সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
চিল ( ছাড়পত্র )
পথ চলতে চলতে হঠাৎ দেখলাম : ফুটপাতে এক মরা চিল !
চমকে উঠলাম ওর করুণ বীভৎস মূর্তি দেখে | অনেক উঁচু থেকে যে এই পৃথিবীটাকে দেখেছে লুন্ঠনের অবাধ উপনিবেশ ; যার শ্যেন দৃষ্টিতে কেবল ছিল তীব্র লোভ আর ছোঁ মারার দস্যু প্রবৃত্তি----- তাকে দেখলাম, ফুটপাতে মখ ঘুঁজে প’ড়ে |
গম্বুজশিখরে বাস করত এই চিল, নিজেকে জাহির করত সুতীক্ষ্ণ চীৎকারে ; হালকা হাওয়ায় ডানা মেলে দিত আকাশের নীলে---- অনেককে ছড়িয়ে ; একক : পৃথিবী থেকে অনেক, অনেক উঁচুতে |
অনেকে আজ নিরাপদ ; নিরাপদ ইঁদুর ছানারা আর খাদ্য-হাতে ত্রস্ত পথচারী, নিরাপদ------- কারণ আজ সে মৃত | আজ আর কেউ নেই ছোঁ মারার, ওরই ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টের মতো ও পড়ে রইল ফুটপাতে, শুক্ নো, শীতল বিকৃত দেহে |
হাতে যাদের ছিল প্রাণধারণের খাদ্য বুকের কাছে সযত্নে চেপে ধরা----- তারা আজ এগিয়ে গেল নির্ভয়ে ; নিষ্ঠুর বিদ্রুপের মতো পিছনে ফেলে আকাশচ্যুত এক উদ্ধত চিলকে ||
ক্ষুধার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম----- চট্টগ্রাম : বীর চট্টগ্রাম ! বিক্ষত বিধ্বস্ত দেহে অদ্ভুত নিঃশব্দ সহিষ্ণুতা আমাদের স্নায়ুতে স্নায়ুতে বিদ্যুৎপ্রবাহ আনে, আনে আজ চেতনার দিন | চট্টগ্রাম : বীর চট্টগ্রাম ! এখনো নিস্তব্ধ তমি তাই আজো পাশবিকতার দুঃসহ মহড়া চলে, তাই আজো শত্রুরা সাহসী | জানি আমি তোমার হৃদয়ে অজস্র ঔদার্য আছে ; জানি আছে সুস্থ শালীনতা জানি তুমি আঘাতে আঘাতে এখনও স্তিমিত নও, জানি তুমি এখনো উদ্দাম---- হে চট্টগ্রাম ! তাই আজো মনে পড়ে রক্তাক্ত তোমাকে সহস্র কাজের ফাঁকে মনে পড়ে শার্দুলের ঘুম অরণ্যের স্বপ্ন চোখে, দাঁতে নখে প্রতিজ্ঞা কঠোর | হে অভক্ত ক্ষুধিত শ্বাপদ----- তোমার উদ্যত থাবা, সংঘবদ্ধ প্রতিটি নখর এখনো হয় নি নিরাপদ | তুমি চাও শোণিতের স্বাদ------- যে স্বাদ জেনেছে স্তালিনগ্রাদ | তোমার সংকল্পস্রোতে ভেসে যাবে লোহার গরাদ এ তোমার নিশ্চিত বিশ্বাস | তোমার প্রতিজ্ঞা তাই আমার প্রতিজ্ঞা, চট্টগ্রাম ! আমার হৃদপিন্ডে আজ তারি লাল স্বাক্ষর দিলাম ||
কলকাতায় শান্তি নেই | রক্তের কলঙ্ক ডাকে মধ্যরাত্রে প্রতিটি সন্ধ্যায় | হৃত্স্পন্দনধ্বনি দ্রুত হয় : মূর্ছিত শহর | এখন গ্রামের মতো সন্ধ্যা হলে জনহীন নগরের পথ ; স্তম্ভিত আলোকস্তম্ভ আলো দেয় নিতান্ত সভয়ে | কোথায় দোকানপাট ? কই সেই জনতার স্রোত ? সন্ধ্যার আলোর বন্যা আজ আর তোলে নাকো জনতরণীর পাল শহরের পথে | ট্রাম নেই, বাস নেই----- সাহসী পথিকহীন এ শহর আতঙ্ক ছড়ায় | সারি সারি বাড়িসব মনে হয় কবরের মতো, মৃত মানুষের স্তূপ বুকে নিয়ে পড়ে আছে চুপ ক’রে সভয়ে নির্জনে | মাঝে মাঝে শব্দ হয় : মিলিটারী লরীর গর্জন পথ বেয়ে ছুটে যায় বিদ্যুতের মতো সদম্ আক্রোশে | কলঙ্কিত কালো কালো রক্তের মতন অন্ধকার হানা দেয় অতন্দ্র শহরে ; হয়তো অনেক রাত্রে পথচারী কুকুরের দল মানুষের দেখাদেখি স্বজাতিকে দেখে আস্ফালন, আক্রমণ করে | রদ্ধশ্বাস এ শহর ছট্ ফট করে সারা রাত----- কখন সকাল হবে ? জীয়নকাঠির স্পর্শ পাওয়া যাবে উজ্জ্বল রোদ্দুরে ? সন্ধ্যা থেকে প্রত্যুষের দীর্ঘকাল প্রহরে প্রহরে সশব্দে জিজ্ঞাসা করে ঘড়ির ঘন্টায় ধৈর্যহীন শহরের প্রাণ : এর চেয়ে ছুরি কি নিষ্ঠুর ? বাদুড়ের মতো কালো অন্ধকার ভর ক’রে গুজবের ডানা উত্কর্ণ কানের কাছে সারা রাত ঘুরপাক খায় | স্তব্ধতা কাঁপিয়ে দিয়ে কখনো বা গৃহস্থের দ্বারে উদ্ধত, অটল আর সুগম্ভীর শব্দ ওঠে কঠিন বুটের |
শহর মুর্ছিত হয়ে পড়ে |
জুলাই ! জুলাই ! আবার আসুক ফিরে আজকের কলকাতার এ প্রার্থনা ; দিকে দিকে শুধু মিছিলের কোলাহল----- এখনো পায়ের শব্দ যাচ্ছে শোনা |
অক্টোবরকে জুলাই হতেই হবে আবার সবাই দাঁড়াব সবার পাশে, আগষ্ট এবং সেপ্টেম্বর মাস এবারে মতো মুছে যাক ইতিহাস ||
আজ এসেছি তোমাদের ঘরে ঘরে------ পৃথিবীর আদালতের পরোয়ানা নিয়ে তোমরা কি দেবে আমার প্রশ্নের কৈফিয়ৎ : কেন মৃত্যকীর্ণ শবে ভরলো পঞ্চাশ সাল ? আজ বাহান্ন সলের সূচনায় কি তার উত্তর দেবে ? জানি ! স্তব্ধ হয়ে গেছে তোমাদের অগ্রগতির স্রোত, তাই দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়ায় কালো করছ ভবিষ্যৎ আর অনুশোচনার আগুনে ছাই হচ্ছে উত্সাহের কয়লা | কিন্তু ভেবে দেখেছ কি ? দেরি হয়ে গেছে অনেক, অনেক দেরি ! লাইনে দাঁড়ানো অভ্যাস কর নি কোনদিন, একটি মাত্র লক্ষ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মারামারি করেছ পরস্পর, তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ | কেবল বঞ্চিত বিহ্বল বিমূঢ় জিজ্ঞাসাভরা চোখে প্রত্যেকে চেয়েছ প্রত্যেকের দিকে ; ------ কেন এমন হল ? একদা দুর্ভিক্ষ এল ক্ষুধার ক্ষমাহীন তাড়নায় পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে ইতর-ভদ্র, হিন্দু আর মুসলমান একই বাতাসে নিলে নিশ্বাস | চাল, চিনি, কয়লা, কেরোসিন ? এ সব দুষ্প্রপ্য জিনিসের জন্য চাই লাইন | কিন্তু বুঝলে না মুক্তিও দুর্লভ আর দুর্মূল্য, তারো জন্যে চাই চল্লিশ কোটির দীর্ঘ, অবিচ্ছিন্ন এক লাইন |
মূর্খ তোমরা লাইন দিলে : কিন্তু মুক্তির বদলে কিনলে মৃত্যু, রক্তক্ষয়ের বদলে পেলে প্রবঞ্চনা | ইতিমধ্যে তোমাদের বিবদমান বিশৃঙ্খল ভিড়ে মক্তি উঁকি দিয়ে গেছে বহুবার | লাইনে দাঁড়ানো আয়ত্ত করেছে যারা, সোভিয়েট, পোল্যান্ড, ফ্রান্স রক্তমূল্যে তারা কিনে নিয়ে গেল তাদের মুক্তি সব প্রথম এই পৃথিবীর দোকান থেকে | এখনো এই লাইনে অনেকে প্রতীক্ষমান, প্রার্থী অনেক ; কিন্তু পরিমিত মুক্তি | হয়তো এই বিশ্বব্যাপী লাইনের শেষে এখনো তোমাদের স্থান হতে পারে---- একথা ঘোষণা ক’রে দাও তোমাদের দেশময় . প্রতিবেশীর কাছে | তারপর নিঃশব্দে দাঁড়াও এ লাইনে প্রতিজ্ঞা . আর প্রতীক্ষা নিয়ে হাতের মুঠোয় তৈরী রেখে প্রত্যেকের প্রাণ | আমি ইতিহাস, আমার কথাটা একবার ভেবে দেখো, মনে রেখো, দেরি হয়ে গেছে, অনেক অনেক দেরি | আর মনে ক’রো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র, নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ, অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা, আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন ||
হে মহামানব, একবার এসো ফিরে শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে, এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার ; লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার | এই যে আকাশ , দিগন্ত , মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি ; কোথাও নেইকো পার মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল, এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল, ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো, হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো |
ব্যাহত জীবনযাত্রা, চুপি চুপি কান্না বও বুকে, হে নীড়-বিহারী সঙ্গী ! আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে ভেবেছ সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে | তবু আজো বিস্ময় আমার----- ধূর্ত , প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের গ্রাস তাদের করেছ ক্ষমা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ | তোমার ক্ষেতের শস্য চুরি ক’রে যারা গুপ্তকক্ষেতে জমায় তাদেরি দুপায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায় ; লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রসাদে মিনারে তুমি যে পেতেছ হাত ; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিষ্ফল------ তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল | তুমি তো প্রহর গোনো , তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি, তাদের ভান্ডার পূর্ণ ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি তোমাকে বিদ্রুপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে---- কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফেরো দুর্বিপাকে |
পৃথিবী উদাস, শোনো হে দুনিয়াদার ! সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-কালো পাহাড় দগ্ধ হৃদয়ে যদিও ফেরাও ঘাড় সামনে পেছনে কোথাও পাবে না পার : কি করে খুলবে মৃত্যু-ঠেকানো দ্বার----- এই মুহূর্তে জবাব দেবে কি তার ?
লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম অনেক দিয়েছি ; উজার গ্রাম | সুদ ও আসলে আজকে তাই যুদ্ধশেষের প্রাপ্য চাই |
কৃপণ পৃথিবী , লোভের অস্ত্র নিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র, লোলুপ রসনা মেলা পৃথিবীতে বাড়াও ও-হাত তাকে ছিঁড়ে নিতে | লোভের মাথায় পদাঘাত হানো------ আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো | দৈত্যরাজের যত অনুচর মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর ; মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ----- হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ | তোমার ফসল, তোমার মাটি তাদের জীয়ন ও মরণকাঠি তোমার চেতনা চালিত হাতে | এখনও কাঁপবে আশঙ্কাতে ? স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি মারণমন্ত্র বলে , শোনো তা কি ? এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র ? কারো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্র : শোন্ রে মালিক , শোন্ রে মজুতদার ! তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়------- হিসাব কি দিবি তার ?
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা, . ভেঙেছিস ঘড়বাড়ি, সে কথা কি আমি জীবনে মরণে . কখনো ভুলতে পারি ? আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের . চিতা আমি তুলবই | শোন্ রে মজুতদার , ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ . করব তোকে এবার |
তারপর বহুশত যুগ পরে ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার, মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার | তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক , মজুতদার মানুষ ছিল কি ? জবাব মেলে না তার |
আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়, দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড় ; আজকের নৈঃশব্দ হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি | দু হাতে বাজাও প্রতিশোধের উন্মত্ত দামামা, প্রার্থনা করো :
হে জীবন , হে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা---- আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি, প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের . তুষার-গলানো উত্তাপ | টুকরো টুকরো ক’রে ছেঁড়ো তোমার অন্যায় আর ভীরতার কলঙ্কিত কাহিনী | শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে একত্রিত হোক আমাদের সংহতি |
তা যদি না হয় , মাথার উপরে ভয়ঙ্কর বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর ; তা যদি না হয়, বুঝব তুমি তো মানুষ নও----- গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও | ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয়নি জল দেয় নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই ||
রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ ঝুম্ ঘন্টা বাজছে রাতে রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে, রানার চলেছে, রানার ! রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার | দিগন্ত থেকে দিগন্ত ছোটে রানার---- কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার | রানার ! রানার ! জানা- অজানার বোঝা আজ তার কাঁধে, বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে ; রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়, আরো জোরে, আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয় | তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে স’রে যায় বন, আরো পথ, আরো পথ ----- বুঝি হয় লাল ও--পূর্ব কোণ | অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিট্ মিট্ ক’রে চায় : কেমন ক’রে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায় ! কত গ্রাম, কত পথ যায় স’রে স’রে------ শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে ; হাতে লন্ঠন করে ঠন্ ঠন্ , জোনাকিরা দেয় আলো মাভৈঃ রানার ! এখনো রাতের কালো |
এমনি ক’রেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে, পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে’ | ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে | অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে, ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে |
রানার ! রানার ! এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে ? রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে ? ঘরেতে অভাব ; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া, পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া, রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে, দস্যুর ভয় , তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে | কত চিঠি লেখে লোকে----- কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে | এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও, এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ, এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে, এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে | দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি,---- এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি----- রানার ! রানার ! কি হবে এ বোঝা ব’য়ে ? কি হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে ? রানার ! রানার ! ভোর তো হয়েছে ----- আকাশ হয়েছে লাল, আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল ?
রানার ! গ্রামের রানার ! সময় হয়েছে নতুন খবর আনার ; শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ . ভীরুতা পিছনে ফেলে----- পৌঁছে দাও এ নতুন খবর, . অগ্রগতির ‘মেলে’, দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি----- . নেই, দেরি নেই আর, ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে . দুর্দম, হে রানার ||
এদেশ বিপন্ন আজ ; জানি আজ নিরন্ন জীবন---- মৃত্যুরা প্রত্যহ সঙ্গী, নিয়ত শত্রুর আক্রমণ রক্তের আল্পনা আঁকে, কানে বাজে আর্তনাদ সুর ; তবুও সুদৃঢ় আমি, আমি এক ক্ষুধিত মজুর | আমার সম্মুখে আজ এক শত্রু : এক লাল পথ, শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষায় উদ্দীপ্ত শপথ | কঠিন প্রতিজ্ঞা-স্তব্ধ আমাদের দৃপ্ত কারখানায়, প্রত্যেক নির্বাক যন্ত্র প্রতিরোধ সংকল্প জানায় | আমার হাতের স্পর্শে প্রতিদিন যন্ত্রের গর্জন স্মরণ করায় পণ ; আবসাদ দিই বিসর্জন | বিক্ষুব্ধ যন্ত্রের বুকে প্রতিদিন যে যুদ্ধ ঘোষণা, সে যুদ্ধ আমার যুদ্ধ, তারই পথে স্তব্ধ দিন গোনা | অদূর দিগন্তে আসে ক্ষিপ্র দিন, জয়োন্মত্ত পাখা---- আমার দৃষ্টিতে লাল প্রতিবিম্ব মুক্তির পতাকা | আমার বেগান্ধ হাত, অবিরাম যন্ত্রের প্রসব প্রচুর প্রচুর সৃষ্টি, শেষ বজ্র সৃষ্টির উত্সব ||
এখন এই তো সময়---- কই ? কোথায় ? বেরিয়ে এসো ধর্মঘটভাঙা দালালেরা ; সেই সব দালালরা----- ছেলেদের চোখের মতো যাদের ভোল বদলায়, বেরিয়ে এসো ! জাহান্নমে যাওয়া মূর্খের দল, বিচ্ছিন্ন, তিক্ত, দুর্বোধ্য পরাজয় আর মৃত্যুর দূত----- বেরিয়ে এসো ! বেরিয়ে এসো শক্তিমান আর অর্থলোভীর দল সংকীর্ণ গলির বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে | গর্তের পোকারা ! এই তো তোমাদের শুভক্ষণ, গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো---- আর বেরিয়ে পড়ো ছোট ছোট সাপেরা বড় আর মোটা সাপেদের যারা ঘিরে থাকো | সময় হয়েছে, আসরফি আর পুরোনো অপমানের বদলে সাদা যাদের পেট----- বংশগত সরীসৃপ দাঁত তারা বের করুক, এই তো তাদের সুযোগ | মানুষ ভালো করেই জানে অনেক মানুষের বিরুদ্ধে একজনকে লাগানোর সেই . পুরনো কায়দা |
সামান্য কয়েকজন লোভী অনেক অভাবীর বিরুদ্ধে---- আর স্বাস্থ্যবানদের বিরুদ্ধে ক্ষয়ে-যাওয়ার দল | সূর্যালোকের পথে যাদের যাত্রা তাদের বিরুদ্ধে তাই সাপেরা |
অতীতে অবশ্য এই সাপেরা জিতেছে বহুবার | কিন্তু এখন সেই সময়, সচেতন মানুষ ! এখন আর ভুল ক’রো না---- বিশ্বাস ক’রো না সেই সব সাপেদের জমকালো চামড়ায় যারা নিজেদের ঢেকে রাখে, বিপদে পড়লে যারা ডাকে তাদের চেয়ে কম চটকদার বিষাক্ত অনুচরদের | এতটুকু লজ্জা হয় না তাদের ধর্মঘট ভাঙতে যে ধর্মঘট বেআব্রু ক্ষুধার চূড়ান্ত চিহ্ন |
---- অবশ্য, এখনো কোনো সম্মানিত প্রতিষ্ঠান হয়নি যার অজ্ঞাত নাম : “ধর্মঘট ভাঙার দল” অন্তত দরজায় সে নাম লেখা থাকে না | ঝড় আসছে-----সেই ঝড় : যে ঝড় পৃথিবীর বুক থেকে জঞ্জালদের টেনে তুলবে | আর হুঁশিয়ার মজুর : সে ঝড় প্রায় মুখোমুখি ||
হঠাৎ ধুলো উড়িয়ে ছুটে গেলো যুদ্ধ-ফেরত এক কনভয় : ক্ষেপে ওঠা পঙ্গপালের মতো রাজপথ সচকিত ক’রে আগে আগে কামান উঁচিয়ে, পেছনে নিয়ে খাদ্য আর রসদের সম্ভার |
ইতিহাসের ছাত্র আমি, জান্ লা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম ইতিহাসের দিকে | সেখানেও দেখি উন্মত্ত এক কনভয় : ছুটে আসছে যুগযুগান্তের রাজপথ বেয়ে | সামনে ধূম-উদ্ গীরণ-রত কামান : পেছনে খাদ্য-শস্য আঁকড়ে ধরা জনতা | কামানের ধোঁয়ার আড়ালে আড়লে দেখলাম, মানুষ | আরো দেখলাম, ফসলের প্রতি তাদের পুরুষানুক্রমিক মমতা | অনেক যুগ, অনেক অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র পেরিয়ে তারা এগিয়ে আসছে : ঝল্ সানো কঠোর মুখে ||
কাস্তে দাও আমার এ হাতে সোনালী সমুদ্র সামনে, ঝাঁপ দেব তাতে | শক্তির উন্মুক্ত হাওয়া আমার পেশীতে স্নায়ুতে স্নায়ুতে দেখি চেতনার বিদ্যুৎ বিকাশ : দু পায়ে অস্থির আজ বলিষ্ঠ কদম ; কাস্তে দাও আমার এ হাতে |
দু চোখে আমার আজ বিচ্ছুরিত মাঠের আগুন, নি-শব্দে বিস্তীর্ণ ক্ষেতে তরঙ্গিত প্রাণের জোয়ার মৌসুমি হাওয়ায় আসে জীবনের ডাক ; শহরের চুল্লী ঘিরে পতঙ্গের কানে |
বহুদিন উপবাসী নিঃস্ব জনপদে, মাঠে মাঠে আমাদের ছড়ানো সম্পদ, কাস্তে দাও আমার এ হাতে | মনে আছে একদিন তোমাদের ঘরে নবান্ন উজাড় ক’রে পাঠিয়েছি সোনার বছরে, নির্ভাবনার হাসি ছড়িয়েছি মুখে তৃপ্তির প্রগাঢ় চিহ্ন এনেছি সম্মুখে, সেদিনের অলক্ষ্য সেবার বিনিময়ে আজ শুধু কাস্তে দাও আমার এ হাতে |
আমার পুরনো কাস্তে পুড়েন গেছে ক্ষুধার আগুনে, তাই দাও দীপ্ত কাস্তে চৈতন্যপ্রখর ------ যে কাস্তে ঝল্ সাবে নিত্য উগ্র দেশপ্রেমে |
জানি আমি মৃত্যু আজ ঘুরে যায় তোমাদেরও দ্বারে, দুর্ভিক্ষ ফেলেছে ছায়া তোমাদের দৈনিক ভান্ডারে ; তোমাদের বাঁচানোর প্রতিজ্ঞা আমার, শুধু আজ কাস্তে দাও আমার এ হাতে | পরাস্ত অনেক চাষী ; ক্ষিপ্রগতি নিঃশব্দ মরণ------ জলন্ত মৃত্যুর হাতে দেখা গেল বুভুক্ষের আত্মসমর্পণ, তাদের ফসল প’ড়ে দৃষ্টি জ্বলে সুদূরসন্ধানী তাদের ক্ষেতের হাওয়া চুপিচুপি করে কানাকানি------ আমাকেই কাস্তে নিতে হবে | নিয়ত আমার কানে গুঞ্জরিত ক্ষুধার যন্ত্রণা, উদ্বেলিত হাওয়া আনে মাঠের সে উচ্ছ্বসিত ডাক, সুস্পষ্ট আমার কাছে জীবনের সুতীব্র সংকেত ; তাই আজ একবার কাস্তে দাও আমার এ হাতে ||
এ বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে এইবার ফলাব ফসল---- আমার এ বলিষ্ঠ বাহুতে আজ তার নির্জন বোধন | এ মাটির গর্ভে আজ আমি দেখেছি আসন্ন জন্মেরা ক্রমশ সুপুষ্ট ইঙ্গিতে ; দুর্ভিক্ষের অন্তিম কবর ! আমার প্রতিজ্ঞা শুনেছ কি ? ( গোপন একান্ত এক পণ ) এ মাটির জন্ম দেব আমি অগণিত পল্টন-ফসল | ঘনায় ভাঙন দুই চোখে ধ্বংসস্রোত জনতা জীবনে ; আমার প্রতিজ্ঞা গ’ড়ে তোলে ক্ষুধিত সহস্র হাতছানি | দুয়ারে শত্রুর হানা মুঠিতে আমার দুঃসাহস | কর্ষিত মাটির পথে পথে নতুন সভ্যতা গড়ে পথ ||
এই হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান---- পৌষপার্বণের প্রাণ-কোলাহলে ভরবে গ্রামের নীরব শ্মশান | তবুও এ হাতে কাস্তে তুলতে কান্না ঘনায় : হালকা হাওয়ায় বিগত স্মৃতিকে ভুলে থাকা দা.য় ; গত হেমন্তে মরে গেছে ভাই, ছেড়ে গেছে বোন, পথে-প্রান্তরে খামারে মরেছে যত পরিজন ; নিজের হাতের জমি ধান-বোনা বৃথাই ধুলোতে ছড়িয়েছে সোনা, কারোরই ঘরেতে ধান তোলবার আসে নি শুভক্ষণ----- তোমার আমার ক্ষেত ফসলের অতি ঘনিষ্ঠ জন | এবার নতুন জোরালো বাতাসে জয়যাত্রার ধ্বনি ভেসে আসে,. পিছে মৃত্যুর ক্ষতির নির্বচন--- এই হেমন্তে ফসলেরা বলে : কোথায় আপন জন ? তারা কি কেবল লুকোনো থাকবে, অক্ষমতার গ্লানিকে ঢাকবে, প্রাণের বদলে যারা প্রতিবাদ করেছে উচ্চারণ ? এই নবান্নে প্রতারিতদের হবে না নিমন্ত্রণ ?