কবি, গীতিকার ও সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত - এর পুরো নাম সুধীন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। তিনি বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগের বিশিষ্ট গীতিকার ও সঙ্গীতকার ছিলেন।
তাঁর পৈত্রিক বাড়ী ছিল অবিভক্ত বাংলার যশোহর জেলার কালিয়া গ্রামে। পিতা মহেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন দার্জ্জিলিং গভমেন্ট স্কুলের শিক্ষক। তাই কবির ছোটবেলা কাটে দার্জ্জিলিং এ। মা ছিলেন সে সময়ের একজন সমাজসেবিকা। কবি খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন এবং হকির মতো খেলায় নিয়মিত অংশ গ্রহণ করতেন।
১৯৪৯-৫০ সাল নাগাদ কবি কলকাতায় বসবাস শুরু করেন এবং বাংলা আধুনিক গানের বর্ণময় জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভবে জড়িয়ে পড়েন। শুরুতে কলকাতায় তাঁর ঠিকানা ছিল ১৯ ডি, গুপ্ত লেন, সাউথ সিঁথি। ৬০এর দশকের মাঝামাঝি তিনি চলে আসেন ৩৬ বি, যতিন দাস রোড-এ এবং শেষে তাঁর ঠিকানা হয় “ডোভার কোর্ট”, ডোভার রোড-এ।
সঙ্গীত জীবন শুরু করেন বিখ্যাত সঙ্গীতকার কমল দাশগুপ্তর সহকারী হিসেবে। এর সঙ্গে সঙ্গে, সেই সময়ে তিনি গণনাট্য সংঘের (Indian Peoples Theatres’ Association) উত্তর কলকাতা ব্রাঞ্চের জন্য গণসঙ্গীতও রচনাও করতেন।
এর পর তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় His Master’s Voice (HMV) কোম্পানির ক্ষিতিশ বসুর সঙ্গে, যিনি তাঁকে আধুনিক বাংলা গানের সুরকারের ভূমিকায় সুযোগ করে দেন। সুধীন দাশগুপ্তর সুরে প্রথম দুটি গান ছিল “কত আশা কত ভালোবাসা” এবং “কেন আকাশ হতে”। গান দুটি রেকর্ড করেন খ্যানামা শিল্পী বেচু দত্ত ১৯৫৩ সালে। এর সাথেই শুরু হয় তাঁর অনবদ্য সঙ্গীত জীবন যা চলেছিল তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
তাঁর স্মরণীয় গানের মধ্যে রয়েছে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে “ময়ুরকণ্ঠী রাতের নীলে”, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর কণ্ঠে “এই ঝির ঝির বাতাসে”, সতিনাথ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে “আকাশ তো মেঘলা”, শ্যাম মিত্রর কণ্ঠে “কেন তুমি ফিরে এলে”, মান্না দে এবং লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠে “কে প্রথম কাছে এসেছি”, লতার কণ্ঠে “আজ মন চেয়েছে”, মান্না দের কণ্ঠে “আমি আগন্তুক” সমেত আরোও বহু বহু গীত। সুধীনবাবুই প্রথম মহানায়ক উত্তম কুমার এবং মান্না দের প্লেব্যাক জুটি শুরু করেন। এই জুটির জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল “এন্টনি ফিরিঙ্গি”, “নিশিপদ্ম”, “সন্ন্যাসী রাজা”-র মত ছায়াছবি। এর আগে উত্তম কুমার মূলত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্লেব্যাকেই অভিনয় করতেন।
শঙ্খবেলা (১৯৬৬) ছায়াছবির রেকর্ডিং-এর জন্য সুধীন বাবু বম্বে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে মান্না দে ও লতা মুঙ্গেশকর ব্যস্ত ছিলেন সুরকার নৌসাদের জন্য “পাকীজা” সিনেমার গানের রেকর্ডিং-এ। নৌসাদ নাকি বলেছিলেন “आवाज़ की अहमियत समझ में नहीं आया, लेकिन सूर बहुत ही उमदा है”।
খুব বিচিত্র এই বাঙালী জাতি! এমন লেখাপড়া জানা বাঙালী হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যাঁর জীবনের কোনো না কোনো সময়ে দু এক লাইন কবিতা লেখেন নি! বাংলা ভাষায় যে পরিমান কবিতার আন্দোলন ঘটে গেছে, যে পরিমান কাব্যচর্চা চলেছে, তেমনটি বোধহয় ভারবর্ষের আর কোনো ভাষায় দেখা যাবে না। অথচ আধুনিক যুগে লক্ষ্য করি যে গীতিকারদের কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাঙালী ভীষণ কুণ্ঠা বোধ করেন! পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় একবার বড় আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন ... আমি কি কবি নই ? ব্যাপারটা যেন এমন, যে কবিতায় সুর দিলেই সেই কবি আর কবি থাকেন না! নজরুলের আগে কিন্তু এমনটা দেখতে পাই না। রবীন্দ্রনাথ বলুন, দ্বিজেন্দ্রলাল বলুন, রজনীকান্ত বলুন, অতুলপ্রসাদ বলুন, দিলীপ রায় বলুন, তাঁরা আধুনিক (?) যুগের এই বিচিত্র ভেদাভেদের মানসিকতা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।
প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়! কেন গীতিকারদের কবিদের সভায় স্থান দেওয়া হচ্ছে ? আমাদের উত্তর হলো এই যে, মিলনসাগরে আমরা মনে করি যে গান তো প্রথমে কবিতা। তাই আমরা গান ও কবিতায় কোন পার্থক্য দেখি না। অনেকে বলেন যে সব গানই কবিতা কিন্তু সব কবিতা গান হয় না!
আমরা মিলনসাগরে তাঁর কবিতা ও গানের কথা ইনটারনেটে প্রকাশিত করে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে আমাদের এই প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করবো।