চৈতন্যের সন্ন্যাস
পুষ্পমালা কাব্যগ্রন্থ থেকে    
শিবনাথ শাস্ত্রী

চৈতন্যের জীবন চরিতে দেখা যায় যে নবদ্বীপবাসী জগন্নাথ মিশ্রের  
বিশ্বরূপ ও কনিষ্ঠের নাম চৈতন্য | বিশ্বরূপ পূর্বেই সন্ন্যাস গ্রহণ করি
তদবধি পাছে চৈতন্যও তাঁহার জ্যেষ্ঠের পদবীর অনুসরণ করেন, ব
উত্কণ্ঠিত থাকিতেন | ইতিমধ্যে কেশব ভারতী নামে এক জন সন্ন্যা
গোপনে তাহার নিকট সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া, নবদ্বীপ পরিত্যাগ
ভ্রমণে নির্গত হন | শচী আদর করিয়া চৈতন্যকে নিমাই বলিয়া ডাকি


.                (১)
 
 
 
 


.                (২)
বউমা! বউমা ঘুমা’ওনা আর!
উঠ অভাগিনী! দেখ একবার ;
প্রাণের নিমাই বুঝি ঘরে নাই,
বুঝিবা পলাল করি অন্ধকার!


.                (৩)
তাই বটে হায়! বধূ একাকিনী
রয়েছে নিদ্রিত সরলা কামিনী ;
শূন্য পড়ি ঘর কোথা প্রাণেশ্বর!
গেছে গেছে করে উঠে বিনোদিনী |


.                (৪)
সে কি বল বউ! ও মা সে কি কথা!
হা মোর নিমাই পলাইল কোথা!
পাগলিনী প্রা., দ্বারে গিয়া হায়!
নাম ধরে কত ডাকিলেন মাতা!


.                (৫)
ডাকেন জননী নিমাই! নিমাই!
প্রতিধ্বনি বলে নাই নাই নাই ;
ডাকিছেন যত শোক সিন্ধু তত
উঠলিয়া উঠে | কোথারে নিমাই!


.                (৬)
গভীর নিশীথে দূর গ্রামান্তরে,
সেই প্রতিধ্বনি যাই যাই করে ;
ভাবেন জননী আসে গুণমণি
ডাকেন উত্সাহে হরিষ অন্তরে |


.                (৭)
নিমাই! নিমাই! হা মাতা সরলে!
পাগলিনী হলে সকলেই ছলে ;
কাঁদ মা জননা! তব গুণমণি
আঁধারে লুকায়ে ওই গেল চলে |


.                (৮)
ওই গেল চলে পাগলের প্রায়,
জাননা ত মাতা কে তারে লওয়ায় |
উন্নত আকাশে খধূপ প্রকাশে @
আপনার বেগে সে কি সেথা যায় ?


.                (৯)
প্রবল আগুন জ্বলেছে ভিতরে,
আর তারে হেথা কেন রাখে ধরে ?
তাই মহা বেগে যায় অনুরাগে,
পাপী জগতের পরিত্রাণ তরে |


.                (১০)
ধরেছ জঠরে তাই বলে তারে,
পার কি রাখিতে আপন আগারে ?
যে কাজ সাধিতে আসা অবনীতে
নিলেন ঈশ্বর সে কাজে তাহারে |


.                (১১)
নদীয়াতে ছিল তোমার
আজি সে হইল পাপীদে
জগতের তরে সে যে প্রা
বুঝিলে না মাতা কাঁদিতে


.                (১২)
শচী মাতা কাঁদে ঘর ফে
বিষ্ণু-প্রিয়া দ্বারে পুতলী
দাঁড়ায়ে ললনা, বিষণ্ণ-বদ
বিন্দু বিন্দু অশ্রু পড়িতে


.                (১৩)
কেঁদনা লেখনি! কর হে
স্নেহময়ী মার যে ঘোর
কাটা ছাগী মত ধড় ফড়
করিছেন মাতা হারায়ে


.                (১৪)
বধূ নিজ-মুখ মুছিছে অঞ্চলে,
আর হস্তে ঠেলে মাগো মাগো বলে ;
শোকের সাগরে দুটি নারী মরে
উঠ প্রতিবাসি! উঠগো সকলে |


.                (১৫)
কেঁদনা লেখনি! পেওনারে ভয়,
লোকে ত বলিবে নিমাই নির্দ্দয়,
তুমি কি জানিবে তুমি কি বুঝিবে
আমি ত জানি না কিসে কি যে হয় |


.                (১৬)
রজনী পোহাল দিক প্রকাশিল ;
শচীর ক্রন্দন গগনে উঠিল ;
উঠি প্রতিবাসী ত্বরা করি আসি
কি হইল বলি দ্বারেতে ডাকিল |


.                (১৭)
ঘরে আসি দেখে সে ঘর আঁধার!
সে প্রসন্ন মুখ সেথা নাহি আর!
শির কর দিয়ে, পড়িল বসিয়ে
“হায় কি হইল!” মুখেতে সবার |


.                (১৮)
এদিকেতে গোরা নিজ বেগে ধায়,
কেশব ভারতী আছেন যথায় |
হরি-গুণ গান করি পথে যান,
প্রেমের সাগর উথলিয়া যায় |


.                (১৯)
নিশিতো ডাকিলে লোকে ধায় যথা,
নিজ মনে গোরা চলিয়াছে তথা ;
পাপীর ক্রন্দন করিছে শ্রবণ
আর বার ভাবে জননীর কথা |


.                (২০)
বলেন সঘনে কোথা দয়াময়!
রহিলা জননী কারো যাহা হয় |
আমি দ্বারে দ্বারে ঘুষিব তোমারে
এ দেহে জীবন যত কাল রয় |


.                (২১)
নির্মল প্রকৃতি সরলা যুবতী
ঘরে আছে জায়া পতিব্রতা সতী ;
তারে দয়া করি, তবে দেখ হরি!
করো করো নাথ! তাহার সদ্গতি |


.                (২২)
প্রিয় নবদ্বীপ! প্রিয় ভাগীরথি!
ছেড়ে যাই আমি দেও অনুমতি!
হরি সংকীর্ত্তনে তোমা দুইজনে
জুড়ায়েছি আমি যেমন শকতি |


.                (২৩)
প্রিয় হরি নাম, ঘুষিব বিদেশে,
দ্বারে দ্বারে যাব ভিখারীর বেশে ;
নিজে পায়ে ধরি ভজাইব হরি ;
হরিনামে পাপী ঘুচাইবে ক্লেশে |


.                (২৪)
এত বলি গোরা নদে ছাড়ি যায় ;
নদে পুরী শোকে করে হায় হায়!
কারে কি যে কর, জান হে ঈশ্বর!
দেখে শুনে কবি হত-বুদ্ধি-প্রায় |


.          ******************     
.                                                                                            
সুচিতে...   

@ খধূপ - হাওয়াই


মিলনসাগর
কবি শিবনাথ শাস্ত্রীর কবিতা
*
প্রকৃত সাহস     
পুষ্পমালা কাব্যগ্রন্থ থেকে
শিবনাথ শাস্ত্রী

.                (১)
 
  
  
  
 
  
 
  
  
  


.                (২)
সুখের শয্যাতে মোহ-নিদ্রাগত,
কে চায় কে চায় থাকিতে নিয়ত!
নারীর রুধিরে জন্ম বলে কি রে
নারীর সমান হব ক্ষীণ-প্রাণ ?
সংসার তর্জ্জনে হব অভিভূত ?
ধিক্ সে জড়তা, ধিক্ সে বাসনা!
বার দর্পে ভরা, ওই দেখ ধরা,
কি সে দুঃখ, যার হেন গুরুভার,
ঈশ্বরের নামে যাহা সহিব না ?
যার ভারে শক্তি একেবারে হত ?


.                (৩)
যতবার পড়ে উঠে ততবার,
বীর-মন্ত্রে দীক্ষা তবে বলি তার!
নরের নরত্ব পশুত্ব দেবত্ব,
এ সংগ্রাম বিনা নর দেব কি না
কে আর প্রকাশে ?---রক্ত শ্রোতে যার
বক্ষস্থল ভাসে, কিন্তু তবু প্রাণ
কভু ম্সান নয়, শুভ ইচ্ছা-ময়!
যার খরতর শরে জর জর,
তাহারি কল্যাণ অন্তরের ধ্যান
নরত্ব দেবত্ব এক স্থানে তার!


.                (৪)
আয় তবে আয় ঘোর দরিদ্রতা!
রুধির-শোষিণী পৈতৃক দেবতা!
আয় বজ্রধ্বনি! আয় কালফণি!
নর শত্রু যারা আয় সবে তোরা,
ঘের চারিদিকে করিয়ে জনতা |
জীবন আকাশ, বিপদ দুর্দ্দিনে
ঘেরিয়া আমার হোক অন্ধকার ;
সব কষ্ট সয়ে, রব স্থির হয়ে,
কে পায় পৌরুষ দুঃখ কষ্ট বিনে ?
ঘুমায়ে মানুষ কে হয়েছে কোথা ?


.                (৫)
তবে মুছি অশ্রু উঠিয়া দাঁড়াই |
যা হবার হলো এ জনম গেল
বিষম সংগ্রামে তাতে দুঃখ নাই |
রক্ত-বিন্দু হতে শুনি এ জগতে
শত রক্ত-বীজ জন্মে যে প্রকার |
জীবন সংগ্রামে ভারতের নামে
যত রক্ত-বিন্দু পড়িল এবার,
শত পুত্র হবে বীর অবতার!
ভারত আঁধার ভারতের ভার
ঘুচাইবে তারা ;---ভেবে মরে যাই |

.          ******************     
.                                                                                            
সুচিতে...   



মিলনসাগর
*
ফুল       
পুষ্পমালা কাব্যগ্রন্থ থেকে
শিবনাথ শাস্ত্রী


(নির্জ্জন উদ্যানে লিখিত)

.                (১)






    





একে ত কোমল, তাতে হিমজল,
যেন ঢল ঢল লাবণ্যের ভার!
নিরখি, নিরখি, যেন ডুবে যাই
ওরে প্রিয় ফুল! তুলনা ত নাই ;
কি তুলনা দিব, মিছা কি বর্ণিব,
অতুলন তুমি বলেছে সংসার |


.                (৩)
নবীন যৌবনে নব প্রস্ফুটিত,
সারল্য, বিনয়, আনন্দে জড়িত,
নারীর বদন সুন্দর কেমন!!
তা সঙ্গে কিরে করিব তুলিত ?
জগতের শোভা রমণীর মুখ
তাতেও জীবের হরে শত দুখ,
সকল হৃদয়ে সকল সময়ে
কিন্তু হেন ভাব হয় না উদিত!


.                (৪)
যেরূপ নির্জ্জনে দূর লোকালয়ে
তরু-পত্রাবৃত কুটির হৃদয়ে,
সতী পতিপ্রাণা, গৃহস্থ ললনা
থাকে একাকিনী কুলধর্ম্ম লয়ে |
তার যে সতীত্ব দেব প্রসংসিত,
তুচ্ছ রূপ শোভা যেখানে নিন্দিত,
অসাধুর দৃষ্টি হলাহল বৃষ্টি
করে না ; সে আছে তব সম হয়ে |


.                (৫)
অথবা সুন্দর শিশু সুকুমার
প্রাতে নিদ্রাভঙ্গে উঠে যে প্রকার,
প্রফুল্ল কোমল মুখে স্বেদজল,
ঠিক যেন এই নিশার নীহার |
নিষ্কলঙ্ক মুখে নিষ্কলঙ্ক হাসি,
এমনি দেখিতে বড় ভালবাসি ;
তবে প্রিয় ফুল! যদিও অতুল
তার সনে করি তুলনা তোমার |


.                (৬)
অথবা নির্জ্জন পল্লীতে যেমন
লুকাইয়া থাকে সাধু কোন জন,
তাঁর যে চরিত্র উজ্জ্বল পবিত্র,
নিজে প্রকাশিত, জানে না ভূবন!
আপন পল্লীতে আপনার ঘরে,
নিজের সৌরভে আমোদিত করে
সেই অজানিত চরিত্র সহিত
হও রে তুলুত হেন লয় মন |


.                (৭)
কোথা দিনমণি সুদূর গগণে,
কোথা তুমি ফুল সহস্র যোজনে!
কিন্তু রে উষার না হতে সঞ্চার,
ফুটিয়া উঠিলে আনন্দিত মনে ;
দিবাকরে দেখি হইলে পাগল,
ঢল ঢল রূপে আনন্দে বিহ্বল,
কতই হাসিছ হেলিছ দুলিছ,
ক্ষুদ্র দৃষ্টি তুলি দিবাকর পানে |


.                (৮)
কোথায় অগম্য অপার ঈশ্বর,
কোথা ক্ষুদ্রজীব হীনমতি নর!
কিন্তু রে গগণে, দেখে সে তপনে
হয় প্রস্ফুটিত জীবেরো অন্তর ;
প্রাণ-পদ্ম ফুটে তারো দলে দলে ;
তারো তনু সিক্ত প্রেম-ভক্তি-জলে ;
এ পাপ ভূবনে সেই জীব সনে
হওরে তুলিত কুসুম সুন্দর |


.                (৯)
তুমি ক্ষুদ্র চক্ষে দিবাকর পানে
যে ভাবে চাহিয়া আছ এক মনে,
নিজ ক্ষুদ্র আঁখি, তাঁর চক্ষে রাখি
জীবাত্মা মগন থাকে যোগধ্যানে ;
চক্ষে চক্ষে উঠে প্রেমের লহরী ;
এ পাপ সংসার যায় যে পাশরি ;
সব আশা ফুটে, কি সৌরভ ছুটে
কার সাধ্য তাহা বর্ণেতে বাখানে |


.                (১০)
তোমার আদর করে সর্ব্বজনে,
সুসভ্য অসভ্য সকল ভূবনে ;
ব্যাধের যুবতী, সরলা প্রকৃতি,
তোমারে তুলিয়া, পরম যতনে
গাঁথিয়া কোমল সুচিকণ হার
সোহাগে হৃদয়ে পরে আপনার ;
তুমি প্রিয় ফুল! কর্ণে হও দুল
সব অলঙ্কার তুমি তার সনে |


.                (১১)
সুসভ্য ইংরাজ পাইলে তোমারে
এখনি সাজাবে, তুলি থরে থরে,
প্রণয়িনী-পাশে লইয়া উল্লাসে
দিবে বসাইয়া হৃদয় উপরে |
বঙ্গবালা পেলে পরিবে যতনে,
সনীল সুন্দর করবী-বন্ধনে,
বসাবে পুলকে, দোলাবে অলকে,
দেখাবে হাসিয়া নিজ প্রাণেশ্বরে!


.                (১২)
কিন্তু রে কুসুম! আর্য্য-সুতগণে,
দিয়াছে তোমারে দেবতা-চরণে |
ঠিক ব্যবহার সেই রে তোমার
সেই রে সদ্গতি ভাবি মনে মনে!
এমন পবিত্র এমন কোমল
দেব পদ ভিন্ন কোথা যাবে বল ?
তোমার মহিমা মানব জানে না
তব গুণ-গ্রাহী শুধু দেবগণে |

.        ******************     
.                                                                                            
সুচিতে...   



মিলনসাগর
*
পরিত্যক্তা রমণী
পুষ্পমালা কাব্যগ্রন্থ থেকে
শিবনাথ শাস্ত্রী

সময়---নিশীথ |
সমীপে, নির্ব্বাণোন্মুখ প্রদীপ |
নবপ্রসূতা কুমারী শয়ানা |


.                (১)








.                (২)
কত শত অশ্রু তুমি রেখেছ ত ঢাঁকিয়া,
সহস্র নিশ্বাস যায় বায়ু সনে বহিয়া |
.        মোর অশ্রু সেই সনে,
.        রাখ সখি! সংগোপনে ;
জুড়াই তাপিত প্রাণ প্রাণ-ভরে কাঁদিয়া,
তোমার অঞ্চল যাক অশ্রুজলে ভিজিয়া |



.                (৩)
অয়ি! সুখময়ি নিশি! তারা-হার পরিয়া,
বসুধার সিংহাসনে রহেছ ত বসিয়া |
.        চেয়ে দেখ পদতলে
.        পড়ে লতা ভাসে জলে,
তুলে লও প্রাণ-ফুল, দয়া করে ছিঁড়িয়া,
নিরমল ফুল থাক তারা সনে মিশিয়া |


.                (৪)
অথবা পার লো যদি হাহাকার বহিতে,
অভাগীর হাহাকার লও তথা ত্বরিতে,
.        যথা সেই নিরদয়,
.        ঘুমাইছে এ সময় ;
যাও তথা হাহাকারে নিদ্রাভঙ্গ করিতে,
নিদ্রাভঙ্গে অভাগীর দুঃখ-কথা কহিতে |


.                (৫)
অভাগীর হাহাকারে যেই আঁখি মেলিবে,
অমনি রজনি! তুমি ধীর স্বরে বলিবে,
.        “ঘুমাও এরবে কেন
.        নয়ন মেলিলে হেন ?
অবলার হাহাকার কেন বৃথা শুনিবে ?
ঘুমাও কাঁদুক তারা চিরকাল কাঁদিবে |”


.                (৬)
রে দীপ! তোমার তৈল ফুরাইয়া আসিছে,
তাই মরি শিখা তব নিবু নিবু করিছে ;
.        আশা-তৈল পামরার
.        বিন্দুমাত্র নাহি আর,
তবু কেন প্রাণ-শিখা এতক্ষণ জ্বলিছে ?
দুর্ব্বল হৃদয়বর্ত্তি হুহু করে পুড়িছে ?


.                (৭)
পুড়িতে পুড়িতে শেষ অবশ্যই হইবে ;
তখন এ পাপ শিখা একেবারে নিবিবে |
.        হাহাকার, অশ্রুজল,
.        ঘুচে যাবে এ সকল ;
নির্দ্দয় পতির আশ সেই দিন মিটিবে,
সেই দিন কমলের শতদল ফুটিবে |


.                (৮)
বিপন্নের বন্ধু তুমি চিরদিন ঘোষণা,
তবে কেন মৃত্যু! আজ অভাগীরে লও না ?
.        নারী প্রাণে কত সয়
.        তাই যদি দেখা হয়,
যথেষ্ট হয়েছে! সত্য আর প্রাণে সয় না,
ফেটে মরি পুড়ে মরি সত্য আর সয় না |


.                (৯)
একা ছিনু, ছিনু ভাল, একাকিনী পড়িয়া
কাঁদিতাম এ বিজনে অশ্রুজলে ভাসিয়া,
.        কত কষ্ট আছে ভালে,
.        কেন এলি হেন কালে ?
নিজে মরি তোমাকে লো কি করিব লইয়া ?
যাই যদি কার কাছে যাইব লো রাখিয়া ?


.                (১০)
তোমারি মায়ায় প্রাণ আর যেতে চায় না,
অনল কি বিষ-পানে আর মন ধায় না |
.        এ হেন জ্বালায় মোরে
.        চিরদিন রাখিবারে,
এলে কি রে ? একি কাণ্ড যে তোমারে চায় না,
তারি ঘরে এলে তুমি! অন্য সেধে পায় না |


.                (১১)
এখন নিতান্ত শিশু কিছু তুমি জান না,
সর্ব্বনেশে মা মা, কথা বলিতে পার না |
.        “কেন মা কাঁদিস” বলে
.        জিজ্ঞাসিবে বড় হলে,
কি উত্তর দিব তার ?---প্রাণে তাত সবে না ;
কাঁদিবে আমার সনে তাও প্রাণে সবে না |


.                (১২)
স্বর্গের বিহঙ্গ! তুমি নিজ পক্ষ ধরিয়া,
অতএব এই বেলা শীঘ্র যাও উড়িয়া |
.        চিরদিন কাঁদিবারে,
.        কেন এলে কারাগারে ?
মায়ের দুর্দশা দেখে উপদেশ লইয়া,
নিষ্কলঙ্ক মূর্ত্তি! যাও মানে মানে উড়িয়া |


.                (১৩)
জন্মেছি কাঁদিতে আমি মরিব ত কাঁদিয়া,
পড়ে আছি, পড়ে থাকি তুমি যাও চলিয়া ;
.        এই বেলা যাও তবে ;
নারিব বিদায় দিতে এইরূপ করিয়া,
দোঁহারে পুড়িতে হবে মায়া জালে পড়িয়া |


.                (১৪)
যাইবার কালে তুমি সেই পথে যাইবে,
তাহাকে নিদ্রিত তথা দেখিবারে পাইবে,
.        ধীরে বসি পদতলে,
.        প্রথমেতে বাবা বলে,
মধুস্বরে ধীরে ধীরে তিন বার ডাকিবে
সম্বোধিয়া তিন বার শেষে চুপ করিবে |


.                (১৫)
তাতে আঁখি নাহি মেলে---পদতলে বসিয়া
হে নির্দ্দয়! জাগো “বলে”---জাগাইবে ডাকিয়া ;
.        তবু যদি নাহি চায়,
.        তখনি ছাড়িবে তায়,
“নারী-হত্যা-পাতকিন্! জাগো জাগো!” বলিয়া
গগণ-বিদারি-স্বরে বলিবে লো ডাকিয়া |


.                (১৬)
জাগিলে বলিবে “কেন এনেছিলে আমারে,
সেই অভাগীর সনে ভাসাইতে পাথারে ?
.        যাই আমি হে কঠিন!
.        সুখে থাকো চিরদিন,
এই আশীর্ব্বাদ সে করিয়াছে তোমারে,
বলে গেনু, কর তুমি যাহা হয় বিচারে |”


.                (১৭)
পবিত্র বিহঙ্গ! তুমি এই কথা বলিয়া,
নিরমল পাখা দুটি গগণেতে তুলিয়া,
.        বিধুমুখে মৃদু হেঁসে
.        উড়ে যেও নিজ দেশে,
তুমি গেলে, পিছু পিছু আমি যাব ছুটিয়া,
কমলের শতদল শোভা পাবে ফুটিয়া |  

.            ******************   
.                                                                                            
সুচিতে...   



মিলনসাগর
*

.  ******************   
.                                                                                            
সুচিতে...   



মিলনসাগর
*
মার্জ্জনা
পুষ্পমালা কাব্যগ্রন্থ থেকে
শিবনাথ শাস্ত্রী

রামের প্রতি রাবণ
(রামায়ণের অনুকরণ)
ভূমে পড়ে ধূলাতে লুটায় |
সঙ্গে শত সহচরী                      মহারাণী মন্দোদরী
পাশে পড়ে অচেতন প্রায় |
স্বর্ণ লঙ্কা অন্ধকার                      সবে করে হাহাকার
কাঁদিতেছে যে আছে যেখানে |
মরেছে পুরুষ যত                      বিধবারা শত শত
কাঁদিতেছে মিলে স্থানে স্থানে |
হেথা দেব রঘু-মণি                       রাবণ মরিল গণি
বসিলেন বিষণ্ণ হইয়ে |
মহাবীর হনুমান                           মন্ত্রিবর জাম্বুবান্
আদি সবে আইল ধাইয়ে |
এসে দেখে রঘু রায়                   বসি স্তম্ভিতের প্রায়
বিষাদেতে মলিন বদন |
বাম করে রাখি শির                 এক দৃষ্টে ভাবে বীর
যেন ঘোর দুঃখেতে মগন |
সবাই দাঁড়ায়ে পাশে                   হঠাৎ সমীপে আসে
হেন সাধ্য কারো নাহি হয় |
ইঙ্গিতে কোলাহল                       ছাড়িয়া বানর দল
দাঁড়াইল হইয়া সভয় |
অবশেষে কিছু পর                    লক্ষ্মণ জুড়িয়া কর
আগে গিয়া করিলা প্রণাম |
এস ভাই রে লক্ষ্মণ!                    এস করি আলিঙ্গন
বলি কোলে করিলা শ্রীরাম |
একে একে কপিগণে                      প্রণমিল শ্রীচরণে
সকলেই দিলা আলিঙ্গন |
পদধূলি লয়ে শিরে                    বসিল চৌদিকে ঘিরে
ভয়ে বসে মুদিত বদন |
কত ক্ষণে রঘুবর                      ধরে লক্ষ্মণের কর
বলিলেন লক্ষ্মণ রে ভাই |
মহাবীর লঙ্কাপতি                   তাঁর আজ কি দুর্গতি
বসে আমি ভাবিতেছি তাই |
এত সব আয়োজন                     করিলাম যে কারণ
সে কামনা পুরিল আমার |
সাগর তো বাঁদা হলো                শত্রুরা সবংশে মলো
জানকীর হইল উদ্ধার |
রাবণের মত ভাই                     কিন্তু আর বীর নাই
বীর-শূন্য ধরণী হইল |
লঙ্কার গৌরব যত                    আজ হতে হলো হত
সব সুখ আজ ফুরাইল |
যদিও রাবণ মোর                    শত্রুতা করেছে ঘোর
তবু আজ কাঁদিছে পরাণ |
ইচ্ছা হয় একবার                  দেখি গিয়ে কি প্রকার
পড়ে বীর পর্ব্বত সমান |
ইচ্ছা হয় কাছে গিয়ে                 প্রেম আলিঙ্গন দিয়ে
অবসানে করি রে সান্ত্বনা |
ইচ্ছা হয় নিজ করে                   তাহারে শুশ্রুষা করে
ঘুচাইগে প্রহার যাতনা |
বলিতে বলিতে রায়                     চলিলেন পায় পায়
বানরেরা চলে মৃদুগতি |
ক্রমে আসি উপনীত                   কুড়ি নেত্র নিমীলিত
করে যেথা পড়ে লঙ্কাপতি |
চেড়ীরা বলিল কাণে                   চাহি শ্রীরামের পানে
মন্দোদরী কাঁদিতে লাগিল |
শত শত সহচরী                       কাঁদে অধোমুখ করি
শোকে যেন তরঙ্গ উঠিল |
হেরিয়া তাদের মুখ                      রামের বিদরে বুক
দুঃখিত কুণ্ঠিত অতিশয় |
কমল নয়ন দিয়া                        পড়ে অশ্রু গড়াইয়া
বিষাদেতে পূরিল হৃদয় |
কাঁদিছেন রঘুপতি                     হেন কালে লঙ্কাপতি
মূর্চ্ছা-ভঙ্গে মেলিলা নয়ন |
নব-জল-ধর-শ্যাম                       সমীপে দেখিলা রাম
শান্ত মূর্ত্তি কমল-লোচন |
দৃষ্টি মাত্রে জুড়ি কর                      প্রণমিলা বীর-বর
শ্রীরামের যুগল চরণে |
বিষাদে পূরিল প্রাণ                       বদন হইল ম্লান
ধারা বহে বিংশতি নয়নে |
রাজা বলে রঘুবর                     এই দেখ যুড়ি কর
তব পদে মাগিছে মার্জ্জনা |
আপন কুকর্ম ফলে                      গেনু আমি রসাতলে
নিজ দোষে এত বিড়ম্বনা |
তব নারী লক্ষ্মী সতী                    অত্যাচার তাঁর প্রতি
কভূ তাহা ধর্ম্মে না কি সয় ?
তাই এত পরিবার                        এক প্রাণী নাহি তার
স্বর্ণ লঙ্কা হলো শূন্যময় |
সতীর চোখের জল                      যেথা পড়ে সেই স্থল
উড়ে পুড়ে যায় সেই ক্ষণে |
শুনে কভু মানি নাই                    আজ দেখিলাম তাই
সত্য আজ বুঝিলাম মনে |
নিজ বল অহঙ্কারে                   ভাবিতাম এ সংসারে
অধর্ম্মের হবে বুঝি জয় |
কিন্তু আজি সেই ঘোর                স্বপন ভাঙ্গিল মোর
আজ জ্ঞান হইল উদয় |
যা হবার হলো তাহা                তোমার কর্তব্য যাহা
করিলে ত বনিতার তরে |
আপন বনিতা লয়ে                যাও তুমি সুখী হয়ে