কবি সুবোধ সরকার-এর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।  www.milansagar.com
*
তুকারাম   
কবি সুবোধ সরকার

মারাঠি ব্রাহ্মণেরা আপনার তিনশো কবিতা পাথর বেঁধে নদীর জলে
ফেলে দিয়ে বলেছিল, ‘শূদ্র, শূদ্রের মতন থাক্
কবিতা লেখার এতই যখন শখ ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মালেই পারতিস্’ |
কিন্তু সারা মহারাষ্ট্রের মানুষ বিশ্বাস করে
আপনার তিনশো কবিতা
এক বছর বাদে জল থেকে উঠে এসেছিল

একটি ব্রাহ্মণকন্যা একবার স্বপ্নে দেখেছিল আপনাকে
বিছানায় উঠে বসে সে তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলে ফেললো
‘জানো কে এসেছিল স্বপ্নে, তুকারাম’
সেই রাতে স্বামী নতুন বৌকে বেদম পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়
মেয়েটি কি পেরেছিল আপনার গ্রামে পৌঁছতে ?
এই মেয়েটি মারাঠি ভাষার প্রথম মহিলা কবি |

তুকারাম, আপনার কবিতা জল থেকে উঠে এসেছিল কিনা জানি না
তবে মেয়েটি স্বামীর হাতে মার খেয়ে বাড়ি ছেড়েছিল
সে চোখ বন্ধ করে মুখস্ত বলত আপনার তিনশো কবিতা

৩৮ বছর বয়সে, তুকারাম, আপনাকে হত্যা করা হলো
কিন্তু ব্রাহ্মণেরা একটা ছোট্ট সত্য বুঝতে পারেনি সেদিন
কবিতার পান্ডুলিপি জলে ফেলে দিলেই, কবিতা ডুবে যায় না |

.              *************************      
.                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
ছাত্রকে লেখা চিঠি  
কবি সুবোধ সরকার

তুমি যেদিন প্রথম এসেছিলে আমার কাছে
তোমার হাতে মায়াকভ্ স্কি
আর চোখে
সকালবেলার আলো |

বিহার থেকে ফিরে এসে তুমি আবার এলে
গলা নামিয়ে, বাষ্প লুকিয়ে
তুমি বলেছিলে বিহারের কথা
খুন হয়ে যাওয়া বাবার কথা
আমি দেখতে পেলাম তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ণতা |

আবার এলে একদিন, আবারও এলে, আবার, আবার
একদিন চিন নিয়ে কথা হল
একদিন ভিয়েৎনাম
একদিন কম্বোডিয়া
একদিন কিউবা
তোমার চোখে সকালবেলার আলো
তুমি চে-গুয়েভারার ডায়েরি মুখস্ত বলেছিলে  |

কিন্তু কী হল তোমার ?
আসা বন্ধ করে দিলে কেন ?
একদিন ফোন করেছিলাম, তোমার বাড়ি থেকে
আমায় বলল, তিনদিন বাড়ি ফেরনি তুমি
এরকম তো ছিলে না তুমি ? কী হয়েছে তোমার  ?

এইমাত্র জানতে পারলাম
তুমি আমূল বদলে গেছ
তুমি আর আমাকে সহ্য করতে পার না
মায়াকভ্ স্কি পুড়িয়ে ফেলেছ
ভারতের গো-বলয় থেকে গ্রাস করতে ছুটে আসা
একটা দলে তুমি নাম লিখিয়েছ |

আমি কোন দোষ করিনি তো  ?
লিখিয়েছ, লিখিয়েছ |
তুমি কেন আমার বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলে ?
আমি কি তোমাকে জোড় করে
কার্ল মার্কস পড়াব ?
ঘোড়াটিকে পুকুর পর্যন্ত ধরে আনা যায়  
তাকে কি জোড় করে জল খাওয়ানো যায় ?
ওগো সকালবেলার আলো, তুমি একদিন
আবার কাছে ফিরে আসবে, দরজা খোলা থাকবে আমার
ভালোবাসা নিয়ো  |

.              *************************      
.                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
ঘুষ  
কবি সুবোধ সরকার

রবীন্দ্ররচনাবলীর নবম খন্ড দিয়ে চাপা দেওয়া সুইসাইড নোট,
ছেলেকে লেখা  | লিখে, হাতে ব্লেড নিয়ে
বাথরুমে ঢুকেছিলেন মাস্টারমশাই
দুপুরবেলা কাজের লোক দরজার তলা দিয়ে
রক্ত আসছে দেখে চিত্কার করে ওঠে |
ছেলেকে লেখা এই তার প্রথম এবং শেষ চিঠি :
‘অরণি,
আমি বিশ্বাস করি সন্তান পবিত্র জলের মতো
যদিও তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো নয়
তবু তোমাকেই লিখে রেখে যাই
গত দু’বছর তোমার মায়ের চিকিত্সাবাবদ
আমার যত্সামান্য সঞ্চয় আপাতত নিঃশেষিত
চিকিত্সার ব্যয়ভার আমি আর নিতে পারছিলাম না |
জীবনে তোমার টাকা ছুঁইনি, মরেও ছোঁব না  |
আমি আজীবন ছাত্র পড়িয়েছি, জ্ঞানত কোনও অন্যায় করিনি |
গত মাসে আমার স্কুলে এক অভিভাবক এসে
ঝুলোঝুলি করেন তাঁর ছেলেকে নেবার জন্য
আমি প্রথম দিন ফিরিয়ে দিই
দ্বিতীয় দিন ফিরিয়ে দিই
তৃতীয় দিন পারিনি | তিনি আমাকে একটা বড় খামে
তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে চলে যান |
সেই টাকায় এই মাসে তোমার মায়ের চিকিত্সা চলছে
জানি না তিনি বাড়ি ফিরবেন কি না কোনও দিন
ফিরলে বোলো, পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার অধিকার চলে গেছে |
ইতি বাবা’
যখন সারাটা দেশ দাঁড়িয়ে আছে টাকার ওপর
তখন রবীন্দ্ররচনাবলী দিয়ে চাপা দেওয়া একটা সুইসাইড নোট |
হাসপাতালে গাছের তলায় গা ছমছম করছিল
এগিয়ে গেলাম সাদা কাপড়ে ঢাকা মাস্টারমশাইয়ের দিকে
একটু বেড়িয়ে থাকা পা দুটোর দিকে------

ওই একটু বেড়িয়ে থাকা পা দুটি যেন ভারতবর্ষের শেষ মাটি |

.              *************************      
.                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
পলাশপুর  
কবি সুবোধ সরকার

পলাশপুর থেকে পড়তে আসা ছেলেটির গলায় তুলসীর মালা
প্রথম ক্লাসের পর জিনস্ পরা একটি মেয়ের সে কী হাসি !
রাত্রে ছেলেটি চিঠি লিখল, শ্রীচরণেষু মা,
আমি ভালোভাবে হোস্টেলে উঠিলাম, কিন্তু
তুলসীর মালা খুলিয়া রাখিয়াছি  |

এক সপ্তাহ বাদে জিনস্ পরা মেয়েটি
ছেলেটির চারটে বোতাম একটানে ছিঁড়ে দিয়ে বলল,
এ যে গত শতাব্দীর জামা | আবার সেই হাসি
রাত্রে লিখল, শ্রীচরণেষু মা, কিছু টাকা প্রয়োজন
নতুন জামা কিনিতে হইবে |

অফ্ পিরিয়ডে ত্রৈলোক্যনাথের ডমরু চরিত পড়ছিল
ওটা কেড়ে নিয়ে একটা পেপারব্যাক ধরিয়ে
মেয়েটি হাসতে হাসতে চলে গেল  |
পলাশপুরের ছেলেটি এই প্রথম মেয়েটিকে দেখল
একটি মেয়ের চলে যাওয়া দেখল  |
রাত্রে চিঠি, শ্রীচরণেষু মা, আমি হ্যারল্ড রবিন্স পড়িতেছি
পলাশপুরে কি বৃষ্টি আসিতেছে ?
কতদিন বকফুল ভাজা খাই নাই  |

জিনস্ পরা, শাড়িপরা, স্কার্টপরা, সালোয়ার পরা চারজন
একদিন ওকে জোর করে নিয়ে এল একটা বাড়িতে
খুব সুন্দর একটা বাড়িতে
স্টিরিওতে বেজে উঠল গমগমে জ্যাজ, আফ্রিকান ড্রাম
পাশের বাড়ি থেকে চার জন নর্থ স্টার এসে দাঁড়াল

অন্ধকার করে শুরু হল নাচ
এবার সবাইকে নগ্ন হতে হতে, পলাশপুর, পলাশপুর
কাম অন, আমি, আমি, টাচ মি হিয়ার !
অন্ধকারে একটা চাপা কান্না শোনা গেল
সুইচ অন, দেয়ালে পিঠ দিয়ে
নগ্ন পলাশপুর কাঁদছে
তার পুরুষত্ব পান করছে সালোয়ার কামিজ
যেন প্রাচীন গ্রিসের কোনও ছবি |

সেদিন রাত্রে সে লিখল, শ্রীচরণেষু মা, কেমন আছ ?
আমি আজ তোমার জন্য কাঁদিতেছিলাম, গ্রীষ্মের ছুটিতে
বাড়ি যাইব না, অনেক গ্রন্থ এখনো পড়া হয় নাই |
পলাশপুর, আমিও তোমার মতো গ্রামের ছেলে
তুমি পড়তে এসেছ, আমি পড়াতে
তোমার মতো আমিও আমার মাকে লিখি
শ্রীচরণেষু মা, টাকা পাঠাইলাম, ঠিকমতো ওষুধ কিনিও
গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়
এখনো অনেক গ্রন্থ পড়া হয় নাই |

.          *************************      
.                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
প্রাক্তন স্বামীর ট্রাউজার
কবি সুবোধ সরকার

তালা খুলে সে যখন ঘরে ঢোকে দুপুর একটা
জেব্রার পেটের মতো থমথমে তিনতলা বাড়ি
দরজা বন্ধ করে একে একে সে খোলে পোষাক
মোজা থেকে বিবুনির কাঁটা অব্দি নগ্ন সে তখন।

ওডিকোলনের গন্ধে ভরে ওঠে সম্পূর্ণ পৃথিবী
নগ্ন হয়ে ভাত খায়, একা, কেউ দেখবার নেই
বলবার নেই, চুলে আটকানো বিরাট চিরুনি
একটি মানুষ নগ্ন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।

আয়নারও ইচ্ছে হয় কথা বলে, সেও তো মানুষ
বাক্সের ভেতর ফেলে রাখা পুরুষের ট্রাউজার
সমর্থ উরুর মতো সে উঠে দাঁড়াতে চায় আজ
তারপর, এই ফ্ল্যাটে, পরাক্রান্ত সে হেঁটে বেড়াবে।

প্রাক্তন স্বামীর ট্রাউজারটিকে দেখে সে কাঁদছে
কিন্তু আয়না বলে, “নগ্ন হয়ে এভাবে কেঁদো না।”

.       
       *************************      
.                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর