কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা
*
বাড়ি
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

নৌকো থেকে নেমে আর মাত্র দু’পা এগোলেই বাড়ি

বাড়ির ভেতর প্রকান্ড মাঠ
শ’য়ে শ’য়ে লোক ফুটবল খেলছে
কোথাও কোনো হাততালির শব্দ নেই
রিনরিন করছে শুধু একটা মূর্ছনা

বালিয়াড়ি থেকে লোক তোমাকে রাস্তা চিনিয়ে দেবে
সরু রাস্তায় পীরিতির আঠা থিকথিক করছে
দয়জায় দরজায় গোলমুখের মেয়ে
তাদের পটলচেরা চোখ থেকে উপচে পড়েছে আনন্দ
কেউ ঠান্ডা জলের গেলাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
কারও হাতে থালাভরা মিঠাই
কারও হাতে তবক-দেওয়া পান

পুরনো বন্ধুরা দৌড়োতে দৌড়োতে আসছে তোমার দিকে
জাপটে ধরছে
আদরে আদরে ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে তোমার
কেউ বলছে ফাঁসির আসামি, শুকিয়ে একদম সাদা কাগজ হয়ে গেছ
কেউ বলছে ঠিক যেন কঙ্কাল, মটি ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে,
কেউ বলছে ভারী চিকনচাকন হয়েছ,  বেশ লাগছে কিন্তু দেখতে
রূপে আলো হয়ে গেছে চারদিক

কোনো অভ্যর্থনায় তোমার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই
কোটরের মধ্যে দুটো আলো জ্বলছে মিটমিট করে
জটপাকানো চুলে জড়িয়ে আছে কাঁটা আর পুটুস ফুলের পাপড়ি
ময়লা জামায় হেঁটে বেড়াচ্ছে গুচ্ছের পিঁপড়ে
তাপ্পি-দেওয়া জুতোয় নানারকম মেঘবাদল

তোমার রূপ দেখে আমাদেরও কান্না পাচ্ছে
কেমন যেন ছোট আর ক্ষুদ্র লাগছে নিজেদের
পেছনে ডাঁই হয়ে আছে মালাচন্দন
কোনো গ্রাহ্য নেই তোমার
দমবন্ধকরা হাওয়াবাতাস ঠেলে তুমি বেরিয়ে আসছ

নৌকো থেকে নেমে আর মাত্র দু’পা এগোলেই বাড়ি !

.               *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বন্ধুকে
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

শূন্য দিনের মেঘ দিয়েছি বন্ধুকে
মেঘ দিয়েছে আকাশ ভেঙে বন্ধুকে
বন্ধু এখন গোরস্থানে চাঁদ বানায়

ঝড়ের শেষে মাঠ দিয়েছি বন্ধুকে
মাঠ দিয়েছি সোনায় মুড়ে বন্ধুকে
বন্ধু এখন তীরধনুকে জল কাটে

প্রেম দিয়েছি বনের কালো বন্ধুকে
কাঁথায় কাঁথায় ফোঁড় তুলেছি শেষরাতে
বন্ধু এখন অশ্রুনদীর ঘাট চেনায়

বন্ধু এখন পদ্য লেখে প্রত্যুষে
বিষের বাটি উপুর করে প্রত্যুষে
নখ ও দাঁতের আখরগুলি মন্দ নয়
পুড়তে পুড়তে বন্ধু লেখে বন্ধুকে

শূন্য দিনের দু-এক মুঠো ছাই ওড়ে

.       *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আত্মপ্রতিকৃতি
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

কেউ মাঠের পাশে খড়মাটির মূর্তি তৈরি করছে
কেউ রাস্তার ধারে দড়িদড়ার মুখোশ
কেউ গাছতলার কাঠঠোকরা, হাঁড়িচাচা কিংবা ভোম্বল সর্দার
কেউ--বা আবার একটু উল্টো সুরে গান গাইছে ---
দিনাবসানের রঙ আর রেখায় মশগুল
মশারি ও ঘুমের মধ্যে রচনা করছে ভারসাম্য
মানুষ তাকিয়ে থাকে তার এবড়ো-খেবড়ো প্রতিকৃতির দিকে----
ঝর্ণা শেষ হয়ে আসছে, ঘুরে যাচ্ছে সমুদ্রের রঙ
তবু আলো-অন্ধকারে তার অবলোকন ফুরোয় না !

.               *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কান্না দিয়ে লেখা
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

আমি যেদিন মারা গেলাম, সেদিনের কথা
খুব মনে পড়ছে |

আমার চোয়াড়ে, হতকুচ্ছিত, ধুমসো শরীরের দিকে তাকিয়ে
পিশাচীর মতো তুমি অনেকক্ষণ ধরে
হাউমাউ করে কাঁদলে |
হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদলে |
গলা ফুলিয়ে কাঁদলে |
বুক ভিজিয়ে পাড়া মাথায় করে দানবীর মতো কাঁদলে |
সেদিনের প্রতিটি কান্না অশ্রু ছিল কি না
অশ্রুর মতো স্ফটিক ছিল কি না
এখন মনে করবার চেষ্টা করছি---
আমি ভেসে গেলাম, ভেসেই গেলাম |


আমার কূলকিনারাহীন ভেসে যাওয়া নিয়ে
একশো বছর পরে যে বইটি বেরোল
রৌদ্রছায়ায় আটকানো সে বইটার নাম, কান্না দিয়ে লেখা |
বইয়ের পাতাগুলি আলগা আর নিষ্প্রদীপ,
অক্ষরগুলো বিপজ্জনক আর বরফজড়ানো  |
অনেক কলহবিবাদের পর, রক্তপাত আর হাতাহাতির শেষে
বইটা কি শেষ পর্যন্ত তোমাকেই উৎসর্গ করেছিলাম ?


সেই ত্রেতা যুগের কথা তো, দাঁড়াও, একবার
মনে করে দেখি |

.               *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বাংলার আগুন
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

আকাশ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে
বীরের রক্ত নামছিল---
দেখতে পাওনি  |

ঝড়ঝঞ্ঝার আড়ালে একটা কালো খর্বুটে মুখ
ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছিল----
দেখতে পাওনি |

শুকনো মাটিতে সকাল থেকে কম্পন,
একটু একটু করে ভূমিকম্প আসছিল---
দেখতে পাওনি |

যখন দেখতে পেলে মানুষের মন বিষিয়ে গেছে
কথা বলার মতো কারও সময় নেই |
আধখানা কবিতার ভেতর থেকে
শুধু ধিকিধিকি করে জ্বলে উঠছে
বাংলার আগুন !

.        *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মুখ
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

পঁচিশ বছর আমাদের মুখ-দেখাদেখি বন্ধ
এতদিনে সব রসের কুন্ড বাষ্প হয়ে গেছে
যৌনতার দীঘল সরোবর শুকিয়ে খটখটে
বুকে জমেছে থলথলে মাংস
গামলার মতো মস্ত পেটে খিদে নেই তেষ্টা নেই
সারাদিন ঢং ঢং শব্দ হয়  |

আমাদের বন্ধ দরজায় কেউ লিখে দিয়েছে চাঁদের বাড়ি,
দরজার গায়ে কেউ দাগিয়ে দিয়েছে উদয়ের পথ,
এ-পথে মাসিমা যায় পিসিমা যায় |

মশারি সরিয়ে আমরা দুজনে দুজনের দিকে
রক্তচোষা বাদুড়ের মতো তাকাই---
সুড়ঙ্গের মুখ চিরকালের মতো বন্ধ,
সোনার থালায় বাসী ভাতে ভনভন করছে মাছি
ঝুলন্ত ফলফুলের গাছে পিঁপড়ের বাসা,
তবু মাংসের স্তর ভেদ করে চৈত্রমাসের
.                               হাওয়া আসছে হু হু---

.            *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সর্বনাশ
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে উঠছে মেঘ
অনেকদিন হল আকাশে কোনো শান্তি নেই
সমুদ্রের মতো জলাশয় টগবগ করে ফুটছে
শোবার ঘরে জমে উঠছে ধূলিধূসর পৃথিবীর
.                               খন্ড খন্ড ছায়া |

যুদ্ধ চলছে তো চলছেই
বিষে বিষক্রিয়ায় কিরণে বিকিরণে
ভারী হয়ে উঠছে দশ দিক
বীরের রক্ত রাস্তায় রাস্তায়
স্রোত হয়ে ভাসছে
সর্বনাশ আর কাকে বলে !

সূর্যের উত্স সন্ধানে দেবতারা
সেই যে কবে সমতলে নেমেছেন
এখনও বাড়ি ফেরার নাম নেই |

.       *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কামান
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

ডুবুডুবু সূর্যের তলায় দাঁড়িয়ে
কামান থেকে আমরা গোলাগুলি ছুঁড়তাম
সে একটা দিন গেছে !
.                কামানও ছিল বটে এক-একটা !
প্রকম্পিত হয়ে উঠত আমবাগান
রাজরক্তে বাংলার মাটি ভিজে যেত !

এখন জংধরা সেইসব কামানে আর ধার নেই
পুটুস পুটুস শব্দ হয় বটে, কিন্তু কামানের
ভোঁতা মুখ থেকে চকিতে বেরিয়ে আসে না
ধোঁয়ার কুন্ডলী কিংবা আগুনের গোলা |
আমরা যারা বীরের বাচ্চা, মরতে
এসেছিলাম, কিন্তু কেউ মরিনি----
ছেঁড়া ইতিহাস বইয়ের সতেরো, সাতাশ, সাঁইত্রিশ,
বাষট্টি, নব্বই----কোনও পাতায়
.                  এখন আমাদের নাম লেখা নেই !

কামানের মাথায় কান্না জমতে জমতে
জীবাশ্ম হয়ে উঠেছে
চাঁদের আলোয় সেই জীবাশ্মকবলিত কামান
আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই !

.       *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
জলছবি
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

পূর্ব আর আগের মতো আমার শিয়রে নেই,
পশ্চিম এখন আমার বৈরী, ঘন ঘন সন্দেহের চোখে তাকায়,
উত্তর দক্ষিণ ঈশান নৈর্ঋত তাদের কথা আর কী বলব,
তারা তো পিচ্চি, ছেলেমানুষ,
অনেকদিন হল কাঁধ থেকে বোঝা নামিয়ে দিয়েছি |

আমি  এখন যাই কোথায় ?
চোর-তস্কর আমার দিকে তাল তাল সোনা এগিয়ে দিচ্ছে,
খুনে-ডাকাত লেলিয়ে দিচ্ছে তাড়া তাড়া নোট আর টাকার বান্ডিল,

একটা ভাঙা ছ্যাতলা পড়া ধূসর দেশের সামনে
জলছবির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি |

.            *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
চাঁদের রক্ত
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

চাঁদকে আমরা হত্যা করতে যাচ্ছি
চাঁদের রক্ত  খুব বেশি দূরে নয় আর |

গাছের তলায় ভিখিরি ছেলের জটলা
তারাও বলছে চাঁদ নাকি শ্রেণিশত্রু  |

শত্রুকে মেরে ঠ্যাঙ ভেঙে দাও এখনই
তবে না তোমরা ইতিহাসবইয়ে অক্ষয় |
প্রাণ ঢেলে যারা নতুন কবিতা বলছে
তারা জানে চাঁদ নিছক ধারনা মাত্র  |

মেঘ কেটে কেটে আমরা পাহাড়ে উঠছি
দেখি কত পারে বানানো ধাতুর পিন্ড |

আমরা কখনও আমাদের কথা ভাবিনি
তা হলে হত না চাঁদের দশায় জন্ম |

চাঁদকে আমরা হত্যা করতে যাচ্ছি
কেননা চাঁদের রক্ত এখনও স্নিগ্ধ |

.        *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর