কবি সুবোধ সরকার-এর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।  www.milansagar.com
*
মণিপুরের মা    

নগ্ন উঠে দাঁড়াল আমার মণিপুরের মা
এই মায়ের দু'চোখ থেকে চোখ পেয়েছি
আশিরনখ ভাষা পেয়েছি, পেয়েছি সা রে গা মা
নগ্ন উঠে দাঁড়াল আমার মণিপুরের মা |

যা খুশি তাই করতে পারে আর্মি আর
পুলিশ, পথে কার্ফ্যু, জ্বলে চারমিনার
কারও কিছু বলার নেই, বলার কথা না
নগ্ন উঠে দাঁড়াল আমার মণিপুরের মা |

আর্মি জিপ চলে গগনতলে
আর্মি জিপ "সারে জাঁহাসে" বলে
আর্মি জিপে মেয়েটি আছড়ায়
আর্মি জিপে বোতাম খোলা চলে |

ও মেয়ে যদি ফিরেও আসে ঘরে
ও মেয়ে যদি গগনতলে মরে
পুলিশ মুছে দিয়েছে তার নাম
বাড়ি কোথায়? ইম্ফলের বাইরে কোনও গ্রাম!

এ সব ঘটে রোজ
কোথায় কোন তরুণী পড়ে আছে
কোথায় তার অন্য বোন নিখোঁজ
শুধু তাদের চুনুরি ঝোলে গাছে

কিন্তু আজ জুলাই মাসে হারাল বিপদসীমা |

উঠে দাঁড়ান মণিপুরের মা
উঠে দাঁড়ান নগ্ন হয়ে স্তন্যদায়িনীরা
পৃথিবী দেখ্ , মায়ের বুকে ক'খানা উপশিরা!
কেমন লাগে নগ্ন হলে তোর নিজের মা?

আসাম রাইফেলস যেই বন্দ করে গেট
যেখানে আমি ছিলাম সেই মায়ের তলপেট
সেখান থেকে বেরিয়ে এল এক গরম গঙ্গা
মণিপুরের মায়েরা দিল মা-কে নতুন সংজ্ঞা |

যেখানে আজ মায়েরা হাঁটে নগ্ন হয়ে মিছিলে
স্থলনায়ক, জলনায়ক, তোমরা তখন কী
.                                      করছিলে?

ভাবছ নাকি তোমার মা এখনও আছেন পরমা?
পুড়ে গিয়েছে, পুড়ে গিয়েছেন...

সব মায়ের মধ্যে থাকা নিজের সেই বড় মা |


.              *************************                                      
উপরে
*
বড়লোক গরিবলোক    

বড়লোক কখনও ভোরের আলো দেখতে পায় না
গরিব তেমনি "সুপ্রভাত" বলে না কাউকে |

বড়লোকের মেয়েরা গায়ে রোদ লাগাতে মরিশাস যায়
গরিবের উঠোন রোদে পুড়ে নৌকো হয়ে থাকে |

বড়লোকেরা রাত বারোটার আগে ঘুমোতে পারে না
খালি পেটে ছোটলোকেরা ঘুমিয়ে পড়ে সন্ধে সাতটায় |

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে খালি পেটের ভেতর একটা বস্তি
ভরা পেটের ভেতর একটা চোদ্দোতলা বাড়ি |

বস্তি বলছে চোদ্দোতলাকে, তুই ভেঙে পড়, তোর দরজা খুলে বস্তিতে লাগাব
চোদ্দোতলা বলছে, "তুই পুড়ে যা, তোর উপর চোদ্দোতলা তুলবো" |


.                  *************************                                
উপরে
*
টালিনালা       

টালিনালা থেকে এসেছি আমরা সরে
রাজনীতি আর পুলিশের হাত ধরে

এই নালাতেই করে দিয়েছিলে ঘর
তোলা দিয়ে গেছি, দিয়েছি পুলিশ-কর |

ওদিকে গড়িয়া ছুটবে মেট্রোরেল
মিলেমিশে গেল বিদ্যাধরীতে তেল |

ছেলেটা আমার কুদঘাটে বিড়ি বাঁধে
শ্যামলা মেয়েটা তিনটে বাড়িতে রাঁধে |

কিন্তু এখন আমারই উনুন ভাঙা
আর কি কখনও জুটবে একটু ডাঙা?

পথে পথে আজ যৌথ রান্নাঘর
তাও ভেঙে দিলে পাড়ার গুপ্তচর |

জানিনা এবার পুজোয় কোথায় যাব
রান্না না হলে জানি না কী করে খাব?


.          **********************                                         
উপরে
*
ইবম্ চা সিং       

৯৫ সালে, দিল্লির শীতে সাহিত্য আকাদেমির কবিতাপাঠে
ইবম্ চা সিং পাখির মতো বলেছিল :
আসুন আমার দেশে, মণিপুরের মৈরাঙে |

মৈরাঙ--- কী অপূর্ব নাম, কে রেখেছিল গো?
একটু দূরেই এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর সেই হ্রদ --- লোকটাক
শিশুর মাড়ির মত রং | শিশুর মাড়ির চেয়ে
সুন্দর পৃথিবীতে আর কিছু নেই |

মাঝরাতে সেই মণিপুর থেকে ফোন : ইবম্ চা সিং
আমি বললাম, কী হচ্ছে আপনাদের ওখানে?

কী হচ্ছে? কী হচ্ছে জানেন না আপনারা?
যদি কাল আসাম রাইফেলস আপনাদের
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ঢুকে পড়ে
রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে হস্তমৈথুন করে?
কী রকম লাগবে আপনাদের?
যদি কাল গড়িয়াহাটা রোডে মাস্টারমশাইকে
ছাত্রদের সামনে ন্যাংটো করে
উঠবোস করায়? কেমন লাগবে?
যদি কাল আপনাদের শঙ্খ ঘোষের মেয়েকে
তুলে নিয়ে যায়? কেমন লাগবে?

ইবম্ চা সিং কাঁদছিলেন |

স্তব্ধ হয়ে বসে আছি আমি |
ও কি মণিপুর থেকে ফোন করেছিল?
না কি ভারতবর্ষের বাইরে থেকে?
লোকটাক হ্রদের চারপাশে ন'টা পাহাড় উঠে গেছে
ওই ন'টা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে
চলেছে আসাম রাইফেলস এর ট্রাক?
ওরাই মনোরমাকে তুলে নিয়ে গেছে?

সত্যি কি ইবম্ চা সিং ফোন করেছিল?
নাকি অন্য কেউ
ওর মেয়ে সিক্সে পড়ে, স্কুলে যেতে পারে না
যদি ফিরে না আসে?
এটা কী করে হয়, আমাদের তো একটাই সংবিধান
কারা আর একটা লিখে রেখে গেছে?

মিলিটারি দিয়ে ঢোকানো যায়
দেশ চালানো যায় না
সেটা মিলিটারিরাও জানে
আর আপনারা জানেন না?


.      **********************                                              
উপরে
*
রূপম       
সুবোধ সরকার   

রূপমকে একটা চাকরি দিন---এম. এ পাস, বাবা নেই
আছে প্রেমিকা সে আর দু'-এক মাস দেখবে, তারপর
নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে গিয়ে বলবে, রূপম
আজ চলি
তোমাকে মনে থাকবে চিরদিন
রূপমকে একটা চাকরি দিন, যে কোন কাজ
পিওনের কাজ হলেও চলবে |

তমালবাবু ফোন তুললেন, ফোনের অন্য প্রান্তে
যারা কথা বলেন
তাদের যেহেতু দেখা যায় না, সুতরাং তারা দুর্জ্ঞেয় |
তমালবাবু মামাকে বললেন কূপমের একটা চাকরি দরকার
মামা বললেন কাকাকে, কাকা বললেন জ্যাঠাকে,
জ্যাঠা বললেন
বাতাসকে |
মানুষ জানলে একরকম, কিন্তু বাতাস জানলে
প্রথমেই ছুটে যাবে দক্ষিণে, সে বলবে দক্ষিণের অরণ্যকে
অরণ্য বলবে আগুনকে, আগুন গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে
আলিমুদ্দিন ছুটল নদীকে বলার জন্য
নদী এসে আছড়ে পড়ল
উপকূলে, আসমুদ্র হিমাচল বলে উঠল
রূপমকে একটা চাকরি দাও, এম. এ. পাশ করে বসে আছে ছেলেটা |

কয়েক মাস বাদের ঘটনা, আমি বাড়িফিরছিলাম সন্ধেবেলায়
গলির মোড়ে সাত-আটজনের জটলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম
জল থেকে সদ্য তুলে আনা রূপমের ডেডবডি
সারা গায়ে ঘাস, খরকুটো, হাতের মুঠোয়
ধরে থাকা একটা এক টাকার কয়েন |
পাবলিক বুথ থেকে কাউকে ফোন করতে চেয়েছিল, রূপম?
ভারত সরকারের এক টাকা কয়েনের দিকে আমার চোখ |

সারা গায়ে সবুজ ঘাস, ঘাস নয়, অক্ষর
এম. এ. পাস করতে একটা ছেলেকে যত অক্ষর পড়তে হয়
সেই সমস্ত ব্যর্থ অক্ষর ওর গায়ে লেগে আছে |

একটা ছেলেকে কেন আপনারা এম. এ. পড়ান, কোন আহ্লাদে আটখানা
বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছেন? তুলে দিন
এই কথাগুলো বলব বলে ফোন তুললাম পবিত্র সরকারের
ফোন বেজে উঠল, ফোন বেজে চলল, ফোন বেজেই চলল
২০ বছর ধরে ওই ফোন বেজে চলেছে, আরো কুড়ি বছর বাজবে |

বাতাস বলছে অরণ্যকে, অরণ্য চলেছে নদীর দিকে
নদী উপকূল থেকে আছড়ে পড়ে বলল :
রূপমকে একটা চাকরি দিন |
কে রূপম?
রূপম আচার্য, বয়স ২৬, এম. এ. পাস
বাঁ দিকের গালে একটা কাটা দাগ আছে |


.            **********************                                      
উপরে
*
বউ না প্রেমিকা       
সুবোধ সরকার   

প্রেমিকারা চালু মাল, সে মালও পালটায়
বউ কিন্তু সুখে দুঃখে বউ থেকে যায় |


.           ********************                                           
উপরে
*
চুমু       
সুবোধ সরকার   

বেডরুমে বুদ্ধমূর্তি, লেনিন ও মার্ক্স --- মেরে জান
চুমু খেতে পারছি না, একটাকে অন্তত সরান |


.           ********************                                           
উপরে
*
বিটগাজর যখন রগে উঠে যায়       
সুবোধ সরকার   

ভারত মহাসাগরের তীরে আমি ইয়ার্কি মারতে আসি নি
আহা মেঘ, ওহো মেঘ কী যে মেঘ |
আমি ন্যাকামি করতে আসিনি
আমি কয়েকটা ঝাড়া হাত-পা সত্যি বলতে চাই |

দাদা, সত্যি সবাই বলে, চেপে যান
চেপে যাওয়ার আগে শুনুন আমার কী হয়েছিল
মাথার বাঁদিকটা ঘর্ ঘর্ করত, ডানদিকে আশ্বিন মাস

এক শিঙওলা ভদ্রলোক ভিড় বাসের ভেতর
একটা স্কুলের মেয়েকে ঘষছিল |
আমি প্রতিবাদ করেছিলাম
সে আমাকে বাস থেকে নামিয়ে থাপ্পড় মেরেছিল বাঁ গালে!

আমার ব্রহ্মতালু গরর্...গরর্...গরর্...গরর্...
একটা বালককে দিয়ে বাসন মাজিয়ে গা টিপিয়ে নিয়ে
পেছনে লাথি মেরে তিনি বললেন, এই ৬০ টাকা
একটা পাঁইট আনবি, তারপর খেতে বসবি, যা |
আমি আর পারিনি, কলার টেনে ধরে তুললাম
কিন্তু সে আমার মুখে একদলা থুথু ছিটিয়ে দিল
থুতুতে কী ছিল জানি না, অসংখ্য ডুমুর ফুল
এসে আমার মুখের সামনে নাচতে লাগল |

পার্টি অফিস থেকে একটা ছেলে এসে বলল
আপনার ভূগোল বদলে দেব |
আমি পার্টি অফিসে গিয়ে বললাম
সম্পাদক বললেন, হুম, ছেলেটিও আমাদের
আপনিও আমাদের, মানিয়ে নিন |

পরের দিন সেই ছেলেটি আমাকে রাস্তায় বলল
মুখে রড ঢুকিয়ে পেছনের ফুটো দিয়ে
বের করে আনব, শালা দেড়েল!

বিটগাজর যখন রগে উঠে যায়
ভারত মহাসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে মেঘ দেখে
আপনি কী বলবেন?
গুরু গুরু মেঘ গরজে গগনে গগনে....


.                  ********************                                        
উপরে
*
আন্দামান       
সুবোধ সরকার   

চোখ থাকলেই দেখা যায় না আকাশ
হাত থাকলেই ধরা যায় না জল
পনেরো বছর সেই মেয়েটি বলছে :
আন্দামান্ চল্ |

পা থাকলেই যাওয়া যায় না স্বর্গে
মন থাকলেই থাকে না মনোবল
কার্নিশে পা, ধাক্কা দিয়ে মেয়েটি এখনও বলছে :
আন্দামানে চল্ |


.            ********************                               
উপরে
*
নিন্দা       
সুবোধ সরকার   

কেউ তোমাকে আতর দেবে
কেউ তোমাকে থুথু
কেউ তোমাকে গোলাপ দেবে
ডাকবে আয়, তু তু |

কেউ তোমাকে হিংসা দেবে
কেউ তোমাকে ভয়
কেউ তোমাকে গোল্লা দেবে
কেউ বা দশে নয় |

কেউ তোমাকে মাথায় করে
উঠছে সিঁড়ি ভেঙে
কেউ তোমাকে বিষ্ঠা দেয়
আহাম্মক জেনে |

কিন্তু শোনো, ঘাবড়িও না
নিন্দা যত পাবে
পাহাড়ে উঠে পায়ে পা দিয়ে
স্কচ পোলাও খাবে |

নিন্দা হোক, নিন্দা হোক
নিন্দা আরশোলা
দিয়েছ বাঁশ, আছোলা বাঁশ
সে কথা যায় ভোলা?

.     ********************                               
উপরে
*
টিকটিকি       
সুবোধ সরকার   

সত্তর দশকে আমরা পুলিশকে
টিকটিকি বলতাম |

কিন্তু আশির দশকে নকশালরা
মানব সংসারে ফিরে আসার পর
টিকটিকিরা বাথরুমের দেয়ালে,
মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয় :
রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলা ঠিক হয়নি |

আশির দশক টিকটিকিদের
কোন নাম দিতে পারে নি,
কেন না পুলিশ আরশোলা হয়ে ওঠে
আর কবি গিরগিটি |

সোভিয়েত গেল
টিকটিকিরা শোবার ঘরে, রান্নাঘরে
ঘোষণা করল : এবার আর আমেরিকার
শত্রু রইল না | বেচারা আমেরিকা!

শত্রু ছাড়া বাড়ে নাকি গ্ল্যামার মহিমা |

.     ********************                                       
উপরে
*
বক       
সুবোধ সরকার   

[
যে লোক ঋণী ও প্রবাসী না হয়ে দিবসের অষ্টম ভাগে শাক রন্ধন করে সেই সুখী ]

ইনি কে? হেলিকপ্টারের পাশে ওকে ঘিরে এত সংবাদিক?
ইনি অর্জুন থ্যাকারে, বম্বে চালান, ক্রিকেট বন্ধ করে দেন
বক বললেন, ইনিই তা হলে তোমার দ্বিতীয় ভাই?

ইনি কে? কী লম্বা, কী পেশী! কালো কুচকুচে গা!
আমেরিকায় থাকেন, ব্ল্যাকদের সঙ্গে মারামারি করেন
ভারতীয় চামড়ার দোকান আছে, এন আর আই
পুজো দেখে, আশ্বিন দেখে, আশ্বিনেই ফিরে যান
বক বললেন ইনি তোমার প্রবাসী ভাই, কুন্তিপুত্র ভীম?

কুল আর দেব রবীন্দ্রভারতী থেকে এম.এ. কোরে
বরিশাল থেকে লেবার নিয়ে গিয়ে
কুয়ালালামপুরে বিক্রি করেন---ওরা এখন আদমব্যাপারী |

তোমার স্ত্রী কোথায়?

দিনে আটবার এই প্রশ্ন আমাকে শুনতে হয়
কি জানতে চান আপনি?

আমার স্ত্রী যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যান
সেদিন আমি কারখানার গেটে
পরের দিন থেকে লক আউট
তিনদিন বাদে পুলিশে যাই |
থানা কখনও স্ত্রী ফেরত দেয় না, দেয় একটা নম্বর
এই সেই নম্বর, দেখবেন?

আমি বক আমি ধর্ম, আমি নম্বর বুঝি না
বলো সে কোথায়?

পুলিশ বলল, লিলুয়া ঘুরে আসুন
লিলুয়ার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে চোখে জল আসছিল
সেদিনই বুঝেছিলাম ওদের জন্য কোন হোম নেই

লোকাল কমিটি বলল, খেতে না পেলেও
তোর বউ চালাক ছিল, ডাঁসা ছিল
সে কাজ পেয়ে গেছে, তুই একটা বিয়ে করে নে |

হে ধর্ম, হে বক, হে অনিল বিশ্বাস
আমি শাকান্ন রান্না করে খাই, টিনের চাল উড়ে যাওয়া
নিজের ঘরে থাকি, মুদির কাছেও ধার নেই
আমাকে কেউ ভিসা কার্ড দেখিয়ে বলে নি, গো গেট ইট

এবার আপনি বলুন আমি না আমার ভায়েরা ভাল আছে?
সিঙ্গাপুর, আমেরিকা ভালো
না সারা ভারতবর্ষব্যাপী আমি, চালের কলে আমি
কয়লার খনিতে আমি, বস্তিতে বস্তিতে আমি
কে বেশি ভালো আছে, বলুন ধর্ম
কে তাহলে সুখী হয়েছে বলুন?

.          ********************                                               
উপরে
*
মৃত্যুর আগে তুমি কাজল পরেছিলে
সুবোধ সরকার   
(কবি এই কবিতাটি লেখেন তাঁর স্ত্রী কবি মল্লিকা সেনগুপ্তর, ভয়ানক ব্যধি ক্যানসারে মৃত্যুর পর। কবিতাটি প্রকাশিত হয়
"দেশ" পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০১১-র সংখ্যায়।
)

তুমি গঙ্গার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
কিন্তু তোমার আঁচলে নদীর আত্মজীবনী লেখা রইল |

বিচানার নীচ থেকে কয়েক লক্ষ কর্কট
বিছানা-সমেত তোমাকে তুলে নিয়ে চলেছে মহাকাশযানে |

ম়ৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে তাও তুমি কাজল পড়েছ,
কাজল ও কান্নার মাঝখানে তোমার মুখে এক চামচ জল

হ্যাঁ, আমি এক চামচ জল হয়ে
এক চামচ অন্তর্জলী হয়ে,  এক চামচ অঞ্জলি হয়ে,

তোমার ভেতরে একটা পূর্ণিমায় ভেসে যাওয়া
বিমানবন্দরে আমি বসে থাকতে চেয়েছিলাম |

আমি বলেছিলাম এটা বিমানবন্দর নয়
এটা একটা গ্রাম, লোকে বিরহী বলে ডাকে

এখানেই আমরা জীবনে প্রথম চুম্বন করেচিলাম
তুমি ছিলে চাবুকের মত তেজি এবং সটান

বেতস পাতার মতো ফার্স্ট ইয়ার এবং সেনসুয়াল কাঠবেড়ালি
বৃষ্টিতে ভিজলে তোমাকে আন্তিগোনের মতো দেখাত |

আমি ছিলাম গাঙচিল,
দু’লাইন কাফকা পড়া অসংগঠিত আঁতেল |

তুমি যমুনার একটা অংশ চেড়ে চলে যাচ্ছ
ডাক্তার তোমার হাতের শিরা খুঁজে পায়নি |

দোষ তোমার নয়, ডাক্তারের
এতবার তোমার শরীর ফুটো করেছিল ওরা

ইরাকের মৃত্তিকাও অতবার বার ফুটো করেনি আমেরিকা
কিন্তু তোমার ধমনী আসলে একটা নদীর আত্মজীবনী

তুমি তিস্তার একটা ঢেউ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
আমার মাছরাঙা সেই ঢেউয়ের ভেতর আটকে গেছে |

সেই মাছরাঙার ঠোঁটে তোমার সংসার
বোরো যেখানে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স না পড়ে পড়ছে সাতটি তারার
.                                                               তিমির |

কিন্তু আমি নদীর পলিমাটি মেখে , হারে রে রে রে রে
একদিন শহরে ঢুকে পড়েছিলাম

কার্জন পার্কে শুয়ে কালপুরুষের সঙ্গে তর্ক করেছি
এসে দাঁড়ালেন বাত্সায়ন এবং নিৎসে

কালপুরুষ বলল, নাও, দুই মহান খচ্চর এসে গেছে,
যৌনতা এবং মৃত্যু

ওরা দুই সহোদর, কে তোমাকে বেছে নেয় সেটাই তোমার
.                                              সেমিফাইনাল
ডব্লু, ডব্লু, ডব্লু ড্যাশ ডটকম |     

রাত দুটোর এ্যাম্বুলেন্সের ভেতর বসে আমি তোমার
হাত দুটি ধরে বলেছিলাম, বলো কোথায় কষ্ট ?

তুমি বলেছিলে, কৃষ্ণচূড়ায়, পারমানবিক পলিমাটিতে
তোমার অসংখ্য জুঁইফিলে জ্বালা করছে |

হাত থেকে একটানে চ্যানেল খুলে ফেলে বললে,
আমাকে বাঁচাও, ভালবাসা, আমি বাঁচতে চাই |

পৃথিবীতে আমি একটু শিউলির গন্ধ পেতে পারি ?
আমার নাক থেকে রাইস টিউব সরিয়ে দাও |

আমি বললাম এটা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট,
এখানে কোনও শিউলি গাছ নেই |

তুমি বললে, ছেলেটা কোথায় গেল, কার সঙ্গে গেল ?
ওকে একটু দেখো,রাত করে বাড়ি ফিরো না |

নার্সিংহোমের বারান্দায় বলে আমি একা, একেবারে একা
‘দ্য এম্পারার অফ অল ম্যালাডিজ’ পড়ছিলাম  |

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার, তুমি ঠিক বলেছ
অন্ধকারে দাবা খেলছেন সারা পৃথিবীর অনকোলজিস্ট

উল্টোদিকে এ্যান্টিচেম্বার ড্রাগ-মাফিয়ারা বসে আছে
মানুষের গভীরতম দুঃখ যাদের ব্যবসা |

তুমি আমাকে বারবার বলতে সিগারেট  খেও না
আমি উড়িয়ে দিয়ে বলতাম, আমরা সবাই চিমনি সুইপার

আমরা কার্বনের সঙ্গে প্রণয় আর প্রণয়ের সঙ্গে
মেটাস্টেসিস বহন করে চলেছি |

কে একদিন রাস্তা থেকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে আসবে
তার আগে আজ, এখনই, আমি প্রজাপতিদের সঙ্গে দৌড়তে চাই,

আজ, এখনই মিলন করতে চাই, আশিরনখ মিলন
দেবতা না চড়ুই, কে দেখে ফেলল,  কিছু যায় আসে না |

মনে নেই আমরা একবার ভাঙা মসজিদে ঢুকেছিলাম
প্রচুর সাপের ভিতর আল্লা পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছিলেন |

বললেন, আয় পৃথিবীতে যাদের কোনও জায়গা নেই
আমি তাদের জুন্নত এবং জাহানারার মাঝখানে

এখটা বিকেল বাঁচিয়ে রেখেছি ভালবাসার জন্য
গাছ থেকে ছিড়ে আনা আপেলে কামড় দিবি বলে |

তুমি তমসার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
কিন্তু তোমার আঁচল ধরে টানছে ছেলের উচ্চমাধ্যমিক |

ছেলে বলছে, মা, আমাকে কুজ্ঝটিকা বানান বলে দিয়ে যাও
আইসিইউ-তে কেউ কুজ্ঝটিকা বানান বলতে পারে না |

ছেলের বাবা বসে আছে, মেডিক্যাল বোর্ড বসেছে বারোতলায়
যেন হাট বসেছে বক্সিগঞ্জে, পদ্মাপারে |

কে যেন বলল, আরে বেরিয়ে আসুন তো ফার্নেস থেকে,
এরা পিঁপড়ে ধরতে পারে না, কর্কট ধরবে ?

একটা পানকৌড়ি ডুব দিচ্ছে গগনবাবুর পুকুরে
কেমোথেরাপির পর তোমাকে গোয়ায় নিয়ে গিয়েছিলাম |

একটা কোঙ্কনি কবিকে বললে,  ‘পানকৌড়ি দেখাও’,
একটা পর্তুগিজ গ্রামে গিয়ে কী দেখেছিলে আমাকে বলনি |

তুমি জলঢাকার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
যে বড় বড় টিপ পরতে তারা গাইছে, আমায় মুক্তি আলোয় আলোয় |

তুমি সুবর্ণরেখার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
তোমার লিপস্টিক বলছে, আমাদের নিয়ে চলো আয়না |

তুমি রোরো নামে একটা চাইবাসার নদী ছেড়ে চলে যাচ্ছ
সে বলছে, মা দাঁড়াও, স্কুল থেকে এক্ষিনি মার্কশিট তুলে আসছি |

তুমি ভল্ গা নামে একটা নদীর অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
পারস্যের রানি আতোসা তোমায় ডাকছে

পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর স্তন ছিল রানি আতোসার
কাটা হয়েছিল খড়গ দিয়ে, কেটেছিল এক গ্রিক ক্রিতদাস |

ইস্তানবুলের নদী বসফরাস ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছ
তোমার এক পা ইউরোপ, এক পা এশিয়া |

তুমি জিপসিদের হাটে তেজপাতা-মোড়ানো ওষুধ আনতে চলেছ
ইহুদি মেয়েরা তোমাকে নিয়ে গুহায় ঢুকে গেল  |
জিপসিরাই পৃথিবীতে প্রথম ব্যথার ওষুধ কুড়িয়ে পেয়েছে
তোমার বিশ্বাস ছিল শেষ ওষুধটাও ওরাই কুড়িয়ে আনবে |

শেষ একটা ওষুধের জন্য গোটা মানবজাতি দাঁড়িয়ে আছে
য়ে সেটা কুড়িয়ে আনবে,  সে বলবে, দাঁড়াও

আমি একটা আগুনের মধ্যে দিয়ে আসছি
বাবাকে বারণ করো হাসপাতালে বসে রাত জাগতে |

আমাকে য়দি কোনও ম্যাটাডোর বা মার্সিডিজ ধাক্কা না মারে
ভোর হওয়ার আগে আমি যে করে হোক শহরে ঢুকব |

এমন একটা অসুখ যার কোনও ‘আমরা ওরা’ নেই
ভিখিরি এবং প্রেসিডেন্টকে একই ড্রাগ নিতে হবে |

ডাক্তার, ভাল যদি নাই পারোষ এত সুঁচ ফোটালে কেন ?
সুঁচগুলো একবার নিজের পশ্চাতে ফুটিয়ে দেখলে হত না ?

তুমি গঙ্গার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ, সত্যি চলে যাচ্ছ-----
রোরো তোমার আঁচল ধরে আছে, আমি তোমার রোদ্দুর |

.                       ********************                                        
উপরে