কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা
*
অশ্বকাহিনী
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

ঘোড়াটিকে অশ্ব বলে ডাকি,
অশ্বটিকে ডাকলাম ঘোড়া,
দু’জনেই সমদর্শী, আর
রাজরক্তে আশরীর মোড়া !

ঘোড়াদুটি সন্তরণপটু,
মেঘেরৌদ্রে বক্ষদেশ ভারী,
দু’জনেই গৃহঅভিমুখী---
আশ্রয় না দিয়ে আমি পারি !

ঘোড়াদুটি তীব্র, তেজিয়ান ,
পিঠে সাঁটা উড়ন্তের ডানা,
বঙ্গবিজয় যেই শেষ
দু’জনের দুই চক্ষু কানা !

ঘোড়াদুটি বলদর্পী, বীর,
কাঁটায় খোঁচায় বড়ো ভয়,
পদ্ধতি প্রণালী জানে, তবু
রতিশাস্ত্রে পারঙ্গম নয় !

ঘোড়াদুটি পূর্ব পশ্চিম,
দেহে মনে অপূর্বের বিভা,
সীমান্তের কাঁটাতারে মুখ----
বাংলার অমর প্রতিভা  !

ঘোড়াদুটি স্ফটিকসম্ভব
মাঝরাত্রে দিব্য, মরকুটে,
দানাপানি ধরে আছি তাই
ভোরবেলা কৃতাঞ্জলিপুটে !

ঘোড়াদুটি পরিপূর্ণ প্রাণ,
এই সত্য লেখা অভিধানে,
ঘোড়া কারও মুখোপেক্ষী নয়---
ধায় ঘোড়া অদৃষ্টের পানে !

.      *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আগুনের পাশে
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

ভোরবেলা অকস্মাৎ দাউদাউ করে আমার মাথা জ্বলে উঠল
হায় হায়, কথা বলবার আমি কোনো
সময়ই পেলাম না,
পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল আমার উর্বরতা,
পা ছড়িয়ে আমি ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে বসলাম |

আগুন যখন নিভে এল মানুষ তখন
বউ ছেলের হাত ধরে সিনেমায় যাচ্ছে,
তার মানে শহরে এখন গোধূলি নামছে,
ইট কাঠ লোহালক্কড় আর জলধিতরঙ্গে
চাপ চাপ মায়া ধরেছে  |
এখন কে বলবে একটু আগেই পুড়তে পুড়তে
ছাই হয়ে গেছে আমার মগজ,
ভস্ম হয়ে গেছে আমার সবটুকু ক্ষাত্রতেজ !
আমি আর ঠিক মানুষ নই, আবার মানুষও,
সত্যিকারের আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে
এখন একা একা আয়নাকে ভেংচি কাটছি !

.           *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আমরা ছিলাম
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

আমরা ছিলাম মনের ঘরে নীল পাথর
বনের সীমায় রাজকন্যার সবুজ চোখ
আমরা ছিলাম অশ্বারোহী বীরপুরুষ----
তরোয়ালের ধাক্কা লেগে আকাশ ফাঁক |

আমরা ছিলাম ঘড়ায় ভর্তি অন্ধকার
হাত লাগালেই সোনার মোহর ছত্রখান
বাগান থেকে রাক্ষসীদের হুহুংকার---
হৃত্প্রদেশের ভিতর এখন কম্পমান !

আমরা ছিলাম রাজার বাড়ির হুকুমদাস
দুপুররাতে চতুঃসীমার অধীশ্বর
আমরা ছিলাম আকাশভাঙা তীরধনুক---
সারাজীবন শয়নকক্ষে বন্দিবীর !

আমরা ছিলাম মর্মতলে চাঁদবণিক
অস্ত্রাঘাতে টুকরো করি সর্পাদেশ
আমরা ছিলাম সুড়ঙ্গের শেষ ধাপে---
শাস্ত্রমতে আহার করি --- নিদ্রা যাই !

.        *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ভালুকছানা
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

যাচ্ছি ঝুপসিদিদির বাড়ির দিকে |
গানের বাড়ির ঠিক সামনে
ভালুকছানার সঙ্গে দেখা  |
রাস্তায় |

আঁচরে কামড়ে আমাকে শেষ করে ফেলল সে  |
গা থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে |
তবু, তবুও---

অনেকক্ষণ থেকে গানের বাড়িতে
হারমোনিয়াম বাজছে  |
ঝুপসিদিদির সারা গায়ে তরঙ্গ |
তরঙ্গের মতো ছোট ছোট ডেউ |

সুর |
সুর উড়ে যাচ্ছে |
ভালুকছানাকে কী করে বোঝাই, এখন
আদর খাওয়ার অত সময় নেই আমার |

.        *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পাহারা
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

যারা পাহাড়ে যাচ্ছে, যাক,
আমরা তাদের বন্দুক পাহারা দেব |
দু’--একটা সংঘর্ষ না হলে
জীবনকে ঠিক জীবন মনে হয় না |
যারা সমুদ্রে যাচ্ছে, যাক,
আমরা তাদের জিন্ স চপ্পল আর তোয়ালে
পাহারা দেব |
সত্যিকারের দু’--একটা ঢেউ চিনে রাখা দরকার |
যারা আকাশে যাচ্ছে তারা বীর, সুসন্তান,
তাদের আমরা আটকে রাখব কেন ?
বছরের পর বছর আমাদের সতর্ক চক্ষু
তাদের উড়ান-ক্ষমতাকে পাহারা দেবে |
আমরা যারা জঙ্গলে রয়ে গেলাম,
পায়ে পায়ে উল্ টে যাওয়া বেচারা,
কাঁটাগাছের মতো দুঃখী,
খেলার মাঠের মতো অভাগা,
কাঙালের মতো দীনহীন,
আমাদের কী হবে ? আমাদের কী হবে ?

এই গভীর ঘন জঙ্গলে কাঠচেরাই আমাদের
ভরসা, আর হাতি---
হাতির বৃংহণ আমাদের পাহারা দেবে,
আমাদের মায়াময় ঘুমচোখ,
আমাদের লন্ঠনের আলো |
আমরাও জঙ্গলের ওই দুঃসাহস
পাহারা দেব বইকি,
জীবনের পর জীবন তাকিয়ে থাকব তার দিকে !

.           *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
রাজহাঁস
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

রাজহাঁস এখন আর বাড়ি থাকে না |  এত কাঁটা আঁশ
রক্তের দাগ তার একটুও পছন্দ নয় | বাগান পেরিয়ে
সে যে একটু দম নেবে, পুষ্করিণীর জলে পালক ছড়াবে,
তার উপায় নেই | শালুক-শ্যাওলা তাকে উপহাস
করবে | মেঘের আড়াল থেকে তাকে সারাক্ষণ লক্ষ রাখবে
মেছোবক | কেউ অন্ধকারে উঁচিয়ে রাখবে ভল্ল, কেউ তীরধনুক |

জলে ডাঙায় এইসব খাবলাখাবলি দেখতে ভালো
লাগে না | মন বিষিয়ে যায় |

সূর্যাস্তের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে রাজহাঁস |
যদি একটি-দুটি আকাশ এখন তার দিকে হাত বাড়ায়, আর
যদি সারা জীবনের আনন্দ হয়ে ওঠে
একটি-দুটি তারা |

ভাবতে ভাবতে সরু রাস্তায় নিবিড় হতে থাকে রাজহাঁসের ছায়া !

.                    *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
একলা পাগল
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

বিকেলবেলা আমার কোলে মাথা রেখেছে পাগল
দেখছে চোখে নীল আকাশের ছায়া পড়েছে কি না

শূন্য থেকে লাফিয়ে পাড়ছে গোলাপায়রার ছানা
পালক খুলে উড়িয়ে দিয়ে বলছে, ‘তুমি নাও |’

ঘরবাড়ি নেই কিন্তু পাগল দেয়াল দিয়ে আঁটা
ভ্যাদ্ ড়া মুখে রতা শেয়াল চোখ কুঁচকে তাকায় !

আপনমনে পাগল কাদের গাল পাড়ছে খুব
‘বঙ্গে এবার বর্গি আসছে, গড়ের মাঠে যাও |’

যাওয়ার আগেই কুজ্ঝটিকা, উড়ছে জামাকাপড়
বিদ্যাসাগর সেতুর উপর উঠে বসেছে সে !

একটি একটি তারা গুনছে, একটি একটি চাঁদ
সাতটি আটটি প্রেম খসিয়ে লিখে রাখছে ‘গগন’ |

অন্ধকারে চোখ জ্বালিয়ে গান বলছে মজার
সুর জেগেছে গীতাঞ্জলির ষোলো-সতেরো পাতায় |


আমরা সবাই তাক ধিনা ধিন, জাপ্টে ধরি টেবিল
হাততালি দেয় পাগল, ‘এবার বই লিখবে তুমি |’

বই লিখবার আগেই আঙুল কামড়ে নিল কেউ
ভাসতে ভাসতে কেয়াপাতার নৌকা যায় দূরে |

ভিতর থেকে কান্না আসছে, কেঁদে ফেলছে পাগল
অশ্রুনদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় এবার !

.             *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
হাওয়ার কথা বলো
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

মানুষ, তাকে ঝাপটা দাও হাওয়ার
সাহস করে
.  শূন্যে তুলে ধরো
অগৌরবের ময়লা থেকে বাঁচাও |

এবার তুমি জ্বালিয়ে দাও ঘরে
কয়েকখানা শান্ত নীল আলো
যাতে সে তার দেখতে পায় মুখ
নিকষ কালো অন্ধকারে দেখুক
সহজ মুখে অসম্ভবের আঁচড় |

মানুষ , তাকে হাওয়ার কথা বলো
বলো প্রাণের ধর্ম হল এই ---
বলতে বলতে ঘুরিয়ে দাও মুখ
পালটে যাওয়া দিনের শেষে যেন
আঁকতে পারে হাজার হাজার
.   মর্মরিত ছবি
ছবির যেন রঙ না ফিকে হয়  |

.     *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সড়ক
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

আমদের কলাগাছে উড়ছে না আর কোনো ভূতের কাপড়
নিবিড় ভাদ্রমাস, গলা তুলে ডাকছে না বিরহী কুকুর
ভাঙা মাদ্রাসার গায়ে অসমাপ্ত বুলেটের গন্ধ লেগে আছে
কারা যেন দৌড়ে গেল শ্বাসরুদ্ধ, আকাশের শ্যেনচক্ষু জ্বলে---

আমাদের একমাত্র বাসরাস্তা আজ থেকে নির্জন সড়ক |

.                  *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আকাশে এলাম
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

ভগবান আমি তোমাকে দেখতে আকাশে এলাম
সে কারণে এত বাঁধভাঙা ঢেউ পাড়ায় পাড়ায় |

পকেটে বাজছে ঝনঝন করে চাঁদের পয়সা
মাঠের আলোয় পা ডুবে গেছে বৃষ্টির নীচে |

এইবার বলো কোনদিকে গেলে মেঘের প্রাসাদ
পর্বত নিয়ে খেলতে পারব অলীকের খেলা |

কোন্ দিকে গেলে সেই স্নানঘাট সেই সরোবর
মুঠোয় ধরতে পারব একটি ব্রহ্মকমল  |

ভগবান আমি তোমাকে দেখতে চোখ খোয়ালাম
পুণ্যের আশা ছাড়লাম আর তুমি ধরা দিলে  !

কোনদিকে গেলে মোহরে মোহরে পথঘাট ভারী
হাড়েকঙ্কালে মাটি ভরে আছে সন্ধ্যাসকাল |

সারাদিন আমি খাইনি শুইনি বিহার করিনি
ভগবান আমি জাগ্রত থেকে তোমার কী লাভ !

উড়তে উড়তে এবার নতুন আকাশে এলাম
চন্দ্রালোকিত রাত্রে তোমাকে জ্যান্ত দেখব |

.            *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর