মন্দিরে, ঐ নীল চূড়া কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "হেমন্তের অরণ্যে আমি পোষ্টম্যান” (১৯৬৯) গ্রন্থের কবিতা।
মন্দিরে ঐ নীল চূড়াটির অল্প নিচে তিনি থাকেন একমুঠি আতপের জন্যে ভিক্ষাপাত্র বাড়িয়ে রাখেন দিন-ভিখারি
অদূরে দেবদারুর সারি ঘন ছায়ার গুহার দ্বারায় আকাশ ঢাকেন মন্দিরে, ঐ নীল চূড়াটির অল্প নিচে তিনি থাকেন |
যার যা কিছু সস্তা, মোটা, উচ্চতাময় কিংবা নিচু বিঘত্খানেক দীর্ঘ এমন ডাল থেকে তাঁর এই উপহার সংগৃহীত তুচ্ছ জবার |
সামান্য হয় তাঁর পূজাতে নষ্ট সময় . এবং তিনি আমার চেয়ে ভালোবাসেন তরঙ্গিণীর দু-হাত ফাঁকা, রক্তে মাখা ওষ্ঠ, করুণ— চায় না ক্ষমা তরঙ্গিণী পাপের দরুন !
অবসর নেই - তাই তোমাদের কাছে যেতে পারি না কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি” (১৯৭১) গ্রন্থের কবিতা।
তোমাকে একটা গাছের কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবো সারা জীবন তুমি তার পাতা গুনতে ব্যস্ত থাকবে সংসারের কাজ তোমার কম—‘অবসর আছে’ বলেছিলে একদিন ‘অবসর আছে – তাই আসি |’
একবার ঐ গাছে একটা পাখি এসে বসেছিলো আকাশ মাতিয়ে, বাতাসে ডুবসাঁতার দিয়ে সামান্য নীল পাখি তার ডানার মন্তব্য আর কাগজ-কলম নিয়ে বসেছিলো ‘হ্যাঁ, আমি তার লেখাও পেয়েছি |’
ক্কচিৎ কখনো ঐ পথে পথিক যায় আমায় এসে বলে—‘বেশ নির্ঝঞ্ঝাট আছো তুমি যাহোক !’ আমার হিসাবনিকাশ, টানাপোড়েন, আমার সারাদিন ‘অবসর নেই—তাই তোমাদের কাছে যেতে পারি না |’
সন্ধে হয়, ইস্টিশানের কোমরের আকন্দ ফুলগুলি ফুটে ওঠে আমার কষ্ট হয় কেমন আকন্দ-র নাকছাবি তোমায় মানাতো বেশ পাতার একটা থোক হিসেব পাঠাতে তত্পর হয়ো— ‘তাছাড়া, কম দিন তো হলো না তুমি গেছো !’
দুপুররাতের কথা তোমাদের কিছু কানে গেছে জ্যোত্স্নায় গাছের ভিতরে পা ছড়িয়ে বসো তুমি ‘গতমাসে একটা রান্নাঘর তৈরি হবার কথা জানিয়েছিলে হোটেলের ভাত-ডাল তাহলে আর তেমন পুষ্টিকর নয় ?’
জীবনে হেমন্তেই তুমি ছুটি পাবে— পুরীতেও যেতে পারো—ফিরতি পথে ভুবনেশ্বরটাও দেখে এসো, আবার কবে যাও না-যাও ঠিক নেই –
আমার হিসাবনিকাশ টানাপোড়েন, আমার সারাদিন ‘অবসর নেই—তাই তোমাদের কাছে যেতে পারি না |’
পোকায় কাটা কাগজপত্র কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি” (১৯৭১) গ্রন্থের কবিতা।
পোকায় কাটা কাগজপত্র দেখলে শব্দ মনে পড়ে – ফ্যান্ জোলেঙ্গা অর্থবিহীন, কিংবা অর্থে জবরদস্ত উলঙ্গ কিশোরী তোমার মাই দুটো সন্ন্যাসেই মস্ত হেন্ করেঙ্গা, তেন্ করেঙ্গা !
‘ফ্যান্ জোলেঙ্গা’ শব্দ যেন হাঁ-করা রমণীর মুখেই চিক্-ঢাকা বারুদের মতন—জোচ্ছনায় বাঘ পেতেছে ওৎ হাতচিঠি, যা হঠাৎ, তাকে হাফগেরস্ত সুখ-অসুখে কিংবা তোমার বাহ্যে-বমির কীর্তিনাশা একটানা কোঁৎ কোথায় যে শব্দ-গঙ্গোত্রী ? দিগ্ বিদিকে চলছি খুঁজে উইঢিবি, ক্যাকটাসের মধ্যে হ্যামেলিনের বাঁশির ইঁদুর ফাঁদ্ রাফাঁই চাঁদোয়ার মধ্যে দূরদেশী গুম্ফা গম্বুজে টেরা চাঁদের মতন কিংবা ফ্যানজোলেঙ্গা—টাকের সিঁদুর ?
হয়তো আমার লক্ষ জীবন লাগবে নিছক গবেষণার গায়ে পলেস্তারা পরাতে – আরেক কথা, হোহেনজোলার্ন পড়লে মনে, ভাবতে বসি, কবিতা কি সত্যি হবার বিষয় ? নাকি মুদ্দ-ফরাস ঘুরতে গেছে মার্টিন ও বার্ণ—
এই মিলেতেই পদ্য মাটি, আলোকরঞ্জন হলে বাঁচাতেন কিংবা সুনীল অ্যাংলো-সাক্সন হার ছিঁড়ে একটুকরো মুক্তোয় আমার পিতাঠাকুর শুনেছি এঁটো হাত নিট্ মদ্যে আঁচাতেন ভোজ্যদ্রব্য বলতে আমার বিউলুডাল, একবাটি সুক্তো |
কীসের জন্যে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৭৩) থেকে নেওয়া। "প্রভু নষ্ট হয়ে যাই” (১৯৭২) গ্রন্থের কবিতা।
সমস্ত যন্ত্রণার চেয়ে বড়ো ধরনের যন্ত্রণা পাই আঁচড়ে-কামড়ে নিজেই মরি গা-ভর্তি ঘা, রক্ত পড়ে, জিউলি গাছের আঠার মতন রক্ত আমার রক্ত পড়ে—বড়ো ধরনের যন্ত্রণা পাই কীসের জন্যে নিজে জানি না ! মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে কারণ, নাকি উড়োজাহাজ ? কারণ, নাকি হলুদবাড়ি ? বলতে এলে বেঁধে ঠেঙাবো, কারণ আমার ছ্যাক্ রাগাড়ি উল্টোপথেই চলবে শুধু, আমি তোমার দেশেও স্বাধীন ! যার করতল নেই সে কাকে ভিক্ষে দেবে ? যার করতল নেই সে বুকে হাত বুলোবে ? উলুকঝুলুক করবে এবং বলবে – অসীম ভালোবাসার রোদন আমার হে কস্তুরী –
অনেক কথা বলবো বলে উঠেছিলাম মঞ্চে যখন মিটিং হঠাৎ ভেঙে যাচ্ছে – লম্বা ঘড়ি গা ঘষছে গোল ঘড়ির সঙ্গে – দুই নাবালক বলছে, ভারি যন্ত্রণা পাই— যন্ত্রণা কি চালের কাঁকর ? ফুটবলে ফাঁক ? হাঁটুর ব্যথা ? যন্ত্রণা কি ভালোমানুষ সবার হাতেই তালি বাজাবে ? মিষ্টি খোকন, তোদের লেখা পড়তে পারি এমন লেখা লেখ্ না যেমন লম্বালম্বি দীঘির ধারে পথের রেখা !
সমস্ত যন্ত্রণার চেয়ে বড়ো ধরনের যন্ত্রণা পাই আঁচড়ে-কামড়ে নিজেই মরি গা-ভর্তি ঘা, রক্ত পড়ে, জিউলি গাছের আঠার মতন রক্ত আমার রক্ত পড়ে—বড়ো ধরনের যন্ত্রণা পাই কিসের জন্যে নিজে জানি না ||
এখানে কবিতা পেলে গাছে-গাছে কবিতা টাঙাবো কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৮২) থেকে নেওয়া। "সুখে আছি” (১৯৭৪) গ্রন্থের কবিতা।
একটি সভায় আমি গেছি বসে কাঠের চেয়ারে— সম্ভবত টিন, যার রং লাগে প্রত্যেকের পিছে তাই দেখে পথচারী গোয়েন্দার চোখের মতন মেয়েদের চোখ হয়, মেয়েরা কী যেন ভাবে তাকে—
এ বাবা গেরস্ত নয়, আলাভোলা, কবির আত্মীয় হয়তো নিজেই লেখে, না তো ছাপে অন্যের প্রতিভা ! কিছু একটা করে ওই কবিত্বের সঙ্গে মিলেমিশে হাত মারে, হেগে যায়—রঙিন পিচকারি কিনে ভরে ভাষার সাবান জল তারপর ছড়ায় ছিটোয় বিভিন্ন কাগজে. . . এভাবেই, যেন গাছ, ছাদ ফুঁড়ে আকাশের দিকে বেড়ে চলে, জীবন্ত বলেই বাড়ে, প্রাসাদ বাড়ে না বোদ্ধার ইটের দাঁতে ছায়া মেলে, বরং ঝিমায় ঘরবাড়ি, ফলমূল, স্বপ্নরাজ্য, কুকুরের বিচি |
তেমনি সভায় আমি বসে আছি টিনের চেয়ারে পাশেরটি হাত দিয়ে ঢেকে রেখে ছিলাম খানিক কাউকে বসাবো যার মুখে টক পচা গন্ধ নেই পরিচ্ছন্ন ভদ্রলোক, কবি নয়, নোংরা শ্রোতা নয় গন্ধে গোলাকার নয়, অধিকন্তু, দুই কানে শোনে ! এখানে শোনে না কেউ, কথা বলে, বর্ণনার কথা ভিতরের কথা নয়, কানে-কানে কথা নয় কোনো |
সেই সভাটিতে গিয়ে, শুয়ে বসে, মলত্যাগ করে আমি খুবই বিষণ্ণতা বোধ নিয়ে বর্তমানে আছি একাকী, বান্ধবহীন | ওরা স্থির সুস্নিগ্ধ যেহেতু কবি বলে-দুঃখ পায়, শরীর তছরূপ করে পায় আনন্দ, আনন্দ ! হায়, আনন্দ কোথায়, কে তা জানে ?
বাস্তবিক যেন হাওয়া, দুরন্ত অবাধ্য ঝঞ্ঝা আমি ছুটেছি যেখানে হেঁটে যাওয়া ছিলো প্রকৃত সঙ্গত গাছের ভিতর দিয়ে একদিনই পরিত্রাণ নেবো মানুষের শহরের হাত থেকে ছুটি নেবো ঠিকই যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যাবো, ভ্রূক্ষেপ করবো না এলোমেলো করে যাবো গ্রাম, বন, মানুষ, বসতি সমস্ত, সমস্ত | কিন্তু, এভাবে কি কিছু পাওয়া যাবে ?
কিছু, মানে কোন্ কিছু কার কিছু ? কার জন্যে কিছু ? উত্তর জানি না বলে সেই কোন্ প্রত্যূষে উঠেছি উঠে থেকে হেঁটে চলা—কোনোদিকে, হাঁটার অসুখে শুধু যাওয়া শুধু যাওয়া – যেতে যেতে পিছু ফেরা নয় পিছনে সভায় দীর্ঘ কাব্যপাঠ, কাব্য-আক্রমণ আমায় হাঁ করে খাবে শহরের উদ্ভিদ-গলিতে |
আমাকে চেনে না কেউ এদেশের নুড়ি ও পাথর যেখানে এসেছি আমি বুঝে নিতে এবং বোঝাতে মহিষের পিঠে চড়ে চলে যেতে উদাসীন সুখে. . . আমার পিঠেও তাকে কোনো কোনো দিন তুলে নেবো— এই পরস্পর, এই সর্বশক্তিমান দেওয়া থোওয়া কখনো বুঝিনি আগে, কখনো চড়িনি বলে মোষ ! এখানে কবিতা পেলে গাছে গাছে কবিতা টাঙাবো |
এই বাংলাদেশে ওড়ে রক্তমাখা নিউজপেপার বসন্তের দিনে! কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৮২) থেকে নেওয়া। "সুখে আছি” (১৯৭৪) গ্রন্থের কবিতা।
দূরের পাহাড়তলি কিংবা তুমি দিনান্তের রেখা . নীল জল অথবা হাউই তুমি তীরন্দাজ করে খরগোশ ধরছো . অতসী কুসুমশ্যাম হৃদয় তোমার . স্বদেশে বিদেশে মিশে শ্রাবণ কি তুমি ? ভালোবাসা দিলে তবে ভালোবাসা পাবে . তোমার যোগ্যতা গূঢ় নিশ্ছিদ্র অতীত নিয়ে তুমি করো খেলা . তোমার লাটাই ভালো চাঁদ বেনে উড়ে যায় কোঙ্কন সিংহল . ব্লিজার্ড ! ব্লিজার্ড !
পুবদিকে দেখা যায় চার্চ, সলেমন তোমরা যেখানে করো বসবাস সেখানে অন্তত . বিশুর নাপিত আসে— এই ঘনিষ্ঠতা, এই এজেন্সি মারফৎ তোমাদের কাটাছেঁড়া, ধর্মযুদ্ধ—নীল ও লোহিত . পোপের জন্ম ও মৃত্যু . ‘উনি কি ফ্যাসিষ্ট ?’ এই বাংলাদেশে ওড়ে রক্তমাখা নিউজপেপার . বসন্তের দিনে বসন্তের দিনে করে বসবাস নেপথ্য ও স্টেজ হিন্দু ও অহিন্দু করে কোলাকুলি, হত্যা, মুষ্ট্যাঘাত !
. চেতনার মতো এই অচেতনা শিখিয়েছো তুমি . তুমি ধর্মমত তুমি যৌন তুমি কামিনীকাঞ্চন তুমি কোষাগার তুমি উচ্চাকাঙ্ক্ষা তুমি ধানজমি তোমার দুষ্কৃতি তুমি ব্রাহ্মণের, চণ্ডালের নও | অন্তরের ঘাম থেকে মুক্তি নেই—মুক্তি নেই কোনো . আবিল পাঁকের থেকে মুক্ত নেই বিদগ্ধ হ্রদের মাছরাঙাদের মতো ওড়ে পেটিকোট তুমি সন্তর্পণ, তুমি শ্মশানের মাঝে বাড়ি করো হৃদয়ের দিনের মতো চঞ্চল তোমার আনাগোনা . দুপুরের থরো-থরো শটিক্ষেত, আখরোট বাদাম তুমি সব পেতে পারো ধর্মাধর্ম – তুচ্ছ ক’রে প্রেম !
এই পথে দেবদারু—বাদুড়, বনের ভাঁট ফুল দেয়ালে দেয়ালে জমা ম্যাজেন্টা ক্রিমজন . মজাদি কি, ভাঙাগ্রাম, দোলমঞ্চ—ব্যর্থ স্থপতির . নশ্বর হাতের কাজ, . ভালোবাসা ? . জোনাকির আলো— . এ কি সব ?
চাঁদের অপরিসীম ক্লান্তি, তাই দূরে আধোলীন . নিকটে আসে না যেন ভুল হবে চরিতার্থতার শেষে আছে কি বিস্ময়ে-ঘেরা দেশ মুক্তির সংশ্রবহারা এ দিনযাপন ? কিংবা মুক্তি মৃত্যু ও শৈশবে |
রাজার বাড়িতে আজ ভোজসভা . তীর্থে প্রিয়নাম তুমি না আড়াল থেকে জনতার, চাক্ষুষ রাজার ! . তুমি কোন্ পথে যাবে ? কার সংবত্সরের ধৈর্য নেবে ? কোন্ অন্নকূট ? . তুমি ধর্ম-পুরোহিত . নিচ্ঞিয়তা তোমার নিয়তি একত্রে করেছো তুমি বর্তমান অতিবর্তমান . ছায়া-ছলনাকে করো সমাসীন . তুমি সব পারো তোমার যোগ্যতা আর স্বাধীনতা অনির্বচনীয় |
ধীরে ধীরে দ্বার খোলে গূঢ়তার, রহস্যবোধের শুকতারা তুলে ধরে অন্ধকার কুঁড়ির চিবুক . --- পছন্দ না হয়ে যায় ! আরো পরিস্ফুটতর হবে
পৃথিবীর অতীতের পারা তাকে স্বচ্ছ করে তোলে মুহূর্তেও ধরা পড়ে প্রতিমুহূর্তের ভূকম্পন মানুষের ধর্ম থেকে মানুষের এই ফিরে যাওয়া . স্তব্ধ হয় চিরঅকস্মাৎ দ্বার খোলে গূঢ়তার, দ্বার খোলে রহস্যবোধের শুকতারা তুলে ধরে অন্ধকার কুঁড়ির চিবুক . --- পছন্দ না হয়ে যায় ! . আরো পরিস্ফুটতর হবে |
আজ সকলই কিংবদন্তি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৮২) থেকে নেওয়া। "ঈশ্বর থাকেন জলে” (১৯৭৫) গ্রন্থের কবিতা।
এক হতচ্ছাড়া যুদ্ধ চাই কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৮২) থেকে নেওয়া। "সুখে আছি” (১৯৭৫) গ্রন্থের কবিতা।
আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে আমার ক্ষুধা আর প্রাণপণ গাছের শিকড় যেন আমি মাটি, যেন কলকাতার প্রধান সহ্যের রাস্তা, যেন আমি দেড়বস্তা রাক্ষুসে বাচ্চার জন্যে দুধহীন মাই খুলে রেখে বসে থাকি আর দাঁত চিবোয় চামচিকে মাংস তার..খেলা করে, তাছাড়া মৃত্যুর সঙ্গে আর কোন্ কূট কাজ ওর ? ঐ ছেলেদের ? . আমি সহ্য করি— আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে আমায় ক্ষুধা আর প্রাণপণ গাছের শিকড় যেন আমি মাটি, যেন, পড়ো ঘর, পুকুরের পাঁক যেন আমি সমস্ত নিষ্ফল চেষ্টা শিল্পপথিকের, যেন ভ্রষ্ট রাজনীতি যেন আমি সকল নির্ভুল অঙ্কে গোলযোগ, সাহিত্যে তীক্ষ্ণধী সহ্য করি প্রেমতাপ, ছেড়ে-যাওয়া গাড়ি ইষ্টিশানে যেন আমি কিছুকিছু মানুষের জন্যে নয়, সকলের জন্যে বেঁচে আছি যদি বেঁচে থাকা বলে, যদি একে চলচ্চিত্র বলে !
মাঝে মাঝে মনে হয়, কলকাতার পয়ঃপ্রণালীর মধ্যে থেকে উঠে আসে, আজীবন যে শুয়ে রয়েছে .. শিশু যারা সামাজিক মাতা-পিতা নয় স্তম্ভিত ক্রিড়ায় যে বোঝে সবার মধ্যে লক্ষ্যণীয় স্থান নেই তার— নিতে হবে, ছলে-বলে, কেড়ে ও কৌশলে রক্তে ও চোখের জলে ভেসে যাবে গাঙ্গেয় কলকাতা... শিরার সড়ক খুলে ঢালা হবে প্রসিদ্ধ বিদ্যুৎ জ্বলবে ও জ্বালাবে তাকে এবং কলকাতা জ্বলে যাবে ||
তুমি আছো-ভিতরে উপরে আছে দেয়াল কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা” পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৮২) থেকে নেওয়া। "সুখে আছি” (১৯৭৫) গ্রন্থের কবিতা।
আমার হাতের উপর ভারি হ’য়ে বসেছে প্রেত . ফুটপাতে শব্দ হয় ক্রমাগত বৃষ্টির মুখ-ঝোঁকা মেঘ দূরে সরিয়ে দিলো হাওয়া আমরা বিকেলবেলা চাঁদ দেখেছিলাম তরমুজের লাল কাটা ফলার মতন ধরণী-সবুজ চাঁদ
পৃথিবীতে যতো কঠিন সমস্যা ছিলো সব চাঁদের নিচে জড়ো হ’য়ে ততো . কঠিন ছিলো না আর চাঁদের মতন কোমল, পাংশু ছিলো জীবন আমাদের—জীবনাকাঙ্ক্ষা পৃথিবীতে বদ্ না-গাড়ু পরিস্কার ছিলো সোনার মতন সোনার মতন মুসলমান নেমে গিয়েছিলো ওজু করতে . ওদের আল্লা করাতে খান্ খান্ হয়ে গিয়েছে কাল তার কাশফুল উড়ছিলো হাওয়ায়—তার কানের পৈতা হয়েছিলো . নির্ঘাত কুটি কুটি
কুশাসনে বসতে আমার ভালো লাগে না ভালো লাগে না আমার ইন্দ্রজাল—মোহরের গল্প আলিবাবা ভালো লাগে না আমার . ভালো লাগে না আমার সাধারণতন্ত্র – দেহ-বিক্রি আমেরিকার কোনো কিছুই ভালো লাগে না আমার— . কেনেডির মৃত্যুই আমার ভালো লেগেছিল |
আকাশমণির মাথায় হাওয়া লাগছে ফুল-বেলপাতা সমস্ত আমার হাত থেকে পড়ে গেলো ডাকছে তক্ষক—শিবের ধিঙ্গি লিঙ্গ করছে খাঁ খাঁ মাঠ ভেঙে রোদ্দুর এসে পড়ছে গায়ে তার . দেবতা সবই আছে—ছাতা নেই—নেই ওয়াটার-প্রুফ . বৃষ্টির বিরুদ্ধে, ঝোড়ো হাওয়ায় দেবতাদের দেশে ইংরেজি নেই—হিন্দী নেই . নেই ভাষা কোনো আর ইংগিতে ইংগিতে বাংলাদেশের মতন কথা আছে তার . আছে যোগাযোগ – আছে কলংকের কাল— . আছে চলাফেরা
দেবতাদের দেশে ইংরেজি নেই—হিন্দী নেই . আছে লরির আওয়াজ, মুক্তি-যুদ্ধ . আছে গড়নির্ণয় দেয়াল-ঘড়ি আছে সবই যাকে তোমরা বলো ‘অ্যাসেট্’ !
মৃত্যুর অনেক আগে জন্মেছি আমরা— . জন্ম আগে—মৃত্যুর কাছে যেতে হলে পথ, পথের পরে পথ ফেলে যেতে হবে আমাদের সেখানে মাইল-পোস্ট নেই--- নেই টেলিফোন-তার মৃত্যুর কাছে যেতে হলে পথ— . পথের পরে পথ ফেলে যেতে হবে আমাদের তুমি আছো—ভিতরে উপরে আছে দেয়াল আছে কুলুঙ্গি, দেয়ালগিরি আছে আসবাব উপঢৌকন মেহগনি-ঘাট পাশবালিশ আছে পিকদানি পানের বরজ কাবুলী কলাগাছ আছে ঘেটো রুই হাতছানি শ্যাওলা দাম আছে প্রকৃত পিছিয়ে-যাওয়া শিশু ভোলানাথ শ্মশানের ছাই
তুমি না দিলে, আমার নয় কিছুই কেননা, তোমায় আমি বিবাহ করেছি— তোমার খেয়েছি লালা, কেটেছি পকেট—বগলের খাঁজে উপুর ক’রে দিয়েছি পাউডার-কৌটো তোমাকে ভালোবেসেছি ভালোবেসেছি যেমন ক’রে কুকুর ভালোবাসে যেমন ক’রে মশারির গর্তে গর্তে মশা বসে যায় . মৌমাছির মতন মাংসাশী পৃথিবীতে বাঁচার কোনো প্রয়োজন ছিলো না— বৈতরণী পার হ’য়ে তারাপীঠ যেতে হয় আমাদের এঞ্জিন আমাদের লাল-হলুদে-মেশা বগিগুলো ফেলে গিয়েছিলো . পথেই !
শান্তিতে কিছুদিন বিদেশে থাকা চলে—দেশের অদ্ভুত গোলযোগ বিড়ম্বনা ভালো লাগে আমাদের চিরদিনই গাধা ভালো লাগে, ভালো লাগে ব়্যাঁদার উপর কাঠ-বরফের কুঁচি পরিপ্রাণহীন খাটা পায়খানা ভালো লাগে আমাদেরও— আমাদেরও দেশের যা কিছু আছে – পেঁপে গাছ ভালো লাগে আমাদের --- আমরা সুখী !