কবি শ্রীজাতর কবিতা
*
উদ্ধার
কবি শ্রীজাত

ভাঙা জাহাজের পাশে বসে আছি
আধো চুপ, আধো আনমনা

ঘুন ধরে গেচে ডেক-পাটাতনে
ঘুম ধরে গেছে কম্পাসে

সুযোগের মতো একের পর এক
ঝরে গেছে ফুল শাল্মলী

ফসফরাসের দাগ ধরে ধরে
এসেছিল যারা আন্দাজে,

ফিরে চলে গেছে, চিরে চলে গেছে
সমুদ্র আর সন্দেহ

পড়ে আছে ধূ-ধূ ভেজা বালি আর
উঠে আসা দল, কচ্ছপের . . .

হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি তবু
চুপ করে আর আনমনে

সকালের আগে আসবে না আজ ?
.                        হেলিকপ্টারে ?
.                                বন্ধুরা ?

.           ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সারারাত বেড়াল কাঁদে
কবি শ্রীজাত

সারারাত বেড়াল কাঁদে
আমাদের পাশের বাড়ি।
মা ভাবে ভাগ্যে আছে
শুভ একটা কিছু
বাবা খুব বিরক্ত হয়
আমারও ঘুম আসে না।
আসলে বেড়ালটারই
অশুভ হবার কথা।
হয় তার বাচ্চা হারায়
নয় সে খিদের মুখে
লাথি খায় গেরস্থালির
আসলে বেড়ালটারই
অশুভ কাটছে ভীষণ।
কিন্তু সে জানে না,
তার এই নীল গোঙানি
অশুভর প্রতীক হয়ে
আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়
আমারও ঘুম আসে না
বাবা খুব বিরক্ত হয়
মা ভাবে ভাগ্যে আছে
অশুভ একটা কিছু...
সারারাত বেড়াল কাঁদে
আমাদের মাথার ভেতর।

.      ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
এমনি বই
কবি শ্রীজাত

এই আমার এমনি বই ফোর কালার দুই মলাট
এই আমার এমনি এক ফালতু বই বিচ্ছিরি
কিন্তু তাও তার ভেতর চোখ ফেলিস সাবধানে
অক্ষরের এক-দু’ পিস একটু হাত ফসকালেই
জঙ্গলের অন্ধকার। ঘাসপাথর। রাস্তা নেই।
আবছা দোল, লণ্ঠনের। আশ্রয়ের কাঠবাড়ি।
দরজা লক। টান দিলেই এক শহর জমজমাট
জ্যান্ত ভিড়, জোরবাজার, দরদামের হল্লা বোল
দিলদরাজ হাড়কেপন খোশমেজাজ এক শহর
ফুটকড়াই, কাচফোড়ন, বচ্চনের অগ্নিপথ
দিনদুপুর জোরগলায় তিন-কা-দশ ব্যালকনি
চোর পুলিস, ঝাঁকবুলেট, কম বয়েস প্রেম পালায়
বৃষ্টি জোর, এফ. বি. আই. কপ্টারের তল্লাসি
হাতসাফাই, খুনজখম, এক মিনিচ শোকপালন
ঈর্ষাফুল কামড়ে খায় আস্তিনের বাস্তু সাপ . . .
এইসবের বেশ দূরেই তৈরি হয় এক বাতাস
ঘোর লাগায়... ঘুর্ণিঘোর... ডাক পাঠায়... ঝঞ্ঝাডাক...
সেই হাওয়ার পাগলা ঝড় তুলকামাল করছে সব
খড়কুটোর এক ঠেলায় উড়ছে সব ঘরবাড়ি
উড়ছে তাস, তুবড়ি আর রং বেরং গ্যাসবেলুন
দশরকম প্লাস্টিকের সূর্য আর চাঁদতারা
শ্যাম্পেন আর ছাঁটকাগজ... এই বিশাল কার্নিভাল
আজ তোদের জন্যে, আয়, বচ্চালোগ হাততালি!
এই আমার যত্তসব যাচ্ছেতাই ধুত্তেরি
ম্যানড্রেকের ডাইরি শেষ। ভাবছি আর লিখব না।
রইল এই দুই মলাট, আশ্রয়ের কাঠবাড়ি
এই আমার এমনি বই, যার ভেতর বন্দী আজ
.                                নীল গ্রহের শেষ ম্যাজিক...

.                 ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ছুট
কবি শ্রীজাত

শরীর থেকে শরীর ছোটে গন্ধ
আগুন থেকে আগুন অপরাধ
আকাশ থেকে আকাশ ছোটে বিদ্যুৎ
পাহাড় থেকে পাহাড় ছোটে খাদ

গুজব থেকে গুজব ছোটে মিথ্যে
প্রহর থেকে প্রহর ছোটে দিন
এ ঘর থেকে ও ঘর ছোটে খেলনা
কাগজ থেকে কাগজ আলপিন

এ হাত থেকে ও হাত ছোটে ওড়না
খবর থেকে খবর অভিঘাত
আড্ডা থেকে আড্ডা ছোটে সন্ধে
ক্লান্তি থেকে ক্লান্তি ছোটে রাত

এতই যদি ক্লান্ত তবে লাভ কী ?
ছুট থামিয়ে বোসো কিছুক্ষণ।
সেই সুযোগে নতুন করে ছুট দিক
আমার থেকে তোমার দিকে মন।

.         ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সুমন একক
কবি শ্রীজাত

তোকে আদর করার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের।
গরম হাতের পাতায় ঠাণ্ডা চুমু(ক) দিয়েই শুনি
সুমন গিটার নিয়ে গান ধরেছেন লোডশেডিং-এর
হৃদয় অন্ধকারে কাঁপছে, যেমন নতুন খুনি!

তাজা ফলের মতো সময় কবে যায় আমাদের ?
পোকা বাছতে গিয়ে অঙ্গে ওঠে আংটি-তাবিজ
তোকে দেখছি পাশে। হয়ত কয়েক বছর বাদে
অনেক দূরের দুটো স্টেশন হবো... তবুও ভাবি

কবে ঠোঁটের উপর ঠোঁট বসাব, ঠিক যেরকম
একলা ট্রেনের মুখে ইঞ্জিন সশব্দে লাগে...
কবে জিভ দিয়ে তুই চাটবি আমার টাকটা জখম
প্রতি পূর্ণিমাতে জন্ম নেব নেকড়ে বাঘের

যেমন সুমন বোঝেন একপিয়ানো উদ্দামতা,
আমার শরীর থেকে পারলে একটু অশান্তি নে---
আমি ডরাই না তোর আনমনা মুখ, মিথ্যে কথা
তোকে আদর করার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের...

.              ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী একটি কবিতা
কবি শ্রীজাত

ধ্বংস বললে কম বলা হবে হয়তো
শেষ বললেও বোঝানো যাবে না কিছু
ভাবার আগেই লাশ হয়ে গেছে, নয়তো
তলায় তলায় সবাই বাঁচতে ইচ্ছুক

ওপরে ওপরে ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে সাম্য
হাঁ করলে মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বন্দুক
পৈতে ছেড়েও থেকে গেছি চেনা ব্রাহ্মণ
আমারও রয়েছে মুসলিম কিছু বন্ধু

রাতের নিউজে, ভোরের খবর কাগজে
ঘুমচোখে রোজ সবাই দেখেছি মৃত্যু
লুকিয়ে কাঁদছি যাতে প্রতিবেশী না বোঝে
সকলের মতো আমিও আসলে মিথ্যুক

চোখ বুজে, মাথা নিচু ক’রে থাকি। সামনে
শরীরে আগুন লাগানো মানুষ জল চায়...
দু’দিন পরেই ট্যুরিজম ভ্যালু নামলে
গুজরাতটাও ঘোরা যাবে কম খরচায়

তখন হয়তো দাঙ্গা অন্য রাজ্যে
লোক পোড়াচ্ছে, ঘর জ্বালাচ্ছে চুপচাপ...
যাদের পুড়লো, তারা পথে বসে কাঁদছে
যাদের পোড়েনি, তাদেরই কিন্তু খুব চাপ---

কিছু ম্যাগাজিন স্টোরি পেয়ে গেল মুফতে
থিম পেয়ে গেল যারা ছবি আঁকে, গান গায়
ভিড়ের মধ্যে নিজের যায়গা খুঁজতে
আমিও যেমন কবিতা লিখেছি দাঙ্গায়...

.            ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
তারপর মুন্নাভাই সার্কিটকে বললেন :
কবি শ্রীজাত

ঝাপটিয়ে পালাল পাখি
আজ নগদ, কাল বাকি
আত্মাটি হল বিদেহী দুনিয়ায়

কষ্টকে প্যাকেটে পুরে
ডিসপ্যাচ করে দে দূরে
মিষ্টি হেসে গালাগালি শুনি আয়

তেষ্টায় জোটেনি জলও
পাত্র আজ টলোমলো
অমৃত না বিষ---খালি জেনে খা

ফুর্তিতে দু’চোখ বেঁধে
মস্তি ক’রে কাটিয়ে দে
টেনশন লেনে কা নেহি। দেনে কা।

.         ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পদ্যসমগ্র
কবি শ্রীজাত

বাতাসকে দিই হাল্কা ধমক রোজ
আলতো টোকায় ছাই ঝাড়ি সূর্যের
আকাশ যখন পদ্যসমগ্র---
আমরা সবাই শক্তি চাটুজ্যে!

.       ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
রাঁধুনি
কবি শ্রীজাত

বান্ধবী, তোর বয়স আমার মনমতো নয়
কেননা তোর জানলা খুললে কদম্বগাছ
সারাটা দিন হেলতে-দুলতে বার্তা পাঠায়---
বার্তা যখন চায়ের চিনি, ডালের ফোড়ন,
বার্তা তখন হাজার চোখের ফাই-ফরমাশ
শেষ অব্দি তাও হারিয়ে যায় ধোঁয়ায়, তলে...
লোকাল ট্রেনের বাঁশি ছড়ায় পুরনো দিন---
লিখিস তখন ? কী বলতে চাস ? কোথায় কোথায়
কোত্থাও নয়। কেবল যেদিন পূর্ণিমা হয়,

রান্নাঘরের মেঝেয় জোটে বরাদ্দ চাঁদ,
সেদিন রাতে আমিও থাকি ;
সেই জোছনায় ডুবন্ত দুই ঝলসানো হাত
পূর্ণ করিস! ভাবনা কিসের ? বান্ধবী, তোর
সঙ্গে আছেন, দু’এক কলি রবীন্দ্রনাথ॥

.           ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কিছু প্রেম কিছু বিচ্ছেদ
কবি শ্রীজাত

ভেঙেছি কঠিন কাব্য
কেটেছে দু’এক ইঞ্চি
ঝলমলাচ্ছে কাপবোর্ড
সস্তায় হলে কিনছি

অথচ এথনো ঘর নেই
বয়েস মাত্র উনত্রিশ
জুটেছে বধির কর্ণে
হেডফোন আর কুন্তী

মাঝামাঝি কোনও সিন নেই।
জিন্দা অথবা মুর্দা,
দুপুরেও দেখে চিনলে,
সন্ধে হলেই সুরদাস।

চুমু এঁটো। তবু খুব খায়
ওর স্বামী আর এর স্ত্রী
মাঝে মাঝে দোসা, থুকপা
অথবা নরম পেস্ট্রি।

পচা সুখ মরা হিংসে
বয়ে নিয়ে চলে গঙ্গা
ভোকাল বলতে ভীমসেন
লোকাল বলতে বনগাঁ।

তারও পরে আছে কাব্য
সেখানে খাটে না টেকনিক
ভাবি তার পিঠে চাপব,
কোত্থেকে এসে পেত্নি।

কে জানে কীসের ধান্দায়
আমাকে গিলিয়ে দিচ্ছে
ঝিনুকে গরম-ঠান্ডা,
কিছু প্রেম, কিছু বিচ্ছেদ!

.     ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর