কবি শিবরাম চক্রবর্তীর কবিতা
|
হাতে হাতে আরাম
শিবরাম চক্রবর্তী
"ডাকাতারবাবু! ডাক্তারবাবু!! হেঁচকি উঠছে এন্তার |"
এই না বলে হর্ষবর্ধন যেই না কাছে গেলেন তাঁর---
কী ক'রে এক চড় কষিয়ে দিয়েছেন তাঁ বাঁ গালে,
সহর্ষে শ্রীহর্ষকে যেই পেয়েছেন নাগালে |
মিলনসাগর
"হাতে হাতে পেলেন তো ফল, দেখুন কেমন দাবাইটার,
এমনি করে একটি চড়ে হেঁচকি সারাই সবাইকার |
মোটে হাতের একটি চোটে এক চাপটের এ টোটকায়
হাতুড়ে-গোবদ্যি বলে তবু সবাই ঘোঁট পাকায়
যা বলে লোক বলুক না হক, ভয় করে না এ ডাক্তার
আরাম করে আরাম দিয়ে আরাম যা পাই আকছার |
সেরে গেলেন, তবু দেখি মুখ যে বেযায় গোমারা-ভার?"
মিলনসাগর
---"আরে মশাই! আমার কি ছাই! হেঁচকি যে ভাই গোবরাটার!"
. ****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
কে যেন ডাকিল---ওরে যাত্রী
“মানুষ” (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থ থেকে
শিবরাম চক্রবর্তী
কে যেন ডাকিল---“ওরে যাত্রী,
পুরাতন বত্সরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রি
. ওই কেটে গেল, এল নবীন প্রভাত!”
শুনিয়া জাগিনু অকস্মাৎ | মিলনসাগর
নববর্ষ আসিয়াছে ?---এলো কি সুন্দর ?
. এলো রুদ্র, এলো ভয়ঙ্কর ?
দারুণ দুর্যোগ হানি’ এলো কি বৈশাখী ?
আকাশের ঝঞ্ঝা ফেরে ধরিত্রীর বন্যারে কি ডাকি ?
. এলো কি প্রলয় ?
বনে বনে শুষ্ক পাতা ঝরিবার নাই আর বাকি ?
নিদারুণ প্রসব ব্যথায় এলো নব-সৃজনের জয় ?
আঁধারের কালো বুকে ঝলিলো কি আলোর কৃপাণ ?
. তারই আগমনী মিলনসাগর
মানুষের দেহে মনে রূপে রসে উঠেছে কি রণি’ ?
. হে দরদী, বল শুনি আজ---
মরুভূর তৃষাতুর তটে দৃষ্টিহীন আঁধারের মাঝ
প্রভাতের যত যাত্রী যুগে যুগে হারায়েছে পথ,
ধরণীর চোরাবালি গ্রাসিয়াছে যাহাদের রথ---
সার্থক হোলো কি আজ তাদের ব্যর্থ অভিযান ?
মানুষের নববর্ষ আসিলো কি নবীন জীবনে ?
মানুষের ললাটে আজ পড়িলো কি রাজটিকা ?
. শেষ তার নিত্য পরাজয় মিলনসাগর
লভিতে অমৃত-ভাগ ভূবন-মন্থনে ?
. কিম্বা বন্ধু, মানুষের নববর্ষ নয়,---
এ শুধু নূতন পাতা খুলিয়াছে প্রাচীন পঞ্জিকা ?
সম্মুখে চাহিয়া দেখি---দীনহীন মানুষের দল
চলিয়াছে রাজপথে ক্ষীণকণ্ঠে করি’ কোলাহল---
. জীবনের ভিখারী তাহারা!
আজিকার এ প্রভাত দেয় নাই কিছুমাত্র সাড়া
. তাহাদের পুরানো জীবনে ;
সাহারা পারায়ে তারা চলিয়াছে আক্লান্ত চরণে---
. যেমন চলেছে কাল তারা |
. ****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
শূন্যসম মূল্যহীন এরা---মানুষের আর দাম নাই |
. তাই তার এত হেলাফেলা
মানুষ-জীবন নিয়ে চিরদিন ছিনিমিনি খেলা!
. জীর্ণপত্রে পুঁথির বিধান---
তারো মূল্য আছে, আছে তাহারো সম্মান!
কীট-দষ্ট দলিত পুঁথির আছে দম্ভ, আছে অধিকার,
কোটি কোটি মানুষের জীবনে ব্যর্থতা রচিবার!
যুগজীর্ণ কঙ্কালের নির্দ্দেশের ফেরে
মানুষের প্রেম রদ্ধ, গতি রুদ্ধ---
. মানুষ না ছোঁয় মানুষেরে!
. সনাতন শাস্ত্রের আদেশ---
আলোকের আনন্দের দেশে রমণীর চির-অপ্রবেশ!
ভূবনের রূপে রসে প্রেমে যৌবনেস্বতন্ত্রে নাই দাবী,
জীবনে কেবল তার এক কারাগার হ’তে
. অন্য কারাঘরে পড়ে চাবি!
সেই জীর্ণ পত্র মাঝে জীর্ণতর ছত্র নিয়ে চলে খুনোখুনি ;
মানুষের জীবনের নব নব কুরুক্ষেত্র
. রচে নিত্য নব কৃষ্ণ নূতন ফাল্গুনী!
মানুষের জেদের নিকটে মানুষের জীবনের দাম
লেখে নিত্য অস্ত্রমুখে নব নব ডায়ার ও শ্রীপরশুরাম!
. নির্ব্বিচারে শিশুবৃদ্ধ করিয়া সংহার
দেশে দেশে পূজ্য হয় তারা, খ্যাত হয় নব অবতার!
. রাষ্ট্র-ধর্ম্ম-শাস্ত্র-গুরু-মন্ত্র-তন্ত্রে দিয়া সিংহাসন
. ষড়-যন্ত্রে চলিতেছে মানুষের শোষণ-শাসন!
. আমি আজ চাহি তার নাম---
কোন্ যুগে মানুষের জীবনের কেবা দিল দাম ?
. কে বলিল উচ্চকণ্ঠে ডাকি,
জীবন কেবল সত্য,---শাস্ত্র রাষ্ট্র সব-কিছু ফাঁকি ?
জীবন ভরিতে হবে আলোকে পুলকে প্রেমে প্রাণে
জীবন-বিরুদ্ধ যাহা মিথ্যা তাহা, নাই তার মানে ;
শত শত শাস্ত্র চেয়ে একটি জীবন মূল্যবান---
রাষ্ট্র লাগি নয় কেহ, মানুষের লাগি তার স্থান
সৌন্দর্য্যেরে, সম্পদেরে, রমণীরে করি’ অবরোধ
জীবন জীবন নহে---শুধু প্রকৃতির প্রতিশোধ!
. কোন বুদ্ধ কহিল শুধাই ?---
রিক্ত করি’ ব্যর্থ করি’ নহে---পূর্ণ করি’ জীবনেরে চাই ?
. যুগে যুগে নব নব ধর্ম্ম-অধিকারী
মানুষেরে করিল কসাই---কিম্বা তারে করিল ভিখারী!
. ক্ষুদ্র শিল নোড়ানুড়ি মাটির পুতুল
মানুষ তাহারো কাছে তুচ্ছ, নহে সে তাহারো সমতুল!
. জীর্ণ ইঁট-কাঠে-গড়া মসজিদ্ মন্দির---
ঝরিলো তাহারো লাগি, বহু রক্ত, বহু অশ্রুনীর!
ওই বুঝি ধর্ম্ম গেলো---মানুষের চোখে নাই নিদ্,
দেখেনা সে ধর্ম্ম তার জীবনের ভীতে কাটে সিঁদ!
মানুষে মানুষ মারি’ ধর্ম্ম রাখে, হয় ধর্ম্মবীর ;---
ধর্ম্ম ঠেলে মরণের পথে নির্ব্বোধ দুর্ভাগাদের ভিড় |
ধর্ম্ম ? হায়, নগ্ন চোখ মেলি’ দেখ তার ভয়াবহ রূপ---
জীবনের রক্ত মাংসে সে যে---মরণের কঙ্কালের স্তূপ!
তার লাগি আত্মদান! নরহত্যা! ব্যর্থতা-বরণ!---
জীবনের সৃষ্টি আজ জীবনের কাছে আবরণ!
. তুচ্ছ মিথ্যা ভাবের ফনুস---
মানুষ সৃজেছে ধর্ম্ম, ধর্ম্ম কভু সৃজেনি মানুষ |
কিন্তু হায় তারো মূল্য আছে---প্রাণ দিয়ে শোধ করা চাই,
. মানুষের কোনো মূল্য নাই!
মানুষের-গড়া মিথ্যা ভৌগলিক সীমা
তাহারো মর্যাদা আছে, রয়েছে মহিমা!
তারো লাগি সৈন্যদল পুষ্ট হয় বন্য বৃত্তি তরে,
. লাঙ্গলের ফাল ভাঙি’ তরবারি গড়ে |
এরদল মানুষেরে সর্বভাবে করিয়া বঞ্চিত
জীবন্ত অস্ত্রের মত কেল্লাঘরে রাখে সুসজ্জিত,
. চিরবন্দী হিংস্র পশুদল---
মানুষেরে মারিবার তরে তাহাদের জীবন কেবল |
. দেশের সম্পদ যত, সৃষ্টি যত, যত কিছু ধন
. সব নিয়ে চলে শুধু মানুষ-মারার আয়োজন!
মানুষেরে মারিবার তরে মানুষ যোগায় রাজকর,
. মানুষে খাটায় মাথা,
রচে বসি’ হিংসা-শাস্ত্র, ঘাতকের বীরত্বের গাথা---
. নব নব অস্ত্র গড়ি’ বিজ্ঞানের বলে
. মানুষেরে বানায় বর্ব্বর |
পৃথিবীরে ভাগ-যোগ করি’ মানুষ রচিল নানা দেশ,
. হেথা হ’তে হোথা যদি যাবে
. কেন নাহি যায় বন্ধুভাবে---
কেন পরে ভাতৃরক্ত-মাখা দেশজয়ী জল্লাদের বেশ ?
পায়ের মাটিরে দিলো কিনা মানুষ মাথারো বড় ঠাঁই,
মাটিরো রয়েছে কিছু দাম, মানুষের কোনো দাম নাই |
. কখনো শুনেচ কারো মুখে---
বাঘেরে খেয়েছে বাঘ, ভালুক ভালুকে ?
মানুষে মানুষ খায়, খেয়ে বেঁচে থাকে প্রতিদিন---
রক্ত খায়, মাংস খায়, মেদমজ্জা খেয়ে করে ক্ষীণ,
খায় মন-আত্মা, খায় জীবনের অর্দ্ধের নিশ্বাস---
অবশেষ-জীবন্ত-কঙ্কাল ফেলে দেয়, করো কি বিশ্বাস ?
যাও---যেথা যেথা কল-কারখানা, যাও গ্রামে গ্রামে,
স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ কর মনুষ্যত্ব চড়োছে নিলামে |
. মনুষের জীবনের হেলাভরে খেলা
. যেথায় চলেছে দুই বেলা |
খনি ভেঙে কুলি বহে শিরে করি’ কয়লার চাপ---
তারি সাথে বহে যেন দুনিয়ার তিক্ত অভিশাপ |
. জঙ্গল কাটিয়া তারা বসায় সহর
তার রক্তে বহে সেথা বিলাসের বিষম বহর |
সে সহরে বিলাসীর লাগি রমণীরা রূপ দেয় ডালি,
নারীর নারীত্ব পায়ে দলি’ পুরুষেরা দেয় করতালি |
অমৃতের মৃতপ্রায় পুত্রগণ দাস হ’য়ে নগরীর পথে,
দুর্ব্বহ জীবন-বোঝা টেনে নিয়ে চলে কোনো মতে |
মানুষের মূল্য
“মানুষ” (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থ থেকে
শিবরাম চক্রবর্তী
ভুল ভাঙা
কবি শিবরাম চক্রবর্তী
সরলা দেবী চৌধুরাণী সম্পাদিত ভারতী পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১ সংখ্যায় (জুন ১৯২৪)
প্রকাশিত।
(রবীন্দ্রনাথের ভুলভাঙা পড়িয়া)
সত্য হে কবি, এ যে ভুল ভাঙা
. আর এক ভুল ধরিতে!
এ যে তটিনীর এক কুল ভাঙা
. আর এক কুল গড়িতে!
প্রেম বহে যায় বাঁধাত রহেনা,
তাই ফেলে যায় বোঝাত বহেনা---
কেন চাহ তারে একটী স্বপনে
. ভরিতে!
সুখ বেদনার এ যে ফুল রাঙা
. কালই নিশাশেষে ঝরিতে
মানব মনের এই দখিনারে
. রেখনাক সখা বাঁধিয়া,
অনেক সুরভি নিতে হবে তারে
. অনেক কুসুম সাধিয়া!
এরে তুমি বহু জীবন ফুটিবে
সার্থ হয়ে এনেকে টুটিবে,
এ যদি বন্দী রহে গো অপরে
. বাঁধিয়া---
ব্যর্থ করিয়া ব্যর্থতা ভাবে
. মরিবে কাঁদায়ে কাঁদিয়া।
জীবন নিত্য-ক্ষণিক-স্বপন
. অনন্ত কাল বয় তো,
এক কোণে এক কালেতে বপন
. করিবার ধন নয় তো!
এক মধুনিশা একটী জীবন
অনন্ত মাঝে দুইই একক্ষণ ;
কোটী বঁধু সেও একজন প্রেম-
. ময় তো!
যাহা ফেলে যায় বহে চলে যায়
. তারেই জীবন কয়তো!
ভুবনে ভুবনে জীবনে জীবনে
. বাজিছে প্রেমের বাঁশী যে
চলিবার টানে তাই প্রাণে-প্রাণে
. বাঁধিছে মোহের ফাঁসি যে!
তাই যৌবন লীলা অনন্ত
নিখিল বিশ্বে চির বসন্ত,
চাই নিশিদিন অনাহত বীণ
. বাজিছে!
কভু প্রেমঘোর কভু আঁখিলোর
. নয়নে নয়নে সাজিছে!
ক্ষণিকেরই তরে নাও যারে চাও---
. মোহের স্বপনে ভুলায়ে,
আপনাক মালা তার গলে দাও
. তার মালা নাও দুলায়ে!
ফুল যাবে ঝরে রবে শুধু ডোর
চুম্বনস্মৃতি-ভরা-আঁখিলোর
পরিমল-ব্যথা রবে কিছু ওর
. কুলায়ে!
ক্ষণিকের আছে চির-আনন্দ
. অসীম জীবন গুলায়ে!
. ****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
বর্ষা-স্বপন
কবি শিবরাম চক্রবর্তী
সরলা দেবী চৌধুরাণী সম্পাদিত ভারতী পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৩৩ সংখ্যায় (আগস্ট ১৯২৪)
প্রকাশিত।
ওগো সেদিন গগন পারে---
. পাগল মেঘে বাদল এল
. হেথায় কাহার খোঁজ সে পেল
. নেবে এল ধারার পথে
. ধরার অভিসারে!
শ্রাবণ ধারার সুরে সুরে
কোন্ সে সুদূর বঁধুর পুরে
. পেতে কি ধন ফিলছিল মন
. সে কোনে জনার আশে---
. ঘন বাব্ লা বনের পাশে
. ভরা পাগ্ লা নদীর ধারে!
আমি হঠাৎ পেলাম তারে
আমার আঁধার কুটীর-দ্বারে
একটী চাওয়াই ঘা দিল মোর
. হৃদয়-তন্ত্রীটারে!
. ও তোর বিজলী-চমক্ চাওয়া
. সাথে বর্ষা মেঘের হাওয়া
. মেঘকালো তার চুলে
. কোমল বাদল হাওয়া দুলে---
. তার ঐ বর্ষা বেশের রূপে
. কখন হারিয়ে গেলা চুপে
. কথা হয়নি কিছুই ভুলে!
. দেখি শূন্য ঘরের কাছে
. শুধু দাগ্ টী পায়ের আছে!
. ও সেই সিক্ত পায়ের ছাপে---
. বৃথাই পারণ আমার কাঁপে!
. কখন্ মিলিয়ে গেছে সে যে
. ঘন শ্রাবণ প্লাবন ধারে!
. ****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর