কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা
*
মিলনলেখা
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

সূর্যের সমস্ত লেখা তোমাকে দিলাম |
চাঁদের সমস্ত লেখা তোমাকে দিলাম |
চাঁদে সূর্যে মিলেমিশে তুমি এক অদ্ভুত রমণী  |
এত লেখালিখি নিয়ে হ্রদের সবুজ জলে
আজ হয়তো তোমার মিলন  |

আমি কতদূরে আছি |  একবার ভেবে দ্যাখো কতটা পাহাড় |
তোমার মিলনলেখা বুকে এঁকে
গ্রামদেশে আমি ফিরে যাব |

.            *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
দস্যুতা
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

সারাজীবন দস্যুতার গল্প লিখে লিখে
ফুরিয়ে গেল শেষের কথাটুকু  |
কাগজগুলোর সেলাই খুলে সরিয়ে রাখি এবার----
দেখি এখন আঁচড়কামড় পচন আর ক্ষত,
কোথায় কোথায় পিঁপড়ে যায়
.                          কোথায় কোথায় মাছি,
মরচেপড়া অস্ত্রগুলো দেখি কেমন বাজে |

মাসবছর দস্যুতার উপাখ্যান লিখে
আঁকি তোমার ঝলসাপোড়া মুখ----
কোথায় কোথায় ছিন্নভিন্ন আস্ত একটা শরীর,
কোথায় কোথায় অশরীরীর ছোট্ট কড়ে আঙুল !

ওহো, আমি এই কথাটাই লিখতে ভুলে গেছি |

.            *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আমার বাড়ি
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

পেরেক পুঁততে পুঁততে যেখানে এসে থামলাম
সেটা ত্রেতা যুগের একটা বাড়ি,
লম্বা থামওয়ালা আকাশছোঁয়া একটা বাড়ি |
প্রান্ত বোঝা যায় না ,
উচ্চতা বোঝা যায় না,
দেউড়ির অতল শূন্যে আটকা পড়ে গেছে সূর্য,
ঘ্রাঁও ঘ্রাঁও করে জোড়া-সিংহ গজরাচ্ছে |
লোকে হাত তুলে ধেই ধেই করে নাচছে,
বলছে সর্বধর্মসমম্বয়,
ঝাড়বাতির নীচে দাঁড়িয়ে বলছে মেলাবার কথা,
মানুষ আর মানুষ----

যতদূর চোখ যায়, গম্বুজ আর খিলানে
চুন-সুরকিওঠা আমার মস্ত মস্ত ছবি,
কতকাল ঝাড়পোঁছ হয়নি,
দোল খাচ্ছে !

.            *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মনোনিবেশ
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

আমি নাচছি ঘুরে ঘুরে
সুরে গাইছি কত গান
আমার দেয়ালচাপা বুকে
লাফায় জ্যান্ত ভগবান !

আমি গিলছি না আর ভাত
গলায় আটকে গেল কাঁটা
আমার দৃষ্টিমরা চোখে
দূরের চশমা আছে আঁটা |

আমি মরছি  কেঁদে কেঁদে
নুড়ি পাথর লেখা গায়ে
বেড়াই সারাদিনের শেষে
ভাঙা চাঁদের পায়ে পায়ে |

আমি হাসতে ভুলে গেছি
তবু আড়াল ভেঙে হাসি
আমার ছড়ানো সম্পদ
নিয়ে পালালো দাসদাসী  !

আমি ঘরপালানো ঘরে
মেয়ের পুতুল ভাঙি গড়ি
সেই একা পুতুল নিয়ে
খেলায় মনোনিবেশ করি |

.    *********************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ভক্তের ভগবান
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

দেখতে খ্যাঁদানাদা হলে কী হবে,
লোকে ভাবছে, আমি ভক্তের ভগবান |
পাপীতাপীদের দিশা দেখাতে
পাহাড় থেকে সমতলে নেমে এসেছি |

আমাকে শস্যের দানা ভেবে
খুঁটে খেতে এসেছিল শালিখ |
পারেনি |
ঠোঁটের ধার কমে গেছে | নখের দৈর্ঘ্য আর আগের মতো নেই |
খয়েরি ডানায় ফিনকি দিয়ে উঠেছে চকচকে রক্ত |
পাখির নিপীড়নও আমাকে চোখে দেখতে হল  !

আমি নদী সৃষ্টি করেছি |
নৌকোর ভাবনাও আমার |
আমিই পৃথিবীতে হাজার হাজার দাঁড়মাঝি ছেড়ে দিয়েছি,
তারাই এখন প্রমত্ত জলধারা সামাল দিচ্ছে |

যে গাছগুলো আমি প্রকৃতির খাঁজে খাঁজে পুঁতেছিলাম
তার সবগুলোই এখন ফুলেফলে ভর্তি,
একটাও বাঁজা নয় |
লোকে ভাবছে মাটি রস আর গর্ভের
কী অসীম ক্ষমতা |

বইয়ের অক্ষরে অক্ষরে যে দিনরাতের আলো
সেগুলো আমারই চোখ থেকে বিচ্ছুরিত,
জন্ম জন্ম ধরে দেখেও লোকে বুঝতে পারছে না  |
এই বই থেকে লোকে একদিন জানতে পারবে
আমি যেরকমই হই, প্রকান্ড কিংবা ক্ষুদ্র,
যেখানেই থাকি, খেলার মাঠ কিংবা থামের আড়াল,
ভক্তের ভগবান তো, আমাকে ঘিরেও লক্ষ লক্ষ মানুষ
পুঁপড়ের মতো ঘুরে বেড়ায় !

.            *********************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পাষন্ড নামের মানুষ
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

এই লোকটাই ঠান্ডা থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে,
ঘন ঘন সেঁক দিয়েছে রাত্রিবেলা ,
বরফজড়ানো শরীর নিয়ে, আমি উঠে দাঁড়িয়েছি এক একদিন---
হিমালয় এত কাছে, সূর্যোদয় হচ্ছে একটু একটু ,
শৃঙ্গের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি  !
কুড়ি বছর ঘর করেছি লোকটার সঙ্গে,
তিরিশ বছর রাজনীতি---
এত কান্না হচ্ছে প্রতিদিন, এত রক্তপাত,
সকালে সন্ধ্যায় এত মাখামাখি
লোকটাই আমার জীবন ফুলের মতো বদলে দিয়েছে,
চারপাশে গড়ে দিয়েছে এত শোভার আধার----
আমার গোল আর ভরাট মুখের সোহাগ খেতে খেতে
এই লোকটাই একদিন ঘুমিয়ে শ্যাওলা হয়ে গেছে  |

মরব বলে কতদিন নীল আকাশের নীচে একা একা দাঁড়িয়েছি,
আমার মাথায় ভেঙে পড়েছে উড়োজাহাজের ডানা,
মেঘবাদলের মস্ত মস্ত চাঁই---
লোকটা আমাকে হাঙরের ভয় দেখিয়েছে,
দেখিয়েছে জলোচ্ছ্বাসের ভয়,
লোকটা বলেছে, মরুশহর, বালির সমুদ্র, বলেছে বেশ্যাবাড়ির দরজা,
আমি সংঘর্ষের দিকে তাকিয়ে বলেছি, বাঃ বাঃ, চমত্কার !
এই লোকটাকে আমি পুরনো দিনের গান ছাড়া আর কী বলব,
প্রতিদিন সুরে সুরে এত আঘাত করে,
এত ভেংচি কাটে, রক্তে এত জীবাণু ছড়িয়ে দেয়,
প্রতিদিন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে এতবার হত্যা করে,
আমি আর ভয় পাই না, সবই তিরিশ বছরের পুরনো রাজনীতি----

লোকটাকে এখন পাষন্ড নামের চমত্কার একটা মানুষ ছাড়া
আমার আর কিচ্ছু মনে হয না |

.                *********************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
হরিণের জন্য
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

হরিণ আমাকে এখানে এনেছে ডেকে
চিনিয়ে দিয়েছে উপত্যকার ভয়
তীর-ধনুকের রক্ত ধুয়েছি যেই------
হরিণ পেয়েছে নব নব জলাশয়  |

হরিণ আমাকে অতি সামান্য চেনে
ধোঁয়ায় আগুনে কাঁপে তার নীল মুখ
আমিও দেখেছি কুহকের ভেঙে যাওয়া
স্রোতের রচনা কতখানি উত্সুক !

শেষ হয়ে এল খেলা মেলাবার দিন
ভোজের থালায় আমিও উঠেছি মেতে
আজ থেকে শুরু জীবন্ত বনবাস----
হরিণ আমাকে কাছে নেয় বুক পেতে |

.           *********************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
যুদ্ধ
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

অনেক অনেক যুদ্ধ দেখা হল
অনেক অনেক অস্ত্রব্যবহার ----
ছিটকে যাওয়া মাথার ঘিলু , ছিন্ন নাড়িভুঁড়ি
শিবিরছাড়া লোকটা এখন নিপাট ভালোমানুষ
নিষ্পলক চোখের নীচে অশ্রুমোছা হাসি-----
দেখতে দেখতে চলচ্ছবি, সন্ধ্যা ঘনঘোর  !

রক্তধোয়া পুকুর ,চলো সাঁতার কেটে আসি !

.           *********************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আমাদের ছোট দেশ
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

আমাদের ছোট দেশ | মরা খাল  | সরু নদী |  দেশ ভরে আছে |
আতাগাছে তোতা পাখি | ঘুড়ি ওড়ে | ছাদে শোয় পোয়াতি কুকুর |
দেশজোড়া গলিপথ | সাদা কালো | দিনভর থকথকে কাদা |
জুতো ডুবে গেল, আর, হায় হায় অবশেষে মরেই গেলাম |
কে আছ বাঁচাও ভাই, প্রিয়জন, দেখে যাও আমার বিপদ |


আমাদের ছোট দেশ | উঁচুনীচু মেয়েলোক  | জমি দেখা যায় |

.                    *********************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সুখাদ্য
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

রান্নাঘর থেকে যখন বেরিয়ে এলাম
চোখে মুখে পেঁয়াজ রসুনের
উত্কট ঝাঁঝ লাগছে,
মাংসের খুশবু প্রায় আত্মহারা করে ফেলল,
এই সময় এই গভীর লোকালয়ে আর চুপচাপ
বসে থাকা যায় না,
ভাবতে ভাবতেই প্রণয়থালায় উঠে এল
ঘোর রক্তবর্ণ সুখাদ্য !
হাড়গোড় চিবোতে চিবোতে
পৃথিবী একসময় অন্ধকার হয়ে এল !

.        *********************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর