এঁটোকাঁটা ধুতে যেই নেমেছি কোমর-জলে, ঠিকরে উঠল চোখ---- জল নেই, পুকুরে সাজানো আলো, ভয় করে, খুব ভয় করে | আলো দেখে যেই আমি লাফিয়ে উঠতে গেছি কেউ যেন লেজের ঝাপটা দিল, বুক জ্বালা করে | বুক থেকে যেই আমি সরিয়ে নিয়েছি হাত, একটি একটি করে কেউ যেন কেটে দিল হাতের আঙুল | উঃ মাগো, আমি যেই মরণকরুণ ডাকে চেঁচিয়ে উঠেছি, দেখি গলা ডুবে গেছে, ঘন জল, নীল জল, শান্ত নিঝুম জল, আমি আর স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারি না |
নৌকার মধ্যে আর কতক্ষণ চোর-পুলিশ খেলবে আর কতক্ষণ ঘুরে বেড়াবে শ্যাওলা আর ঝাঁঝির ভেতর বেলা ছোটো হয়ে আসছে হৃৎপিন্ডের মধ্যে একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছে নুন এবার আমাদের চুমু খাওয়ার সময় হয়ে এল |
পাখির আরেক নাম স্বাধীনতা | আরও পাখি | আরও আরও পাখি | খাঁচার দু-দিকে তুমি নদীনৌকো | পারাপার | পঞ্চাশ বছর | খাঁচা ভাঙো বজ্রপাত | গাঢ় নীল মুক্তিপথ | আরও আরও আরো আরও | আরও | ছিঁড়েখুঁড়ে তছনছ | দু-পাশে সরিয়ে দাও প্রহেলিকা | মেঘ | এখনও দিনের শেষে গান হয় | ভাতের অপূর্ব গান | ব্যঞ্জনের . আরও আরও গান | দুয়ারে ধানের ছায়া | ধনাগম | উড়ে চলো ও শ্যামল | আরও আরও . পঞ্চাশ বছর |
একরাত্রে ভয়ঙ্কর অপরাধ, তাই পালিয়েছি ওই ছোটো দরজা দিয়ে----- যদি দেখে ফেলে কোনো গোপন ন্যায়ের দন্ড, প্রতিবেশী, অতীতের শিক্ষকমশাই, বনের পুলিশ যদি দেখে ফেলে যদি দেখে ফাটলের কালো টিকটিকি , তাই আমি কোথাও থামিনি | সড়ক দীর্ঘ হয়ে সীমান্তের গ্রাম ঢুঁড়ে গেছে---- ভাতের হোটেল দেখে চোখে জল, শুকিয়ে গেয়েছে জিভ, খাঁচায় মোচড়, তবু আমি কোথাও থামিনি | কী এমন অপরাধ একরাত্রে, হাসতে পারিনি আমি, কাঁদতে পারিনি আমি কী এমন দোষ ? দৌড়েছি প্রাণের ভয়ে, উর্ধ্বমুখ পলাতক, ছোট্ ছোট্ দিগন্ত ওপার--- অপরাধ এরকমই, থামতে দেয় না ! দু’পাশে শত্রুর ছায়া, মাঠভর্তি তৈরি লোক, লাঠিসোঁটা আর জনরোষ !
বিষয়বাসনা আর মনে তেমনভাবে দোলা দেয় না | মুখে গ্যাঁজলা আসক্তির খাঁচা দুলে ওঠে অন্ধকারে | একদিন শুয়ে বসে ঘুমহীন রাত্রে দিনের পর দিন না-ঘুমানো রাত্রে শুয়ে বসে একদিন তোমাকে তৈরি করলাম | তৈরি করার সেই আনন্দই তো আলাদা---- করতে-করতে কত-যে পুলক রোমাঞ্চ হয় কত-যে আনন্দ লাগে কত-যে বেদনার ঘোর কামড়ে ধরে কত-যে ভাবতরঙ্গ উথালপাতাল হয় মনের ভিতর মাথামোটা লোকেরা তা কোনোদিন বুঝবে না ! এই না বোঝার আনন্দেই একদিন মাথা রিমঝিম করে উঠল |
শুয়ে বসে একদিন আনন্দ করতে-করতে তোমাকে বারকোষ থেকে বার করে আনলাম ভোগের মালসায় চালকলার চূড়ায় সাজিয়ে রাখলাম তোমাকে তোমারও যে কত আনন্দ শুয়ে-বসে শুয়ে-বসে তুমি নাচলে, গাইলে, বাজালে, ভাবাবেশে আছাড় খেলে, ছড়িয়ে দিলে এলাচ, কর্পূর, উথ্বানের জল, ধূলিকণা |
আনন্দ করতে-করতে একদিন ভোরবেলায় শুয়ে-বসে দেখি ভোগের মালসা শূন্য | শ্রীখোল বাজছে, ধেই-ধেই করে নাচছে বউ ঝি গৃহলক্ষ্মী | মধুর সুরে কীর্তনাঙ্গের গান গাইতে-গাইতে লুটিয়ে পড়েছে জগাই মাধাই | কিন্তু তুমি কোথায় আনন্দনাড়ু শুয়ে-বসে আনন্দ করতে-করতে তুমি এখন কোথায় ?
তুমি ডাইনিবুড়ি আর রাখালছেলের গল্প পড়বে আমি উনুনে কাঠ উসকে দেব বেঁটে রাক্ষসের লম্বা ছায়া পড়বে তোমার গায়ে ঝকমক করে উঠবে তোমার মকরমুখী বালা, তোমার কানপাশার . লালসবুজ পাথর আমি বলব : একটু সোজা হয়ে বোসো মালঞ্চ, পিঠে টান ধরবে গরিবের কথা বাসি না-হলে মিষ্টি লাগে না ! মাটির হাঁড়িতে টগবগ করবে নতুন চালের ভাত---- এত সহজে তুমি কি কথা শোনার মানুষ ? আমি আর-একটু নরম হয়ে বলব : তেপান্তর কী এমন দূর, জয়রামবাটী কামারপুকুরের চেয়ে তো বেশি নয় ! চলো না একটু গা সইয়ে আসি---- তুমি দোওয়ালের ঝুল ঝাড়বে আর আমি থালায় পাট করে রাখব কাঁথাকানি আমরা দু’জনেই খিড়কিঘাট থেকে দেখব তালগাছ খেজুরগাছ সূর্য অস্ত যাচ্ছে শেয়ালছানা আর পাতিহাঁস ন্যাড়া বেলগাছের টঙে জোবড়ানো একতাল ধূসর রঙ একটু-একটু করে ফুটে উঠেছে ভূতের ঠ্যাঙ---- পেঁয়াজ কাটতে-কাটতে বোধ হয় ঝাপসা হয়ে এল তোমার চোখ আমি বলব : আঃ কী যে করো, বঁটি শুইয়ে রাখো, হোঁচট খাবে ব্যথা লাগবে রক্ত পড়বে তোমার !
মনের কোণে-কোণে অনেকদিনের ধুলো জমে আছে ব্যাঙের চামড়ার মতো খসখসে হয়ে উঠছে শরীর একেকদিন ভাবি এখনও আমি কি সেই বাংলার ডাকাত এখনও কি আমার ভয়ে কোতুলপুরের গোরু আর বাঘ একঘাটে জল খায় ? ভাবি একেকদিন কালিপড়া লন্ঠনের আলোয় একটু নিজের মুখ দেখি আয়নার সামনে একটু গোঁফ চুমরে আসি সরিয়ে দিই পাকা চুলের বাহার---- ওই ভাবনাটুকুই সার, সন্তাপে গলা জুড়িয়ে আসে !
বুকে হাত রাখতে গিয়ে দেখি আর যেন আঙুল সরছে না ও তো বুক নয়, যেন শুকনো খটখটে দুধের ধারা ঠান্ডামরা দুটো আবহমানের পাথর ! আমি আস্তে আস্তে মশারি ছেড়ে চোরের মতো বেরিয়ে আসি বাইরে হাতজোড় করে বলি : তুমি কাঁদছ কেন মালঞ্চমালা ? কাঁদছ বলেই প্রতিদিন মনের কেণে এমনভাবে ধুলো জমছে তুমি না ছেলেপুলের মা, শক্ত হয়ে দাঁড়াও, তুমি না পেটে ধরেছ দু-দুটো . প্রদীপের আলো ?
বনের চাপা গুমোট পথ দিয়ে চলেছে আমাদের স্বপ্নের পালকি নিস্তেজ হয়ে আসছে চোখ ফুল আর মালার গন্ধ সরিয়ে আমরা কেউ কারও মুখের দিকে তাকাতে পারছি না !