পেরেক পুঁততে পুঁততে যেখানে এসে থামলাম সেটা ত্রেতা যুগের একটা বাড়ি, লম্বা থামওয়ালা আকাশছোঁয়া একটা বাড়ি | প্রান্ত বোঝা যায় না , উচ্চতা বোঝা যায় না, দেউড়ির অতল শূন্যে আটকা পড়ে গেছে সূর্য, ঘ্রাঁও ঘ্রাঁও করে জোড়া-সিংহ গজরাচ্ছে | লোকে হাত তুলে ধেই ধেই করে নাচছে, বলছে সর্বধর্মসমম্বয়, ঝাড়বাতির নীচে দাঁড়িয়ে বলছে মেলাবার কথা, মানুষ আর মানুষ----
যতদূর চোখ যায়, গম্বুজ আর খিলানে চুন-সুরকিওঠা আমার মস্ত মস্ত ছবি, কতকাল ঝাড়পোঁছ হয়নি, দোল খাচ্ছে !
দেখতে খ্যাঁদানাদা হলে কী হবে, লোকে ভাবছে, আমি ভক্তের ভগবান | পাপীতাপীদের দিশা দেখাতে পাহাড় থেকে সমতলে নেমে এসেছি |
আমাকে শস্যের দানা ভেবে খুঁটে খেতে এসেছিল শালিখ | পারেনি | ঠোঁটের ধার কমে গেছে | নখের দৈর্ঘ্য আর আগের মতো নেই | খয়েরি ডানায় ফিনকি দিয়ে উঠেছে চকচকে রক্ত | পাখির নিপীড়নও আমাকে চোখে দেখতে হল !
আমি নদী সৃষ্টি করেছি | নৌকোর ভাবনাও আমার | আমিই পৃথিবীতে হাজার হাজার দাঁড়মাঝি ছেড়ে দিয়েছি, তারাই এখন প্রমত্ত জলধারা সামাল দিচ্ছে |
যে গাছগুলো আমি প্রকৃতির খাঁজে খাঁজে পুঁতেছিলাম তার সবগুলোই এখন ফুলেফলে ভর্তি, একটাও বাঁজা নয় | লোকে ভাবছে মাটি রস আর গর্ভের কী অসীম ক্ষমতা |
বইয়ের অক্ষরে অক্ষরে যে দিনরাতের আলো সেগুলো আমারই চোখ থেকে বিচ্ছুরিত, জন্ম জন্ম ধরে দেখেও লোকে বুঝতে পারছে না | এই বই থেকে লোকে একদিন জানতে পারবে আমি যেরকমই হই, প্রকান্ড কিংবা ক্ষুদ্র, যেখানেই থাকি, খেলার মাঠ কিংবা থামের আড়াল, ভক্তের ভগবান তো, আমাকে ঘিরেও লক্ষ লক্ষ মানুষ পুঁপড়ের মতো ঘুরে বেড়ায় !
এই লোকটাই ঠান্ডা থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে, ঘন ঘন সেঁক দিয়েছে রাত্রিবেলা , বরফজড়ানো শরীর নিয়ে, আমি উঠে দাঁড়িয়েছি এক একদিন--- হিমালয় এত কাছে, সূর্যোদয় হচ্ছে একটু একটু , শৃঙ্গের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি ! কুড়ি বছর ঘর করেছি লোকটার সঙ্গে, তিরিশ বছর রাজনীতি--- এত কান্না হচ্ছে প্রতিদিন, এত রক্তপাত, সকালে সন্ধ্যায় এত মাখামাখি লোকটাই আমার জীবন ফুলের মতো বদলে দিয়েছে, চারপাশে গড়ে দিয়েছে এত শোভার আধার---- আমার গোল আর ভরাট মুখের সোহাগ খেতে খেতে এই লোকটাই একদিন ঘুমিয়ে শ্যাওলা হয়ে গেছে |
মরব বলে কতদিন নীল আকাশের নীচে একা একা দাঁড়িয়েছি, আমার মাথায় ভেঙে পড়েছে উড়োজাহাজের ডানা, মেঘবাদলের মস্ত মস্ত চাঁই--- লোকটা আমাকে হাঙরের ভয় দেখিয়েছে, দেখিয়েছে জলোচ্ছ্বাসের ভয়, লোকটা বলেছে, মরুশহর, বালির সমুদ্র, বলেছে বেশ্যাবাড়ির দরজা, আমি সংঘর্ষের দিকে তাকিয়ে বলেছি, বাঃ বাঃ, চমত্কার ! এই লোকটাকে আমি পুরনো দিনের গান ছাড়া আর কী বলব, প্রতিদিন সুরে সুরে এত আঘাত করে, এত ভেংচি কাটে, রক্তে এত জীবাণু ছড়িয়ে দেয়, প্রতিদিন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে এতবার হত্যা করে, আমি আর ভয় পাই না, সবই তিরিশ বছরের পুরনো রাজনীতি----
লোকটাকে এখন পাষন্ড নামের চমত্কার একটা মানুষ ছাড়া আমার আর কিচ্ছু মনে হয না |
অনেক অনেক যুদ্ধ দেখা হল অনেক অনেক অস্ত্রব্যবহার ---- ছিটকে যাওয়া মাথার ঘিলু , ছিন্ন নাড়িভুঁড়ি শিবিরছাড়া লোকটা এখন নিপাট ভালোমানুষ নিষ্পলক চোখের নীচে অশ্রুমোছা হাসি----- দেখতে দেখতে চলচ্ছবি, সন্ধ্যা ঘনঘোর !