কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা
*
আমাদের ঘোড়াজন্ম
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

ঘোড়া নিয়ে আমি একসময় দু-হাতে কবিতা লিখতাম |
বিষয় ঘোড়া বলে কবিতাগুলির উড়ানক্ষমতাও ছিল চমত্কার !
উড়তে উড়তে ফ্যাকফ্যাকে সাদা কাগজ যখন হয়ে উঠত পাংশু আর গনগনে
অক্ষর হয়ে উঠত মাংসল আর ধোঁয়াধূসর
বুঝতে পারতাম চৈতক না-হয়ে যায় না !
এদের দেখার জন্যই বারাসতের মানুষ হাঁ করে বসে থাকে
মধ্যমগ্রামের মানষ উরু চাপড়ায়
জীবনমুখী এই কবিকতাগুলি নিয়েই আমি একটি বই লিখেছিলাম
একবার : আমাদের ঘোড়াজন্ম !
প্রচারউন্মুখ তরুণ কবিরা এই লম্বাটে, ঘোড়ামুখো বইটি পড়েই
জানতে পেরেছিলেন অশ্বশক্তির প্রকৃত উত্স
বুঝতে পেরেছিলেন জরাগ্রস্ত, ধর্মভীরু ঘোড়াই কালে-কালে গাধা হয়ে ওঠে
আর গাধার জ্যোতিঃপুঞ্জ থেকেই একদিন তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসে খচ্চর !

ঘোড়া নিয়ে এখন আর আগের মতো কবিতা লিখতে পারি না |
দিগন্তের ওপারে যেসব ঘোড়া ঘুমিয়ে থাকে
মেয়েদের সামনে যারা অবলীলায় আগুন উদ্ গিরণ করে
আমি আড়াল থেকে সারাদিন তাদের দেখতে পাই----
তাদের নিম্নাঙ্গ এবং প্রণালী আমার চোখ ঝলসে দেয়,
বুঝতে পারি স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্যের সামনে কখনও-কখনও
অন্ধকার নেমে আসে |
গভীর রাত্রে যখন আর কিস্ সু করার থাকে না আমার
আমি এই ঘোড়াদের জীবনধারার সামনে হাঁটু গেড়ে চুপচাপ বসে থাকি  |

.                      *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
দশতলার বাড়ি
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

সন্ধেবেলা দেখি তুমি খোলা জান্ লা,
ঘুম-ঘুম দশতলার বাড়ি,
মিথ্যার ওপরে কিছু টুকরো ছাদ----
ছাদে কোনো তারা নয়, লাল নীল এরোপ্লেন জ্বলে,
যেই-না রাত্রি হয়, রহস্যের, রোমাঞ্চের,
মেঘে মেঘে মহাযুদ্ধ , রোমহর্ষ জাগে |
কেউ বা পাহাড়ে যায়, কেউ চাঁদে, সমুদ্রের অনেক ওপারে
লালগ্রহ মঙ্গলের কাছে গিয়ে
কারও -কারও মুড়ো খসে পড়ে---
কেউ বা আবার কিছু দূরে গিয়ে মুক্তমন,
হাঙরের কুমিরের জলাশয়ে ভাসে |

দশতলার বাড়ি থেকে উড়ন্ত দেশের মুখ মনে পড়ে,
প্রেম নেমে আসে !

.            *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মারুতি
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

আমি যে ধন্য আমি যে ধন্য আজ
দেখলাম এই প্রথম মারুতি গাড়ি
আমি যে ধন্য আমি যে ধন্য আজ
এই আনন্দে কবিতা করতে পারি |

সাদা রঙে আঁকা মারুতি গাড়ির প্রাণ
বুক পেট জানু হাঁসের পালকে ঢাকা
আমি যে ধন্য আমি যে ধন্য আজ
গরিবের ঘরে অপূর্ব চারচাকা  !

নড়বড়ে সাঁকো, ফাঁকা ফাঁকা বাড়িঘর
বাঁকের পরেই বড়ো রাস্তার শেষ
আমি যে ধন্য আমি যে ধন্য আজ
মারুতিও চেনে শ্যামল বাংলাদেশ !

সাদার ভেতরে আরও ঝকমকে সাদা
মারুতির হাঁস গরিবের কুঁড়েঘরে
আমি যে ধন্য আমি যে ধন্য আজ
এই আনন্দে বাঙালি কবিতা করে

.       *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মেয়ের জন্য রূপকথা
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

মহাকাশ পেরোলেই একটা সরু ভাঙাচোরা রাস্তা |
রাস্তা পেরোলেই একটা ঝলমলে বাঁক |
বাঁক পেরোলেই রামধনুর দেশ |
একটু লম্বা, অগোছালো, মাইলের পর মাইল মেঘ,
তা ছাড়া রাস্তার শেষ নেই, তা ছাড়া ঝড় আর শূন্যতা |
এই দেশটা পেরিয়ে যেতে পারলেই
একটা ধু-ধু ফাঁকা মাঠ | মাঠ পেরিয়ে গেলেই
একটা দুরন্ত জলাশয় | জনমানবহীন অতল কালো জল
তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে |
জল পেরোতে পারলেই উঁচু উঁচু বালির পাহাড় |
হাড়জিরজিরে উট দাঁড়িয়ে আছে | কয়েকটা কাঁটাগাছ |
প্যাটপ্যাট করে তোমার পায়ে কাঁটা ফুটছে | হাত ছড়ে যাচ্ছে |
এই গাছগুলো পেরিয়ে গেলেই স্বপ্নের মতো ঘরবাড়ি |
দরজা | জানলা | হাঁস | ময়ূর | বোলতা | ভিমরুল |
ফুল ফুটছে | দৈত্যের বাগানে শিশু লাফিয়ে বেড়াচ্ছে |
বারান্দায়, মঞ্চে, ছাদে, আটচালায় যে দিকেই চোখ যায়
রাক্ষস আর রাক্ষস | কেউ গাইছে, কেউ নাচছে, কেউ ভ্যাঙাচ্ছে,
কেউ খেজুরের খোসা ছাড়াচ্ছে, কেউ মিলনের জন্য জায়গা খুঁজছে |
কারও হাতে চুষিকাঠি, কারও হাতে মাইপোশ |
এই মধুর মর্মস্পর্শী দৃশ্যগুলো পেরিয়ে যেতে পারলেই
দুধের মতো একখানা সাদা ধপধপে ঘর |
ঘরটা পেরোতে পারলেই কালো গভীর সুড়ঙ্গ |
ঠেলেঠুলে সুড়ঙ্গটা কোনওমতে পেরোতে পারলেই
ইস্ কী ভয়ঙ্কর সুন্দর, আঃ, কী নরম ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া,
উঃ, কী অসাধারণ সুগন্ধ | তোমার গা থেকে পশম উড়ে যাচ্ছে |
শীত করছে তোমার | নাকের ডগা, কানের লতি, বুকের বোঁটা,
কোমরের খাঁজ, চুলের ঢাল, পায়ের ডিম---- সব কেঁপে-কেঁপে উঠছে |
এই কম্পন সরিয়ে যেই তুমি এগিয়ে যাবে খানিকটা
দেখবে গুটি গুটি পায়ে তোমার দিকে এগিয়ে আসছে চাপ-চাপ কুয়াশা |
আর রাস্তা খুঁজে পাবে না তুমি | পেছন থেকে
কেউ তোমাকে জাপ্টে ধরবে | কঠিন, কঠিন, অসম্ভব
কঠিন লাগবে তোমার | আর নড়বার ক্ষমতা থাকবে না
তোমার চোখ কান ত্বক রসনা মায়াকানন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন হৃদ
সব অন্ধকার হয়ে যাবে | জিভ ঠেলে বেরিয়ে আসবে |
তারপর, আঃ কী আনন্দ | উঃ, কী যন্ত্রণা | মুক্তি, মুক্তি,
কী আশ্চর্য অপরূপ মুক্তি তোমার

.       *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
নাড়াজোলের হাঁস
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

আর পাঁচটা হাঁসের সঙ্গে
নাড়াজোলের হাঁসের কোনও মিলই নেই |

নাড়াজোলের হাঁসের জলে থাকে না
প্যাঁক প্যাঁক করে না
গেঁড়িগুগলি খায় না
ডাঙা থেকেই যক্ষের সঙ্গে ভাব জমায় |
কঠিন, পাথুরে মাটি থেকেই শুনতে পায়
পাতালকুঠরির হাতছানি |

কোনও শেয়াল নেই নাড়াজোলে |
দুটো-একটা ছিল আছে |
বাজপাখি আছে |
তারাই রাজবাড়ির গবাক্ষে আর অলিন্দে
ডানা ঝাপটায় |
ফলে নাড়াজোলের হাঁসপাখি কাউকে ভয় পায় না |
গর্ত থেকে সড়ক
সড়ক থেকে সুরঙ্গ
সুরঙ্গ থেকে প্রান্তর সে অবাধে ঘুরে বেড়ায়  |
তার চলার পথ এত সুগম যে, সে একবারও
কোথাও হোঁচট খায় না |
আর- পাঁচটা হাঁসের সঙ্গে
নাড়াজোলের হাঁসের কোনও মিলই নেই |
তার সাদা পালকের দিকে আমরা যখন আড়চোখে তাকাই
নাকের ডগায় বিনবিন করে ওঠে ঘাম |
কানের লতি লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে |
থরথরে করে কাঁপতে থাকে দন্ড |

অদ্ভুত একটা আকাশে নাড়াজোলের হাঁস উড়ে বেড়ায় |

.             *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মাথা
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

তোমার মাথার দাম এক লক্ষ টাকা |
চমত্কার | চমত্কার |রাস্তাঘাট ফাঁকা |

বন্ধুর মুখোশে বন্ধু | বোঝাপড়া চাই  |
শত্রুর শেষ রাখতে নাই |

ফাঁকা নৌকো | ভটভটি | বৃষ্টিভেজা বাড়ি |
একটু তফাতে রাখো তিন চাকার গাড়ি |

মাঝি নেই | মাল্লা নেই | রাস্তা নেই আর |
জব্দ করে ধরো টাঙি | ভোজালি | চপার |

তৃণতুচ্ছ মাথা, তবু আলো পড়ে ঘাসে  |
যেন না রক্তের গন্ধে বাঘ দৌড়ে আসে |

কী করে ধরবে তুমি | এত অস্ত্র | চরিত্রের ভয় |

দু’পাশে নতুন শত্রু | মুখোশ | মুখোশ |
তোমার মাথার দাম তিন পয়সা নয় |

.          *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আজ টুকটুকির বিয়ে
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

আইবুড়ো ভাত খেতে সেদিন টুকটুকি
আমাদের বাড়ি এসেছিল |
খাওয়াদাওয়ার পর এঁটো থালায় কড়ে আঙুল দিয়ে
টুকটুকি  মানুষের মুখ আঁকছিল  |
মুখ আঁকতে আঁকতে নৌকো
নৌকো আঁকতে আঁকতে মাছ
মাছ আঁকতে আঁকতে পতঙ্গ
কিন্তু কোনো ছবিই তার ঠিকমতো পছন্দ হচ্ছিল না |
আসলে এইরকম অনেকগুলো অপছন্দের সঙ্গে
আজ টুকটুকির বিয়ে  |

টুকটুকির বর লোক ভালো----
কাকে যমক বলে কাকে উত্প্রেক্ষা
এসব জানতে তার বয়ে গেছে,
কিন্তু সে কবিতা লেখে অতি চমত্কার  !
নদীর ঢেউ গুনতে গুনতে সে রাত্রি কাবার করে দেয়,
কিন্তু একটা নদীর নাম জানে না !
তার কবিতায় এত ফুলের সুগন্ধ
কিন্তু সে চেনে না কোন্ টা আকন্দ আর কোনটা কেয়া !
আজ টুকটুকির বিয়ে,
ভাবছি তাকে শিকড়মাটিসুদ্ধু একটা আস্ত আকন্দফুলের ঝাড়
উপহার দেব !

টুকটুকিই বা  মেয়ে হিসেবে কম কী !
কতবার যে সে আমার জন্য বেড়াল হয়েছে
আর কতবার যে খরখরে সাদা কাগজ,
তার কোনো হিসেব নেই------
মনে পড়ে সে শুধু জ্যোত্স্নার ভাষা বুঝত,
আমি তার হাত ধরে অন্ধকার চিনতে শিখিয়েছিলাম  |
আজ টুকটুকির বিয়ে
ভাবছি আমার সমস্ত শরীর আজ তাকে উপহার দেব |
সে হাত বাড়াবে কিনা আমি জানি না  !

.          *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ফুদিপিসিমা
কবি শ্যামলকান্তি দাশ

ফুদিপিসিমা বলে কেউ এখানে থাকেন না
একসময় থাকতেন হয়তো
কিন্তু অনেকদিন হল তিনি আকাশের তারা হয়ে গেছেন  |

আমাদের চারপাশে এখন যে মিহি কুয়াশা ভেসে বেড়ায়
বাগানের মাঝখানে আকাশের যে লম্বা লম্বা ছায়া পড়ে
তাকেই লোকে ফুদিপিসিমা বলে ভুল করে !

যারা ফুদিপিসিমার জন্য কান্নাকাটি করে
তারা বোকার হদ্দ
লেখাপড়া শেখেনি
তারা সুড়ঙ্গ দেখেনি, সেতুর আড়াল দেখেনি
কুমুদ কহ্লারের খুনসুটি দেখেনি
রাত্রিবেলা কতরকম যে শব্দ হয় সমতল অসমতলে
এই ভোঁদাইগুলো তার কোনো খবরই রাখে না |

আমি বলি কি, শুধুমুধু দাঁড়িয়ে না থেকে
একটু কষ্ট করে সোজা হেঁটে যান
প্রথমে রক্তলাল দরজা
তারপর মেঘবর্ণ ঘর
তারপর নীলিমালীন দেওয়াল
তারও পরে ফিনফিনে, আবছা টুকরো, টুকরো  টুকরো আলো
একটা পাখা ঘুরছে বন্ বন্ বন্ বন্

জানি আপনি এবার আত্মহারা হয়ে যাবেন
আর আপনার চোখের পলক পড়বে না
ওই তো--- ওই তো---ও আপনার মনের ভুল
ফুদিপিসিমা বলে সত্যই কেউ এখানে থাকেন না
আপনি যাঁকে ফুদিপিসিমা ভাবছেন
তিনি আসলে একখন্ড বিদ্রূপ ছাড়া আর কিচ্ছু নন |

.               *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মাটির ভিতরে
কবি শ্যামলকান্তি দাশ


মাটির ভেতরেও অদ্ভুত একটা কান্না আছে,
সারাদিন গুমরে গুমরে ওঠে |
সেই কান্না তুলে এনে একদিন
ঘরে, বইপত্রের পাশে সাজিয়ে রাখি |

এই কান্নায় অক্ষর ভাষা পায়, আমার
ছেঁড়া টুকরো অসংবৃত রচনায় আলো পড়ে |

মাটির ভেতরে যে কান্না প্রতিদিন
একটু একটু করে বড় হচ্ছে
আমি সেই কান্না দিয়ে জীবন তৈরি করি,
একটা সরু রাস্তাকে অনেকদূর পর্যন্ত ভিজিয়ে দিই !



কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া মাটির ভেতর
সন্ধেবেলা একটা হরিণ ফুট উঠছে |

এমন মধুর দৃশ্য তারাভরা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে
মানুষ বড় একটা দেখেনি |

আমরা ঘাসপাতার দুর্গ বানাই
হরিণের জন্য এরকম সুরক্ষিত দুর্গ
আগে আর কখনো হয়নি  |

দুর্গের সবুজ দয়জায় প্রহরে প্রহরে
চাঁদ ফুটে ওঠে |



মাটির ভেতর থেকে বীজ আর শস্যদানা তুলে নেওয়ার
এই এক আনন্দ |
বৃষ্টি হচ্ছে | রামধনু উঠছে | ময়ূর ডাকছে |

আমরা সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে বাড়ি ফিরছি |

.               *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কুকুরের জন্য
কবি শ্যামকান্তি দাশ

গলায় চেন পরালে কুকুর আপত্তি করে না
সে প্রেমিক এবং তস্কর দেখলে তেড়ে যায়
মন্ত্রীর গাড়ি দেখলে রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায়
তার চোখে অশ্রু মনে বেদনা গোপন অঙ্গে মিনতি
সে গর্জমান সমুদ্রের ধারে চুপচাপ শুয়ে থাকে
এবং ভুলেও কখনও মনিবের ধ্যান ভাঙায় না
তাঁর দেহ স্তব্ধতা এবং চপ্পল পাহাড়া দেয়

ভোরের আলোর মতো কয়েকটি উজ্জ্বল মাংসখণ্ড---
কুকুর, আপনার জন্য এই আমাদের বিনীত উপহার!

.               *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর