কবি সুচিত্রা মিত্র – প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী গায়িকা সুচিত্রা মিত্রের জন্মগ্রহণ করেন ঝাড়খণ্ডের
ডিহিরী জংশন লাইনে শালবন ঘেরা গুঝাণ্টি নামে একটি রেল স্টেশনের কাছে, ট্রেনের কামরায়। পিতা
ছিলেন বাংলায় রামায়ণ রচয়িতা
কবি কৃত্তিবাস ওঝা’র উত্তর পুরুষ কবি সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়
(১৮৮৪-১৯৬৬) এবং মাতা সুবর্ণলতা দেবী। পিতা ছিলেন বিশিষ্ট লেখক
, অনুবাদক এবং কবি

তাঁদের পৈত্রিক নিবাস ছিল উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলে। তাঁর পড়াশুনা শুরু হয় কলকাতার বেথুন
কলেজিয়েট স্কুলে। স্কুলে প্রার্থনা সংগীতের মতো করে গাওয়া হতো রবীন্দ্রনাথের গান। এখানে পড়ার সময়
গানের চর্চা শুরু হয় দুই শিক্ষক অমিতা সেন এবং অনাদিকুমার দস্তিদারের কাছে। পরে তিনি স্কটিশ চার্চ
কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন।

খুব অল্প বয়সে তিনি রবীন্দ্রসংগীত শিখতে শুরু করেন। বাবা ছিলেন রবীন্দ্র সংগীতের বিশেষ অনুরাগী।
তাঁর মা গান করতেন। তিনি পঙ্কজকুমার মল্লিকের গান শুনে রবীন্দ্র সংগীত শেখায় বিশেষভাবে উৎসাহিত
হয়েছিলেন। পরে তিনি যাদের কাছে গান শিখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন
ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী,
শৈলজারঞ্জন মজুমদার এবং শান্তিদেব ঘোষ।

ছেলেবেলায় তিনি কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ ও সাহচর্য লাভ করেছিলেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ক্লাস  
টেন-এ পড়ার সময় শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবন থেকে বৃত্তি লাভ করেছিলেন। ১৯৪২-এ ম্যাট্রিক পরীক্ষা
 
না দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর মাত্র ২০ দিন পরে তিনি শান্তিনিকেতন চলে যান।  ১৯৪৩-এ  
শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী
হিসাবে প্রাইভেটে ইন্টারমিডিযেট পরীক্ষা দেন। একই বছর রবীন্দ্র সংগীতে ডিপ্লোমা লাভ করেন৷ এরপর
 
স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকেই অর্থনীতিতে সম্মান-সহ বিএ পাস করেন। ১৯৪৭ সালের ১ মে
তিনি ধ্রুব মিত্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের এক ছেলে কুণাল মিত্র বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের
 
মেরিল্যান্ডের বাসিন্দা। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় সুচিত্রা মিত্রের।


কলেজ জীবনে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিযোগে যারা গ্রেপ্তার
হয়েছিলেন তাদের মুক্তির জন্য পতাকা হাতে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেছেন, টিয়ার গ্যাসের ঝাঝেঁ নাকাল
হযেছেন। মিছিল, প্রতিবাদ করতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে মার পর্যন্ত খেয়েছেন। পরবর্তী জীবনে অবশ্য
তিনি সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দেন। তবে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরটি অক্ষূ
ণ্ণ ও অম্লান থাকে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে
দিল্লী থেকে প্রচারিত আকাশবাণীর জাতীয় অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। আকাশবাণীতে
জওহরলাল নেহেরুকে কটাক্ষ করে বাল্মিকী প্রতিভায় গান গাওয়ার অভিযোগে তাঁকে অবাঞ্চিত ঘোষণা
করা হয়। দীর্ঘ ছ'বছর তিনি আকাশবাণীতে গান করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন।

তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। এখানে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় লেকচারার
হিসাবে। তারপর পদোন্নতি পেযে রিডার হয়েছেন, অধ্যাপক হয়েছেন এবং "রবীন্দ্র সংগীত বিভাগের"
প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন। ২১ বছর একনাগাড়ে শিক্ষকতার পর ১৯৮৪ সালে তিনি রবীন্দ্র ভারতী
থেকে অবসর নেন। রবীন্দ্রভারতীতে অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত থাকাকালে তিনি বাংলায় এমএ পাস করেন।

একেবারে কৈশোরেই তাঁর শিল্পী জীবনের শুরু। ১৯৪৫-এ প্রথম তাঁর গানের রেকর্ড বেরোয় তখন তাঁর বয়স
ছিল মাত্র ২১ বছর। সেটা ছিল রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ড।  এক পিঠে "মরণেরে তুঁ হু মম শ্যাম সমান", অন্য
পিঠে "হৃদয়ের একুল ওকুল দু’কুল ভেসে যায়"। দ্বিতীয় রেকর্ডটি তাঁর পিতার লেখা গান, এক পিঠে "তোমার
আমার ক্ষণেক দেখা", অন্য পিঠে "আমায় দোলা দিয়ে যায়"। এরপর মৃত্যু অবধি তাঁর সাড়ে চারশোরও
বেশি রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বের হয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্র সম্পর্কে প্রয়াত ধূর্জটিপ্রসাদ
মুখোপাধ্যায়ের মতে, "রবীন্দ্রনাথের গানে সেরা হচ্ছে সুচিত্রা... সে বেশ গলা ছেড়ে পুরো দমে গায়। এর মধ্যে
কোনো গোঁজামিল নেই... তার সাবলীলতা... সে এক দেখার এবং শোনার জিনিস। তার  ছন্দজ্ঞানও
অসামান্য... সুচিত্রা নিখুঁত। মনে হয় দিনেন্দ্রনাথ বুঝি ফিরে এলেন"।

