কবি শশিভূষণ দাশগুপ্তর কবিতা
*
ছুটির দিনটা
কবি শশিভূষণ দাশগুপ্ত
১৯৮৮সালে প্রকাশিত নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও সরল দে সম্পাদিত "পাঁচশো বছরের কিশোর
কবিতা" কাব্য সঙ্কলনের কবিতা। মিলনসাগরে প্রকাশ - ৩০.১১.২০১৩



ছুটির দিনটা                পাক খায় তিনটা
তাক ধিন্ ধিন্ তা          নাচি আর গাই ;
চেয়ে দেখি বাইরে          রোদটুকু নাইরে
হুল্লোড়ে ডাকে মেঘ         হাঁই মাঁই কাঁই।

ভ্যাংচায় হুলো মেঘ        ল্যাংচায় নুলো মেঘ
ছিচ কাঁদে ভুলো মেঘ      পথ ভুলে কোণে ;
কোনটার ধরে নাক         বায়ু খায় ঘুরপাক
যত রোস হাঁক ডাক        কেইবা তা শোনে!

কেলো ভূতো পেলটা        রাখ মারবেলটা,
ভাল নাহি লাগে আজ       টুং টাং খেলা ;
তার চেয়ে শুয়ে টান        গায়ে দিয়ে কাঁথাখান
চুপচাপ বনে যাই            লক্ষ্মীর চেলা।

হাঁই মাঁই করে মেঘ          সাঁই সাঁই বায়ু বেগ
পিট পিট চোখ দুটো        বোজা আছে অল্প ;
তার মাঝে আছো বেশ     গায়ে গায়ে দিয়ে ঠেস
শুনি বসে ঘরছাড়া          মেঘেদের গল্প।

.                *****************             

.                                                                                
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
জামরুল
কবি শশিভূষণ দাশগুপ্ত
মাঘ ১৩৭২ বঙ্গাব্দে (জানুয়ারী ১৯৬৬) প্রকাশিত, প্রমথনাথ বিশী ও ডঃ তারাপদ
মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত
"কাব্যবিতান" কাব্য সঙ্কলনের কবিতা। মিলনসাগরে প্রকাশ -
৩০.১১.২০১৩।


জ্যৈষ্ঠের অপরাহ্ন-বেলা  |
পীচে-বাঁধানো রাস্তা গ’লে মিশে যাচ্ছে
বিক্ষুব্ধ বাতাসের সঙ্গে |
মাঝে মাঝে জানালায় ধাক্কা দিয়ে যায়
প্রতপ্ত নগরীর দীর্ঘশ্বাস |

চা-পানের নিমন্ত্রণ |
সেটা অবশ্য সাধারণ নাম বা উপলক্ষ্য
যাকে ঘিরে লক্ষ্য হয়ে ওঠে পাঁচ রকমের আয়োজন------
ভূরি জলযোগ, সুশীতল পানীয়-------
সুরম্য দর্শনীয় এবং সুমধুর শ্রবণীয়
এবং ইত্যাদি |

বিরাট বড়লোকের বাড়ি |
কক্ষের দরজা বন্ধ----
জানালাগুলো বন্ধ এবং ভিজে খস্ খসে ঢাকা,
ভিতরে সাঁই সাঁই চলেছে পাখা
আর জ্বলছে তুহিন-রাতের চাঁদের আলোর মত
ঈষৎ নীল কাচের অস্বচ্ছ আবরণ পরানো
বিজুলীর বাতি,
মিলনসাগর    
বাইরের জগৎটাকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখবার
নিখুঁত ব্যবস্থা |

খাবার এল অনেক------প্রাচুর্যে এবং প্রকারে,
নিম্ কি আর কচুরি আর শিঙাড়া------
ভাজি আর ডালনা আর চাটনি------
তারি পাশে একখানি চীনেমাটির থালায় সাজানো
আম আর লিচু ----- আর দুটো জামরুল  |

বাজে রেডিও ----- বিলিতি ঢঙের রেকর্ড------
ওঠে হাসি-ঠাট্টার রোল,
তাও অবশ্য পরদা-মাফিক ----
স্থান-কাল-পাত্রের বিচারে |
রুদ্ধ কক্ষ |
বায়ু ঢুকবার পথ নেই---আলো ঢুকবার রন্ধ্র নেই------
শব্দের প্রবেশও সবটা না হলেও অনেকটা নিষিদ্ধ  |
সামনে চীনেমাটির সাদা বাসন------
তারই উপরে দু’টো জামরুল  |

চেয়ে আছি ঐ দুটো জামরুলের দিকে,
সহসা দমকা হাওয়ায় খুলে গেল মনের জানালা,-----
চারিদিকে অনেক আলো, অনেক হাওয়া,
অনেক পথ-প্রান্তর-খোলা আকাশ |
সেই জানালার পথ দিয়ে
চলে গেলুম অনেক দূরের দেশে
অনেক বন-প্রান্তর পাহাড়-নদী মাঠঘাট অতিক্রম ক’রে  |
যেখানে গিয়ে পৌঁছলুম
সেখানে পড়ে রয়েছে শ্যাওলা-ভরা একটি দীঘি
কর্মহীন নিরালা গ্রাম্য স্থবির |
তার সামনে -----যতদূর চোখ যায়
ধূ ধূ করে দিগন্তজোড়া মাঠ ;
তার বুকে ঝিলমিল-করা রোদের তাপ
ঝলসে’ ওঠে চাষীর ঘামে-ভেজা কালো দেহে-----
আর সাদা বলদ দু’টোর পিছল গায়ে |

নির্জন দুপুর -----স্তব্ধ দুপুর------
শ্যাওলাভরা দীঘির চারিকূল ঘেঁষে
বেড়ে উঠেছে পানিকচু আর হিঞ্চে-----
আর পুরু হয়ে উঠেছে কলমীর দল-----
যার উপরে বকগুলো আর বেলেহাঁসগুলো
ঘুরে বেড়ায় স্বেচ্ছাবিহারীর ছন্দে |
কালো দীঘির মাঝখানে যেটুকু রয়েছে ফাঁক
সেখানে ডুবছে আর খেলছে
মিলনসাগর    
পানকৌড়ির একটি ছোট্ট দল ;
মাছরাঙা হ্রস্বগ্রীবায় লাল চঞ্চু ঊর্ধ্ব ক’রে
ধ্যান ধ’রে আছে পূব-দক্ষিণ কোণের তেঁতুল গাছটায় |

এপারে একটি বকুল গাছ,
তার নীচে বাহুতে মাথা দিয়ে
অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে ভিন গাঁয়ের পথিক,
পাশে ঘুমিয়ে আছে বাঁশের লাঠির আগায় বাঁধা
ময়লা ছেঁড়া কাপড়ের কি যেন একটা পুঁটুলি |
তারি পাশে একটা জামরুল গাছ -------
তিনখানি ভাঁজ হয়ে দীঘির কূলে হেলে পড়েছে |
যে বাঁকা ডালখানি এগিয়ে গেছে দীঘির দিকে
তাঁরই উপরে নিশিন্ত নিরালায় রয়েছে ব’সে
একটি বার-তের বছরের গেঁয়ো জীব ;
কোঁচড়ভরা টস্ টস্ করে জামরুল |
মাঝে মাঝে কোঁচড় খুলে খায়,
পা দোলায় আর গুন্ গুন্ গান গায়-----
আর তাকিয়ে থাকে মাঠের দিকে,
কালো দীঘির বুকে ডুব মেরেছে যে পানকৌড়ি
তার দিকে,
আর ঝুপ ক’রে ছোট একটা মাছ তুলে নিল যে মাছরাঙা
তারি দিকে  |

চীনেমাটির বাসনে সাজানো জামরুলের দিকে তাকাই
আর আনমনে ভাবি --------
এত রূপ এই জামরুলের !

.        *****************             

.                                                                    
          সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
বোধিসত্ত্বের প্রার্থনা
কবি শশিভূষণ দাশগুপ্ত
সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত, ১১ ক্লাইভ রো, কলকাতা থেকে প্রকাশিত “বঙ্গশ্রী” পত্রিকার ভাদ্র
১৩৪৪ (অগাস্ট ১৯৩৭) সংখ্যায় প্রকাশিত কবিতা। মিলনসাগরে প্রকাশ ২৩.৪.২০২১।

ক্ষণেক দাঁড়াও নির্বাণকামী যুদ্ধদেবতাগণ,
ওই শোন জাগে চরণ ঘিরিয়া নিখিলের ক্রন্দন !
মুক্তি নিও না চিত্তভরি গো, লভিও না নির্বাণ,
চরণনিয়ে বেদনা-আতুর কাঁদে অসহায় প্রাণ।
দুঃখ-শোকের তপ্ত-অনলে জাগিছে লক্ষ শিখা,
অগণিত অভিশপ্ত জীবনে শুধু জাগে মরীচিক।
জরা-জঙ্গম ভীরু দুর্ব্বল মোহের পক্ষে লীন,---
শিয়রে দাঁড়ায়ে করাল মৃত্যু নিষ্ঠুর সুকঠিন!
বড়ই দৈন্য----বড় যে বেদনা---বড় যে ক্লেশের ভার,
তপ্ত মরুর বুকজোড়া শুধু অনন্ত হাহাকার!
কোথা সান্ত্বনা---? কোথা নির্ভয়? কোথা তৃষ্ণার বারি?
তোমাদের পানে চাহিয়া রয়েছে অগণিত নরনারী ;---
হে সু্ম্বুদ্ধ,---তোমরাও যদি লহ বরি’ নির্বাণ,
শূন্যে মিলাবে মহামানবের বেদনা-করুণ গান!
যে দিকে যে আছ শুদ্ধবুদ্ধ মোরে দেহ এই বর,
পুঞ্জিত হোক বিশ্বের ব্যথা আমার বুকের ’পর,---

একটিও প্রাণী যতদিন ধরি' কাঁদিবে বাঁধন-ডোরে
ততদিন ধরে’ হে দেবতাগণ,---মুক্তি দিও না মোরে।

.    
              *****************             

.                                                                              
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
শ্মশান-প্রদীপ
কবি শশিভূষণ দাশগুপ্ত
সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত, ১১ ক্লাইভ রো, কলকাতা থেকে প্রকাশিত “বঙ্গশ্রী” পত্রিকার
আষাঢ় ১৩৪৪ (জুন ১৯৩৭) সংখ্যায় প্রকাশিত কবিতা। মিলনসাগরে প্রকাশ ২৩.৪.২০২১।


জীবন-প্রদীপ নিভে গেল যার কালের অন্ধকারে,
সন্ধ্যা-আঁধারে মাটির প্রদীপে বন্দনা একি তারে!
আগাছায়-ঘেরা তুলসী-তলায় এই যে মাটির নীচে
জানিস্‌ কি এক বিরাট স্বপ্ন নিমেষে হয়েছে মিছে!
নিমেষে নিভেছে গগন-বিথার হাজার আশার বাতি,
ঝরিয়া পড়েছে নব-মুকুলিকা রাঙা-কল্পনা-পাতি,---
নীরব হয়েছে দুঃখসুখের স্পন্দনময়ী ভাষা,
মাটির কবরে নির্ব্বাণ লভে জীবনের কাঁদা-হাসা!
কত যে বাসনা---স্নেহ-ভালবাসা--দেহ ও মনের ক্ষুধা,---
মান-অপমান-জয়-পরাজয়---কত বিষ, কত সুধা,---
এ মাটির নীচে হারায়েছে আজ সকল অর্থ তার,
সমুখে পিছনে ঘনায়েছে শুধু নিবিড় অন্ধকার!
ধরণীর বুকে ক্রন্দন জাগে,---কোথা যায়---কোথা যায়,
স্তব্ধ রহে যে কালের আঁধার সাড়া নাহি দিল হায়!
শুধু যে আঁধার---শুধু নীরবতা---কিছু নাহি জাগে আর,
নিভান প্রদীপ রেখে যায় শুধু অসীমের বিস্তার !

সন্ধ্যায় আজি ঘনায়ে এসেছে নিবিড় অন্ধকার,---
দিনের কথাটি ফুরায়ে এসেছে, শুদ্ধ যে চারিধার,---
নিশ্চল শুধু দাঁড়ায়ে রয়েছে তন্দ্রামগন শাখী,
কুলায়ের মাঝে ফিরিয়া আসিয়া নীরব হয়েছে পাখী ;
কেন আর তবে মাটির প্রদীপ ক্ষীণ তোর কম্পনে
ব্যর্থ প্রয়াসে জীবনের স্মৃতি টেনে রাখ প্রাণপণে !
কালের অতলে হারায়েছে যার ব্যর্থ অর্থ ভার,
তাহারে ঘিরিয়া জাগুক শুধুই নীরব অন্ধকার!

.                  *****************             

.                                                                              
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর
*
এপারে-ওপারে
কবি শশিভূষণ দাশগুপ্ত
রায়বাহাদুর জলধর সেন সম্পাদিত “ভারতবর্ষ” পত্রিকার বৈশাখ ১৩৪৪ (এপ্রিল ১৯৩৭)
সংখ্যায় প্রকাশিত কবিতা। মিলনসাগরে প্রকাশ ২৩.৪.২০২১।

ওপারে দেবতা একাকী বাজায় বাঁশী,---
.        এপারে ধরার আঁখি করে ছল্‌ ছল্‌,---
মাঝখানে শুধু লুকায়ে চপল হাসি
.        কালের যমুনা বয়ে যায় কল্‌ কল্‌।
বাতাস বহিছে অনাদি-বিরহ-বাণী,
কাঁপিছে ধরার বন-অঞ্চলখানি,
ওপারে এপারে কত যেন জানাজানি,---
.        জানে যেন তাহা যমুনার কালো জল।
ওপারের বঁধু একা করে হাতছানি,
.        হেথা বিরহিণী---আঁখি দু'টি ছল্ ছল্!

ওপারের কূলে ভাসায়ে প্রেমের তরি
.        ডাকিছে বিদেশী অজানার কোন্‌ নেয়ে,
যমুনার জলে ভাসাইয়া যে গাগরি
.        চাহিয়া রেয়েছে অ-বোলা কিশোরী মেয়ে।
ওপারের ঢেউ ভাঙে এপারের কূলে,
ওকূল ভরিছে কবরীর কেয়া ফুলে,
ওপারে এপারে নীরবে নয়ন তুলে
.        যুগযুগান্তে দু'জনে রয়েছে চেয়ে---
বিদেশীর নাও ওপারে উঠিছে দুলে,---
.        অশ্রু মুছিছে হেথা সুন্দরী মেয়ে!

.                  *****************             

.                                                                              
সূচীতে . . .   


মিলনসাগর