অচেনা, কিছু চেনাও চিরতরে |
শবযাত্রী সন্দিগ্ধ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হে প্রেম হে নৈশব্দ্য” (১৯৬১) গ্রন্থের কবিতা।
মড়া পোড়াতে যাবো না বৈকুন্ঠ, আমরা কি মরবো না | খোল ভেঙে দে বেতাল ঠেকায় চোখে টলছে হাজার চন্দ্রবোড়া কালরাতে যে-সাতপহর গাওনা হলো, তর্জা কাপ কবি বিলেতবাতি ঝুললো, পোকা, লোকলস্কর | কেউ ডেকেছে | কেন | আমরা কেউ ম’রে গেলেই সঙ্গে যাবো তেমনটি করবো না | সাধলে কবি সাতপহর মেলায় গিয়ে গান বাঁধবে নানা আনন্দ কি বৈতরণীর অন্য পারে বিন্দু পাওয়া যাবে |