রবীন্দ্র সংগীত ছাড়াও তাঁর গলায় প্রাণ পেয়েছে অতুলপ্রসাদের গান, ব্রহ্মসংগীত, আধুনিক বাংলা গান এবং
হিন্দি ভজন।

কবি ধ্রুপদী সংগীত শিখেছেন ভি ভি ওয়াঝেলকরের কাছে। প্রায় দু’বছর নাচ শেখার চেষ্টাও করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই অভিনয় ভালোবাসতেন। তাই পরিণত বয়সে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত "দহন" নামক
চলচিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে নির্মিত উমাপ্রসাদ মৈত্রের "জয়
বাংলা" এবং মৃণাল সেনের “পদাতিক” ছায়াছবিতেও অভিনয় করেছেন। এছাড়াও, বিষ্ণু পাল চৌধুরীর
টেলিফিল্ম "আমার নাম বকুল"-এর একটি পর্বেও তিনি অভিনয় করেন।

দীর্ঘদিন তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের
(IPTA) সঙ্গে
সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

১৯৪১ সালে বৃত্তি নিযে গান শেখার উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগেই তিনি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  
নাটকে অভিনয় করেছেন। পরবর্তীতে যে সকল নাটকে অভিনয় করেছেন সেগুলো হলোঃ মুক্তধারা, বিসর্জন,
তপতী, নটীর পুজা, মায়ার খেলা, চিরকুমার সভা ও নীলদর্পণ প্রভৃতি।

১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে সংগীত নাটক
অকাদেমি এ্যাওয়ার্ড তিনি পেয়েছেন। এছাড়া এইচ.এম.ভি গোল্ডেন ডিস্ক এ্যাওয়ার্ড, বিশ্বভারতী থেকে
দেশিকোত্তম এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে আলাউদ্দিন পুরস্কার লাভ করেছেন। পেয়েছেন সংগীত
নাটক একাডেমি পুরস্কার-সহ নানা সম্মান। সাম্মানিক ডি-লিট পেয়েছেন রবীন্দ্রভারতী  বিশ্ববিদ্যালয়,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে তিনি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। ছোটদের জন্য লিখেছেন কবিতা ও গল্প।
লিখেছেন স্মৃতিকথা। তিনি খলিল জিবরানের কবিতার অনুবাদ করেছেন। সুচিত্রা মিত্র আবৃত্তি করতে
ভালবাসতেন। ছবি আঁকা ছিল তাঁর আরেকটি নেশা। ছবির প্রদর্শনী পর্যন্ত তিনি করেছেন।

কর্মযোগী সুচিত্রা মিত্র ১৯৪৬-এ কলকাতায রবীন্দ্র সংগীতের স্কুল "রবিতীর্থ" স্থাপন করেন। ভারতে এটি
রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষার অগ্রগণ্য বিদ্যাপীঠ হিসাবে পরিগণিত। স্কুলের নামটি অধ্যাপক কালিদাস নাগ কর্তৃক
প্রদত্ব। রবিতীর্থের তিনি ছিলেন প্রধান শিক্ষিকা। রবিতীর্থের শিক্ষার্থীদের নি
য়ে তিনি বহুদেশে নৃত্যনাট্য
পরিবেশন করেছেন।

তাকেঁ নিযে কবিতা লিখেছেন
কবি বিষ্ণু দে এবং কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর আবক্ষ মূর্তি গড়েছেন
শিল্পী রামকিংকর
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরী করেছেন সুব্রত ঘোষ ও রাজা সেন। তিনি
সংস্কৃতি এবং আভিজাত্যকে সমন্বিত করেছিলেন সংগীত চর্চার মাধ্যমে, নিজ জীবনাচরণে। ওস্তাদ আমজাদ
আলী খান সুচিত্রা মিত্রকে বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসাবে। ১৯৯৫ সালে আজকাল
পত্রিকার উদ্যোগে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মকথা
'মনে রেখো'

বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছিলেন তিনি। সমসাময়িক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক
ব্যক্তিত্বদের কাছে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়ও সম্মানীয়। তাঁকে নিয়ে অনেকেই কবিতা রচনা করেছেন।

দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুকালে তাঁর
বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

আমরা
মিলনসাগরে  কবি সুচিত্রা মিত্রর কবিতা তুলে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম। আমরা
তাঁর মাত্র তিনটে কবিতা হাতে পেয়েছি। আগামিতে আরএ কবিতা সংগ্রহ করে এখানে তুলতে পারবো এই
আশা রাখি।

পাঠকবন্ধুদের কাছে এই আবেদন রাখছি যে যদি আপনারা তাঁর আরও কবিতা
আমাদের পাঠান তাহলে আমরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্রেরকের নাম ও ঠিকানা  এই পাতায় উল্লেখ
করবো।


উত্স --- বাংলা উইকিপেডিয়া।    


কবি সুচিত্রা মিত্রর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন



আমাদের ই-মেল -
srimilansengupta@yahoo.co.in     


এই পাতা প্রথম প্রকাশ - ১৪.০২.২০১৫
...