কবি শিবনাথ শাস্ত্রীর কবিতা |
মার্জ্জনা পুষ্পমালা কাব্যগ্রন্থ থেকে শিবনাথ শাস্ত্রী রামের প্রতি রাবণ (রামায়ণের অনুকরণ) |
ভূমে পড়ে ধূলাতে লুটায় | সঙ্গে শত সহচরী মহারাণী মন্দোদরী পাশে পড়ে অচেতন প্রায় | স্বর্ণ লঙ্কা অন্ধকার সবে করে হাহাকার কাঁদিতেছে যে আছে যেখানে | মরেছে পুরুষ যত বিধবারা শত শত কাঁদিতেছে মিলে স্থানে স্থানে | হেথা দেব রঘু-মণি রাবণ মরিল গণি বসিলেন বিষণ্ণ হইয়ে | মহাবীর হনুমান মন্ত্রিবর জাম্বুবান্ আদি সবে আইল ধাইয়ে | এসে দেখে রঘু রায় বসি স্তম্ভিতের প্রায় বিষাদেতে মলিন বদন | বাম করে রাখি শির এক দৃষ্টে ভাবে বীর যেন ঘোর দুঃখেতে মগন | সবাই দাঁড়ায়ে পাশে হঠাৎ সমীপে আসে হেন সাধ্য কারো নাহি হয় | ইঙ্গিতে কোলাহল ছাড়িয়া বানর দল দাঁড়াইল হইয়া সভয় | অবশেষে কিছু পর লক্ষ্মণ জুড়িয়া কর আগে গিয়া করিলা প্রণাম | এস ভাই রে লক্ষ্মণ! এস করি আলিঙ্গন বলি কোলে করিলা শ্রীরাম | একে একে কপিগণে প্রণমিল শ্রীচরণে সকলেই দিলা আলিঙ্গন | পদধূলি লয়ে শিরে বসিল চৌদিকে ঘিরে ভয়ে বসে মুদিত বদন | কত ক্ষণে রঘুবর ধরে লক্ষ্মণের কর বলিলেন লক্ষ্মণ রে ভাই | মহাবীর লঙ্কাপতি তাঁর আজ কি দুর্গতি বসে আমি ভাবিতেছি তাই | এত সব আয়োজন করিলাম যে কারণ সে কামনা পুরিল আমার | সাগর তো বাঁদা হলো শত্রুরা সবংশে মলো জানকীর হইল উদ্ধার | রাবণের মত ভাই কিন্তু আর বীর নাই বীর-শূন্য ধরণী হইল | লঙ্কার গৌরব যত আজ হতে হলো হত সব সুখ আজ ফুরাইল | যদিও রাবণ মোর শত্রুতা করেছে ঘোর তবু আজ কাঁদিছে পরাণ | ইচ্ছা হয় একবার দেখি গিয়ে কি প্রকার পড়ে বীর পর্ব্বত সমান | ইচ্ছা হয় কাছে গিয়ে প্রেম আলিঙ্গন দিয়ে অবসানে করি রে সান্ত্বনা | ইচ্ছা হয় নিজ করে তাহারে শুশ্রুষা করে ঘুচাইগে প্রহার যাতনা | বলিতে বলিতে রায় চলিলেন পায় পায় বানরেরা চলে মৃদুগতি | ক্রমে আসি উপনীত কুড়ি নেত্র নিমীলিত করে যেথা পড়ে লঙ্কাপতি | চেড়ীরা বলিল কাণে চাহি শ্রীরামের পানে মন্দোদরী কাঁদিতে লাগিল | শত শত সহচরী কাঁদে অধোমুখ করি শোকে যেন তরঙ্গ উঠিল | হেরিয়া তাদের মুখ রামের বিদরে বুক দুঃখিত কুণ্ঠিত অতিশয় | কমল নয়ন দিয়া পড়ে অশ্রু গড়াইয়া বিষাদেতে পূরিল হৃদয় | কাঁদিছেন রঘুপতি হেন কালে লঙ্কাপতি মূর্চ্ছা-ভঙ্গে মেলিলা নয়ন | নব-জল-ধর-শ্যাম সমীপে দেখিলা রাম শান্ত মূর্ত্তি কমল-লোচন | দৃষ্টি মাত্রে জুড়ি কর প্রণমিলা বীর-বর শ্রীরামের যুগল চরণে | বিষাদে পূরিল প্রাণ বদন হইল ম্লান ধারা বহে বিংশতি নয়নে | রাজা বলে রঘুবর এই দেখ যুড়ি কর তব পদে মাগিছে মার্জ্জনা | আপন কুকর্ম ফলে গেনু আমি রসাতলে নিজ দোষে এত বিড়ম্বনা | তব নারী লক্ষ্মী সতী অত্যাচার তাঁর প্রতি কভূ তাহা ধর্ম্মে না কি সয় ? তাই এত পরিবার এক প্রাণী নাহি তার স্বর্ণ লঙ্কা হলো শূন্যময় | সতীর চোখের জল যেথা পড়ে সেই স্থল উড়ে পুড়ে যায় সেই ক্ষণে | শুনে কভু মানি নাই আজ দেখিলাম তাই সত্য আজ বুঝিলাম মনে | নিজ বল অহঙ্কারে ভাবিতাম এ সংসারে অধর্ম্মের হবে বুঝি জয় | কিন্তু আজি সেই ঘোর স্বপন ভাঙ্গিল মোর আজ জ্ঞান হইল উদয় | যা হবার হলো তাহা তোমার কর্তব্য যাহা করিলে ত বনিতার তরে | আপন বনিতা লয়ে যাও তুমি সুখী হয়ে |