কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
ঝর্না  
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হে প্রেম হে নৈশব্দ্য” (১৯৬১)
গ্রন্থের কবিতা।


সারঙ্গ, যদি ঝর্না ফোটাই তুমি আসবে কি    তুমি আসবে কি
সন্তর্পন পল্লব দোলে এত অজস্র বন্ধু হাওয়া
গাছের শিরায় ফেটেছে নূপুর অমর নূপুর জলে ভাসবে কি |
পাহাড়খণ্ড  পাহাড়খণ্ড ওর নৃত্যের দোষ নিয়ো না হে |

অলস-অলস ভালোবাসা তুমি নদীপথ আঁকো নখে-নখে, তীরে
দাঁড়িয়ে পড়েছে শাদা গাছগুলি, উপঢৌকন সবুজ জড়োয়া
দেখছো না কেন  দুলছো না কেন  তবু যে পুলিন জল মেশে ধীরে
কোথায় মেশে না ? পাহাড়খণ্ড  ওর কোনোদিন দোষ নিয়ো না হে |

তৃষ্ণা জড়ায় পাকে-পাকে আহা সারঙ্গ এসো ঝর্নাপ্রান্তে

মাইল-মাইল ধূলাবালি ওড়ে অচ্ছায় যত গাছের পাহারা
মুছে যাবে তার নূপুরে, নৃত্যে, শুধু জল টানে পিপাসু ভ্রান্তে
ও ঝর্না ওগো ঝর্না তাহাকে ভালোবাসবে কি  ভালোবাসবে কি ?

.                           *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
অতিজীবিত
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হে প্রেম হে নৈশব্দ্য” (১৯৬১)
গ্রন্থের কবিতা।


বাগানের গাছটিও বাড়বে রোদ্দুরে বৃষ্টিতে
আমার ফুল ফুটবে তুমি সৌরভ পাবে না
পুকুর ভাসবে সবুজপানায় নিরুত্সুক দ়ৃষ্টিতে
মুখ আমার ভাসবে আলোয় গৌরব পাবে না

একা-একাই তোমার বোনা গাছটি দেখবো ফুলটি দেখবো
বাগানে কোনো বড় গভীর ছায়ার তলায় ঘুমিয়ে পড়বো
জল আসবে বৃষ্টি আসবে ভাসবে দেহ  সে-ও আসবে
শশাকুচির আমবাগানে তোমার স্পর্শ রাখবে না |

নতুন হাত নিড়ুনি করবে এধার-ওধার দু-চারটি ঘাস
পুঁই তুলবে, মাচা বাঁধবে কুমড়োলতা মাখবে না
পুরোনো নষ্ট শর্করায় নতুন কালো গাভীর পীযূষ
আমি মানবো সাপটে ধরবো নতুন বাগান, নতুন গাছটি
বেঁচে উঠবো সরল ঋজু রোদ্দুরে বৃষ্টিতে |

.                           *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
ভ্রান্তি
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হে প্রেম হে নৈশব্দ্য” (১৯৬১)
গ্রন্থের কবিতা।


জল যায় রে শিলা আমার বক্ষপট দহে
সলিতালতা রূপসী পোড়ে নিবিড় তরী ভ’রে
ফেরা ভালো ফেরাই ভালো, বাতাসে কত সহে
দহনভার ভস্মতার মরীচিকার মালা ?

রাখো কোথায় ?  ছন্নপট বিনা-হৃদয় জুড়ে
হে শিলামালা চরণমূলে রাখিবে ধ’রে যদি
ফিরায়ো না সে শুভ্র হাঁস নখরাহতে ধীরে
নভোছায়ায় মগ্ন যেথা লুটায় রেখা-নদী |

জল যায় রে এমন দিনে চাঁচর মুখপানে
তারাভিলাষী মাতাল শূক ফেনাবগাঢ় রাতে
পুড়িয়া মরে মান্দাসিনী ছুঁয়ো না মায়াভানে
চরণমূলে চিহ্ন থাক্ শিলাবনত প’ড়ে |

তোমায় কিছু দিয়েছিলাম, প্রীতির ছায়াতলে
নীলাঞ্জন, ঝরিয়া গেলে রম্য চিতাপটে—
চমত্কার বারুণীগতি  আছো তো সখা ভালো ?
বাতাসে তার চমত্কার ভস্মভার মরীচিকার শূন্য নদীতটে |

.                           *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
মুকুর     
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হে প্রেম হে নৈশব্দ্য” (১৯৬১)
গ্রন্থের কবিতা।


মৃদঙ্গ বাজত দেখি নাচত চন্দন
কুলশীল জানা নাই রসাবিষ্ট যত
মেলার আলোক নৃত্যপটে মেলার আঁধার বন
হারালো বন হারালো আলো  মৃদঙ্গ নাচত রে |

খসিল মৌচাক তারা উচ্ছ্রিত জোছনা রে
তুমি চন্দন ভোলালে ঘর জনমসুধার ধারা
ধরিলে জোনাকে চন্দন  ধরিলে জোনাকে হে
অভ্রফুলে ভাসিল গান বিপথগান বাঁধনহারা |

প্রভু হে কেন শুকালো ফুল, মুড়ালো গাছ, পীতল মালা
দরদী মুখে মলিন হাসি বুঝিনি ছল শিল্পকূট
প্রিয় আমার নিয়েছো সব, ভ্রান্ত কর, নীরব, লুলা
স্বপ্ন নাও স্মৃতিও নাও পদ্ম নাও অক্ষিপুটে |

মৃদঙ্গ বাজত না রে নাচত চন্দন
চলো চন্দন মেলায় যাবো শূন্যমেলা চিতল ভঙ্গ,
নীরবে থেকো হে তারা সখি আঁধারতম আঁধার বন
লুলা হাতের পাতকী নাচে তুমিই তো মৃদঙ্গ রে |

.                           *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
নিমন্ত্রণ
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হে প্রেম হে নৈশব্দ্য” (১৯৬১)
গ্রন্থের কবিতা।


কোথায় থেকে তোমার ডাক শুনতে পেয়ে এলাম গতকাল
আমায় কেন ডেকেছো তাই বললে হেসে-হেসে
এমন সময় আবার এলো তেমন বৃষ্টি মাঠে
ক্ষেতের পর ক্ষেতে ফুরালো, খামার, জঞ্জাল |
এবার তোমার পিছনপানে আকাশ, আমি বৃষ্টি ফেলে

তুমি যেমন তেমনটি আর কোথাও কিছু নেই
তুমি যেমন, অপার জ্যোত্স্না ঝরিয়ে যেতে পারো |
চারিদিকের ক্ষেত-খামার ঝর্না হ’য়ে যায়
তুমি যেমন তেমনই ঠিক, এই তো চ’লে যাই
আকাশ, তোমার আর্শিখানা পড়শি-কুটুম রাখলো নিজের হাতে |

.                           *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
ছায়ামারীচের বনে       
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হে প্রেম হে নৈশব্দ্য” (১৯৬১)
গ্রন্থের কবিতা।


হৃদয়ে আমার গন্ধের মৃদুভার,
তুমি নিয়ে চলো ছায়ামারীচের বনে
স্থির গাছ আর বিনীত আকাশ গাঢ়
সহিতে পারি না, হে সখি, অচল মনে |

হারা-মরু-নদী কী দুঃখ অনিবার
ভরসা ফলের পাত হৃদে বড়ো বাজে
গহন শোকের হাওয়া ঘেরে মরি-মরি
বরষা কখন ঘন মরীচিকা সাজে |

হে উট, গভীর ধমনী, আমারে নাও
যোজনান্তর কাঁটাগাছ দূরে-দূরে       
আরো বহুদূরে কুয়োতলা কালো জল—
হে উট, গভীর উট নাচো ঘুরে-ঘুরে |

কী ধার উজল অবিরত টিলা পড়ে
টিলা নয় যেন বঁড়শি, টিয়ার দাঁত |
অচল আকাশ ছাড়ে না সঙ্গ, জড়ে
বাঁধা থাকে মৃত ভায়োলিন বাড়ে রাত |

ফুটো তাঁবু লাগে পাঁজরে, ফাঁদ্ রা ডুলি,
বুড়ো বেদুইন খরমুজ খায় দেখে
বলি, বড়মিঁয়া, যাবো সে কমলাপুলি
নিশানা কী তার ? চাঁদ ছিলো চাঁদে লেগে |

.                        *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
কখনো বুকের মাঝে ওঠে গ্রীস
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হে প্রেম হে নৈশব্দ্য” (১৯৬১)
গ্রন্থের কবিতা।


কখনো বুকের মাঝে ওঠে গ্রীস
শিল্পের দক্ষিণপার্শ্ব ভ’রে কালো নীরব তুহিন জ’মে যায় |
রুদ্ধ অভিমান করস্পর্শে যে মোছাতে পারে
সেই অনাবশ্যকতা আমায় একাগ্র রেখে
একদিকে চ’লে গেছে |

অতগুলি বাগানের তীব্র ফল, আমি একা
অস্ত্রের গৌরবহীন
প’ড়ে আছি |

তুমি আজো ভীত আজো রুগ্ ণ হয়ে ওঠো |
চাদরের নিরুপম তপ্ত দুঃখে শিমূলের মতো
তোমার আচ্ছন্ন রাখি, হে বিষণ্ণ মহত্ত্বরহিত মাতা
তোমাকেও |

অতিশয় প্রেম নানাদিকে যায় পথিকের |
আর স্তব্ধ লোভ গ্রীস যেন অমল মুকুট তুলে ধরে
অতগুলি বাগানের তীব্র ফল, আমি একা
অস্ত্রের গৌরবহীন
প’ড়ে আছি |

.                 *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
প্রেম
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "ধর্মে আছ জিরাফেও আছ”
(১৯৬৫) গ্রন্থের কবিতা।


অবশ্য রোদ্দুরে তাকে রাখবো না আর
ভিন্ দেশি গাছপালার ছায়ায় ঢাকবো না আর
তাকেই শুধুই বইবো বুকের গোপন ঘরে
তার পরিচয় ? মনে পড়ে মনেই পড়ে |

চিরটাকাল সঙ্গে আছে—জড়িয়ে লতা
শাখার, বাহুর নিমন্ত্রণকে ব্যাপকতা
বলার সময় হয় নি আজো ক্ষেমংকরে
তার পরিচয় ? মনে পড়ে মনেই পড়ে |
গোপন রাখলে থাকবে না আর – বাইরে যাবে
পারলে হৃদয় দুর্বলতা দেশ জ্বালাবে
মিছেই আমায় জব্দ করে
তার পরিচয় ? মনে পড়ে মনেই পড়ে

.                 *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
মনে পড়লো
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "ধর্মে আছ জিরাফেও আছ”
(১৯৬৫) গ্রন্থের কবিতা।


মনে পড়লো, তোমায় পড়লো মনে
.        বাঁশি বাজলো হঠাৎই জংশনে
লেভেল-ক্রশিং –  দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন
.        এখন তুমি পড়ছো কি হার্ট ক্রেন ?

দেড়শো মাইল পেরিয়ে গেলাম কাছে
.        বললে তুমি, এমন করলে বাঁচে
ঐ সামান্য বিদ্যাদানের টাকা !
.        সত্যি, পকেট—ইঁদুর বাদে, ফাঁকা |

এমন সময় বুদ্ধি দিলে ভারি
.        বসেছিলাম চাঁদের আড়াআড়ি
বললে, এই যে – রাখো তোমার কাছে |
.        তোমার ছবি আমার বাক্সে আছে |

মনে পড়লো,  তোমায় পড়লো মনে
.        বাজলো বাঁশি হঠাৎই জংশনে
লেভেল-ক্রশিং—দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন
.        অনাবশ্যক পড়ছো কি হার্ট ক্রেন ?

.                 *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
এবার হয়েছে সন্ধ্যা
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "ধর্মে আছ জিরাফেও আছ”
(১৯৬৫) গ্রন্থের কবিতা।


এবার হয়েছে সন্ধ্যা |   সারাদিন ভেঙেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে
তোমারও তো শ্রান্ত হলো মুঠি
অন্যায় হবে না—নাও ছুটি
বিদেশেই চলো
যে-কথা বলোনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো |

শ্রাবণের মেঘকি মন্থর !
তোমার সর্বাঙ্গ জুড়ে জ্বর
ছলোছলো
যে-কথা বলোনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো |

এবার হয়েছে সন্ধ্যা, দিনের ব্যস্ততা গেছে চুকে
নির্বাক মাথাটি পাতি, এলায়ে পড়িব তব বুকে
কিশলয়, সবুজ পারুল
পৃথিবীতে ঘটনার ভুল
চিরদিন হবে
এবার সন্ধ্যায় তাকে শুদ্ধ করে নেওয়া কি সম্ভবে ?

তুমি ভালবেসেছিলে  সব
বিরহে বিখ্যাত অনুভব
তিলপরিমাণ
স্মৃতির গুঞ্জন—নাকি গান
আমার সর্বাঙ্গ করে ভর ?
সারাদিন ভেঙেছো পাথর
পাহাড়ের কোলে
আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে
তবু নও ব্যথায় রাতুল
আমার সর্বাংশে হলো ভুল
একে একে
শ্রান্তিতে পড়েছি নুয়ে | সকলে বিদ্রূপভরে দ্যাখে |

.                 *****************             

.                                                                               
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর