কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
জুলেখা ডব্ সন
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "ধর্মে আছ জিরাফেও আছ” (১৯৬৫)
গ্রন্থের কবিতা।


ছিলো অনেক রাজার বাড়ি                  চকমিলানো হাজার গাড়ি
এবং হ্রদে সোনালি অগণন
হাঁসের দল দোলায় পাখা                      তবু তোমার সঙ্গে থাকা
চমত্কার জুলেখা ডব্ সন |
ঈশানকোণে অমনোযোগে                   মেঘের ঝুঁটি ধরেছে রোগে
দুমড়ে পড়ে প্রবলা শালবন
চাঁদ উঠেছে অন্তরীক্ষে                         মনোস্থাপন করি ভিক্ষে
তোমার জন্য জুলেখা ডব্ সন |

.                           *****************                          

.                                                                                                 
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
হলুদবাড়ি
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "ধর্মে আছ জিরাফেও আছ”
(১৯৬৫) গ্রন্থের কবিতা।


মাঠের ধারে গড়েছে মিস্তিরি
হলুদবাড়ি, সামান্য তার উঠান
ইটের পাঁচিল জাফরি-কাটা সিঁড়ি
এই সমস্ত – গড়েছে মিস্তিরি |

বাড়ির ওপর তার যে ছিলো কী টান
মুখের মতো রাখতো পরিপাটি
যাতে বিফল বলে না, বিচ্ছিরি
কিংবা শূন্য সম্মেলনের ঘাঁটি |

মাঠের ধারে গড়েছে মিস্তিরি
হলুদবাড়ি—যেখানে মেঘ করে
এবং দোলে জাফরি-কাটা সিঁড়ি
ভাগ্যবিহীন, তুচ্ছ আড়ম্বরে |

হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যাবেলা সড়ক
কাঁপিয়ে গাড়ি দাঁড়ালো দক্ষিণে
দৌড়ে এলো মজা দেখার মড়ক
নিলেন তিনি সকল অর্থে কিনে |

লোকালয়ের বাহির দিয়ে সিঁড়ি
বদল করে দিলো না মিস্তিরি !

.            *****************                          

.                                                              
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
বিষ-পিঁপড়ে
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "সোনার মাছি খুন করেছি”
(১৯৬৭) গ্রন্থের কবিতা।


সারা শরীর জুড়ে তোমার বিষ-পিঁপড়ে ছড়িয়ে দিলুম
আস্তে, যেমন জামরুলে, ঐ নীল ভিজানো গাছের ছালে
ছড়িয়ে দিলুম যেমন চাষা ছড়িয়েছিলো পুরুষ্টু বীজ
ক্ষেত ভরে যার শষ্য ওঠে, তোমার শষ্য শরীর ভরে
কুড়িয়ে নিয়ে হঠাৎ কেন বিষ-পিঁ পড়ে ছড়িয়ে দিলুম—
কারণ ছিলো ? কারণ আছে |

ঐখানে গোপন ডুবুরি তোমার জলে স্নান করেছে |
সর্ব অঙ্গে ছড়িয়ে আছে তোমার দেওয়া কুসুম-গন্ধ
হলুদ তোমার হলুদ, এই কি সারাজীবন সন্ধ্যাবেলার
সঙ্গ দেওয়া ? ভবিষ্যতের ঘর-বাঁধা খড় খুঁজতে যাওয়া ?
এই কি তোমার রাত পোহানো, পথিকে পথ দেখিয়ে আনা ?
এই কি তোমার প্রতিচ্ছবি, যে ছিলো বুক ভরিয়ে, ব্যেপে –
আপাদমাথা সারা শরীর—তাই শরীরে ছড়িয়ে দিলুম
সর্বনাশা বিষের যাদু, লুট করে হাড় ভাঙতে বাকি
ওরাই আমার সেনাবাহিনী, আমাকে সৎ সিংহাসনে
বসিয়ে রাখে সারাজীবন—

তবু আমার দুঃখ, দুঃখ হঠাৎ ঘরে ঢুকলো একা—
নও তুমিও সঙ্গিনী তার, সে এক শতরঞ্চি বেড়াল
খাটের বাজু জড়িয়ে দাঁড়ায়—তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে—
অন্ধ গলায় চেঁচিয়ে বলে, ‘আমিই কঠোর সঙ্গিনী তোর |’

.                         *****************                          

.                                                              
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
নীল ভালোবাসায়
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "সোনার মাছি খুন করেছি”
(১৯৬৭) গ্রন্থের কবিতা।


আমি সোনার একটি মাছি খুন করেছি রাতদুপুরে
তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, আঁধার-সমুদ্রে নৌকা
যেমনভাবে বেঁচে ফিরতো—তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম
আমি সোনার একটি  মাছি খুন করেছি রাতদুপুরে |
হঠাৎ ছুরি দৌড়ে এলো—হাতের মুঠো জব্দ করে
আঁধারে চালাতে বললো, যেমনভাবে মারে বৈঠা
সুখে ওপার হেঁকে বলছে, দুঃখমোচন করতে এসো
আমার পদ্মদীঘির কাছে শান-বাঁধানো ঘাটটি আছে
সেখানে কেউ কাপড় কাচে, দুঃখগ্লানি তুচ্ছ হলো –
নেশা আমার লাগলো চোখে, কে তুই মাছি দুঃখদায়ক
আমাকে বাঁধনে বেঁধে ফেলে রেখেছিস তোর কোটরে
হেঁটোয় কাঁটা – ওপরে কাঁটা, এই কি দীর্ঘ জীবনযাপন ?
এই রোমাঞ্চকর যামিনী, হায় মাছি তুই সোনারবরন !
খুন করেছি হঠাৎ আমি আমি বাঁচবো বলে একা-একাই
দূর সমুদ্রে পাড়ি দেবোই, পাহাড়চূড়োয় থাকবো বসে
চিরটা কাল চলবো ছুটে – পিছনে নেই, পশ্চাতে নেই
তদন্তে ক্রুর পায়ের শব্দ, আমায় ওরা ছেড়ে দিয়েছে

ছেড়ে দিয়েছে বলেই আমি  সোনার মাছি জড়িয়ে আছি
দীর্ঘতম জীবন এবার তোমার সঙ্গে ভোগ করেছি
এই রোমাঞ্চকর যামিনী – সোনায় কোনো গ্লানি লাগে না
খুন করে নীল ভালোবাসায় চমকপ্রদ জড়িয়ে গেলা ||

.                         *****************                          

.                                                              
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
পাখি আমার একলা পাখি      
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "সোনার মাছি খুন করেছি”
(১৯৬৭) গ্রন্থের কবিতা।


হলুদ পর্দা ছিঁড়ে ফেলতে এক মুহূর্ত সময় লাগবে –
তার পরে লুট—প্রভুর পায়ের কাছেই কি বাতাসা পড়ছে ?        
মালসা-ভোগের সময় মানায় অন্ধ হাতে ধুলোর মুঠি ?
জিভ হলুদ বাসনার কাঠি, তাতেই খাঁচা তৈরি হতো –
পাখি আমার একলা পাখি, একলা-ফেকলা দু-জন পাখি |

স্বাদু ফলের চতুর্দিকে জালের তৈরি শক্ত বেড়ায়
বাদুড় তুমি একলা পড়ো, আমি দাঁতেই কাটছি সুতো
ঢুকবো সমুদ্দুর-লেগুনে –নীল জলে লুটোচ্ছে মোহ
আধভেজা ফুল-শায়ার মতন, সেই শায়াতে জড়িয়ে আছে
জল, জেলি, লোভ, রক্ত আমার—
পাখি আমার একলা পাখি, একলা-ফেকলা দু-জন পাখি |

বাবার হাতে তৈরি আমি, এক মুহূর্তে ভাঙবো পিঠের
উল্টে-রাখা সাধের সিন্দুক—মোহর মেজেয় পড়বে ঝরে
নীল জলে লাল পাথরকুচি আষ্টেপৃষ্ঠে আলিবাবার
আমি একটি সোনার মাছি মাড়িয়ে ফেলবো রাতদুপুরে
স্বাদু ফলের চতুর্দিকে জালের তৈরি শক্ত বেড়ায়
বাদুড় তুমি একলা পড়ো --- আমি সিন্দুকে সাঁতার কাটছি |

পাখি আমার একলা পাখি, একলা-ফেকলা দু-জন পাখি
লাগছে ভালো—সারাজীবন খাঁচার মধ্যে, বাসনা-কাঠি
ঘিরে রেখেছে ন্যাংটো শরীর—এদেশে কাপাস ফলে না
খাদ্য-জলের নেই ব্যবসায়, তাই থুতু-পেচ্ছাপর ভক্ত
সব শরীরটা ঠুকরে খেয়েও দু-জোড়া ঠোঁট বাঁচিয়ে রাখা
নোংড়া পাখি, নোংরা পাখি—নোংরা-ঠোংরা দু-জন পাখি |

.                         *****************                          

.                                                              
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
বহুদিন বেদনায় বহুদিন অন্ধকারে
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হেমন্তের অরণ্যে আমি
পোষ্টম্যান” (১৯৬৯) গ্রন্থের কবিতা।


বহুদিন বেদনায়, বহুদিন অন্ধকারে হয় হৃদয়ের উদ্ ঘাটন
সে-সময়ে পর্দা সরে যায় প্রাচী দিগন্তের দিকে—
যে-সময়ে মেহগনি খাট ডুবে যায় মেঘে-মেঘে
যে-সময়ে মনোহর প্রত্যভিবাদন নিতে ধানক্ষেতে নেমে আসে চাঁদ
অন্ধকার অবহেলা অন্ধকার বড়ো বেদনার—
সে-সময়ে হৃদয়েরই উদঘাটনে ভাসে মুখবাঁধা ঈগলবকের ঝাঁক একই দলে,
হলুদ পাতায় ভরে যায় নদীদের বটতলা,
সে-সময়ে তোমাদের বাড়ির কাউকে দেখা গেলে
.                      ( এমনকি অতিচেনা রোমশ বিড়াল ! )
সিন্দুরের ফোঁটা তার কপালে দিতাম এঁকে, তবে
তোমরা সকলে মিলে বুঝে নিতে সময়সংকেত –
.             সেই লোকটির হাতে এ-ফোঁটা পরানো হয়েছিলো |

অতি আদরের পথে গলির বারান্দা ভালোবেসে
শেষবার সেই লোক কাহাদের বিড়ালেরই সাথে
.             করিয়াছে মুখোমুখি দেখা !
অবহেলা তোমাদের, অবহেলা তাহার তো নয়—
অমর নারীর মতো তোমরা করিতে পারো খেলা,
.              তাহাদের সে-সময় আছে ?
এই তো সেদিন আমরা আমাদেরই জন্মদিনে করেছি গ্রহণ –
.                                                             বয়সের পরচুলা |

বয়স তো কারো একা নয় ?
বয়স দাঁড়িয়ে থাকে কোনো মাঠে স্কেলকাঠি হয়ে—
মানুষ মাপিতে যায়, মানুষী মাপিতে যায়, বালকেরা হাসে—
৫’- ৩“-এ হয়ে যায় মনোরমা কাপ নির্বাচন !
বহুদিন বেদনায়, বহুদিন অন্ধকারে হয় হৃদয়ের উদ্ ঘাটন
সে-সময়ে পর্দা সরে যায় প্রাচী দিগন্তের দিকে |

.                       *****************                          

.                                                              
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
এবার আসি
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হেমন্তের অরণ্যে আমি
পোষ্টম্যান” (১৯৬৯) গ্রন্থের কবিতা।


সবাই বলতো পিঠে একটা কুলো বেঁধে নাও
চলো
পাঁচনবাড়ি উঁচিয়েই আছে
মারের ডগায় সদাসর্বদাই এগিয়ে যেতে পারবে
চলো
যেতে যেতেই এপাশ-ওপাশ দেখা যাবে
মাঝ বরাবর রাস্তা
রাস্তা বলতে সাপ-নাগালে উঠি-মুঠি আলপথ
তাতে পা দিলেই নজরালির তালপুকুর
মিটমিট করছে জমি-জেরাত

সুতরাং, চলো
যেতে যেতেই এপাশ-ওপাশ দেখা যাবে
উড়ো চাল চূড়ো বাড়ি
ঐ তো বদু বুড়োর ছিলো
আজ নেই ?
না |
না মানে, কবলা-কসরৎ দিগ্ ব্দিক ক’রে
মাগ-ভাতারে বদু বুড়ো সাপ্ টে খুইয়েছে সবই
আছে আছে
সব গেলেই সব যায় না
কিছু আছে
উনুনমাটির গা চিতিয়ে চওড়া হয়েই আছে
ছাই
শপথ করো
হারলেও কেন ছাড়বে না
শপথ করো, কেননা
--ঐখানেই তোমার জিৎ
তুমি মীমাংসার পক্ষপাতী
অবুঝের সঙ্গে লড়ে লাভ ?
ছিঃ

আজই তৈরি করেছি
সাঁকো
যেখানেই থাকো
একবার মন-মন কাজে এলেই হবে
এবারের উত্সবে
কানা-খোঁড়া সবাইকে চাই
হাতের লাটাই
আর ঘুড়ি
দু-তরফ, হা ভাইজান, থুড়ি
চারোতরফ মিলমিশই তো মেলা
সুতরাং
যেখানেই থাকো
একবার মন-মন কাজে এলেই হবে
এবারের উত্সবে
কানা-খোঁড়া সবাইকে চাই

চলো চলো
যেতে-যেতেই ইস্টিশান পাবে
ফেরা-ফিরতি লোক দেখবে বিস্তর
কিন্তু ঐ দেখা পর্যন্ত
মুখ-শোঁকাশুঁকি করার সময় নেই
জলের দরে জমি বিকোচ্ছে
হোগলাবনে মটকা মেরে পড়ে আছে রোদ্দুর
বাঁশঝাড়ে লুটপাট আবছায়া
তবু, ও-সব বিচার তোমার নয়
তোমার নয় ছাঁদনাতলা পোর্টার-পাখি
টিকিটের ওপর কেবলই যাত্রার ছাপ
দোলের রঙে রঙিন কুকুর পথে বেরিয়েছে
তোমার নয় মৌসুমি সমুদ্রের ভারাক্রান্ত প্রসববেদনা
তোমার নয় আদায়-তশিল, ধারকর্জ—
চলো চলো
যেতে-যেতেই ইস্টিশান পাবে
ফেরা-ফিরতি লোক দেখবে বিস্তর
কিন্তু ঐ দেখা পর্যন্তই

মই
কিংবা সিঁড়ি
দুজনেরই বাসনা বিচ্ছিরি
সুতরাং—চলো
যেতে-যেতেই ইস্টিশান পাবে
দাঁড়াবে
পা তুলে বক
আর কিছু না-হোক
ফলারটা বাঁধা
সা রে গা মা পা ধা
স্কুল-পাঠশালা বন্ধ
ফিরতে আনন্দ নয়, যেতেই আনন্দ

ভালো আছো ?
মন্দ কি ?
দুটোই একবগ্ গা প্রশ্ন
উত্তরের বদলে দক্ষিণ
নাকের বদলে নরুন
ঐ বদল কথাটাকেই সমর্থন করুন
এবার আসি
সাতগাঁয়ে আমিই এক চলার লোক
পথটাও কম নয় নিতান্ত
কেই বা জানতো
পথের দুপাশে খাড়াই
ইচ্ছে করে ছাড়াই
হাড়-মাস পেথ্বক করি
দুর্গা দুর্গা হরি

এবার আসি
সুতরাং, এবার আসি ||

.         *****************                          

.                                                              
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
স্বপ্নের মধ্যে গোয়ালিয়র মনুমেন্ট, তুমি
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হেমন্তের অরণ্যে আমি
পোষ্টম্যান” (১৯৬৯) গ্রন্থের কবিতা।


স্বপ্নের মধ্যে, শুধুই স্বপ্নের মধ্যে, গোয়ালিয়র মনুমেন্ট তুমি—
.                                   ইটকাঠের স্তূপ রাজস্থানী মার্বেল
তুমি উদার—ঠিকঠাক শপথ রেখেছিলে
তোমায় নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করি আমি
.                                         মহান খেলনায় গিয়ে পৌঁছুলাম
এ-বয়স খেলনার নয়, হেলাফেলা সারাবেলা নয়,
.                    রবীন্দ্রনাথের মতন নয় গঙ্গাস্তোত্রে গা ভাসানো
আমার সুসময় দুঃসময় দুটোই অল্প
রেলগাড়ির ব্রিজ আর কতোটুকু ? আমি সেই ব্রিজের মতন
.                                      অল্পসল্প হাহাকার –ব্রুকলীন ব্রীজ
নই হার্ট ক্রেন আমেরিকান কবির
মিটিঙে সবাই বলে, আমি তোমাকে ট্রেনের সঙ্গে মেলাতে চেয়েছিলাম
অথচ তুমি জানো সবই--- আমাদের মিল-মিলন হবার নয়
তুমি দূর ছায়ার মধ্যে গণ্ডোলায় ভেসে বেড়াচ্ছো   
আমার স্বপ্নের মধ্যে, শুধুই স্বপ্নের মধ্যে গোয়ালিয়র মনুমেন্ট,
.                          আষ্টেপৃষ্ঠে গোয়ালিয়র মনুমেন্ট ইটকাঠের স্তূপ
.                                                                   রাজস্থানী মার্বেল
তুমি উদার – ঠিকঠাক শপথ রেখেছিলে |

প্রথম ফুল ফোটার দিনে একঝলক কিশোরীর আলুস্থালু
.                          অলিগলি পেরিয়ে পেয়েছিলাম তোমার, কবিতার
সিঁড়ি – একলা অবাক নির্জন সিঁড়ি—যা কোনদিন
.                                  প্রাসাদে পৌঁছায় না
শুধুই সিঁড়ি, একলা অবাক নির্জন সিঁড়ি আর
.                                  কম্যুনিষ্ট ম্যানিফেস্টো—
দূর ছাই ! কি পাগলের মতন আবোলতাবোল –
.                                  কবিতা লেখার কথা আমার
সিঁড়ির কথা রাজমিস্তির, হলুদবাড়ি – তাও রাজমিস্তিরির
.                                  কবিতা লেখার কথা আমার
স্বপ্নের মধ্যে, শুধুই স্বপ্নের মধ্যে গোয়ালিয়র মনুমেন্ট তুমি—
.                                  ইটকাঠের স্তূপ রাজস্থানী মার্বেল
তুমি উদার—ঠিকঠাক শপথ রেখেছিলে
হাতের পরে মাথা রেখেছিলে, দুই ঊরু ভ’রে রেখেছিলে কার্পাস
.           শুধু চীনেবাদামের খোসা ছড়ানো আমার কবিতার সঙ্গে
.                                                              মিশ খাচ্ছে না
এরায়কণ্ডিশনিং-এর ক্ষেত্রেও বাদামের খোসা নিষিদ্ধ ! চুম্বন নিষিদ্ধ
তাম্রকূট আইন ক’রে বন্ধ করা, দূর ছাই !
কবিতার কাছে যতো কথা জড়ো করছি ততোই ছড়িয়ে পড়ছে
তোমার-আমার মনের স্বপ্নের সাধের মতন—বাতাস নেই,
.                  গাবভেরেণ্ডার পাতা নড়ছে না—জোয়ারের জল
তবু ছড়িয়ে পড়ছে, শুধুই ছড়িয়ে পড়ছে |

.                              *****************                          

.                                                              
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
কাল রাতে জাগিয়ে রেখেছিলো আমায় পুরানো চাঁদ
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হেমন্তের অরণ্যে আমি
পোষ্টম্যান” (১৯৬৯) গ্রন্থের কবিতা।



কাল সারারাত অতিশয় স্বপ্নে স্বপ্নে বিদ্যুচ্চমকে জাগিয়ে রেখেছিলো
.                                                     আমার পুরানো চাঁদ
পাল্লাদাস ক্ষণে ক্ষণে আমায় সেই স্বপ্নছায়াময়ঘুম থেকে জাগিয়ে বলেছিলো
এই তো গ্রীসদেশ, এখানে কেউ ঘুমায় না—
তখনই চাঁদ অস্পষ্ট কালো এক ঝিনুকের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো
আমার আর গ্রীসদেশ দেখা হলো না—
দেখা হলো না পাল্লাদাসের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে
.        অসচরাচর গ্রীসের হাজার হাজার বছরের শৌখিন সমাধিস্তবক
.                                                                         বাগানের ফুল
সারারাত অকুন্ঠ নতুন মৌসুমির মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম আমি
মেঘের খাঁজে খাঁজে ছিলো আলো আর আঁধার
রূপসীর বগলের কনিফেরাসের মতো
কঙ্কাল পাঁজরের মতো, নতুন ভয়েলের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল মেঘ
.                                                       আমার মাথার উপর
আমার করুগেট ছাদের উপর গোলাপায়রা ছুটি-হাওয়া ইস্কুলের মতন
.                                                             বসেছিলো
এতো আলো, মেঘ এতো, শেফালিলতা ভরে মখমলের মতো এতো
.                                                              সনির্বন্ধ গাঁদাফুল
আমারও কাজে লাগলো না আজ
যেমন বিষণ্ণভাবে আমি
যেমন বিষণ্ণভাবে ভগবানের সঙ্গে কথোপকথন করে ব্রাহ্মণ
তেমনভাবে তোমার স্মৃতিগুলি কররেখা আঁচ করার মতো
.                          মুখের উপর তুলে ধরেছিলাম আমি
কাল সারারাত অতিশয় স্বপ্নে স্বপ্নে বিদ্যুচ্চমকে জাগিয়ে রেখেছিলো
.                                                                    আমার পুরানো চাঁদ
তোমাদের উঠানের সঙ্গে সাগরের এক গোপন বৈঠকে আমি
তরণীমুক্ত যাত্রীর মতো বিহ্বলতায় সরে গিয়েছিলাম
কাল সারারাত ধরে এক অন্ধকার গ্রীসদেশে পাল্লাদাসের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে
.                                                              কিছুই দেখিনি আমি
কতোদিন সমাধি-প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসেছি
টেলিফোন করে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো বলে বেরিয়ে আর
.                                                      নিজের সমাধি খুঁজে পাচ্ছি না
যেখানেই দাঁড়াই সবাই বলে—আমিও একা আছি—তুমি ঢুকে পড়ো
.                                                    কয়েকদিনের জন্য থেকে যাও
কতো লোক তো ভুবনেশ্বরে বেড়াতে যায়—ছুটিছাটায় –
তাদের অন্তিম আতিথ্যে মনে পড়েছিলো তোমাদের কথা কালরাতে
.                                             স্বপ্নে স্বপ্নে বিদ্যুচ্চমকে পুরানো চাঁদে
তোমরা সকলেই তোমাদের আপনাপন কবরে শুয়ে রয়েছো
তোমার বোন চারুশীলা পরীক্ষার পর কবরে শুয়ে আমার কবিতা
.                                                  কাঠি দিয়ে ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছে—
কোথায় ওর দিদির কথা, কোথায় বা ওর দিদির প্রতি তরুণ কবির প্রেম !

একটি তারা দেখে দ্বিতীয় তারা খুঁজে বেড়াচ্ছে কবর থেকে মুখ বাড়িয়ে –
.                                                               মঙ্গল করো        
কলকাতার মৌলালিতে পাইপের ভেতর অমন মুমুক্ষু দেখেছি আমি অনেক
বৃষ্টির দিনে দেখছ সঞ্চরমাণ ট্রাম স্টিমারের মতো
কালরাতে এমন অন্ধকার গ্রীসদেশে ঘুরেছি আমি অনেক

নতুন মৌসুমির পানে হাত পেতে কাল সারারাত আমি চাকুরিপ্রার্থী
.                                             চাঁদের প্রতি তাকিয়ে বসে ছিলাম
আমাদের উঠানে ছেলেদের রবারের বল একটি পড়েছিলো
আমাদের উটানে ইমারত তৈরি হবার উপযুক্ত কড়িবরগা ছিলো পড়ে
আমাদের উঠানে উলোটপালোট খাচ্ছিলো
.                   পাল্লাদাসের সমাধিফলকে দুর্নিরীক্ষ ডার্জ..

কিছুক্ষণ আগে গ্রীস থেকে বেড়িয়ে ফিরলাম আমি
যারা যারা আমায় নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলো
.                   তাদের সকলের সমাধি আমি অন্ধকারে এসেছি দেখে
এপিটাফ এপিটাফ এপিটাফে ভরে গিয়েছি আমি
চৌরঙ্গির দশফুট উঁচু দেয়ালের মতো পোস্টারে ভরে গিয়েছি আমি
তোমায় লেখা চিঠি আমার দেড় বছর পরে ফিরেছে কাল—
এপিটাফ এপিটাফ এপিটাফে ভরে গিয়েছি আমি
কাল সারারাত অতিশয় স্বপ্নে স্বপ্নে বিদ্দ্যুচ্চমকে জাগিয়ে রেখেছিলো
.                                                     আমার পুরানো চাঁদ |

.                              *****************                          

.                                                              
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর
*
মজা হোক – ভারি মজা হোক
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়
“শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হেমন্তের অরণ্যে আমি
পোষ্টম্যান” (১৯৬৯) গ্রন্থের কবিতা।


তোমায় একটা লাল বুলবুলি কিনে দেবো, ঢেউয়ের মতন ঝুঁটি তার
এখন একটু চুপটি করে বসে থাকো
আমি একটি হাত টেবিলের তলা দিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছি, সেই হাতে
ভুবন ধরার মতো তোমার পদতল ধরে রাখো
আমিও চুপটি করে বসে থাকবো
তুমি আমায় একটা লাল বুলবুলি কিনে দেবে
.                                              ঢেউয়ের মতন ঝুঁটি তার
আমরা দুজন ওদের আদর-আহ্লাদের ফাঁকে ফাঁকে
.                                              নাচ-নাচুনি কোঁদল দেখবো |
আমি বিষয়টা খুব নম্রভাবেই শুরু করতে চাই
চুলের টায়রা থেকে শুরু করার উচ্চাভিলাষ আমার নেই
বুলবুলিটা কথার কথা—বলতে হয় বলেই বললুম
.                                              ঘুষ-ঘাষের কথা নয় তো |
তবু একটা চেড়ার আড়াল, একটা ফর্ম থাকা ভালো |

তোমার বুক দেখলে আমার মেদিনীপুরের কথা মনে পড়ে
দেশ-গ্রাম নয়—সুদ্দু ঐ মেদিনী শব্দটা
নাম বদলে মাঝে-মাঝে ‘মেদিনীদুপুর’ করতেও ইচ্ছে হয়—
দুপুর, মানে দুখানা, দুখানা মানে দু-বুক—

এতো খুলে না বললেও চলতো, চেড়ার আড়াল তো
.                                                       মোটামুটি পছন্দই করো
তবু আচারের তিজেল খুলে হাত গুটিয়ে বসে থাকে সাধ্য কার ? একা ?
বিষয়ের মুখোমুখি ?
সমালোচকের কানে গোঁজা পেন্সিল তক্ষুনি গদ্যপদ্য কাটাছেঁড়া করতে
.                                                        নেমে আসবে না ?
বহুকাল বাদে তোমাকে পেয়েছি, তোমায় পেয়ে আমাকেও পেয়েছি
ভারি মজা করার ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু
এসো, দুজনেই আঁধার করা টেবিলের তলে সেঁধিয়ে পড়ি
মজা হোক—ভারি মজা হোক একখানা
বিনি টিকিটে বহু লোককে হাসানো যাক
ঐসব মন-খারাপ মজাদিঘি ব্যাঙ-বাবাজি লোক ঠেকিয়ে
.                                                          ভীষণ মজা হোক |

.                              *****************                          

.                                                              
সূচিতে . . .     

মিলনসাগর