কবি শতরূপা সান্যালের কবিতা
*
দুঃখ সখা
কবি শতরূপা সান্যাল

আপনি বললেন, “ভুলে যাবেন না
জন্ম থেকেই আপনি বলি প্রদত্ত, কনডেম্ ড্”
আমি বুঝতে পারলাম না আপনার কথা।

আমার হাত দুটো ডানা হয়ে গেছিল
উড়তে গিয়ে কোথাও আকাশ খুঁজে পেলাম না।
আমার পা দুটোয় রোলার স্কেটের দুরন্ত গতি
রাস্তা আমার পা দুটোকে নিতে রাজি হল না
আমার মাথা সব গাছ ছাড়িয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে
আকাশ ছুঁতে ফন ফন্ করে বাড়ছিল
চেপে ধরে আমায় একটা হরলিক্সের বোতলে
ঢুকিয়ে দেওয়া হল।

দম বন্ধ হয়ো আসছে
একটি হাওয়া পেতে চাইছে আমার ফুসফুস।

কেন কাকজ্যোত্স্নায় দুঃথে ভিজে যাই
কেন ফুটিফাটা স্বদেশের মাটিতে আমার
পা ফেটে রক্ত পড়ে
কেন কান পাতলে শুনি হু হু কান্নার কোরাস . . .
আমি তো স্বাধীন দেশে জন্মানো এক অভাগা বটগাছ
শিকড় যার গঙ্গেত্রীর দিকে ধাবমান
পাতার আঙুলে যার সূর্যের আদর
আমার শিরায় ছুটে যাচ্ছে অনেক
পীর-পয়গম্বর শ্রমন সাধুর দেহ-নির্যাস
আমার শিরায় ছুটে যাচ্ছে দুঃখ আর চোখের জল
তবু আমি কাঁতে চাইলাম
আপনিও দিলেন না কান্নার কোনও আবহ।
বরং পিট সিগারের গিটারে ঝঙ্কার তুললেন
এপাড় গঙ্গা ওপাড় গঙ্গায় চুমো খেলেন
ভীমসেন যোশী বড়ে গোলাম আলির পায়ে
বিসমিল্লার শানাই-ও
দুঃখ ঝিকমিক করে উঠলো গলানো সোনার মতো।
আমার শুকনো চোখে কণ্ঠ রেখে বললেন
“হেরে যাবেন না বন্ধু
দুঃখ আপনার সখা
রক্তক্ষরণ আমাদের নিত্যসঙ্গী
কেননা আপনি জন্ম থেকেই দুঃখের কাছে বলিপ্রদত্ত।
ভুলে যাবেন না।”

.        *************************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিসর্জন
কবি শতরূপা সান্যাল

সাধে কি তোমায় ডেকেছি “কৃষ্ণসখা” বলে ?
ঠিক মথুরায় গিয়ে ভুলে গেলে
এই বৃন্দাবন, এই মথুরা, এই প্রফুল্ল কদম্ববন।
তোমার সামনে পিছনে লোক লস্কর
পাইক পেয়াদা মন্ত্রী বিদূষক
কোথায় কোন গোপবালিকা আনমনে
চোখের জলে পথ ভুল করে পড়ে রইল
কে আর মনে রাখে!

সে মেয়ে তো রন্নাবান্না ঘরকন্নায় ভালই ছিল---
তুমিই তো তাকে বারেবারে বাঁশিতে
ডাকলে, মুগ্ধ করলে, ভোলালে তার ইহকাল পরকাল।
ঝুঁকি যা নেবার সে-ই নিল।
তবু চার দিনের পুজো শেষ হতেই
দেবী হয়ে গেলেন মাটির প্রতিমা।
মন্দির থেকে একেবারে সোজা জলে বিসর্জন।
কৃষ্ণ হে---তিনশো বছরের বুড়ি কলকাতার
এঁদো গলিতে চোখের জলে গলে যাচ্ছে
তোমার প্রাণপ্রিয়া---দেবীপ্রতিমা!
রাজদণ্ড ছেড়ে একবারও কি বাঁশিতে ফুঁ দেবে না ?

.           *************************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কবিতা লিখো না
কবি শতরূপা সান্যাল

তানপুরাটার তার বেঁধে দিতে
হেমন্তরাতে ক্ষুধিত পাষাণ
সিঁড়ি বেয়ে নামে বিগত মাড়োয়াঁ
সিং দরজায় দরবারী টান।

হিং টিং ছট কবিতার তোড়ে
বন কেটে সাফ কাগজ যোগাতে
কেষ্ট বিষ্টু বারেন্দ্র রাঢ়ী
হাতে হাতে দেয় খায় পাতে পাতে।

তানপুরা শুধু চাইতে জানে না
উথাল পাথাল গ্রামীণ যুবার
অনুক্ত প্রেম-প্রীতি-উচ্ছ্বাসে
বাঁদিয়ে রাখতে কোনো গুরুবার!

কবিতা লিখো না মাটিয়াল ছেলে
কবি হতে চেয়ে ভিড়ো না দলে
বানজারা তবু এখানে ওখানে
গোটা গিলে খাবে বেসামাল হলে।

তার বেঁধে দিতে হাজার বছর
তোমার সামনে ফিরে ফিরে আসে
আদরে সোহাগে যেখানেই বাঁচো
কবিতা থাকুক প্রাণে নিঃশ্বাসে।

.       **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আতঙ্ক প্রহর
কবি শতরূপা সান্যাল

যে সকালে আতঙ্ক শুধুই
মৃত্যু-মৃত্যু খেলা পথে ঘাটে
বোমা রক্ত বিস্ফোরণ ধোঁয়া
সেই ভোর বসেছে চৌকাঠে।

এখনই বিদেয় করো ওকে
শূন্যহাতে ফিরাও এখনই
বেলা গেলে ঠিক ভরে নেবে
ঝুলি ভর্তি মৃত্যু-রাগ মণি!

অনাহারী শিশুরা তাকিয়ে
অসহায় সন্ত্রস্ত বাছারা---
যুদ্ধবাজী এবার থামুক---
ঘরে যাক রণক্ষেত্রে যারা।

কারও বাবা-ভাই-ছেলে-স্বামী
পরস্পর ঘৃণার সংঘাতে
যুযুধান প্রতিপক্ষ হয়ে
রক্তের আদিম স্বাদে মাতে।

বন্ধ হোক এই তীব্র ঘৃণা
শেষ হোক আতঙ্ক প্রহর
রক্তস্নান জল-পট ছুঁয়ে
সেরে যাক পৃথিবীর জ্বর।

.   **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
এক ধর্ষিতা মৃতা বালিকার চিঠি
কবি শতরূপা সান্যাল

ঘুমিয়ে আছে শহর গঞ্জ গ্রাম
এ ঘুম তাদের ভাঙবে কবে মা ?
আমার মতন আরো কতই বিভা
কৈশোরটাই চোখেও দেখবে না ?

আটটা বছর খেলাধুলোর পাশে
অনেক কিছুই শিখেছিলাম আমি
নরম পায়ে এক্কা দোক্কা লাফে
কেউ বলেনি আমিও হব নারী।

হজমি কিনে একলা ফেরার পথে
অত্তোবড় লোকটা আমায় ডেকে
অন্ধকারে কী যন্ত্রণা মাগো---
তারপরে দম আটকে মারল শেষে।

তোমরা দেখো, ওর কামিজের নীচে
আমার ব্যাথার রক্ত লেগে আছে
তোমরা দেখো, আরো ছ’জন বিভা
খুন হবে, ওর সাতখুনই মাফ হবে।

পুরুষ মানুষ কিনা।
আমার কান্না মরণ-ব্যথা তুমিই শুনো মা।

.          **********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর