সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
চিল
( ছাড়পত্র )

পথ চলতে চলতে হঠাৎ দেখলাম :
ফুটপাতে এক মরা চিল !

চমকে উঠলাম ওর করুণ বীভৎস মূর্তি দেখে |
অনেক উঁচু থেকে যে এই পৃথিবীটাকে দেখেছে
লুন্ঠনের অবাধ উপনিবেশ ;
যার শ্যেন দৃষ্টিতে কেবল ছিল
তীব্র লোভ আর ছোঁ মারার দস্যু প্রবৃত্তি-----
তাকে দেখলাম, ফুটপাতে মখ ঘুঁজে প’ড়ে |

গম্বুজশিখরে বাস করত এই চিল,
নিজেকে জাহির করত সুতীক্ষ্ণ চীৎকারে ;
হালকা হাওয়ায় ডানা মেলে দিত আকাশের নীলে----
অনেককে ছড়িয়ে ;  একক  :
পৃথিবী থেকে অনেক, অনেক উঁচুতে |

অনেকে আজ নিরাপদ ;
নিরাপদ ইঁদুর ছানারা আর খাদ্য-হাতে ত্রস্ত পথচারী,
নিরাপদ------- কারণ আজ সে মৃত |
আজ আর কেউ নেই ছোঁ মারার,
ওরই ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টের মতো
ও পড়ে রইল ফুটপাতে,
শুক্ নো, শীতল বিকৃত দেহে |

হাতে যাদের ছিল প্রাণধারণের খাদ্য
বুকের কাছে সযত্নে চেপে ধরা-----
তারা আজ এগিয়ে গেল নির্ভয়ে ;
নিষ্ঠুর বিদ্রুপের মতো পিছনে ফেলে
আকাশচ্যুত এক উদ্ধত চিলকে ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
চট্টগ্রাম : ১৯৪৩
( ছাড়পত্র )

ক্ষুধার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম-----
চট্টগ্রাম : বীর  চট্টগ্রাম !
বিক্ষত বিধ্বস্ত দেহে অদ্ভুত নিঃশব্দ সহিষ্ণুতা
আমাদের স্নায়ুতে স্নায়ুতে
বিদ্যুৎপ্রবাহ আনে, আনে আজ চেতনার দিন |
চট্টগ্রাম : বীর চট্টগ্রাম  !
এখনো নিস্তব্ধ তমি
তাই আজো পাশবিকতার
দুঃসহ মহড়া চলে,
তাই আজো শত্রুরা সাহসী |
জানি আমি তোমার হৃদয়ে
অজস্র ঔদার্য আছে ;  জানি আছে সুস্থ শালীনতা
জানি তুমি আঘাতে আঘাতে
এখনও স্তিমিত নও, জানি তুমি এখনো উদ্দাম----
হে চট্টগ্রাম !
তাই আজো মনে পড়ে রক্তাক্ত তোমাকে
সহস্র কাজের ফাঁকে মনে পড়ে শার্দুলের ঘুম
অরণ্যের স্বপ্ন চোখে, দাঁতে নখে প্রতিজ্ঞা কঠোর |
হে অভক্ত ক্ষুধিত শ্বাপদ-----
তোমার উদ্যত থাবা, সংঘবদ্ধ প্রতিটি নখর
এখনো হয় নি নিরাপদ |
তুমি চাও শোণিতের স্বাদ-------
যে স্বাদ জেনেছে স্তালিনগ্রাদ |
তোমার সংকল্পস্রোতে ভেসে যাবে লোহার গরাদ
এ তোমার নিশ্চিত বিশ্বাস |
তোমার প্রতিজ্ঞা তাই আমার প্রতিজ্ঞা, চট্টগ্রাম !
আমার হৃদপিন্ডে আজ তারি লাল স্বাক্ষর দিলাম ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
সেপ্টেম্বর  ‘৪৬
( ছাড়পত্র )

কলকাতায় শান্তি নেই |
রক্তের কলঙ্ক ডাকে মধ্যরাত্রে
প্রতিটি সন্ধ্যায় |
হৃত্স্পন্দনধ্বনি দ্রুত হয় :
মূর্ছিত শহর |
এখন গ্রামের মতো
সন্ধ্যা হলে জনহীন নগরের পথ ;
স্তম্ভিত আলোকস্তম্ভ
আলো দেয় নিতান্ত সভয়ে |
কোথায় দোকানপাট ?
কই সেই জনতার স্রোত ?
সন্ধ্যার আলোর বন্যা
আজ আর তোলে নাকো
জনতরণীর পাল
শহরের পথে |
ট্রাম নেই, বাস নেই-----
সাহসী পথিকহীন
এ শহর  আতঙ্ক ছড়ায় |
সারি সারি বাড়িসব
মনে হয় কবরের মতো,
মৃত মানুষের স্তূপ বুকে নিয়ে পড়ে আছে
চুপ ক’রে সভয়ে নির্জনে |
মাঝে মাঝে শব্দ হয় :
মিলিটারী লরীর গর্জন
পথ বেয়ে ছুটে যায় বিদ্যুতের মতো
সদম্ আক্রোশে |
কলঙ্কিত কালো কালো রক্তের মতন
অন্ধকার হানা দেয় অতন্দ্র শহরে ;
হয়তো অনেক রাত্রে
পথচারী কুকুরের দল
মানুষের দেখাদেখি
স্বজাতিকে দেখে
আস্ফালন, আক্রমণ করে |
রদ্ধশ্বাস এ শহর
ছট্ ফট করে সারা রাত-----
কখন সকাল হবে ?
জীয়নকাঠির স্পর্শ
পাওয়া যাবে উজ্জ্বল রোদ্দুরে ?
সন্ধ্যা থেকে প্রত্যুষের দীর্ঘকাল
প্রহরে প্রহরে
সশব্দে জিজ্ঞাসা করে ঘড়ির ঘন্টায়
ধৈর্যহীন শহরের প্রাণ  :
এর চেয়ে ছুরি কি নিষ্ঠুর ?
বাদুড়ের মতো কালো অন্ধকার
ভর ক’রে গুজবের ডানা
উত্কর্ণ কানের কাছে
সারা রাত ঘুরপাক খায় |
স্তব্ধতা কাঁপিয়ে দিয়ে
কখনো বা গৃহস্থের দ্বারে
উদ্ধত, অটল আর সুগম্ভীর
শব্দ ওঠে কঠিন বুটের |

শহর মুর্ছিত হয়ে পড়ে |

জুলাই !  জুলাই !  আবার আসুক ফিরে
আজকের কলকাতার এ প্রার্থনা ;
দিকে দিকে শুধু মিছিলের কোলাহল-----
এখনো পায়ের শব্দ যাচ্ছে শোনা |

অক্টোবরকে জুলাই হতেই হবে
আবার সবাই দাঁড়াব সবার পাশে,
আগষ্ট এবং সেপ্টেম্বর মাস
এবারে মতো মুছে যাক ইতিহাস ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
ঐতিহাসিক
( ছাড়পত্র )

আজ এসেছি তোমাদের ঘরে ঘরে------
পৃথিবীর আদালতের পরোয়ানা নিয়ে
তোমরা কি দেবে আমার প্রশ্নের কৈফিয়ৎ :
কেন মৃত্যকীর্ণ শবে ভরলো পঞ্চাশ সাল ?
আজ বাহান্ন সলের সূচনায় কি তার উত্তর দেবে ?
জানি ! স্তব্ধ হয়ে গেছে তোমাদের অগ্রগতির স্রোত,
তাই দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়ায় কালো করছ ভবিষ্যৎ
আর অনুশোচনার আগুনে ছাই হচ্ছে উত্সাহের কয়লা |
কিন্তু ভেবে দেখেছ কি ?
দেরি হয়ে গেছে অনেক, অনেক দেরি !
লাইনে দাঁড়ানো অভ্যাস কর নি কোনদিন,
একটি মাত্র লক্ষ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
মারামারি করেছ পরস্পর,
তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে
বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ |
কেবল বঞ্চিত বিহ্বল বিমূঢ় জিজ্ঞাসাভরা চোখে
প্রত্যেকে চেয়েছ প্রত্যেকের দিকে ;
------ কেন এমন হল  ?
একদা দুর্ভিক্ষ এল
ক্ষুধার ক্ষমাহীন তাড়নায়
পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে
ইতর-ভদ্র, হিন্দু আর মুসলমান
একই বাতাসে নিলে নিশ্বাস |
চাল, চিনি, কয়লা, কেরোসিন ?
এ সব দুষ্প্রপ্য জিনিসের জন্য চাই লাইন |
কিন্তু বুঝলে না মুক্তিও দুর্লভ আর দুর্মূল্য,
তারো জন্যে চাই চল্লিশ কোটির দীর্ঘ, অবিচ্ছিন্ন এক লাইন |

মূর্খ তোমরা
লাইন দিলে : কিন্তু মুক্তির বদলে কিনলে মৃত্যু,
রক্তক্ষয়ের বদলে  পেলে প্রবঞ্চনা |
ইতিমধ্যে তোমাদের বিবদমান বিশৃঙ্খল ভিড়ে
মক্তি উঁকি দিয়ে গেছে বহুবার |
লাইনে দাঁড়ানো আয়ত্ত করেছে যারা,
সোভিয়েট, পোল্যান্ড, ফ্রান্স
রক্তমূল্যে তারা কিনে নিয়ে গেল তাদের মুক্তি
সব প্রথম এই পৃথিবীর দোকান থেকে |
এখনো এই লাইনে অনেকে প্রতীক্ষমান,
প্রার্থী অনেক ;  কিন্তু পরিমিত মুক্তি |
হয়তো এই বিশ্বব্যাপী লাইনের শেষে
এখনো তোমাদের স্থান হতে পারে----
একথা ঘোষণা ক’রে দাও তোমাদের দেশময়
.                                প্রতিবেশীর কাছে |
তারপর নিঃশব্দে দাঁড়াও এ লাইনে প্রতিজ্ঞা
.                                আর প্রতীক্ষা নিয়ে
হাতের মুঠোয় তৈরী রেখে প্রত্যেকের প্রাণ |
আমি ইতিহাস, আমার কথাটা একবার ভেবে দেখো,
মনে রেখো, দেরি হয়ে গেছে, অনেক অনেক দেরি |
আর মনে ক’রো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র,
নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ,
অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা,
আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন  ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
বোধন
( ছাড়পত্র )

হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে,
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার ;
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার |
এই যে আকাশ , দিগন্ত , মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি ;
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো |

ব্যাহত জীবনযাত্রা, চুপি চুপি কান্না বও বুকে,
হে নীড়-বিহারী সঙ্গী ! আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে
ভেবেছ সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার
পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে |  তবু আজো বিস্ময় আমার-----
ধূর্ত , প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের গ্রাস
তাদের করেছ ক্ষমা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ |
তোমার ক্ষেতের শস্য
চুরি ক’রে যারা গুপ্তকক্ষেতে জমায়
তাদেরি দুপায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায় ;
লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রসাদে মিনারে
তুমি যে পেতেছ হাত ;  আজ মাথা ঠুকে বারে বারে
অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিষ্ফল------
তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল |
তুমি তো প্রহর গোনো ,
তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি,
তাদের ভান্ডার পূর্ণ ;  শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি
তোমাকে বিদ্রুপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে----
কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফেরো দুর্বিপাকে |

পৃথিবী উদাস, শোনো হে দুনিয়াদার !
সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-কালো পাহাড়
দগ্ধ হৃদয়ে যদিও ফেরাও ঘাড়
সামনে পেছনে কোথাও পাবে না পার :
কি করে খুলবে মৃত্যু-ঠেকানো দ্বার-----
এই মুহূর্তে জবাব দেবে কি তার ?

লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম
অনেক দিয়েছি ; উজার গ্রাম |
সুদ ও আসলে আজকে তাই
যুদ্ধশেষের প্রাপ্য চাই |

কৃপণ পৃথিবী , লোভের অস্ত্র
নিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র,
লোলুপ রসনা মেলা পৃথিবীতে
বাড়াও ও-হাত তাকে ছিঁড়ে নিতে |
লোভের মাথায় পদাঘাত হানো------
আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো |
দৈত্যরাজের যত অনুচর
মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর ;
মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ-----
হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ |
তোমার ফসল, তোমার মাটি
তাদের জীয়ন ও মরণকাঠি
তোমার চেতনা চালিত হাতে |
এখনও কাঁপবে আশঙ্কাতে ?
স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি
মারণমন্ত্র বলে , শোনো তা কি ?
এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র ?
কারো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্র :
শোন্ রে মালিক , শোন্ রে মজুতদার !
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়-------
হিসাব কি দিবি তার ?

প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
.                     ভেঙেছিস ঘড়বাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
.                     কখনো ভুলতে পারি ?
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের
.                     চিতা আমি তুলবই |
শোন্ রে মজুতদার ,
ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ
.                       করব তোকে এবার |

তারপর বহুশত যুগ পরে
ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে
নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার,
মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার |
তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক , মজুতদার
মানুষ ছিল কি ? জবাব মেলে না তার |

আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়,
দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড় ;
আজকের নৈঃশব্দ হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি |
দু হাতে বাজাও প্রতিশোধের উন্মত্ত দামামা,
প্রার্থনা করো :

হে জীবন , হে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা----
আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি,
প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের
.                           তুষার-গলানো উত্তাপ |
টুকরো টুকরো ক’রে ছেঁড়ো তোমার
অন্যায় আর ভীরতার কলঙ্কিত কাহিনী |
শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে
একত্রিত হোক আমাদের সংহতি |

তা যদি না হয় , মাথার উপরে ভয়ঙ্কর
বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর ;
তা যদি না হয়, বুঝব তুমি তো মানুষ নও-----
গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও |
ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয়নি জল
দেয় নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল
পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই
ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
বিবৃতি
( ছাড়পত্র )

আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে,
জমে ভিড় ভ্রষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে,
দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল,
প্রত্যেক নিরন্ন প্রাণে বয়ে আনে অনিবার্য মিল |

আহার্যের অন্বেষণে প্রতি মনে আদিম আগ্রহ
রাস্তায় রাস্তায় আনে প্রতিদিন নগ্ন সমারোহ ;
বুভুক্ষা বেঁধেছে বাসা পথের দুপাশে,
প্রত্যহ বিষাক্ত বায়ু ইতস্তত ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাসে |

মধ্যবিত্ত ধূর্ত সুখ ক্রমে ক্রমে আবরণহীণ
নিঃশব্দে ঘোষণা করে দারুণ দুর্দিন,
পথে পথে দলে দলে কঙ্কালের শোভাযাত্রা চলে,
দুর্ভিক্ষ জুঞ্জন তোলে আতঙ্কিত অন্দরমহলে !
দুয়ারে দুয়ারে  ব্যগ্র উপবাসী প্রত্যাশীর দল,
নিষ্ফল প্রার্থনা-ক্লান্ত, তীব্র ক্ষুধা অন্তিম সম্বল ;
রাজপথে মৃতদেহ উগ্র দিবালোকে,
বিস্ময় নিক্ষেপ করে অনভ্যস্ত চোখে |

পরন্তু এদেশে আজ হিংস্র শত্রু আক্রমণ করে,
বিপুল মৃত্যুর স্রোত টান দেয় প্রাণের শিকড়ে,
নিয়ত অন্যায় হানে জরাগ্রস্ত বিদেশী শাসন,
ক্ষীণায়ু কোষ্ঠীতে নেই ধ্বংস-গর্ভ সংকটনাশন |
সহসা অনেক রাত্রে দেশদ্রোহী ঘাতকের হাতে
দেশপ্রেমে দৃপ্ত প্রাণ রক্ত ঢালে সূর্যের সাক্ষাতে |

তবুও প্রতিজ্ঞা ফেরে বাতাসে নিভৃত,
এখানে চল্লিশ কোটি এখনো জীবিত,
ভারতবর্ষের ‘পরে গলিত সূর্য ঝরে আজ----
দিগ্বিদিকে উঠেছে আওয়াজ,
রক্তে আনো লাল,
রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল  |
উদ্ধত প্রাণের বেগে উন্মুখ আমার এ দেশ,
আমার বিধ্বস্ত প্রাণে দৃঢ়তার এসেছে নির্দেশ |

আজকের মজুর ভাই দেশময় তুচ্ছ করে প্রাণ,
কারখানায় কারখানায় তোলে ঐকতান |
অভুক্ত কৃষক আজ সূচীমুখ লাঙলের মুখে
নির্ভয়ে রচনা করে জঙ্গী কাব্য এ মাটির বুকে |
আজকে আসন্ন মুক্তি দূর থেকে দৃষ্টি দেয় শ্যেন,
এদেশে ভান্ডার ভ’রে দেবে জানি নতুন য়ুক্রেন |

নিরন্ন আনার দেশে আজ তাই উদ্ধত জেহাদ,
টলোমলো এ দুর্দিন , থরোথরো জীর্ণ বনিয়াদ |
তাইতো রক্তের স্রোতে শুনিপদধ্বনি
বিক্ষুদ্ধ টাইফুন-মত্ত চঞ্চল ধমনী  :
বিপন্ন পৃথ্বীর আজ শুনি মুহুর্মুহু ডাক
আমাদের দৃপ্ত মুঠি আজ তার উত্তর পাঠাক |
ফিরুক দুয়ার থেকে সন্ধানী মৃত্যুর পরোয়ানা,
ব্যর্থ হোক কুচক্রান্ত, অবিরাম বিপক্ষের হানা ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
রানার
( ছাড়পত্র )

রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ ঝুম্ ঘন্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার !
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার |
দিগন্ত থেকে দিগন্ত ছোটে রানার----
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার |
রানার !     রানার  !
জানা- অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে ;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে,  আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয় |
তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে স’রে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ ----- বুঝি হয় লাল ও--পূর্ব কোণ |
অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিট্ মিট্ ক’রে চায় :
কেমন ক’রে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায় !
কত গ্রাম, কত পথ যায় স’রে স’রে------
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে ;
হাতে লন্ঠন করে ঠন্ ঠন্ , জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ রানার !  এখনো রাতের কালো |

এমনি ক’রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’ |
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে |
অনেক দুঃখে, বহু  বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে |

রানার !     রানার !
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে ?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে ?
ঘরেতে অভাব ;  পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয় , তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে |
কত চিঠি লেখে লোকে-----
কত সুখে,  প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে |
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে |
দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি,----
এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি-----
রানার !  রানার !  কি হবে এ বোঝা ব’য়ে ?
কি হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে ?
রানার !  রানার !  ভোর তো হয়েছে ----- আকাশ হয়েছে লাল,
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল ?


রানার !    গ্রামের রানার !
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার ;
শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ
.           ভীরুতা পিছনে ফেলে-----
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর,
.           অগ্রগতির ‘মেলে’,
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি-----
.           নেই, দেরি নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে
.             দুর্দম, হে রানার ||


.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মধ্যবিত্ত '৪২
( ছাড়পত্র )

পৃথিবীময় যে সংক্রামক রোগে,
আজকে সকলে ভুগছে একযোগে,
এখানে খানিক তারই পূর্বাভাস
পাচ্ছি, এখন বইছে পুব-বাতাস \
উপায় নেই যে সামলে ধরব হাল,
হিংস্র বাতাসে ছিঁড়ল আজকে পাল,
গোপনে আগুন বাড়ছে ধানক্ষেতে,
বিদেশী খবরে রেখেছি কান পেতে |
সভয়ে এদেশে কাটছে রাত্রিদিন,
লুব্ধ বাজারে রুগ্ন স্বপ্নহীন |
সহসা নেতারা রুদ্ধ -- দেশ জুড়ে
‘দেশপ্রেমিক’ উদিত ভুঁই ফুঁড়ে |
প্রথমে তাদের অন্ধ বীর মদে
মেতেছি এবং ঠকেছি প্রতিপদে ;
দেখেছি সুবিধা নেই এ কাজ করায়
একক চেষ্টা কেবলই ভুল ধরায় |
এদিকে দেশের পূর্ব প্রান্তরে
আবার বোমারু রক্ত পান করে,
ক্ষুব্ধ জনতা আসামে, চাটগাঁয়ে,
শাণিত-দ্বৈত-নগ্ন অন্যায়ে ;
তাদের স্বার্থ আমার স্বার্থকে,
দেখছে চেতনা আজকে এক চোখে ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
শত্রু এক
( ছাড়পত্র )

এদেশ বিপন্ন আজ ; জানি আজ নিরন্ন জীবন----
মৃত্যুরা প্রত্যহ সঙ্গী,  নিয়ত শত্রুর আক্রমণ
রক্তের আল্পনা আঁকে, কানে বাজে আর্তনাদ সুর ;
তবুও সুদৃঢ় আমি,  আমি এক ক্ষুধিত মজুর |
আমার সম্মুখে আজ এক শত্রু  :  এক লাল পথ,
শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষায় উদ্দীপ্ত শপথ |
কঠিন প্রতিজ্ঞা-স্তব্ধ আমাদের দৃপ্ত কারখানায়,
প্রত্যেক নির্বাক যন্ত্র প্রতিরোধ সংকল্প জানায় |
আমার হাতের স্পর্শে প্রতিদিন যন্ত্রের গর্জন
স্মরণ করায় পণ ; আবসাদ দিই বিসর্জন |
বিক্ষুব্ধ যন্ত্রের বুকে প্রতিদিন যে যুদ্ধ ঘোষণা,
সে যুদ্ধ আমার যুদ্ধ, তারই পথে স্তব্ধ দিন গোনা |
অদূর দিগন্তে আসে ক্ষিপ্র দিন, জয়োন্মত্ত পাখা----
আমার দৃষ্টিতে লাল প্রতিবিম্ব মুক্তির পতাকা |
আমার বেগান্ধ হাত, অবিরাম যন্ত্রের প্রসব
প্রচুর প্রচুর সৃষ্টি, শেষ বজ্র সৃষ্টির উত্সব ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মজুরদের ঝড়
( ল্যাংস্টন হিউজ )
( ছাড়পত্র )

এখন এই তো সময়----
কই ? কোথায় ? বেরিয়ে এসো ধর্মঘটভাঙা দালালেরা  ;
সেই সব দালালরা-----
ছেলেদের চোখের মতো যাদের ভোল বদলায়,
বেরিয়ে এসো  !
জাহান্নমে যাওয়া মূর্খের দল,
বিচ্ছিন্ন, তিক্ত, দুর্বোধ্য
পরাজয় আর মৃত্যুর দূত-----
বেরিয়ে এসো !
বেরিয়ে এসো শক্তিমান আর অর্থলোভীর দল
সংকীর্ণ গলির বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে |
গর্তের পোকারা !
এই তো তোমাদের শুভক্ষণ,
গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো----
আর বেরিয়ে পড়ো ছোট ছোট সাপেরা
বড় আর মোটা সাপেদের যারা ঘিরে থাকো |
সময় হয়েছে,
আসরফি আর পুরোনো অপমানের বদলে
সাদা যাদের পেট-----
বংশগত সরীসৃপ দাঁত তারা বের করুক,
এই তো তাদের সুযোগ |
মানুষ ভালো করেই জানে
অনেক মানুষের বিরুদ্ধে একজনকে লাগানোর সেই
.                                       পুরনো কায়দা |

সামান্য কয়েকজন লোভী
অনেক অভাবীর বিরুদ্ধে----
আর স্বাস্থ্যবানদের বিরুদ্ধে
ক্ষয়ে-যাওয়ার দল |
সূর্যালোকের পথে যাদের যাত্রা
তাদের বিরুদ্ধে তাই সাপেরা |

অতীতে অবশ্য এই সাপেরা জিতেছে বহুবার |
কিন্তু এখন সেই সময়,
সচেতন মানুষ !   এখন আর  ভুল ক’রো না----
বিশ্বাস ক’রো না সেই সব সাপেদের
জমকালো চামড়ায় যারা নিজেদের ঢেকে রাখে,
বিপদে পড়লে যারা ডাকে
তাদের চেয়ে কম চটকদার বিষাক্ত অনুচরদের |
এতটুকু লজ্জা হয় না তাদের ধর্মঘট ভাঙতে
যে ধর্মঘট বেআব্রু ক্ষুধার চূড়ান্ত চিহ্ন |

---- অবশ্য, এখনো কোনো সম্মানিত প্রতিষ্ঠান হয়নি
যার অজ্ঞাত নাম  :
“ধর্মঘট ভাঙার দল”
অন্তত দরজায় সে নাম লেখা থাকে না |
ঝড় আসছে-----সেই ঝড় :
যে ঝড় পৃথিবীর বুক থেকে জঞ্জালদের টেনে তুলবে |
আর হুঁশিয়ার মজুর :
সে ঝড় প্রায় মুখোমুখি  ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
ডাক
( ছাড়পত্র )

মুখে-মৃদু-হাসি অহিংস বুদ্ধের
ভূমিকা চাই না | ডাক ওঠে যুদ্ধের |
গুলি বেঁধে বুকে উদ্ধত তবু মাথা---
হাতে হাতে ফেরে দেনা-পাওনার খাতা,
শোনো হুঙ্কার কোটি অবরুদ্ধের |
দুর্ভিক্ষকে তাড়াও,  ওদেরও তাড়াও----
সন্ধিপত্র মাড়াও, দুপায়ে মাড়াও |
তিন-পতাকার মিনতি : দেবে না সাড়াও ?
অসহ্য জ্বালা কোটি কোটি ক্রুদ্ধের !

ক্ষতবিক্ষত নতুন সকাল বেলা,
শেষ করব এ রক্তের হোলিখেলা,
ওঠো সোজা হয়ে, পায়ে পায়ে লাগে ঠেলা
দেখ, ভিড় দেখ স্বাধীনতালুব্ধের |

ফাল্গুন মাস, ঝরুক জীর্ণ পাতা
গজাক নতুন পাতারা, তুলুক মাথা,
নতুন দেয়াল দিকে দিকে হোক গাঁথা-----
জাগে বিক্ষোভ চারিপাশে ক্ষুদ্ধের |

হ্রদে তৃষ্ণার জল পাবে কত কাল ?
সম্মুখে টানে সমুদ্র উত্তাল  :
তুমি কোন্ দলে  ? জিজ্ঞাসা উদ্দাম :
‘গুন্ডা’র দলে আজো লেখাও নি নাম ?


.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মৃত্যুঞ্জয়ী গান
( ছাড়পত্র )

নিয়ত দক্ষিণ হাওয়া স্তব্ধ হল একদা সন্ধ্যায়
অজ্ঞাতবাসের শেষে নিদ্রাভঙ্গে নির্বীর্য জনতা
সহসা আরণ্য রাজ্যে স্তম্ভিত সভয়ে ;
নির্বায়ুমন্ডল ক্রমে দুর্ভাবনা দৃঢ়তর করে |
দূরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন ! মহামারী অন্তরে বিক্ষোভ,
সঞ্চারিত রক্তবেগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতে :
অবসন্ন বিলাসের সঙ্কুচিত প্রাণ |

বণিকের চোখে আজও কী দুরন্ত লোভ ঝ’রে পড়ে :
মুহুর্মুহু রক্তপাতে স্বধর্ম সূচনা ;
ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায় |
নশ্বর পৌষদিন, চারিদিকে ধূর্তের সমতা
জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন ;
শোকাচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন
পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যতে :
দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর---
দৃষ্টিপথ অন্ধকার , সন্দিহান আগামী দিনেরা |
গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভান,
কন্টকিত প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর |

সহসা জানলায় দেখি দুর্ভিক্ষের স্রোতে
জনতা মিছিলে আসে সংঘবদ্ধ প্রাণ----
অদ্ভুত রোমাঞ্চ লাগে সমুদ্র পর্বতে ;
সে মিছিলে শোনা গেল
জনতার মৃত্যুজয়ী গান ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
কনভয়
( ছাড়পত্র )

হঠাৎ ধুলো উড়িয়ে ছুটে গেলো
যুদ্ধ-ফেরত এক কনভয় :
ক্ষেপে ওঠা পঙ্গপালের মতো
রাজপথ সচকিত ক’রে
আগে আগে কামান উঁচিয়ে,
পেছনে নিয়ে খাদ্য আর রসদের সম্ভার |

ইতিহাসের ছাত্র আমি,
জান্ লা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম
ইতিহাসের দিকে |
সেখানেও দেখি উন্মত্ত এক কনভয় :
ছুটে আসছে যুগযুগান্তের রাজপথ বেয়ে |
সামনে ধূম-উদ্ গীরণ-রত কামান :
পেছনে খাদ্য-শস্য আঁকড়ে ধরা জনতা |
কামানের ধোঁয়ার আড়ালে আড়লে দেখলাম,
মানুষ |
আরো দেখলাম, ফসলের প্রতি তাদের পুরুষানুক্রমিক
মমতা |
অনেক যুগ, অনেক অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র পেরিয়ে
তারা এগিয়ে আসছে : ঝল্ সানো কঠোর মুখে ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
ফসলের ডাক :  ১৩৫১
( ছাড়পত্র )

কাস্তে দাও আমার এ হাতে
সোনালী সমুদ্র সামনে, ঝাঁপ দেব তাতে |
শক্তির উন্মুক্ত হাওয়া আমার পেশীতে
স্নায়ুতে স্নায়ুতে দেখি চেতনার বিদ্যুৎ বিকাশ :
দু পায়ে অস্থির  আজ বলিষ্ঠ কদম ;
কাস্তে দাও আমার এ হাতে |

দু চোখে আমার আজ বিচ্ছুরিত মাঠের আগুন,
নি-শব্দে বিস্তীর্ণ ক্ষেতে তরঙ্গিত প্রাণের জোয়ার
মৌসুমি হাওয়ায় আসে জীবনের ডাক ;
শহরের চুল্লী ঘিরে পতঙ্গের কানে |

বহুদিন উপবাসী নিঃস্ব জনপদে,
মাঠে মাঠে আমাদের ছড়ানো সম্পদ,
কাস্তে দাও আমার এ হাতে |
মনে আছে একদিন তোমাদের ঘরে
নবান্ন উজাড় ক’রে পাঠিয়েছি সোনার বছরে,
নির্ভাবনার হাসি ছড়িয়েছি মুখে
তৃপ্তির প্রগাঢ় চিহ্ন এনেছি সম্মুখে,
সেদিনের অলক্ষ্য সেবার বিনিময়ে
আজ শুধু কাস্তে দাও আমার এ হাতে |

আমার পুরনো কাস্তে পুড়েন গেছে ক্ষুধার আগুনে,
তাই দাও দীপ্ত কাস্তে চৈতন্যপ্রখর ------
যে কাস্তে ঝল্ সাবে নিত্য উগ্র দেশপ্রেমে |

জানি আমি মৃত্যু আজ ঘুরে যায় তোমাদেরও দ্বারে,
দুর্ভিক্ষ ফেলেছে ছায়া তোমাদের দৈনিক ভান্ডারে ;
তোমাদের বাঁচানোর প্রতিজ্ঞা আমার,
শুধু আজ কাস্তে দাও আমার এ হাতে |
পরাস্ত অনেক চাষী ; ক্ষিপ্রগতি নিঃশব্দ মরণ------
জলন্ত মৃত্যুর হাতে দেখা গেল বুভুক্ষের আত্মসমর্পণ,
তাদের ফসল প’ড়ে দৃষ্টি জ্বলে সুদূরসন্ধানী
তাদের ক্ষেতের হাওয়া চুপিচুপি করে কানাকানি------
আমাকেই কাস্তে নিতে হবে |
নিয়ত আমার কানে গুঞ্জরিত ক্ষুধার যন্ত্রণা,
উদ্বেলিত হাওয়া আনে মাঠের সে উচ্ছ্বসিত ডাক,
সুস্পষ্ট আমার কাছে জীবনের সুতীব্র সংকেত ;
তাই আজ একবার কাস্তে দাও আমার এ হাতে ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
কৃষকের গান   
( ছাড়পত্র )

এ বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে
এইবার ফলাব ফসল----
আমার এ বলিষ্ঠ বাহুতে
আজ তার নির্জন বোধন |
এ মাটির গর্ভে আজ আমি
দেখেছি আসন্ন জন্মেরা
ক্রমশ সুপুষ্ট ইঙ্গিতে ;
দুর্ভিক্ষের অন্তিম কবর !
আমার প্রতিজ্ঞা শুনেছ কি ?
( গোপন একান্ত এক পণ )
এ মাটির জন্ম দেব আমি
অগণিত পল্টন-ফসল |
ঘনায় ভাঙন দুই চোখে
ধ্বংসস্রোত জনতা জীবনে ;
আমার প্রতিজ্ঞা গ’ড়ে তোলে
ক্ষুধিত সহস্র হাতছানি |
দুয়ারে শত্রুর হানা
মুঠিতে আমার দুঃসাহস |
কর্ষিত মাটির পথে পথে
নতুন সভ্যতা গড়ে পথ ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
এই নবান্নে   
( ছাড়পত্র )

এই হেমন্তে কাটা হবে ধান,
আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান----
পৌষপার্বণের প্রাণ-কোলাহলে ভরবে গ্রামের নীরব শ্মশান |
তবুও এ হাতে কাস্তে তুলতে কান্না ঘনায় :
হালকা হাওয়ায় বিগত স্মৃতিকে ভুলে থাকা দা.য় ;
গত হেমন্তে মরে গেছে ভাই,  ছেড়ে গেছে বোন,
পথে-প্রান্তরে খামারে মরেছে যত পরিজন ;
নিজের হাতের জমি ধান-বোনা
বৃথাই ধুলোতে ছড়িয়েছে সোনা,
কারোরই ঘরেতে ধান তোলবার আসে নি শুভক্ষণ-----
তোমার আমার ক্ষেত ফসলের অতি ঘনিষ্ঠ জন |
এবার নতুন জোরালো বাতাসে
জয়যাত্রার ধ্বনি ভেসে আসে,.
পিছে মৃত্যুর ক্ষতির নির্বচন---
এই হেমন্তে ফসলেরা বলে :  কোথায় আপন জন ?
তারা কি কেবল লুকোনো থাকবে,
অক্ষমতার গ্লানিকে ঢাকবে,
প্রাণের বদলে যারা প্রতিবাদ করেছে উচ্চারণ ?
এই নবান্নে প্রতারিতদের হবে না নিমন্ত্রণ ?

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
আঠারো বছর বয়স   
( ছাড়পত্র )

আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি |

আঠারো বছর বয়সেই নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-----
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা |

এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে |

আঠারো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা |

আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ |

আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্রান্ত ;  একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো |

তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে |

এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-----
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে ||

.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
হে মহাজীবন   
( ছাড়পত্র )

হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো !
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা------
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় :
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্ সানো রুটি ||



.            ***************     

.                                                                        
ছাড়পত্র-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*