ফুলবাজার
কবি শঙ্খ ঘোষ

পদ্ম, তোর মনে পড়ে খালযমুনার এপার ওপার
রহস্যনীল গাছের বিষাদ কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?

স্পষ্ট নৌকো, ছৈ ছিল না, ভাঙা বৈঠা গ্রাম হারানো
বন্য মুঠোয় ডাগর সাহস, ফলপুলন্ত নির্জনতা

আড়ালবাঁকে কিশোরী চাল, ছিটকে সরে মুখের জ্যোতি
আমরা ভেবেছিলাম এরই নাম বুঝি বা জন্মজীবন |

কিন্তু এখন তোর মুখে কী মৃণালবিহীন কাগজ-আভা
সেদিন যখন হেসেছিলি সত্যি মুখে ঢেউ ছিল না!

আমিই আমার নিজের হাতে রঙিন ক'রে দিয়ে ছিলাম
ছলছলানো মুখোশমালা, সে কথা তুই ভালই জানিস---

তবু কি তোর ইচ্ছে করে আলগা খোলা শ্যামবাজারে
সবার হাতে ঘুরতে-ঘুরতে বিন্দু বিন্দু জীবনযাপন?

.                   ******************     
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর
পুনর্বাসন
কবি শঙ্খ ঘোষ

যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ঘাসপাথর
সরীসৃপ
ভাঙা মন্দির
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
নির্বাসন
কথামালা
একলা সূর্যাস্ত
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ধ্বংস
তীরবল্লম
ভিটেমাটি
সমস্ত একসঙ্গে কেঁপে ওঠে পশ্চিম মুখে
স্মৃতি যেন দীর্ঘযাত্রী দলদঙ্গল
ভাঙা বাক্স প'ড়ে থাকে আমগাছের ছায়ায়
এক পা ছেড়ে অন্য পায়ে হঠাত সব বাস্তুহীন |

যা কিছু আমার চার পাশে আছে---
শেয়ালদা
ভরদুপুর
উলকি-দেয়াল
যা কিছু আমার চার পাশে আছে---
কানাগলি
স্লোগান
মনুমেন্ট
যা কিছু আমার চার পাশে আছে---
শরশয্যা
ল্যাম্প পোস্ট
লাল গঙ্গা
সমস্ত এক সঙ্গে ঘিরে ধরে মজ্জার অন্ধকার
তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বাজে জলতরঙ্গ
চূড়োয় শূণ্য তুলে ধরে হাওড়া ব্রিজ
পায়ের নিচে গড়িয়ে যায় আবহমান |

যা কিছু আমার চার পাশে ঝর্না
উড়ন্ত চুল
উদোম পথ
ঝোড়ো মশাল
যা কিছু আমার চার পাশে স্বচ্ছ
ভোরের শব্ দ  
স্নাত শরীর
শ্মশান শিব
যা কিছু আমার চার পাশে মৃত্যু
একেক দিন
হাজার দিন
জন্ম দিন
সমস্ত একসঙ্গে ঘুরে আসে স্মৃতির হাতে
অল্প আলোয় বসে থাকা পথ ভিখারি
যা ছিল আর যা আছে দুই পাথর ঠুকে
জ্বালিয়ে নেয় এতদিনের পুনর্বাসন |

.           ******************     
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর
মহা নিমগাছ
কবি শঙ্খ ঘোষ

ঈশানে নৈঋতে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে
মাটির উপর মুখ রেখে
সে এখন শুয়ে আছে শেষ রাতের খোলা প্রান্তরে

আর কেউ নেই
শুধু তার পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে লক্ষ লক্ষ তারা

হাতের ডানায় লেগে আছে ঘাসের সবুজ, বুকে ভেজা মাটি এইটুকু ছাতা
যেন কোনো কোমলতা ছিল না কোথাও কোনোখানে

তারপর
আকাশ আর পৃথিবীর ঢাকনা খুলে বেরিয়ে আসে ভোর
এসে দেখে :

যেখানে সে পা দুখানি রেখেছে, সেখানে
কাল বিকেলের শেষ ঝড়ে
পড়ে আছে কুরে খাওয়া সনাতন মহা নিমগাছ |


.                   ******************     
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর
ছুটি   
কবি শঙ্খ ঘোষ

হয়তো এসেছিল | কিন্তু আমি দেখিনি |
এখন কি সে অনেক দূরে চ'লে গেছে?
যাব | যাব | যাব |

সব তো ঠিক করাই আছে | এখন কেবল বিদায় নেওয়া,
সবার দিকে চোখ,
যাবার বেলায় প্রণাম, প্রণাম!

কী নাম?
আমার কোনো নাম তো নেই, নৌকো বাঁধা আছে দুটি,
দুরে সবাই জাল ফেলেছে সমুদ্রে---


.                   ******************     
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর
*
সবিনয় নিবেদন
কবি শঙ্খ ঘোষ

আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে |
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা |
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা |
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে---
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে |

.          ******************     
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর
শবসাধনা
কবি শঙ্খ ঘোষ

বুঝি তোমার চাউনি বুঝি
থাকবে না আর গলিঘুঁজি
      থাকবে না আর ছাউনি আমার কোথাও
ও প্রমোটার ও প্রমোটার
তোমার হাতে সব ক্ষমতার
      দিচ্ছি চাবি, ওঠাও আমায় ওঠাও |

তুমিই চিরনমস্য, তাই
তোমার পায়ে রত্ন জোটাই
      তোমার পায়েই বিলিয়ে দিই শরীর---
যাঁর যা খুশি বলুন তিনি
করবে তুমি কল্লোলিনী
      ভরসা কেবল কলসি এবং দড়ির |

আমার বলে রইলো শুধু
বুকের ভেতর মস্ত ধু ধু
      দিয়েছি সব যেটুকু ছিল দেবার
ঘর ছেড়ে আজ বাইরে আসি
আমরা কজন অন্তেবাসী
      শবসাধনার রাত কাটাব এবার |


.            ******************     
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর
কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতা
বহিরাগত
কবি শঙ্খ ঘোষ

আমার কথা কি বলতে চাও না? নিশ্চিত তুমি বহিরাগত |
উঁচু স্বর তুলে কথা বলে যারা জেনে নাও তারা বহিরাগত |
গাঁয়ে কোণে কোণে গাঁয়ের মানুষ খেতে বা খামারে বহিরাগত |
মরা মানুষের মুখাচ্ছাদন সরিয়ো না, ও তো বহিরাগত |
মাঠে মাঠে ধরে যেটুকু ফসল সেসবও এখন বহিরাগত |
চালার উপরে ঝুঁকে পড়ে চাঁদ বহুদূর থেকে বহিরাগত |
বর্ষাফলকে বিষ মেখে নিয়ে কালো মুখোশের আড়ালে যত
বহিরাগতরা এসে ঠিক ঠিকই বুঝে নেয় কারা বহিরাহত |


.                   ******************     
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর
setstats
মাওবাদী
কবি শঙ্খ ঘোষ
(প্রকাশিত হয়েছে : অনুষ্টুপ, শারদীয় সংখ্যা ১৪১৯, সম্পাদনা: অনিল আচার্য)

এখনও তুমি প্রতিবাদ করো?
---মাওবাদী।
প্রশ্ন করার সাহস করেছো?
---মাওবাদী।
চোখে চোখ রেখে কথা বলো যদি
ঘড়ি ঘড়ি সাজ মানবদরদী
আদরের ঠাঁই দেবে এ-গারদই
---মাওবাদী।
সহজ চলার ছন্দটা আজ
একটু না হয় দাও বাদই।

দুই চোখে দেখি সর্ষেফুলের মতো থোকা থোকা
---মাওবাদী।
এখানে-ওখানে দোকানে-বাজারে হাজারে হাজারে
---মাওবাদী।
বাঁকা হাসি দেখে ঠিকই চিনে যাই
মাওবাদী, তুমি মাওবাদী!!

.             ******************     
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর
যমুনাবতী
কবি শঙ্খ ঘোষ

One more unfortunate
weary of breath
Rashly importunate
.                ---Thomas Hood

নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
.        একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
.        বাঁচার আনন্দে।
নোটন নোটন পায়রাগুলি
.        খাঁচাতে বন্দী
দু’এক মুঠো ভাত পেলে তা
.        ওড়াতে মন দি

হায় তোকে ভাতদিই  কী করে যে ভাত দিই হায়
হায় তোকে ভাত দেব কী দিয়ে যে ভাত দেব হায়

নিভন্ত এই চুল্লী তবে
.        একটু আগুন দে
হাড়ের শিরায় শিখার মাতন
.        মরার আনন্দে।
দুপারে দুই রুই কাত্লার
.        মারণা ফন্দী
বাঁচার আশায় হাত-হাতিয়ার
.        মৃত্যুতে মন দি।

.        বর্গী না টর্গী না, যমকে কে সামলায়!
.        ধার-চকচকে থাবা দেখছ না হামলায় ?
.        যাস্ নে ও হামলায়, যাস্ নে॥

কান্না কন্যার মায়ের ধমনীতে আকুল ঢেউ তোলে, জ্বলে না
মায়ের কান্নায় মেয়ের রক্তের উষ্ণ হাহাকার মরে না
চলল মেয়ে রণে চলল।

বাজে না ডম্বরু, অস্ত্র ঝন্ ঝন্ করে না, জানল না কেউ
চলল মেয়ে রণে চলল।
পেশীর দৃঢ় মুঠোর দৃঢ় কথা, চোখের দৃঢ় জ্বালা সঙ্গে
চলল মেয়ে রণে চলল।

নেকড়ে-ওজর মৃত্যু এল
.        মৃত্যুরই গান গা
মায়ের চোখে বাপের চোখে
.        দু-তিনটে গঙ্গা।
দূর্বাতে তার রক্ত লেগে
.        সহস্র সঙ্গী
জাগে ধক্ ধক্, যজ্ঞে ঢালে
.        সহস্র মণ ঘি।

যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা আর বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে
বিষের টোপর নিয়ে।
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ, গিয়ে।

নিভন্ত এই চুল্লীতে বোন আগুন ফলেছে।

.             ******************     
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর
আড়ালে
কবি শঙ্খ ঘোষ

দুপুরে রূক্ষ গাছের পাতার
কোমলতাগুলি হারালে---
তোমাকে বক্ ব, ভীষণ বক্ ব
আড়ালে।

যখন যা চাই তখুনি তা চাই।
তা যদি না হবে তাহলে বাঁচাই
মিথ্যে আমার সকল আশায়
নিয়মেরা যদি নিয়ম শাসায়
দগ্ধ হাওয়ার কৃপণ আঙুলে---
তাহলে শুকনো জীবনের মূলে
বিশ্বাস নেই, সে জীবনে ছাই!

মেঘের কোমল করুণ দুপুর
সূর্যে আঙুল বাড়ালে---
তোমাকে বক্ ব, ভীষণ বক্ ব
আড়ালে।

.        ******************     
.                                                                               
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর