অনেকটা পথ হেঁটে বাড়িটির কাছাকাছি যাই গিয়ে দেখি ধুন্ধুমার রং আর নেই তার চতুর্দিকে, আছে বর্গাদারের অসীম ধানখেত, ভিটেমাটি, অন্নকষ্টকাল, আমার দুহাত বেঁধে রেখেছি লতায় কুসুমিত---- এক দৌড়ে সত্যি আর পালাতে পারি না, জুতো খোয়া যায় রোজ দরজা পর্যন্ত আজও তুমি এগোবে কি ? গাছতলায় আমার বিছানা সাজানো, পাশে আলো-আঁধারির স্নানঘর আমি রুগ্ ণ, অসুখের থেকে উঠে এসেছি এখানে --- ভেতরে আমার এক অরণ্য গজিয়ে ওঠে, সেখানে পাখির ঘর মাচা ও কার্নিশ পাশ ফিরে শুই, মাথা রাখি গাছে, শূন্যতায় ধোঁয়া ওঠে খুব বাড়িটি ঝাপসা হয়, দেখতেও পারি না কিছু --- অগোছালো শীতেও তিনতলা থেকে নেমে যায় হেঁটে হেঁটে বাড়িটির কোনও গল্প নেই, ঘরময় আরোগ্যের খুনশুটি শুধু প্রণাম করতে ইচ্ছে হয় বাড়িটিকে, জানি, ফের একারণেই প্রণাম |
আমাদের বাড়ি ছিল গন্ডগ্রামে, গাছপালা আর সরু নদী তারা চর্তুদিক ঘিরে রেখে আমাকে কবিতায় সাজাত দুটো ডিঙি, খেয়ামাঝি দুজন, এপারে গ্রাম, অন্যদিকে অরণ্যসংকুল-- মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসতাম ওপারের বাঘ, হাতি, নেকড়ে, ভাল্লুকও আমাদের গরু ছিল গোয়ালে চারটি, চাঁদ নেমে আসতো উঠোনে রোজ আমরা দুইভাই স্কুলে যেতে যেতে হুটোপুটি করে ধুলো মাখতাম গায়ে আমাদের সাবা ছিল না---- লাঠি ও বন্দুক কিছুই না আমরা জোনাকি আর তুঁতপোকা দুহাতের মুঠো ভর্তি করে রাখতাম আলো দিত রূপকথা, পানকৌড়ি, দোয়েল-চন্দনা আমার মা আলপথ ধরে হাঁটতেন একা বৃষ্টি-মুখর বর্ষায়, জল পা ভিজিয়ে দিত মা-র, একদিন বৃষ্টি তাঁর কানে কানে ফিসফিস করে বলে ঘরে যাও, ঘরে ফেরো শিগগির, জঙ্গলের দিকে, নদীর ওপার থেকে আগুন আসছে তেড়ে ; আমাদের ঘরবন্দি করে রেখেছিলেন বাবা-মা, কোথাও ছিল না কোনও শব্দ, ফুলগুলি রং ছড়াত কেবল লুকিয়ে জানালা দিয়ে দেখতাম আমি একদিন দ্রুত ধেয়ে আসছিল জঙ্গলের নতুন আঁধার সেই অন্য দহনের আলোয় উদ্বাস্তু হয়ে যাই আমরাও আরও, আরও একবার
মাছের বাজার আমি ঢুকিনি সেদিন, পাশে সরু ভেজা গলি কিছুটা পা বাঁচিয়ে কটু গন্ধ, খোশবাই নয় আমি জানি, দ্রুত পা চালাই সেখানে ঢ্যাঁড়স, ডাঁটা, পটোলের স্তুপ জমে কচুরিপানায়-- আমি দুর্ব্বা হাতে নিয়ে বাজারে ঢুকেছি, দুটো টম্যাটোর নতমুখে হাসি বিলক্ষণ বোঝা যায় কতটা ধুঁধুল কিংবা শিমলতা আমাকে খেয়েছে ! পসার এমনই তবু পণ্যশালা নয় এতটুকু--- এই বিপণির সঙ্গে মিশে যাই ঠিক শিকভাঙা খাঁচার মতন পারিপার্শ্বের জগৎ দেখি না তাকিয়ে, কাঁধে হাত রাখি দোকানির, এ স্পর্শে নিশ্চিত ক্রেতা-বিক্রেতার রঙ্গ উপভোগ্য হয় ; বুঝি না মূল্যের এই লাফালাফি --- কিনে নিতে হয় থলেভর্তি সব আত্মকথাটুকু, বেদনাবোধের গল্পও তখন আশ্চর্যভাবে ঢুকে যায় ওই ধ্রুবতারাটির মতো, যার রূপ আমি চিনি, ছুঁয়ে দেখিনি কখনও |
ভালো ও খারাপ সময়গুলি একলাফে পেরিয়ে এলাম পেরিয়ে কোথায় যে পৌঁছোলাম জানি না সংসার বিচ্ছিন্ন দুটো বক আমার কানে কানে কীসব বলে গেল এইমাত্র আমি সামনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই, পেছনেও, একটা শিমুল গাছ কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হেসে উঠল জোরে আর বক দুটি উড়ে গেল তৎক্ষণাৎ আমি অসহায় শিউলির মতন চওড়া রাস্তার ওপর শুয়ে থাকলাম একা আমার ভয় সঙ্গ ছাড়ল না ---- দুদিকের গাড়িগুলি ছুটে যাচ্ছে দ্রুত চুপচাপ গোপনে নিভে আসছে দিনের স্বর্ণময়তা আমি ফের শৈশব থেকেই গুনতে শুরু করলাম দিনগুলি --- হঠাৎ-ই একটা গাড়ি, চারটে পা বাড়িয়ে থেমে গেল আমার সামনে তার নাকের শৃঙ্গ থেকে নেমে এল জলোচ্ছ্বাস মুখের ভিতরের আগ্নেয়গিরি ধেয়ে আসছে আমার দিকে গাড়িটির ভিতরে এক পরিচিত বেহালাবাদক আমাকে ডাকছেন ইশারায় তাঁর হাতে একগুচ্ছ গোলাপ চারপাশে জমে আছে মনখারাপের গুমোট হাওয়া আমি গাড়িটির মধ্যে কোনোভাবেই উঠতে পারছি না আমার কবজি, ঊরু-জঙ্ঘা শুকনো পাতার মতন ঝরে পড়ছে অবিরাম মাথার খুলি ও ঠোঁট বেলাশেষের গান গাইতে গাইতে কোথায় যে হারিয়ে গেল
আমি শেষবারের মতন একটি নদী খুঁজছি কাছে যাব বলে পাপ-পূণ্য নিয়ে সেখানে একবার অন্তত অবগাহন করতে চাই |
এই শীতের শেষে কোথাও যাবার নেই ধু ধু হলুদের মাঝে হঠাৎ-ই পর্দা টেনে দিল কেউ দৈবের কথা শোনে বাজার-ফেরত মানুষও . আর চায়ের দোকানের বেঞ্চে দুজন ফিচেল বাঁশিঅলা দূরে গান ও কুয়াশায় ভ্রমণের প্রস্তাব ভাসিয়ে দেয় পেছনে যাবতীয় আচারের বয়ামগুলি . শুকনো ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে ডিজেলের ধোঁয়ায় তত্পর হয় রোদ-পোহানো কুকুরটিও এই সময়ের শীত শেষবারের মতো . এলোমেলো ছুটোছুটি করছে কেমন সবাইকে যেতে হবে একে একে জানি পতাকার মতন নিমের ডাল হাতে নিয়ে . চলো গায়ে আলোয়ান চাপিয়ে বেড়িয় পড়ি সবাই হই হই করে রোদ্দুর ফের হুমড়ি খেয়ে ফিরে আসবে ছাদে আর তখনই বুকের মধ্যে আছড়ে পড়বে মৃত্যু-আতঙ্ক তবু সে চলে গেল অবেলায় হঠাৎ প্রত্যেকের জন্য এখন আলাদা আলাদা মনখারাপ জমিয়ে রাখছি
এবারের শীতের সঙ্গে চলো সব ভেসে যাই অনেক অনেক দূরে |
এখানে উই, শ্যাওলার ঢিবির মধ্যে বসে আছি আমার সামনের চেয়ারে বসে যিনি গল্প করছেন . তিনি বহুদিন আগে থেকেই মৃত তাঁর চুলের মধ্যে জট পাকিয়ে আছে জোনকির আলো-আঁধার গলায় জড়ানো শঙ্খচূড় . গা গতরে বেয়ে উঠছে কর্ণকীট, গুবরে পোকা সন্ধেগুলি একা একা ওঁর সঙ্গেই কথা বলি দীর্ঘদিনের অন্তর্দাহ, হাহাকারের কথা একজন অন্ধও আসতেন তখন ঘন ঘন, এসে, আমাকে বিদ্রুপবাক্যে ঝাঁঝরা করে দিতেন . আমার ছলনা ছিল অপরিসীম আত্মাহুতিরও ঢের আগে, আমি পিঁপড়ে, মথ, আরশোলা এদের ছলাকলা, ফোঁসফোঁসানি নিয়ে . ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যাবার চেষ্টাও করি একবার আমি সান্ত্বনার চারণভুমি চিনতে পারি না আগামী সন্ধেগুলিও এইভাবেই চেয়ারে মৃতের মতন বসে থাকব একা একা |
সেই প্রথম আমরা মাদল বাজাতে শুরু করলাম আমাদের আনন্দ হয়েছিল খুব---- এক বরেণ্য জনপ্রতিনিধি আমাদের গ্রামে এসে গরিবের বউ, মাতালের ভাইপো বিজু মাস্টারের নাতি আর শালিক-ফিঙে-চড়ুই সবাইকে জড়ো করলেন স্কুলের মাঠে দুঃখ মেশানো ভোরবেলার রোদ ঝিমিয়ে এল হঠাৎ তাঁর পাঞ্জাবি ও পায়জামায় নানা রঙের বর্ণচ্ছটা . গলায় গাঁদা ফুলের মালা ঝোলানো চুল পরিপাটি করে আঁচড়িয়ে হাসিমুখে সেইদিন . পতাকা তুললেন স্কুলের মাঠে লোভাতুর ফণা তুলে তাকালেন শূন্যে আকাশের দিকে----- সমবেত জনতা হাততালি দিয়ে উঠল |
তিতির না তিত্তিরি --- কী নামে ডাকব বোঝার আগেই সে মধুপায়ীর বাচ্চা যেন ফুড়ুত হল গিয়ে ঢুকল টম্ টমের ঘরে---- দ্রৌপদীর তখন বস্ত্রহরণ সারা অঙ্গ থেকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ফাঁস খুলল মিহিরভাইয়া খুলে ধানখেতে ছুঁড়ে দিল সব চন্দ্রহার, মেখলা নোলক এমনকি শোলার টোপরও ;
পূর্বদিকে একটা ভুতুড়ে বাড়ি ছিল সেখানে ভোরের আলো ঝিলিক দিয়ে লাল হত মাঝে মাঝে পায়ের কাছে লুটোপুটি খেত দুর্বা-ঘাস একটা খয়েরি বোতল ঠিক নাবিকের মতো দেখতে তিরতির করে দুলে উঠত স্বপ্ন নিয়ে --- তার সারা শরীরে ওষুধ-ওষুধ গন্ধ তখন |
সেই রাত্রি ছিল কোজাগরির আগোছালো রান্নাবান্না হাঁড়ি-কড়াই ছড়িয়ে ছিটিয়ে সদ্যোজাত বিষাদ-প্রতিমা উদাস ছিল কেমন খোলা দরজায় এমন মুক্ত বাতাসের ছুটোছুটি চৌকাঠে শীতকাল--- দ্রৌপদী কোথাও নেই কোনো হাঁড়িকাঠে হয়তো বা--- গোলাপের পাপড়ি খুলে খুলে পড়ে যেমন সমর্পণে, ওড়নায় জড়ানো সুখানুভবের আনাচে কানাচে চিরুনিতল্লাশি চতুর্দিকে উলুধ্বনি উঠে জন্মাল নতুন হিংসা-দ্বেষ হে কৃষ্ণকাক, ছিঁড়ে খা সবটুকু মনোমোহিনী ধ্বংস হওয়ার আগে ওই দ্যাখ্ একটা মৌরি ফুলও মুখ লুকোল লজ্জায় |
কতক্ষণ ছিলে তুমি ওভাবে পাঞ্চালী ? একটা সাপ ও কাঠবেড়ালী ছিল কি শরীরের কাছাকাছি ? ছিল নিশ্চয়ই ভুতুড়ে হয়ে-ওঠার মতন পালক-ছড়ানো ধানখেত, আলপথও রক্তে ভেজা ছিল আকাশ লাল হয়ে ওঠার আগে ওই বিবশ রাতটুকু হাহাকার করে সেইদিন তোমার অভিমানও ঘুমের ভিতরে কেঁপে কেঁপে উঠছে
ওই নিধনকারী যুবক তিনজন হাতে রং মাখানো ওড়না-আঁচল পতাকায় জয়ী হল শেষমেশ গ্রাম-বাংলায় বহুদিন পর শীত এল চুপিচুপি ঘন জ্যোত্স্নায় রাস্তাঘাট তারপর নদী হল অন্য এক ছলনাময়ী নদীর কথা ভেসে যায় ভেসে যায় লন্ডভন্ড করে দিয়ে পালায় হঠাৎ-ই অন্যকোনোখানে | রঙিন রুমালে গন্ধ ছিল মুকুলের হাবিজাবির বাইরে সে এক নতুন আলোছায়া মনে হয় সত্যান্বেষণে নেমেছিল কেউ কেউ--- প্রতিপ্রশ্ন সওয়াল বটের ছায়া ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে নিল সবটুকু--- একলা রাত ছিল, অহংকারী রাতও হেরে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে নূপুর ও নাকছাবি পড়ে রইল দূরে, ফাঁকায় |
গাঢ় ঘুমের পর উঠে দাঁড়াল যাজ্ঞসেনী আরোগ্য নেই শুধু নীল রঙে ডুবিয়ে অদৃশ্যে বেঁধেছে কেউ ঘরের বাইরে কাটাঝোঁপে ছেঁড়া কাপড়চোপড় টম্যাটো ও বেগুন গাছের ফুলগুলি ঝিকমিক করছে শীতে--- সে আজ অফিস যাবে মেট্রো ও বাসের ভিড়েই একা রত্মময় শিরোভূষণ তার আগেই খসে পড়েছে কোথাও |
১ আমি সত্যি গাছ হয়ে গেছি দুটো পাখি এসে গান শোনাল সন্ধ্যায় চেহারা পালটানো খেলা শুরু হবে ঠিক বৃষ্টি-ঝড় থেকে আজ আমাকে বাঁচাও |
২ তুমুল সুখের দিনে ছিল দুটি ফুল মুচকুন্দ কামিনীরও হাসি নিজেই সাঁতার কাটি বাগানে বাগানে সিপাহী জানে না সেই উদ্ধারণীর আমি-কথা |
৩ চতুর্দিকে অন্ধকার ধেয়ে এলে দেখি গেঁড়িগুগলির সঙ্গে সারারাত ভোঁদড়ের গানে আমার দরজা বন্ধ কান পেতে শোনো চুপচাপ একবস্ত্রে আজ এসে দাঁড়াল সকাল |
৪ এখনও সমস্ত দিন আমি ভাবি ---- কী হল জিরাফ ? অন্ধ হয়ে হাঁটাহাঁটি করে উচ্চতা ভুলো না যেন শুধু দৃষ্টি ফিরিও না গন্ধবতী খাঁড়ি দরিয়ায় মেঘের ভিতরে রেখো গোপনীয় যা ছিল আমার |