শামসুর রাহমানের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
কবি শামসুর রাহমান

নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্রুত  প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলিশৈশবে 'পাখী সব করে রব' ব'লে মদনমোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,
অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁ নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে।

আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ'ড়ে পলে পলে,
তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে
আমারই বন্দরে।

গলিত কাচের মতো জলে ফাত্না দেখে দেখে রঙিন মাছের
আশায় চিকন ছিপ ধরে গেছে বেলা। মনে পড়ে কাঁচি দিয়ে
নক্সা কাটা কাগজ এবং বোতলের ছিপি ফেলে
সেই কবে আমি হাসিখুশির খেয়া বেয়ে
পৌঁছে গেছি রত্নদীপে কম্পাস বিহনে।

তুমি আসো আমার ঘুমের বাগানেও
সে কোন্ বিশাল
গাছের কোটর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে আসো,
আসো কাঠবিড়ালির রূপে,
ফুল্ল মেঘমালা থেকে চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো ঐরাবত সেজে,
সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ
মুখের মতোই দুলে দুলে ওঠো তুমি
বার বার কিম্বা টুকটুকে লঙ্কা ঠোঁট টিয়ে হ'য়ে
কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়।

আমার এ অক্ষিগোলকের মধ্যে তুমি আঁখিতারা।
যুদ্ধের আগুণে,
মারীর তাণ্ডবে,
প্রবল বর্ষায়
কি অনাবৃষ্টিতে,
বারবনিতার
নূপুর নিক্কনে
বনিতার শান্ত
বাহুর বন্ধনে,
ঘৃণায় ধিক্কারে,
নৈরাজ্যের এলো-
ধাবাড়ি চিত্কারে,
সৃষ্টির ফাল্গুনে

হে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মিলিত সর্বক্ষণজাগরণে।

তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার ?
উনিশ শো' বাহন্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ'লে আমার সত্তার দিকে
কতো নোংরা হাতের হিংশ্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস !
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।


.           *************************         

.                                                                                    
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
কবি শামসুর রাহমান

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিত্কার করতে করতে
তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব'লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব'লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব'লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় ব'সে আছেন - তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধ'রে দগ্ধ ঘরের।

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব'লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝড়ে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ'তে চলেছে --
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
মতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।


.           *************************  

.                                                                                    
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
একটি কবিতার জন্য
কবি শামসুর রাহমান

বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলি ;
দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো ?
বৃক্ষ বলে আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায়
যদি মিশে যেতে পারো, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা !

জীর্ণ দেয়ালের কানে বলি ;
দেয়াল আমাকে তুমি একটি কবিতা দিতে পারো ?
পুরোনো দেয়াল বলে শ্যাওলা-ঢাকা স্বরে,
এই ইঁট সুরকির ভেতর যদি নিজেকে গুঁড়িয়ে দাও, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা !

একজন বৃদেধের নিকট গিয়ে বলি, নতজানু,
হে প্রাচীন দয়া ক'রে দেবেন কি একটি কবিতা ?
স্তব্ ধতার পর্দা ছিঁড়ে বেজে ওঠে প্রাজ্ঞ কণ্ঠে - যদি
আমার মুখের রেখাবলী
তুলে নিতে পারো
নিজের মুখাবয়বে, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।

কেবল কয়েক ছত্র কবিতার জন্যে
এই বৃক্ষ, জরাজীর্ণ দেয়াল এবং
বৃদ্ধের সম্মুখে নতজানু আমি থাকবো কতোকাল ?
বলো কতোকাল ?

.           *************************  

.                                                                             
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
রাজকাহিনী
কবি শামসুর রাহমান

ধন্য রাজা ধন্য,
দেশজোড়া তার সৈন্য !

পথে-ঘাটে-ভেড়ার পাল।
চাষীর গরু, মাঝির হাল,
ঘটি-বাটি, গামছা, হাঁড়ি,
সাত-মহলা আছে বাড়ি,
আছে হাতি, আছে ঘোড়া।
কেবল পোড়া মুখে পোরার

দুমুঠো নেই অন্ন,
ধন্য রাজা ধন্য।

ঢ্যাম কুড় কুড় বাজনা বাজে,
পথে-ঘাটে সান্ত্রী সাজে।
শোনো সবাই হুকুমনামা,
ধরতে হবে রাজার ধামা।
বাঁ দিকে ভাই চলতে মানা,
সাজতে হবে বোবা-কানা।
মস্ত রাজা হেলে দুলে
যখন-তথন চড়ান শূলে

মুখটি খোলার জন্য।
ধন্য রাজা ধন্য।

.    *************************  

.                                                                            
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?
কবি শামসুর রাহমান

এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?
তেমন যোগ্য সমাধি কই ?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল-সাগর-জল-
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !
তাইতো রাখি না এ লাশ আজ
মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।

.           *************************  

.                                                                                
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
নীলে ঘোড়া
কবি শামসুর রাহমান

নীলে ঘোড়া নীলে ঘোড়া পক্ষীরাজের ছা,
মেঘডুমাডুম আকাশ পারে তা থৈ তা থৈ তা।
মেঘের দোলায় চললি কোথায়, কোন্ সে অচিন গাঁ ?
আয়না নেমে গলির মোড়ে করবে না কেউ রা'।
খিড়কি দুয়োর কেটে দেব পেট ভ'রে খা।
মাছের কাঁটা ফুটলো পায়ে, হাঁটতে পারি না।
চিকচিকে তোর ডালায় ক'রে আমায় নিয়ে যা।

.           *************************  

.                                                                                 
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বন্দী-শিবির থেকে
কবি শামসুর রাহমান

ঈর্ষাতুর নই, তবু আমি
তোমাদের আজ বড়ো ঈর্ষা করি | তোমরা সুন্দর
জামা পরো, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ জমাও,
কখনো সেজন্য নয় | ভালো খাওদাও
ফুর্তি করো সবান্ধব, সেজন্যেও নয়  |

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশের কবি, তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড়ো ঈর্ষান্বিত আজ |
যখন যা খুশি
মনের মতন শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার
তোমরা সবাই |
যখন যে-শব্দ চাও, এসে গেলে সাজাও পয়ারে,
কখনো অমিত্রাক্ষরে, ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো-বা  |
সেসব কবিতাবলী যেন রাজহাঁস,
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়, কুড়ায় আদর
অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ
এ বন্দী-শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মড়লেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো |
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ |
প্রকাশ্য রাস্তায় যদি তারস্বরে চাঁদ ফুল পাখি
এমন কি ‘নারী’ ইত্যাকার শব্দাবলী
করি উচ্চারণ, কেউ করবে না বারণ কখনো  |
কিন্তু কিছু শব্দকে করেছে
বেআইনী ওরা
ভয়ানক বিস্ফোরক ভেবে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ ক’রে বারবার
তৃপ্তি পেতে চাই | শহরের আনাচে কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে গলিতে
রঙিন সাইনবোর্ডে, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে
স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানি নি আগে | উঁচিয়ে বন্দুক
স্বাধীনতা, বাংলা দেশ---- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন ক’রে রাখছে সর্বদা  |

অথচ জানে না ওরা কেউ
গাছের পাতায়, ফুটপাতে
পাখির পালকে কিংবা নারীর দু-চোখে
পথের ধুলোয়,
বস্তির দুরন্ত ছেলেটার
হাতের মুঠোয়
সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি |

.           *************************  

.                                                                                 
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
উদ্ধার
কবি শামসুর রাহমান

কখনো বারান্দা থেকে চমত্কার ডাগর গোলাপ
দেখে, কখনো বা
ছায়ার প্রলেপ দেখে চৈত্রের দুপুরে
কিংবা দারুমূর্তি দেখে সিদ্ধার্থের শেল্ ফ-এর ওপর
মনে করতুম,
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড়ো শান্তিপ্রিয় |
যখন আমার ছোট্ট মেয়ে
এই কোণে ব’সে
পুতুলকে সাজায় যতনে, হেসে ওঠে
ভালুকের নাচ দেখে, চালায় মোটর, রেলগাড়ি
ঘরময়, ভাবি,
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন বড়ো শান্তিপ্রিয় |
যখন গৃহিণী সংসারের কাজ সেরে
অন্য সাজে রাত্রিবেলা পাশে এসে এলিয়ে পড়েন,
অতীতকে উসকে দেন কেমন মাধুর্যে
অরব বচনাতীত, ভাবি-----
যুদ্ধের বিপক্ষে আমি, আজীবন শান্তিপ্রিয় |
আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা |
অস্ত্রের ঝনঝনা
ধমনীর রক্তের ধারায়
ধরায় নি নেশা কোনোদিন
যদিও ছিলেন পিতা সুদক্ষ শিকারী
নদীর কিনারে আর হাঁসময় বিলে,
মারিনি কখনো পাখি একটিও বাগিয়ে বন্দুক
নৌকোর গলুই থেকে অথবা দাঁড়িয়ে
একগলা জলে | বাস্তবিক
কস্মিনকালেও আমি ছুঁই নি কার্তুজ |

গান্ধিবাদী নই, তবু হিংসাকে ডরাই
চিরদিন ; বাধলে লড়াই কোনোখানে
বিষাদে নিমগ্ন হই | আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা |
মারী আর মন্বন্তর  লোক শ্রুত ঘোড়সওয়ারের
মতোই যুদ্ধের অনুগামী  |  আবালবৃদ্ধবনিতা
মৃত্যুর কন্দরে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে
অবিরাম | মূল্যবোধ নামক বৃক্ষের
প্রাচীন শিকড় যায় ছিঁড়ে, ধ্বংস
চতুর্দিকে বাজায় দুন্দুভি |
আজন্ম যুদ্ধকে করি ঘৃণা  |

বিষম দখলীকৃত এ ছিন্ন শহরে
পুত্রহীন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে জিগ্যেস করুন,
সৈনিক ধর্সিতা তরুণীকে
জিগ্যেস করুন,
কান্নাক্লান্ত সদ্য-
বিধবাকে জিগ্যেস করুন,
যন্ত্রণাজর্জর ঐ বাণীহীন বিমর্ষ কবিকে
জিগ্যেস করুন,
বাঙালি শবের স্তূপ দেখে দেখে যিনি
বিড়বিড় করছেন সারাক্ষণ, কখনো হাসিতে
কখনো কান্নায় পড়েছেন ভেঙে----তাকে
জিগ্যেস করুন,
দগ্ধ, স্তব্ধ পাড়ার নিঃসঙ্গ যে-ছেলেটা
বুলেটের ঝড়ে
জননীকে হারিয়ে সম্প্রতি খাপছাড়া
ঘোড়ে ইতস্তত, তাকে জিগ্যেস করুন,
হায়, শান্তিপ্রিয় ভদ্রজন,
এখন বলবে তারা সমস্বরে যুদ্ধই উদ্ধার |

.           *************************  

.                                                                                 
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর