লোকে আমায় ভালোই বলে দিব্যি চলনসই দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কই। ঘটশিলাতে যাবার পথে ট্রেন ছুটছে যখন মায়ের কাছে বাবার খাছে করছি বকম্ বকম্। হঠাৎ দেখি মাঠের মধ্যে চলন্ত সব গাছে এক একরকম ভঙ্গি ফোটে এক একরকম নাচে। “ওমা দেখ নৃত্যনাট্য” --- যেই বলেছি আমি মা বকে দেয়, “বড্ড তোমার বেড়েছে ফাজলামি।” চিড়িয়াখানার নাম জানো তো আমার সেজ মেসোর? আদর করে দেখিয়েছিলেন পশুরাজের কেশর ক’দিন পরে চুন খসানো দেয়াল জুড়ে এ কী ঠিক অবিকল সেই রকমই মূর্তি যেন দেখি ? ক্লাসের মধ্যে যেই বলেছি সুরঞ্জনার কাছে “জানিস ? আমার ঘরের মধ্যে সিংহ বাঁধা আছে!” শুনতে পেয়ে দিনিমণি ওমনি বলেন “শোনো, এসব কথা আবার যেন না শুনি কক্ষনো।”
বলি না তাই সে সব কথা সামলে থাকি খুব কিন্তি সেদিন হয়েছে কি এমনি বেয়াকুব--- আকাশপারে আবারও চোখ গিয়েছে আটকে শরৎ মেঘে দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথকে।
বলেছিলাম তোমায় নিয়ে যাব অন্য দূরের দেশে সেই কথাটা ভাবি, জীবনের ওই সাতটা মায়া দূরে দূরে দৌড়ে বেড়ায় সেই কথাটা ভাবি। তাকিয়ে থাকে পৃথিবীটা, তোমার কাছে হার মেনে সে বাঁচবে কেমন ক’রে! যেখানে যাও অতৃপ্তি আর তৃপ্তি দুটো জোড়ায় জোড়ায় সদরে-অন্দরে।
উদাসিনী নও কিছুতে---বুঝতে পারি তোমার বুকে অন্য কিছু আছে, যন্ত্রণা তার পাকে পাকে হৃদয় খোলে, সে খোলাটার অন্য মানে আছে। ঘুমের মধ্যে দেখি আলোর ভরা-কুসুম নীলাংশুকে বাঁধতে পারে না এ : উঠেই দেখি কী বিচিত্র, একটি আঁচড় লাগে নি তার ভালোবাসার গায়ে!
বলেছিলাম তোমায় আমি ছড়িয়ে দেব দূর হাওয়াতে সেই কথাটা ভাবি তোমার বুকের অন্ধকারে সুখ বেজেছে মদির হাতে সেই কথাটা ভাবি॥
যেদিন নদীর জলে ভেসেছিল দু’হাজার শব যেদিন পাড়ার সব দুয়োরে কুলুপ আঁটা ছিল যেদিন শহরজোড়া গাছে গাছে ঝোলা কাটা হাত অসাড় ইশারাভরে ডেকেছিল হৃৎপিণ্ডগুলি যেদিন মাটির থেকে উঠেছিল শুধু কচি হাড় বুভুক্ষু সমস্ত মুখ ভরে দিয়েছিল হুতাশনে রাজপথে ছুটেছিল যেদিন উলঙ্গ নারীদল এবং স্তনের শীর্ষে গাঁথা ছিল হাজার ত্রিশূল যেদিন কবন্ধগুলি মদভাণ্ড রেখে ডানপাশে নিজেরই মুণ্ডের চোখ খুঁজেছিল টেবিলের নীচে যেদিন পৃথিবী তার সম্বিৎ হারিয়ে ছিল চুপ ঝর্ঝর ঝরার শব্দে ঝরে পড়েছিল সব ধী মুখেরা ফসিল আর যেদিন ফসিলই হল মুখ সেদিনও কি জানতে চাও তাহলে কবির ধর্ম কী ?
আমি এই শতাব্দীর শেষ প্রান্ত থেকে কথা বলি আমি এই শালপ্রাংশু মধ্যরাত্রি থেকে কথা বলি আমার মায়ের রক্ত হাতে নিয়ে আমি কথা বলি হোলি খেলেছিল যারা আমার মেয়ের রক্ত নিয়ে। আগুন জ্বালিয়ে যারা শবের উপরে নেচেছিল এই শেষ অন্ধকারে তাদের সবার কথা বলি আর যারা চুপ ছিল যারা কিছু দেখেও দেখেনি একাকার মনে যারা অনায়াসে ছিল অন্যমনে গলের ভিতরে যারা দলবৃত্তে অন্ধ হয়ে ছিল অথবা মৃতই ছিল---সেই সব প্রাক্তন হৃদয়ে একমুঠো ছাই ছুড়ে পিছনে না চেয়ে ফিরে এসে নক্ষত্রের ক্ষত বুকে রক্ষাবাহিনীর ব্যূহমুখে এই শতাব্দীর শেষ ভূমিহারদের কথা বলি বলি যে জাতক বীজে মাটির কেশর মেখে মেখে এক মরণের থেকে আরেক মরণে যেতে যেতে আণার আমির থেকে জেগে ওঠে আরো আরো আমি আমিই শতাব্দী আমি আদিঅন্তহারা মহাদেশ আমি এই শতাব্দীর শহিদশিখর থেকে বলি মৃত্যুর ভিতরে আজ কোথাও মৃত্যুর নেই লেশ দেখো এ মৃত্যুর মধ্যে কোথাও মৃত্যুর নেই লেশ!
রাগ কোরো না রাগুনি মুখ কোরো না বেগুনি বাস আসবে এখুনি ছুটতে হবে তখুনি বাসের পিছন পিছনে কী শুনতে সে কী শোনে বাসের গায়ে কাঁঠালফল নেই পা-দানি নেই হাতল কোলে তোমায় নিল না জায়গা তো আর ছিল না তাই বলে কি রাগতে হয় ধৈর্য ধরে থাকতে হয় !