কবি শ্রীজাতর কবিতা
*
পাকদণ্ডি
কবি শ্রীজাত

পাকদণ্ডি বেয়ে আজ যে উঠছে
মাথা ভর্তি মরা বোলতা ঝিকমিক
গলাভর্তি খিদে তেষ্টা ঝমঝম

পাকদণ্ডি বেয়ে আজ যে উঠছে
ভুলে যাচ্ছে পথ কিন্তু পিচ্ছিল
ভুলে যাচ্ছে হাতে রইল সংযম

পাকদণ্ডি বেয়ে আজ যে উঠছে
নীচে রাস্তা, ভিড়ভাট্টা, খিস্তি
নীচে দুলছে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ঙয়, টান . . .

পাকদণ্ডি বেয়ে আজ যে উঠছে
তার হাত-পা খসে পড়ছে দাউ দাউ
আর মুণ্ডু কিনে নিচ্ছে শয়তান!

.        ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
চন্দ্রকোষ
কবি শ্রীজাত

তীক্ষ্ণ ফলায় গেঁথেছি চাঁদ
খেলা শুরু হলে তোমাকে বাদ
.        (তোমাকে বাদ! তোমাকে বাদ!)

গলিয়ে ফেলেছি পুরনো ঘুম
পথ হারানোর কী মরশুম
.        (কী মরশুম, কী মরশুম)

হারিয়েছি পথ তোর পাড়ায়
ইতিউতি কারা গলা বাড়ায়---
.        (সাহস তো খুব, গলা বাড়ায় ?)

গলা কেটে নাও! কাটা গলায়
ঝ’রে পরে সুর। আর ফলায়
চাঁদ ফেটে নামে চন্দ্রকোষ
.        (তোমার দোষ! তোমার দোষ!)

দোষ কেটে যায়, আহা, নিখাদ---

খেলা শুরু হয়
খেলা শেষ হয়

আমি দিতে থাকি তোমাকে বাদ...
.                তোমাকে বাদ...
.                        তোমাকে বাদ...

.        ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ডুবুরিয়া
কবি শ্রীজাত

ঘর থেকে একটু দূরে বিশ্রাম রাখার মতো টিলা
আমাদের দেখা হলো---সে তো শুধু প্রেমের অছিলা

বাবি সে গুছিয়ে বসা। ভাবি সেই ঘাসে ভরা কোল...
না ভাবি আমারই জন্যে প’ড়ে ছিল উপমাসকল

বাচ্চাদের খেলা দেখি। আমাদেরো নানাবিধ খেলা
ফলাফল দাবি করে, আস্তে-আস্তে পড়ে আসে বেলা...

সন্ধে এসে কী রূপ ফোটাবে, তুমি নিজেও জানো না
আমি জানি, আমি খুব মনে মনে মেনেছি যাতনা

মনে মনে আমি শেষ। বাইরে আমি সামান্য প্রবাসী---
খুলে দেওয়া চুল থেকে পৃথিবীর গন্ধ নিতে আসি

না আসি জানিয়ে দিতে। বাঁকে বাঁকে প্রতিবেশী আলো
আমাকে বিষণ্ণ পেয়ে জলে ভরা আঁচল দেখালো

আমার আঁচলে ভয়। জলেও তো ভয় পেয়ে গেছি
অথচ সাহস দ্যাখো---জলের দারেই দাঁড়িয়েছি

বাবছি জল দেখতে দেখতে, আবার লাগাবো কিনা ডুব...
কবে না, তোমার কাছে চ’লে যাবো। ভয় করছে খুব!

.                   ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আগুনরূপাকে
কবি শ্রীজাত

তুমি টিনেজ নদী, কিছু পাগলপারা
আমি প্রাচীন দেয়াল, ঝুরো পলেস্তারা
তুমি কাচের বিষাদ, মিহি বাতাস ঝালর
আমি বেমক্কা হাত, বাঙি ব্যাথর আলো

তুমি অসম্ভবা। চিরসুপার লোটো।
আমি বাদলদিনে একা দেবব্রত
তুমি সফল পথের ধারে পরাগধানী
আমি সামান্য লোক, দুটো ম্যাজিক জানি

তাতে আধেক জোটে, থাকে আধেক দেনা
এক পাঁকাল হাতে লেখা দাঁড়াচ্ছে না।
তবু লেখাই দাঁড়ায়, ছোটে কী জোর হাওয়া---
জিয়া ধড়ক ধড়ক... যেন ট্রেনের আওয়াজ

আমি নতুন মাতাল। জমে দু’পেগ হেবি।
যদি প্রসাদ না পাই তুমি কিসের দেবী ?
তুমি কীসের মহৎ তুমি কীসের উদার
যদি সাপের কামর খেয়ে মেটাই ক্ষুধা

যদি বিষের পায়েস খেয়ে হজম করি
তবে প্রসাদ পাব ? তবে কভার স্টোরি ?
এসো খেলাও আমায়। আমি সুরের আদল
দেখি সাহস কত, দুটো কথায় বাঁধো---

দ্যাখো বাঁধন ছিঁড়ে ওড়ে লেখার খাতা
মাথা আকাশছোঁয়া, নীচে, হ্যাঁ, কলকাতা
তারও পাড়ায়-পাড়ায় কত পাগল ছেলে
গেল নিরুদ্দেশে... তুমি আরাম পেলে

জানি আমার প্রিয়, তুমি আগুনরূপা
রাতে চিতার মতো জ্বলে তোমার দু’পাশ
জ্বলে দেমার শিখা। তবু সজাগ থেকো
হাতে সময় ঢালাও। তুমি যতই পালাও
.                তুমি যতই জ্বালাও
.                আমি আগুন খেকো।

.           ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
তার চোখদুটো
কবি শ্রীজাত

তার চোখদুটো ছিল বারতীয়
আর চাউনি কিছুটা মার্কিন
লোকে মরে যাচ্ছিল মার খেয়ে
লোকে মারছিল। তাতে তার কী ?

সে তো জলে খুঁজছিল জীবাণু
যেন দিন কেটে যায় বাতিকে
মুখে সুগন্ধ, আহা, প্রগতির
আর চুলে রং বহুজাতিকের

তার বিছানা তুলোর বন্ধু
তার বিকেলের নাম স্ট্রবেরি
যদি অকারণই এত সুন্দর,
কেন কারণ খুঁজছে সবেরই ?

তার দু’পায়ে মাটির ছন্দ
যদি নাই মেলে তবে কার কী ?
সে তো উঁচু করে নেবে নিচু নাক
য়ার চাইনি কিছুটা মার্কিন...

তবু চোখদুটো ছিল ভারতীয়
শুধু ভারতীয়...
.                আর কিছু না!

.        ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
দ্বিধা
কবি শ্রীজাত

ফেলেছ চোখের জল, রত্ন হয়ে গেছে।
প্রেমিকা বলেচে--- ‘সোনা কাঁদে না অমন’

সেসবও লাগে নি ভাল। ঝগড়া... কাটাকাটি...
প্রতিশোধ নিতে অন্য নারীতে গমন

সেখানেও একই কথা। তফাত বোঝাতে
এ-ক্ষতে এলাচ রাখছ, ও-ক্ষতে চমন

পৃথিবী দু’দিকে। তুমি কোন দিকে যাবে ?
দুয়ারে কলিংবেল, শিয়রে শমন।

.          ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অপেক্ষা
কবি শ্রীজাত

ভ্রু পল্লবে ডাক দিয়েছ, বেশ।
আমার কিন্তু পুরনো অভ্যেস
মিনিট দশেক দেরিতে পৌঁছনো।

তোমার ঘড়ি একটু জোরেই ছোটে
আস্তে করে কামড় দিচ্ছ ঠোঁটে
ঠোঁটের নীচে থমকে আছে ব্রণ।

কুড়ি মিনিট ? বড্ড বাড়াবাড়ি!
দৌড়ে ধরছ ফিরতি পথের গাড়ি
ফিরতি পথেই ভুল হল সময়---  ?

আমারও সব বন্ধুরা গোলমেলে
বুঝিয়ে দেবে তোমায় কাছে পেলে
কেমন করে গল্প শুরু হয়!

খোলাচুলের সজ্ঞা দিতে দিতে
সন্ধে নেমে আসবে বস্তিতে
ভাবছ তোমার অপেক্ষা সার্থক ?

জানবেও না আমি ততক্ষণে
অন্ধকার চন্দনের বনে
ঘুরে মরছি, কলকাতার লোক. . .

.       ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বসন্তের চিঠি
কবি শ্রীজাত

বসন্ত এসেছে। আমার শহর ভীষণ একলা এখন
দূর থেকে আজ কে বুঝবে তার চোখের কোণে জল না ধুলো
হাওয়ায় উড়ছে শুকনো পাতা, পায়ের ছাপও থাকছে না আর
আস্তে-আস্তে ঝাপসা হচ্ছে ভালোবাসার রাস্তাগুলো

তবুও কথা জমছে। কথার নাম জানি না, মানে বুঝি না
টেলিগ্রাফের তারের উপর শালিক বসেছে জোড়ায় জোড়ায়
দুপুর রোদ্দুরে মুখে মুখোশ এঁটে ঘুরে বেড়াই
রাতে বুকের মধ্যে কারা দাঙ্গা করে, টায়ার পোড়ায়. . .

সেই সঙ্গে ঘুম আসে আর ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন ঢোকে
স্বপ্নে আমি মাথা ঝাঁকাই স্বভাবসুলভ অবাধ্যতায়
হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের মুখের আদল ভাসে তখন
ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে পড়ি, মন খারাপের সময় কোথায়

অথচ এই খারাপ মনে বেঁচে থাকার ইচ্ছে দারুণ
কে জানে এই চিঠি লিখছি কীসের টানে, কোন গরজে
বয়স যেন পাহাড়ি পথ, কাদের নীচে পড়ার সময়
পলকা আমার শরীর শুধু শরীর, তুমুল শরীর খোঁজে

ওই ঠোঁটে ঠোঁট রাখবো ভাবি। লাগবে কি এক শতাব্দীকাল ?
তোর কপালে সিঁদুরে মেঘ, আমার হাতে কাপাস তুলো
শিগগিরি আয়। এই বসন্তে আমার শহর একলা ভীষণ
আস্তে আস্তে ঝাপসা হচ্ছে ভালোবাসার রাস্তাগুলো

.                 ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বৈশাখ
কবি শ্রীজাত

গেল চৈত্র, গেল সেল, পকেট ফুরালো
বত্সর নতুন কিন্তু নিভু নিভু আলো

অথচ বৈশাখ, দ্যাখো, এসে গেছে আজ
তাওয়ায় গড়াচ্ছে তেল, চনমনে পেঁয়াজ

মেশাও তো দেখি যাদু, মশলায়-চিকেনে
যা চোখ, নজর রাখো, কে কেনে কী কেনে

ভাঙা চশমা, আলমারি, রূপোর দোয়াত
ঝোপ বুঝে কোপ মারো। মেপে কাটো হাত।

কাটা হাত নিয়ে ফের বিক্রি আয়োজন
দড়িপাল্লা... বাটখারা... তিল-তিল ওজন...

বিক্রি তো প্রাচীন যন্ত্র, জাদু দেখাবার
দশটা পেটে লাথি পড়লে একটায় খাবার

যা চোখ, মাথার মধ্যে উপায় লিখে নে---
কাটা হাত মিশিয়ে দে মশলায়-চিকেনে!

.            ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মাঘ
কবি শ্রীজাত

ময়দান-ময়দান খেলা। ধুলোর সাগর।
কত ইচ্ছাজাগরণ, যত ইচ্ছা ঘোর---

তোমার পুস্তকমেলা, আশমান কিতাবি
বইয়ের দেরাজ খেলা, হারিয়েছি চাবি

‘অমুকে হারিয়েছেন . . .’ গমগম ঘোষণা
আমিও হারিয়ে গেছি। খুঁজে দ্যাখো সোনা,

এ-দরজায়, সে-হাউসে, এ-স্টলে, ও-বাঁকে
কতবার বই ভেবে দেখেছি তোমাকে

অথচ মলাট পালটে পেপারব্যাকে সেজে
পুনরায় উচ্ছেদের নোটিস এসেছে।

উঠে যাব। উঠে যাব। উঠে-উঠে যাব।
যেখানে দেখিব ছাই দু’চোখ ভেজাব।

এ মাটি ছাড়লাম তবে, আমাতে তোমাতে
অন্য বইয়ে দেখা হবে, অন্য কোনও মাঠে . . .

.            ********************  

.                                                                                   
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর