ঘোড়া নিয়ে আমি একসময় দু-হাতে কবিতা লিখতাম | বিষয় ঘোড়া বলে কবিতাগুলির উড়ানক্ষমতাও ছিল চমত্কার ! উড়তে উড়তে ফ্যাকফ্যাকে সাদা কাগজ যখন হয়ে উঠত পাংশু আর গনগনে অক্ষর হয়ে উঠত মাংসল আর ধোঁয়াধূসর বুঝতে পারতাম চৈতক না-হয়ে যায় না ! এদের দেখার জন্যই বারাসতের মানুষ হাঁ করে বসে থাকে মধ্যমগ্রামের মানষ উরু চাপড়ায় জীবনমুখী এই কবিকতাগুলি নিয়েই আমি একটি বই লিখেছিলাম একবার : আমাদের ঘোড়াজন্ম ! প্রচারউন্মুখ তরুণ কবিরা এই লম্বাটে, ঘোড়ামুখো বইটি পড়েই জানতে পেরেছিলেন অশ্বশক্তির প্রকৃত উত্স বুঝতে পেরেছিলেন জরাগ্রস্ত, ধর্মভীরু ঘোড়াই কালে-কালে গাধা হয়ে ওঠে আর গাধার জ্যোতিঃপুঞ্জ থেকেই একদিন তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসে খচ্চর !
ঘোড়া নিয়ে এখন আর আগের মতো কবিতা লিখতে পারি না | দিগন্তের ওপারে যেসব ঘোড়া ঘুমিয়ে থাকে মেয়েদের সামনে যারা অবলীলায় আগুন উদ্ গিরণ করে আমি আড়াল থেকে সারাদিন তাদের দেখতে পাই---- তাদের নিম্নাঙ্গ এবং প্রণালী আমার চোখ ঝলসে দেয়, বুঝতে পারি স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্যের সামনে কখনও-কখনও অন্ধকার নেমে আসে | গভীর রাত্রে যখন আর কিস্ সু করার থাকে না আমার আমি এই ঘোড়াদের জীবনধারার সামনে হাঁটু গেড়ে চুপচাপ বসে থাকি |
সন্ধেবেলা দেখি তুমি খোলা জান্ লা, ঘুম-ঘুম দশতলার বাড়ি, মিথ্যার ওপরে কিছু টুকরো ছাদ---- ছাদে কোনো তারা নয়, লাল নীল এরোপ্লেন জ্বলে, যেই-না রাত্রি হয়, রহস্যের, রোমাঞ্চের, মেঘে মেঘে মহাযুদ্ধ , রোমহর্ষ জাগে | কেউ বা পাহাড়ে যায়, কেউ চাঁদে, সমুদ্রের অনেক ওপারে লালগ্রহ মঙ্গলের কাছে গিয়ে কারও -কারও মুড়ো খসে পড়ে--- কেউ বা আবার কিছু দূরে গিয়ে মুক্তমন, হাঙরের কুমিরের জলাশয়ে ভাসে |
দশতলার বাড়ি থেকে উড়ন্ত দেশের মুখ মনে পড়ে, প্রেম নেমে আসে !
আর পাঁচটা হাঁসের সঙ্গে নাড়াজোলের হাঁসের কোনও মিলই নেই |
নাড়াজোলের হাঁসের জলে থাকে না প্যাঁক প্যাঁক করে না গেঁড়িগুগলি খায় না ডাঙা থেকেই যক্ষের সঙ্গে ভাব জমায় | কঠিন, পাথুরে মাটি থেকেই শুনতে পায় পাতালকুঠরির হাতছানি |
কোনও শেয়াল নেই নাড়াজোলে | দুটো-একটা ছিল আছে | বাজপাখি আছে | তারাই রাজবাড়ির গবাক্ষে আর অলিন্দে ডানা ঝাপটায় | ফলে নাড়াজোলের হাঁসপাখি কাউকে ভয় পায় না | গর্ত থেকে সড়ক সড়ক থেকে সুরঙ্গ সুরঙ্গ থেকে প্রান্তর সে অবাধে ঘুরে বেড়ায় | তার চলার পথ এত সুগম যে, সে একবারও কোথাও হোঁচট খায় না | আর- পাঁচটা হাঁসের সঙ্গে নাড়াজোলের হাঁসের কোনও মিলই নেই | তার সাদা পালকের দিকে আমরা যখন আড়চোখে তাকাই নাকের ডগায় বিনবিন করে ওঠে ঘাম | কানের লতি লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে | থরথরে করে কাঁপতে থাকে দন্ড |
আইবুড়ো ভাত খেতে সেদিন টুকটুকি আমাদের বাড়ি এসেছিল | খাওয়াদাওয়ার পর এঁটো থালায় কড়ে আঙুল দিয়ে টুকটুকি মানুষের মুখ আঁকছিল | মুখ আঁকতে আঁকতে নৌকো নৌকো আঁকতে আঁকতে মাছ মাছ আঁকতে আঁকতে পতঙ্গ কিন্তু কোনো ছবিই তার ঠিকমতো পছন্দ হচ্ছিল না | আসলে এইরকম অনেকগুলো অপছন্দের সঙ্গে আজ টুকটুকির বিয়ে |
টুকটুকির বর লোক ভালো---- কাকে যমক বলে কাকে উত্প্রেক্ষা এসব জানতে তার বয়ে গেছে, কিন্তু সে কবিতা লেখে অতি চমত্কার ! নদীর ঢেউ গুনতে গুনতে সে রাত্রি কাবার করে দেয়, কিন্তু একটা নদীর নাম জানে না ! তার কবিতায় এত ফুলের সুগন্ধ কিন্তু সে চেনে না কোন্ টা আকন্দ আর কোনটা কেয়া ! আজ টুকটুকির বিয়ে, ভাবছি তাকে শিকড়মাটিসুদ্ধু একটা আস্ত আকন্দফুলের ঝাড় উপহার দেব !
টুকটুকিই বা মেয়ে হিসেবে কম কী ! কতবার যে সে আমার জন্য বেড়াল হয়েছে আর কতবার যে খরখরে সাদা কাগজ, তার কোনো হিসেব নেই------ মনে পড়ে সে শুধু জ্যোত্স্নার ভাষা বুঝত, আমি তার হাত ধরে অন্ধকার চিনতে শিখিয়েছিলাম | আজ টুকটুকির বিয়ে ভাবছি আমার সমস্ত শরীর আজ তাকে উপহার দেব | সে হাত বাড়াবে কিনা আমি জানি না !
ফুদিপিসিমা বলে কেউ এখানে থাকেন না একসময় থাকতেন হয়তো কিন্তু অনেকদিন হল তিনি আকাশের তারা হয়ে গেছেন |
আমাদের চারপাশে এখন যে মিহি কুয়াশা ভেসে বেড়ায় বাগানের মাঝখানে আকাশের যে লম্বা লম্বা ছায়া পড়ে তাকেই লোকে ফুদিপিসিমা বলে ভুল করে !
যারা ফুদিপিসিমার জন্য কান্নাকাটি করে তারা বোকার হদ্দ লেখাপড়া শেখেনি তারা সুড়ঙ্গ দেখেনি, সেতুর আড়াল দেখেনি কুমুদ কহ্লারের খুনসুটি দেখেনি রাত্রিবেলা কতরকম যে শব্দ হয় সমতল অসমতলে এই ভোঁদাইগুলো তার কোনো খবরই রাখে না |
আমি বলি কি, শুধুমুধু দাঁড়িয়ে না থেকে একটু কষ্ট করে সোজা হেঁটে যান প্রথমে রক্তলাল দরজা তারপর মেঘবর্ণ ঘর তারপর নীলিমালীন দেওয়াল তারও পরে ফিনফিনে, আবছা টুকরো, টুকরো টুকরো আলো একটা পাখা ঘুরছে বন্ বন্ বন্ বন্
জানি আপনি এবার আত্মহারা হয়ে যাবেন আর আপনার চোখের পলক পড়বে না ওই তো--- ওই তো---ও আপনার মনের ভুল ফুদিপিসিমা বলে সত্যই কেউ এখানে থাকেন না আপনি যাঁকে ফুদিপিসিমা ভাবছেন তিনি আসলে একখন্ড বিদ্রূপ ছাড়া আর কিচ্ছু নন |
গলায় চেন পরালে কুকুর আপত্তি করে না সে প্রেমিক এবং তস্কর দেখলে তেড়ে যায় মন্ত্রীর গাড়ি দেখলে রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায় তার চোখে অশ্রু মনে বেদনা গোপন অঙ্গে মিনতি সে গর্জমান সমুদ্রের ধারে চুপচাপ শুয়ে থাকে এবং ভুলেও কখনও মনিবের ধ্যান ভাঙায় না তাঁর দেহ স্তব্ধতা এবং চপ্পল পাহাড়া দেয়
ভোরের আলোর মতো কয়েকটি উজ্জ্বল মাংসখণ্ড--- কুকুর, আপনার জন্য এই আমাদের বিনীত উপহার!