কবি শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় - জন্মগ্রহণ করেন অধুনা বাংলাদেশের ভৈরব নদ এবং রূপসা নদী
পরিবেষ্টিত খুলনা শহরে। পিতা শচীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পুলিশের অফিসার। মাতা পি. সি.
রায়-এর কন্যা এবং স্বদেশী আন্দোলনের একজন যোদ্ধা, রাধারাণী দেবী।

কৈশোরের শেষ ও তারুণ্যের ছায়া মাড়িয়ে যৌবনের দোরগোড়ায় পৌছে এল সেই অস্থির দিনগুলো।
ভাতৃঘাতী দাঙ্গা, দেশভাগ। পাকিস্তান-আনসার বাহিণীর দানবীয় ধ্বনিতে তখন
 সেখানে সবাই  ভয়ে  
কম্পমান। বাড়ি-ঘর,  সহায় সম্বল সব ছেড়ে জন্মভূমিকে শেষ বারের মতো প্রণাম জানিয়ে,  “রিফিউজি”
নামক নতুন উপাধি মাথায় নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হলেন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। শুরু হয়ে গেল বেঁচে
থাকার লড়াই। অনেক ঘুরতে ঘুরতে শেষে আশ্রয় পেলেন অগ্রজা শিবানী চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে,
কলকাতার দক্ষিণ টালিগঞ্জের “বাঁশদ্রোণী”-তে। দিদি শিবানী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন প্রতিষ্ঠিত প্রাবন্ধিক এবং
চিত্র-গ্রাহিকা।

কলকাতার আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে কবি, কিছুদিনের মধ্যে, খানপুর স্কুলে সামান্য মাইনের
শিক্ষকতার চাকরি পান। দিদি শিবানী চট্টোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় লেখালেখি শুরু করেন আনন্দবাজার
পত্রিকার রবিবাসরীয়, দেশ, বসুমতী প্রভৃতি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

কবি ৪০ থেকে ৬০ এর দশকের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে
তিনি নানা রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। “গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা” গানের
সংকলনে, কৌশিক সেনগুপ্ত লিখেছেন “যাটের দশকের বাংলার রাজনীতির পরিবেশ তখন উত্তাল। মানুষের
অধিকার যেখানেই খর্ব হয়েছে, শিবদাস সেখানেই প্রতিবাদে, প্রতিরোধে শামিল। খাদ্য অন্দোলনে পুলিশের
লাঠির বাড়ি খাওয়া, ট্রাম আন্দোলনে জেল খাটা, এ সবই স্বেচ্ছায় সে বরণ করে নিয়েছিল।”

কবির গীতিকার হিসেবে প্রথম অবদান ছিল প্রখ্যাত শিল্পী অপরেশ লাহিড়ীর অনুরোধে আর.এস.পি. দলের
(বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল) একটি অনুষ্ঠানের জন্য উদ্বোধনী সংগীত লিখে দেওয়া। লিখলেন “এই কি পৃথিবী
সেই ? যেথায় আশার আলো ছলনা করে…”।  গানটি সেই অনুষ্ঠানেই গাওয়া হয়েছিল অপরেশ লাহিড়ীর
সুরে।

এরপর পঞ্চাশের দশকেই, কবি শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের আলাপ হয় দমদমের
মতিঝিলের এক সাহিত্য সভায়।
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রই তাঁকে নিয়ে গিয়ে আকাশবাণীর তালিকাভুক্ত গীতিকার
করে দিয়েছিলেন।

এরপর এইচ.এম.ভি.
(His Master’s Voice) থেকে কবি শিল্পী সুরকার অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ও সনৎ
সিংহের কণ্ঠে বার হয় তার লেখা যুগান্তকারী গান  “সরস্বতী বিদ্যেবতি তোমায় দিলাম খোলা চিঠি”! গানটি
বিগত যাট বছর ধরে বাঙালী শিশুমানসকে একই ভাবে প্রভাবিত করে আসছে। এই গানটি আজও বাঙালীর
প্রিয়তম গানের মধ্যে অন্যতম। এমন বাঙালী পাওয়া কঠিন হবে যে এই গানটি, জীবনের কোনো এক সময়,
শোনেননি বা নিজের গলায় গান নি!

১৯৫৫ সালে, খাদ্য আন্দোলনের সময়ে সব কিছুতেই লাইন দেওয়াকে নিয়ে লিখেছিলেন “লাইন লাগাও লাইন
লাগাও” গানটি। গানে সুর দিয়েছিলেন  ভি.ভালসারা।  এটিই ছিল ভি.বালসারার সুর দেওয়া প্রথম বাংলা
গান। অপরেশ লাহিড়ীর কণ্ঠে গানটির আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা আজও বাঙালী ভুলতে পারে নি।

জীবনের গভীর মূল্যবোধ থেকে লিখেছেন “মানুষ মানুষের জন্য”, “হে দোলা”, “আমি এক যাযাবর”, “বিস্তীর্ণ
দুপারে”, “গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা”, “আজ জীবন খুঁজে পাবি”, “সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে
নজরুল”, প্রভৃতি অনবদ্য সব গান। গানগুলি ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে জনপ্রিয়তার শিখরে স্থান পায়। কবির
লেখা বহু রোম্যান্টিক আধুনিক গানও বিভিন্ন সময়ে চরম জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

ক্যালকাটা ইউথ কয়্যারের কর্ণধার রুমা গুহঠাকুরতা কবির লেখা গান “ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম” গানটি
পরিবেশন করেছেন ওয়াই.এস.মুলকি-র সুরে। বিভিন্ন সময়ে গণসঙ্গীত হিসেবে তাঁর আরও বহু গান গাওয়া
হয়েছে।

পরিচয় হয় রুমাদেবীর পুত্র প্রখ্যাত শিল্পী অমিতকুমারের সঙ্গে। অমিতকুমারের কণ্ঠেও রয়েছে কবির লেখা
বহু গান। অমিতের মাধ্যমে পরিচয় হয় পিতা কিশোরকুমারের সঙ্গে। কিশোরকুমার কবিকে বম্বে নিয়ে যান
এবং তাঁর কণ্ঠেও কবির লেখা বহু গান ও গীতি আলেখ্য আমরা পাই।

শেষ জীবনে, কবির অতি স্নেভাজন
কবি প্রবীর জানার নেওয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি জানিয়েছিলেন
যে তাঁর রচিত গানের মধ্যে তাঁর নিজের সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল “ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম”। তাঁর হার্টের
সমস্যার জন্য শেষদিকে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার   রবীন্দ্রনাথ  ট্যাগোর হসপিটালে (দেবী শেট্টি
হাসপাতাল)। প্রবাদপ্রতীম চিকিত্সক দেবী শেট্টির অনুরোধেও কবি রচনা করেছিলেন একটি গান। গানটি
আমরা হাতে পেলেই এখানে প্রকাশিত করবো।

৮ই অগাস্ট ২০০৭ তারিখের রাত্রি ৮টায়, কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে, কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করেন।

তাঁর লেখা অনেক গান, জনপ্রিয় হওয়া সত্যেও, বহু মানুষের কাছে গীতিকারের নামটি, কি এক অজ্ঞাত
কারণে পৌঁছায় নি। বিভিন্ন চটি গানের বইতে তাঁর অনেক গান অন্য কোনো গীতিকারের নামে চলছে। তাঁর
গানের সংকলন “গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা” বইটিতে তাঁর কিছু অনুবাদ করা গানও অনর্ভুক্ত করা
হয়েছে। সেই সব গানে কিন্তু স্পষ্ট করে মূল গানের গীতিকারের নাম দেওয়া রয়েছে।    

আমরা মিলনসাগরে, চেষ্টা করেছি তাঁর কিছু গান ও কবিতার কথা এখানে তুলতে। আমরা কৃতজ্ঞ কবি
শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাগ্নেপ্রতীম ও স্নেহভাজন
কবি প্রবীর জানা, প্রাবন্ধিক ও কালি কলম পত্রিকার গ্রন্থ
সমালোচক শ্রী চুনিলাল রায়, শৈলেন্দ্রকুমার চৌধুরী স্মৃতি রক্ষা কমিটির শ্রী সমর চৌধুরী এবং শ্রী
অম্লানকুসুম সেনগুপ্তের কাছে যাঁরা আমাদের এই প্রয়াসটি রূপায়ণ করতে সাহায্য করেছেন। আমরা কৃতজ্ঞ
কবি প্রবীর জানার কাছে যিনি তাঁর সংগ্রহ থেকে আমদের কবির ছবিটি দিয়েছেন।



আমরা
মিলনসাগরে  কবি শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা ও গান তুলে আনন্দিত। তাঁর গানের কথা
আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে আমাদের এই প্রচেষ্টাকে সার্থক মেন করবো।


উত্স - কবি প্রবীর জানা, প্রাবন্ধিক ও কালি কলম পত্রিকার গ্রন্থ সমালোচক শ্রী চুনিলাল রায়, শৈলেন্দ্রকুমার
.        
চৌধুরী স্মৃতি রক্ষা কমিটির শ্রী সমর চৌধুরী এবং শ্রী অম্লানকুসুম সেনগুপ্তের সঙ্গে একটি
.        
সাক্ষাত্কার। ১৭.৫.২০১৩ তারিখে মিলসাগরের পক্ষে এই সাক্ষাত্কারটি নিয়েছিলেন মিলন সেনগুপ্ত।
.        শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, “ইতিহাসের ইতিকথা”, “গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা”, দে’জ পাবলিশিং,
.        কলকাতা বইমেলা ২০০৬।   
.        কৌশিক সেনগুপ্ত, “মনে রেখ, লিখে রেখ, এই নাম”, “গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা”, দে’জ
.        পাবলিশিং, কলকাতা বইমেলা ২০০৬।


কবি শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন


আমাদের ই-মেল -
srimilansengupta@yahoo.co.in     


এই পাতা প্রকাশ - ২৮.০৫.২০১৩
...