৯৫ সালে, দিল্লির শীতে সাহিত্য আকাদেমির কবিতাপাঠে ইবম্ চা সিং পাখির মতো বলেছিল : আসুন আমার দেশে, মণিপুরের মৈরাঙে |
মৈরাঙ--- কী অপূর্ব নাম, কে রেখেছিল গো? একটু দূরেই এশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর সেই হ্রদ --- লোকটাক শিশুর মাড়ির মত রং | শিশুর মাড়ির চেয়ে সুন্দর পৃথিবীতে আর কিছু নেই |
মাঝরাতে সেই মণিপুর থেকে ফোন : ইবম্ চা সিং আমি বললাম, কী হচ্ছে আপনাদের ওখানে?
কী হচ্ছে? কী হচ্ছে জানেন না আপনারা? যদি কাল আসাম রাইফেলস আপনাদের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ঢুকে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে হস্তমৈথুন করে? কী রকম লাগবে আপনাদের? যদি কাল গড়িয়াহাটা রোডে মাস্টারমশাইকে ছাত্রদের সামনে ন্যাংটো করে উঠবোস করায়? কেমন লাগবে? যদি কাল আপনাদের শঙ্খ ঘোষের মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়? কেমন লাগবে?
ইবম্ চা সিং কাঁদছিলেন |
স্তব্ধ হয়ে বসে আছি আমি | ও কি মণিপুর থেকে ফোন করেছিল? না কি ভারতবর্ষের বাইরে থেকে? লোকটাক হ্রদের চারপাশে ন'টা পাহাড় উঠে গেছে ওই ন'টা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলেছে আসাম রাইফেলস এর ট্রাক? ওরাই মনোরমাকে তুলে নিয়ে গেছে?
সত্যি কি ইবম্ চা সিং ফোন করেছিল? নাকি অন্য কেউ ওর মেয়ে সিক্সে পড়ে, স্কুলে যেতে পারে না যদি ফিরে না আসে? এটা কী করে হয়, আমাদের তো একটাই সংবিধান কারা আর একটা লিখে রেখে গেছে?
মিলিটারি দিয়ে ঢোকানো যায় দেশ চালানো যায় না সেটা মিলিটারিরাও জানে আর আপনারা জানেন না?
রূপমকে একটা চাকরি দিন---এম. এ পাস, বাবা নেই আছে প্রেমিকা সে আর দু'-এক মাস দেখবে, তারপর নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে গিয়ে বলবে, রূপম আজ চলি তোমাকে মনে থাকবে চিরদিন রূপমকে একটা চাকরি দিন, যে কোন কাজ পিওনের কাজ হলেও চলবে |
তমালবাবু ফোন তুললেন, ফোনের অন্য প্রান্তে যারা কথা বলেন তাদের যেহেতু দেখা যায় না, সুতরাং তারা দুর্জ্ঞেয় | তমালবাবু মামাকে বললেন কূপমের একটা চাকরি দরকার মামা বললেন কাকাকে, কাকা বললেন জ্যাঠাকে, জ্যাঠা বললেন বাতাসকে | মানুষ জানলে একরকম, কিন্তু বাতাস জানলে প্রথমেই ছুটে যাবে দক্ষিণে, সে বলবে দক্ষিণের অরণ্যকে অরণ্য বলবে আগুনকে, আগুন গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে আলিমুদ্দিন ছুটল নদীকে বলার জন্য নদী এসে আছড়ে পড়ল উপকূলে, আসমুদ্র হিমাচল বলে উঠল রূপমকে একটা চাকরি দাও, এম. এ. পাশ করে বসে আছে ছেলেটা |
কয়েক মাস বাদের ঘটনা, আমি বাড়িফিরছিলাম সন্ধেবেলায় গলির মোড়ে সাত-আটজনের জটলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম জল থেকে সদ্য তুলে আনা রূপমের ডেডবডি সারা গায়ে ঘাস, খরকুটো, হাতের মুঠোয় ধরে থাকা একটা এক টাকার কয়েন | পাবলিক বুথ থেকে কাউকে ফোন করতে চেয়েছিল, রূপম? ভারত সরকারের এক টাকা কয়েনের দিকে আমার চোখ |
সারা গায়ে সবুজ ঘাস, ঘাস নয়, অক্ষর এম. এ. পাস করতে একটা ছেলেকে যত অক্ষর পড়তে হয় সেই সমস্ত ব্যর্থ অক্ষর ওর গায়ে লেগে আছে |
একটা ছেলেকে কেন আপনারা এম. এ. পড়ান, কোন আহ্লাদে আটখানা বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছেন? তুলে দিন এই কথাগুলো বলব বলে ফোন তুললাম পবিত্র সরকারের ফোন বেজে উঠল, ফোন বেজে চলল, ফোন বেজেই চলল ২০ বছর ধরে ওই ফোন বেজে চলেছে, আরো কুড়ি বছর বাজবে |
বাতাস বলছে অরণ্যকে, অরণ্য চলেছে নদীর দিকে নদী উপকূল থেকে আছড়ে পড়ে বলল : রূপমকে একটা চাকরি দিন | কে রূপম? রূপম আচার্য, বয়স ২৬, এম. এ. পাস বাঁ দিকের গালে একটা কাটা দাগ আছে |
ভারত মহাসাগরের তীরে আমি ইয়ার্কি মারতে আসি নি আহা মেঘ, ওহো মেঘ কী যে মেঘ | আমি ন্যাকামি করতে আসিনি আমি কয়েকটা ঝাড়া হাত-পা সত্যি বলতে চাই |
দাদা, সত্যি সবাই বলে, চেপে যান চেপে যাওয়ার আগে শুনুন আমার কী হয়েছিল মাথার বাঁদিকটা ঘর্ ঘর্ করত, ডানদিকে আশ্বিন মাস
এক শিঙওলা ভদ্রলোক ভিড় বাসের ভেতর একটা স্কুলের মেয়েকে ঘষছিল | আমি প্রতিবাদ করেছিলাম সে আমাকে বাস থেকে নামিয়ে থাপ্পড় মেরেছিল বাঁ গালে!
আমার ব্রহ্মতালু গরর্...গরর্...গরর্...গরর্... একটা বালককে দিয়ে বাসন মাজিয়ে গা টিপিয়ে নিয়ে পেছনে লাথি মেরে তিনি বললেন, এই ৬০ টাকা একটা পাঁইট আনবি, তারপর খেতে বসবি, যা | আমি আর পারিনি, কলার টেনে ধরে তুললাম কিন্তু সে আমার মুখে একদলা থুথু ছিটিয়ে দিল থুতুতে কী ছিল জানি না, অসংখ্য ডুমুর ফুল এসে আমার মুখের সামনে নাচতে লাগল |
পার্টি অফিস থেকে একটা ছেলে এসে বলল আপনার ভূগোল বদলে দেব | আমি পার্টি অফিসে গিয়ে বললাম সম্পাদক বললেন, হুম, ছেলেটিও আমাদের আপনিও আমাদের, মানিয়ে নিন |
পরের দিন সেই ছেলেটি আমাকে রাস্তায় বলল মুখে রড ঢুকিয়ে পেছনের ফুটো দিয়ে বের করে আনব, শালা দেড়েল!
বিটগাজর যখন রগে উঠে যায় ভারত মহাসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে মেঘ দেখে আপনি কী বলবেন? গুরু গুরু মেঘ গরজে গগনে গগনে....
[যে লোক ঋণী ও প্রবাসী না হয়ে দিবসের অষ্টম ভাগে শাক রন্ধন করে সেই সুখী ]
ইনি কে? হেলিকপ্টারের পাশে ওকে ঘিরে এত সংবাদিক? ইনি অর্জুন থ্যাকারে, বম্বে চালান, ক্রিকেট বন্ধ করে দেন বক বললেন, ইনিই তা হলে তোমার দ্বিতীয় ভাই?
ইনি কে? কী লম্বা, কী পেশী! কালো কুচকুচে গা! আমেরিকায় থাকেন, ব্ল্যাকদের সঙ্গে মারামারি করেন ভারতীয় চামড়ার দোকান আছে, এন আর আই পুজো দেখে, আশ্বিন দেখে, আশ্বিনেই ফিরে যান বক বললেন ইনি তোমার প্রবাসী ভাই, কুন্তিপুত্র ভীম?
কুল আর দেব রবীন্দ্রভারতী থেকে এম.এ. কোরে বরিশাল থেকে লেবার নিয়ে গিয়ে কুয়ালালামপুরে বিক্রি করেন---ওরা এখন আদমব্যাপারী |
তোমার স্ত্রী কোথায়?
দিনে আটবার এই প্রশ্ন আমাকে শুনতে হয় কি জানতে চান আপনি?
আমার স্ত্রী যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যান সেদিন আমি কারখানার গেটে পরের দিন থেকে লক আউট তিনদিন বাদে পুলিশে যাই | থানা কখনও স্ত্রী ফেরত দেয় না, দেয় একটা নম্বর এই সেই নম্বর, দেখবেন?
আমি বক আমি ধর্ম, আমি নম্বর বুঝি না বলো সে কোথায়?
পুলিশ বলল, লিলুয়া ঘুরে আসুন লিলুয়ার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে চোখে জল আসছিল সেদিনই বুঝেছিলাম ওদের জন্য কোন হোম নেই
লোকাল কমিটি বলল, খেতে না পেলেও তোর বউ চালাক ছিল, ডাঁসা ছিল সে কাজ পেয়ে গেছে, তুই একটা বিয়ে করে নে |
হে ধর্ম, হে বক, হে অনিল বিশ্বাস আমি শাকান্ন রান্না করে খাই, টিনের চাল উড়ে যাওয়া নিজের ঘরে থাকি, মুদির কাছেও ধার নেই আমাকে কেউ ভিসা কার্ড দেখিয়ে বলে নি, গো গেট ইট
এবার আপনি বলুন আমি না আমার ভায়েরা ভাল আছে? সিঙ্গাপুর, আমেরিকা ভালো না সারা ভারতবর্ষব্যাপী আমি, চালের কলে আমি কয়লার খনিতে আমি, বস্তিতে বস্তিতে আমি কে বেশি ভালো আছে, বলুন ধর্ম কে তাহলে সুখী হয়েছে বলুন?
মৃত্যুর আগে তুমি কাজল পরেছিলে সুবোধ সরকার (কবি এই কবিতাটি লেখেন তাঁর স্ত্রী কবি মল্লিকা সেনগুপ্তর, ভয়ানক ব্যধি ক্যানসারে মৃত্যুর পর। কবিতাটি প্রকাশিত হয় "দেশ" পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০১১-র সংখ্যায়।)
তুমি গঙ্গার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ কিন্তু তোমার আঁচলে নদীর আত্মজীবনী লেখা রইল |
বিচানার নীচ থেকে কয়েক লক্ষ কর্কট বিছানা-সমেত তোমাকে তুলে নিয়ে চলেছে মহাকাশযানে |
ম়ৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে তাও তুমি কাজল পড়েছ, কাজল ও কান্নার মাঝখানে তোমার মুখে এক চামচ জল
হ্যাঁ, আমি এক চামচ জল হয়ে এক চামচ অন্তর্জলী হয়ে, এক চামচ অঞ্জলি হয়ে,
তোমার ভেতরে একটা পূর্ণিমায় ভেসে যাওয়া বিমানবন্দরে আমি বসে থাকতে চেয়েছিলাম |
আমি বলেছিলাম এটা বিমানবন্দর নয় এটা একটা গ্রাম, লোকে বিরহী বলে ডাকে
এখানেই আমরা জীবনে প্রথম চুম্বন করেচিলাম তুমি ছিলে চাবুকের মত তেজি এবং সটান
বেতস পাতার মতো ফার্স্ট ইয়ার এবং সেনসুয়াল কাঠবেড়ালি বৃষ্টিতে ভিজলে তোমাকে আন্তিগোনের মতো দেখাত |
আমি ছিলাম গাঙচিল, দু’লাইন কাফকা পড়া অসংগঠিত আঁতেল |
তুমি যমুনার একটা অংশ চেড়ে চলে যাচ্ছ ডাক্তার তোমার হাতের শিরা খুঁজে পায়নি |