.          ******************     
.                                                                                        
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
কবি শুভ দাশগুপ্তর কবিতা
*
হয়ত আমিই সেই মেয়ে! হয়তো! হয়তো বা।

.            ******************     
.                                                                                        
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পড়ল মুণ্ডমালা। উধাও হল হস্তধৃত খড়গ। মুক্তকেশী বিশ্বরূপা এসে দাঁড়ালেন একেবারে সামনে। না,
সেই অসহ্য জ্যোতির্ময়ী বিশ্ববিহ্বলা রূপ আর নেই। যেন খুব চেনা, যেন খুব জানা, যে
তার সবটুকুই বড় আপন। মা এলেন।
ভাল করে দ্যাখ্ তো আমায়।
একি ? তুমি তো আমার মা!
আমি সকলের মা। চেতন অচেতন। গতি অগতি সবার মা।
কেন ডাকলে মা ?
আমার স্বরূপ তোমার জানা প্রয়োজন তাই। দেখো আমার ওষ্ঠাধরে। আমার নেত্রযুগলে। আমার
গোপন---সর্বত্রই তো তুমিই।
আমিই ?
হ্যাঁ। তুমিও অনন্ত জ্যোতি সেই জননী। যুগান্তরের লাঞ্ছনা, অপমান, ব্যর্থতা তোমাকেো করছে
আশ্রয়হীন, বস্ত্রহীন, খাদ্যহীন, প্রেমবঞ্চিত, স্নেহ বঞ্চিত অথচ তুমি মা। তুমিই সৃষ্টি। তুমিই উত্স।
তুমিই বীজমন্ত্র। এই মহারাত্রির নিদ্রাবরণের অভ্যন্তরে তোমার চৈতন্যের ঘননীল আকাশে আমি
এসেছি তোমার প্রলম্বিত নিদ্রাকে ভঙ্গ করতে। তোমার তুমিকে আমার আমির আত্মাশক্তিতে
জাগ্রত করতে।
ওঠো। জাগো। বলো---
আমিই সে।
আমিই সেই আদি
আমিই সেই অন্ত
আমিই উত্স
আমিই সৃষ্টি
আমিই স্থিতি
সমস্ত অন্যায় প্রবঞ্চনা সমস্ত প্রতারণার যুদ্ধক্ষেত্রে
নির্মম তীক্ষ্ম তীব্র আমিই সেই মহাশক্তি---
আমিই জননী।

.            ******************     
.                                                                                        
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ফিরে এসো আগুন
কবি শুভ দাশগুপ্ত

পরম আকাঙ্ক্ষিত আগুন। বহুদিন ঘরছাড়া তুমি।
কতবার কতভাবে চেষ্টা করেছি, তোমার খোঁজ পেতে।
পাইনি, তুমি জানো কত চিঠি লিখেছি তোমার নামে
কখনও তুমি বহুদূর বিদেশের মাটি থেকে হাজার হাজার।
সৈন্যের নেতৃত্ব দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল চুরমার করতে এগিয়ে আসা
নেতাজী সুভাস।

তোমাকে দেখেছি আগুন, বারবার সুজলা সুফলা এই মায়াময় দেশের
ঘাসে ঘাসে, নদী-পাহাড়ে-অরণ্যে-শহরে-গ্রামে-গঞ্জে-হাটে।
প্রিয় আমার,
শিকাগো বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে তুমি হিরন্ময় হয়ে উঠেছিলে
স্বামী বিবেকানন্দের বিশ্বজয়ী বেশে।
. . . “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে”  . . . বলে বজ্র কণ্ঠে
দীপ্যমান তুমি বিশ্বকবি রূপে।
তোমাকে দেখেছি স্বাধীন মাটিতে,
খাদ্যের দাবীতে গ্রাম শহরের গরীব মানুষের,
লাঠি গুলি বেয়নেটের খাদ্যে পরিণত হওয়া মিছিলে।
তোমাকে দেখেছি তেভাগায়, তোমাকে দেখেছি তেলেঙ্গানায়,
তোমাকে দেখেছি আগুন বারবার অসংখ্যবার, হে আমার প্রিয়,
বহুদিন আর দেখা হয় না তোমার সাথে,
চারপাশের গাঢ় অন্ধকার ক্রমশ গাঢ়তর।
শেষবার তোমায় দেখেছিলাম,
আমিই সেই মেয়ে ( এক )
কবি শুভ দাশগুপ্ত

আমিই সেই মেয়ে।
চোখে আপনি এঁকে দিতে চান ঝুটা স্বপ্নের কাজল আর ফুরিয়ে যাওয়া
সিগারেটের প্যাকেটের মত যাকে পথের পাশে ছুঁড়ে ফেলে আপনার ফুল সাজানো
গাড়ি শুভবিবাহ সুসম্পন্ন করতে ছুটে যায় শহরের পথে---

কনে দেখা আলোর গোধুলিতে একা দাঁড়িয়ে থাকা
আমিই সেই মেয়ে।
আমিই সেই মেয়ে---এমন কি দেবতারাও যাকে ক্ষমা করেন না। অহংকার
আর শক্তির দম্ভে যার গর্ভে রেখে যান কুমারীর অপমান
আর চোখের জলে কুন্তী হয়ে নদীর জলে
বিসর্জ্জন দিতে হয় কর্ণ কে। আত্মজকে।
আমিই সেই মেয়ে।

সংসারের অসময়ে আমিই ভরসা।
আমার ছাত্র পড়ানো টাকায় মায়ের ওষুধ কেনা হয়।
আমার সমস্ত শরীর প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।
কালো আকাশ মাথায় নিয়ে
আমি ছাতা হয়ে থাকি
ছাতার নিচে সুখে বাঁচে সংসার।

আপনি
আপনারা
আমার জন্য অনেক করেছেন।
সাহিত্যে কাব্যে শাস্ত্রে লোকাচারে আমাকে
মা বলে পুজো করেছেন।
প্রকৃতি বলে আদিখ্যেতা করেছেন---আর
শহর গঞ্জের কানাগলিতে
ঠোঁটে রঙ মাখিয়ে কুপি হাতে দাঁড় করিয়েও দিয়েছেন।
হ্যাঁ, আমিই সেই মেয়ে।
আমিই সেই মেয়ে ( দুই )
কবি শুভ দাশগুপ্ত

.        মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং
.        কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভূষিতাং॥

ঘনমেঘে আকাশ কৃষ্ণবর্ণ। মহাকালের অমোঘ খড়গের মত থেকে থেকে ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ।
সময়ের গম্ভীর ডম্বরু বাজছে মেঘমন্দ্র স্বরে। সমস্ত চরাচর থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছে আলোর
সামান্যতম আভাস। কোথাও চোখে পড়ছে না কোনো নক্ষত্র। তারা। শুধু অন্ধকার। গাঢ় তীব্র
পৃথিবীর হাট মাঠ ঘাট পেরিয়ে, জানা বসতির গন্ধ রূপ বর্ণকে হেলায় তুচ্ছ করে, আশৈশব একটু
একটু করে বুঝে ওঠা প্রাত্যহিকতার আত্মম্ভরী সাজসজ্জাকে ব্যঙ্গ করে---সেই নারীমূর্তি আমাকে
নিয়ে চললো তারই পানে।

পায়ের নিচের থেকে দ্রুত, অতিদ্রুত সরে যাচ্ছে চোরাবালির মত বর্তমান। আমি দু’হাতে ভয়ার্ত
আবেগে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরতে চাইছি হাজার বছরের প্রবীণ বটের ঝুড়ির মত আমার সংস্কার---
পারছিনা। কসাই’এর হাতে মুণ্ডচ্ছেদ হবার অব্যবহিত পরমুহূর্তের ছাগশিশুর মত উন্মত্ত দাপাদাপি
করছে আমার বোধ আমার চেতনা। কিন্তু মহারাত্রে সংযম আমার আয়ত্তে নেই। ভয়ের সিঁদুর
আমার সিঁথিকে রক্তচিহ্ন লাঞ্ছিত রাখতে পারছে না।
মাতৃমূর্তি ক্রমে স্পষ্ট উদ্ভাসে সামনে প্রকট হলেন।
এত তীব্র উজ্জ্বল কালো। বিস্ময়ে আমার বাক্শক্তি পঙ্গু।
এত অনিবার্য আলো. এত অমোঘ আলো। এত পরিবর্তনহীন আলো স্বপ্নেও তো রখনো দেখিনি---!
এত কালো!
তবু সে সূর্যের চেয়েও ভাস্বর
চন্দ্রের শতকোটি বর্ষের মিলিত সুষমা অপেক্ষা মাধুরীময়ী
নক্ষত্রের বিশ্বমোহিনী দীপ্তি অপেক্ষা দীপ্য।
এত কালো!

.        যা শ্রীঃ স্বয়ং সুকৃতিনাং ভবণেষলক্ষ্মীঃ
.        পাপাতমনাং কৃতধিয়াং হৃদয়েষু বুদ্ধি।
.        শ্রদ্ধা সতাং কুলজপ্রভবস্য লজ্জা
.        তাং ত্বাং নতাঃ স্ম পরিপালয় দেবী বিশ্বম্।

ভীত কম্পিত ওষ্ঠাধরে আমার জেগে উঠল প্রশ্ন :---
কে আপনি ?
কে ?
আমি জননী। জন্মজন্মান্তরে। কাল হতে কালান্তরে। যুগে যুগে আমি
জননী। আমিই উত্স। আমিই সৃষ্টি। কোটি কোটি ছায়াপথগামী
গ্রহনক্ষত্রপুঞ্জ মধ্যে আমিই প্রাণ। আমি শব্দ। আমি অঙ্কুর। আমি
বীজমন্ত্র। আমিই জীবন।

এ অসম্ভব রূপরাশি! . . .
হ্যাঁ। আমিই সুন্দর। আমি মাতৃহৃদয়োত্সারিত স্নেহ। সমুদ্রে আমি তরঙ্গমালা।