স্বচ্ছ রাত্রি এনেছে ল্লাবন, উষ্ণ নিবিড় ধূলিদাপটের মরুচ্ছায়ায় ঘনায় নীল | ক্লান্ত বুকের হৃত্স্পন্দন ক্রমেই ধীর হয়ে আসে তাই শেষ সম্বল তোলো পাঁচিল | ক্ষণভঙ্গুর জীবনের এই নির্বিরোধ হতাশা নিয়েই নিত্য তোমার দাদন শোধ ?
শ্রান্ত দেহ কি ভীরু বেদনার অন্ধকূপে ডুবে যেতে কাঁদে মুক্তি মায়ায় ইতস্তত ; কত শিখন্ডী জন্ম নিয়েছে নূতন রূপে ? দুঃস্বপ্নের প্রায়শ্চিত্ত চোরের মতো | মৃত ইতিহাস অশুচি ঘুচায় ফল্গু-স্নানে ; গন্ধবিধুর রুধির তবুও জোয়ার আনে |
পথবিভ্রম হয়েছে এবার, আসন্ন মেঘ | চলে ক্যারাভান ধূসর আঁধারে অন্ধগতি, সরীসৃপের পথ চলা শুরু প্রমত্ত বেগ জীবন্ত প্রাণ, বিবর্ণ চোখে অসম্মতি | অরণ্য মাঝে দাবদাহ কিছু যায় না রেখে মনকে বাঁচাও বিপন্ন এই মৃত্যু থেকে |
সঙ্গীবিহীন দুর্জয় এই পরিভ্রমণ রক্তনেশায় এনেছে কেবলই সুখাস্বাদ, এইবার করো মেরুদুর্গম পরিখা খনন বাইরে চলুক অযথা অধীর মুক্তিবাদ | দুর্গম পথে যাত্রী সওয়ার ভ্রান্তিবিহীন ফুরিয়ে এসেছে তন্দ্রানিঝুম ঘুমন্ত দিন |
পালাবে বন্ধু ? পিছনে তোমার ধূমন্ত ঝড় পথ নির্জন, রাত্রি বিছানো অন্ধকারে | চলো, আরো দূরে : ক্ষুধিত মরণ নিরন্তর, পুরানো পৃথিবী জেগেছে আবার মৃত্যুপারে, অহেতুক তাই হয়নি তোমার পরিখা-খনন, থেমে আসে আজ বিড়ম্বনায় শ্রান্ত চরণ |
মরণের আজ সর্পিল গতি বক্রবধির----- পিছনে ঝটিকা, সামনে মৃত্যু রক্তলোলুপ | বারুদের ধূম কালো ছায়া আনে,----তিক্ত রুধির ; পৃথিবী এখনো নির্জন নয়, ---- জ্বলন্ত ধূপ | নৈঃশব্দ্যের তীরে তীরে আজ প্রতীক্ষাতে সহস্র প্রাণ বসে আছে ঘিরে অস্ত্র হাতে ||
কত যুগ, কত বর্ষান্তের শেষে . জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী : আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে . বজ্রের কানাকানি | সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে . শান্তি পালাল আজ | দিন ও রাত্রি হল অস্থির . কাজ, আর শুধু কাজ ! জনসিংহের ক্ষুব্ধ নখর . হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর . ওঠে তার গর্জন------- প্রতিশোধ, প্রতিশোধ !
হাজার হাজার শহীদ ও বীর স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর . ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন | ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধ : . কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্ ঝন্ | প্রশ্ন নয়কো পারার না পারার, অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার . দ্বার ভাঙা আজ পণ ; এতদিন ধ’রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্ ঝন্ |
ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়, ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে . আজো রোমাঞ্চকর ; ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায় কে আছে আজকে ওদের ফিরায় . কে ভাবে ওদের পর ? ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড় !
নিদ্রায়, কাজকর্মের ফাঁকে ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে . ওদের ফিরাব কবে ? কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে কোটি মানুষের দুর্বার চাপে . শৃঙ্খল গত হবে ? কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে কোটি জনতার জোয়ারের জলে . ভেসে যাবে কারাগার | কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার ?
মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি ; ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে, বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে . গোপন করেছে ঋণী | মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি ! . হে খাতক নির্বোধ, রক্ত দিয়েই সব ঋণ করো শোধ ! শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো, . শোনো স্বদেশের ভাই, রক্তের বিনিময় হয় হোক . আমরা ওদের চাই ||
আবার এবার দুর্বার সেই একুশে নভেম্বর----- আকাশে কোণে বিদ্যুৎ হেনে তুলে দিয়ে গেল . মৃত্যুকাঁপানো ঝড় | আবার এদেশে মাঠে, ময়দানে সুদূর গ্রামেও জনতার প্রাণে হাসনাবাদের ইঙ্গিত হানে প্রত্যাঘাতের স্বপ্ন ভয়ঙ্কর | আবার এসেছে অবাধ্য এক একুশে নভেম্বর ||
পিছনে রয়েছে একটি বছর, একটি পুরনো সাল, ধর্মঘট আর চরম আঘাতে উদ্দাম, উত্তাল ; বার বার জিতে, জানি অবশেষে একবার গেছি হেরে----- বিদেশী ! তোদের যাদুদন্ডকে এবার নেবই কেড়ে | শোন্ রে বিদেশী শোন্ আবার এসেছে লড়াই জেতার চরম শুভক্ষণ ! আমরা সবাই অসভ্য, বুনো----- বৃথা রক্তের শোধ নেব দুনো একপা পিছিয়ে দু’পা এগোনোর . আমরা করেছি পণ,
ঠ’কে শিখলাম-------- . তাই তুলে ধরি দুর্জয় গর্জন | আহ্বান আসে অনেক দূরের, হায়দ্রাবাদ আর ত্রিবাঙ্কুরের ; আজ প্রয়োজন একটি সুরের . একটি কঠোর স্বর : “বিদেশী কুকুর ! আবার এসেছে একুশে নভেম্বর |” ডাক ওঠে, ডাক ওঠে------ আবার কঠোর বহু হরতালে আসে মিল্লাত, বিপ্লবী ডালে এখানে সেখানে রক্তের ফুল ফোটে | এ নভেম্বরে আবারো তো ডাক ওঠে ||
আমাদের নেই মৃত্যু এবং আমাদের নেই ক্ষয়, অনেক রক্ত বৃথাই দিলুম তবু বাঁচবার শপথ নিলুম কেটে গেছে আজ রক্তদানের ভয় ! ল’ড়ে মরি তাই আমরা অমর, আমরাই অক্ষয় ||
আবার এসেছে তেরোই ফেব্রুয়ারি, . দাঁতে দাঁত চেপে . হাতে হাত চেপে . উদ্যত সারি সারি, কিছু না হলেও আবার আমরা . রক্ত দিতে তো পারি ? পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে ফেব্রুয়ারি | এ নভেম্বরে সংকেত পাই তারি ||
আর এক যুদ্ধ শেষ, পৃথিবীতে তবু কিছু জিজ্ঞাসা উন্মুখ | উদ্দাম ঢাকের শব্দে সে প্রশ্নের উত্তর কোথায় ? বিজয়ী বিশ্বের চোখ মুদে আসে, নামে এক ক্লান্তির জড়তা | রক্তাক্ত প্রান্তর তার অদৃশ্য দুহাতে নাড়া দেয় পৃথিবীকে, সে প্রশ্নের উত্তর কোথায় ? তুষারখচিত মাঠে, ট্রেঞ্চে, শূন্যে, অরণ্যে, পর্বতে অস্থির বাতাস ঘোরে দুর্বোধ্য ধাঁধায়, ভাঙা কামানের মুখে ধ্বংসস্তুপে উত্কীর্ণ জিজ্ঞাসা : কোথায় সে প্রশ্নের উত্তর ?
দিগ্বিজয়ী দুঃশাসন ! বহু দীর্ঘ দীর্ঘতর দিন তুমি আছো দৃঢ় সিংহাসনে সমাসীন, হাতে হিসেবের খাতা, উন্মুখ এই পৃথিবী : আজ তার শোধ করো ঋণ | অনেক নিয়েছ রক্ত, দিয়েছ অনেক অত্যাচার, আজ হোক তোমার বিচার | তুমি ভাব, তুমি শুধু নিতে পার প্রাণ, তোমার সহায় আছে নিষ্ঠুর কামান ; জানো নাকি আমাদেরও উষ্ণ বুক, রক্ত গাঢ় লাল, পেছনে রয়েছে বিশ্ব, ইঙ্গিত দিয়েছে মহাকাল, স্পীডোমিটারের মতো আমাদের কী দুঃখ নিঃসীম, দেখ ঘরে ঘরে আজ জেগে ওঠে এক এক ভীম | তবুও যে তমি আজো সিংহাসনে আছ | সে কেবল আমাদের বিরাট ক্ষমায় | এখানে অরণ্য স্তব্ধ, প্রতীক্ষা-উত্কীর্ণ চারিদিক, গঙ্গায় প্লাবন নেই, হিমালয় ধৈর্যের প্রতীক ; এ সুযোগে খুলে দাও ক্রুর শষাসনের প্রদর্শনী, আমরা প্রহর শুধু গণি |
পৃথিবীতে যুদ্ধ শেষ, বন্ধ সৈনিকের রক্ত ঢালা : ভেবেছো তোমার জয়, তোমার প্রাপ্য এ জয়মালা ; জানো না এখানে যুদ্ধ------ শুরু দিনদলের পালা ||
তোমরা এসেছ, বিপ্লবী বীর ! অবাক অভ্যুদয় ! যদিও রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে সারা কলকাতাময় | তবু দেখ আজ রক্তে রক্তে সাড়া ---- আমরা এসেছি উদ্দাম ভয়হারা | আমরা এসেছি চারিদিক থেকে, ভুলতে কখনো পারি ! একসূত্রে যে বাঁধা হয়ে গেছে কবে কোন্ যুগে নাড়ী | আমরা যে বারে বারে তোমাদের কথা পৌঁছে দিয়েছি এদেশের দ্বারে দ্বারে, মিছিলে মিছিলে সভায় সভায় উদাত্ত আহ্বানে, তোমাদের স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছি জনতার উথ্বানে | উদ্দাম ধ্বনি মুখরিত পথেঘাটে, পার্কের মোড়ে, ঘরে, ময়দানে, মাঠে মুক্তির দাবি করেছি তীব্রতর সারা কলকাতা শ্লোগানেই থরোথরো | এই সেই কলকাতা ! একদিন যার ভয়ে দরু দুরু বৃটিশ নোয়াত মাথা | মনে পড়ে চব্বিশে ? সেদিন দুপুরে সারা কলকাতা হারিয়ে ফেলেছে দিশে ; হাজার হাজার জনসাধারণ ধেয়ে চলে সম্মুখে পরিষদ-গেটে হাজির সকলে, শেষ প্রতিজ্ঞা বুকে গর্জে উঠল হাজার হাজার ভাই : রক্তের বিনিময়ে হয় হোক, আমরা ওদের চাই | সফল ! সফল ! সেদিনের কলকাতা----- হেঁট হয়েছিল অত্যাচারী ও দাম্ভিকের মাথা | জানি বিকৃত আজকের কলকাতা বৃটিশ এখন এখানে জনত্রাতা !
গৃহযুদ্ধের ঝড় বয়ে গেছে------ ডেকেছে এখানে কালো রক্তের বান ; সেদিনের কলকাতা এ আঘাতে ভেঙে চুরে খান্ খান্ | দিকে দিকে আজ বিদেশী প্রহরী, সঙ্গিন উদ্যত, তোমরা এসেছ বীরের মতন, আমরা চোরের মতো |
আজতোমাদের মুক্তিসভায় তোমাদের সম্মুখে, শপথ নিলাম আমরা হাজার মুখে : যতদিন আছে আমাদের প্রাণ, আমাদের সম্মান, আমরা রুখব গৃহযুদ্ধের কালো রক্তের বান | অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা, বুঝি আরো দিতে হবে এগিয়ে চলার প্রত্যেক উৎসবে | তবুও আজকে ভরসা, যেহেতু তোমরা রয়েছ পাশে, তোমরা রয়েছ এদেশের নিঃশ্বাসে |
তোমাদের পথ যদিও কুয়াশাময়, উদ্দাম জয়যাত্রার পথে জেনো ও কিছুই নয় | তোমরা রয়েছ, আমরা রয়েছি, দুর্জয় দুর্বার, পদাঘাতে পদাঘাতেই ভাঙব মুক্তির শেষ দ্বার | আবার জ্বালাব বাতি, হাজার সেলাম তাই নাও আজ, শেষযুদ্ধের সাথী ||
সীমান্তে আজ আমি প্রহরী | অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রান্ত ক’রে আজ এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি------ স্বদেশের সীমানায় |
ধূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী, স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে : -----ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও |
আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক, হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল, রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ, আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি | আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ, স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ, চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠি : কিছুতেই বুঝি না কী ক’রে এড়াব তাকে ?
কী ক’রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক ? যুদ্ধ শেষ | মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি, চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া, প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল, গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক, রাত্রে চাঁদ ওঠে : আমার চোখে ঘুম নেই |
তোমাকে ভেবেছি কতদিন, কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে, কত গোলা ফাটার মুহূর্তে | কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে কতবার হৃদয় জ্লেছে অনুশোচনার অঙ্গারে তোমার আর তোমাদের ভাবনায় | তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্রের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে, ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুসঃহ আঘাতে বার বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব | আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্রে | জানি না আজো, আছ কি নেই, দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে জানি না তাও |
তবু লিখছি তোমাকে আজ : লিখছি আত্মম্ভর আশায় ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে | জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক’রে নেই মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে ; জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে, মিলিত খুশিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার | তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে সে তোমার হৃদয় | যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে ; পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায় | আর সামনে নয়, এবার পেছন ফেরার পালা |
পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক, এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে | প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক’রে পেলাম কী ? উত্তর তার---- তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয় ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব, ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র ; আর নিষ্কন্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা | আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার ||
এ আকাশ, এ দিগন্ত, এই মাঠ, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি, সহস্র বছর ধ’রে একে আমি জানি পরিপাটি, জানি এ আমার দেশ অজস্র ঐতিহ্য দিয়ে ঘেরা, এখানে আমার রক্তে বেঁচে আছে পূর্বপুরুষেরা | যদিও দলিত দেশ, তবু মুক্তি কথা কয় কানে, যুগ যুগ আমরা যে বেঁচে থাকি পতনে উথ্বানে ! যে চাষী কেটেছে ধান, এ মাটিতে নিয়েছে কবর, এখনো আমার মধ্যে ভেসে আসে তাদের খবর | অদৃশ্য তাদের স্বপ্নে সমাচ্ছন্ন এদেশের ধূলি, মাটিতে তাদের স্পর্শ, তাদের কেমন ক’রে ভুলি ? আমার সম্মুখে ক্ষেত, এ প্রান্তরে দয়াস্ত খাটি, ভালবাসি এ দিগন্ত, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি | এখানে রক্তের দাগ রেখে গেছে চেঙ্গিস্ , তৈমুর, সে চিহ্নও মুছে দিল কত উচ্চৈঃশ্রবাদের খুর | কত যুদ্ধ হয়ে গেছে, কত রাজ্য হয়েছে উজাড়, উর্বর করেছে মাটি কত দিগ্বিজয়ীর হাড় | তবুও অজেয় এই শতাব্দীগ্রথিত হিন্দুস্থান, এরই মধ্যে আমাদের বিকশিত স্বপ্নের সন্ধান | আজন্ম দেখেছি আমি অদ্ভুত নতুন এক চোখে, আমার বিশাল দেশ আসমুদ্র ভারতবর্ষকে | এ ধুলোয় প্রতিরোধ, এ হাওয়ায় ঘুর্ণিত চাবুক, এখানে নিশ্চিহ্ন হল কত শত গর্বোদ্ধত বুক | এ মাটির জন্যে প্রাণ দিয়েছি তো কত যুগ ধ’রে, রেখেছি মাটির মান কতবার কত যুদ্ধ ক’রে | আজকে যখন এই দিক্ প্রান্তে ওঠে রক্ত-ঝড়, কোমল মাটিতে রাখে শত্রু তার পায়ের স্বাক্ষর, তখন চিৎকার ক’রে রক্ত বলে ওঠে ‘ধিক্ ধিক্, এখনো দিল না দেখা দেহে দেহে নির্ভয় সৈনিক ! দাসত্বের ছদ্মবেশ দীর্ণ ক’রে উন্মোচিত হোক একবার বিশ্বরূপ ---- হে উদ্দাম, হে অধিনায়ক !’ এদিকে উৎকর্ণ দিন, মণিপুর, কাঁপে মণিপুর চৈত্রের হাওয়ায় ক্লান্ত, উৎকন্ঠায় অস্থির দুপুর----- কবে দেখা দেবে, কবে প্রতীক্ষিত সেই শুভক্ষণ ছড়াবে ঐশ্বর্য পথে জনতার দুরন্ত যৌবন ? দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে অতর্কিতে শত্রু তার পদচিহ্ন রাখে----- এখনো শত্রুকে ক্ষমা ? শত্রু কি করেছে ক্ষমা . বিধ্বস্ত বাংলাকে ?
আজকের এ মুহূর্তে অবসন্ন শ্মশানস্তব্ধতা, কেন তাই মনে মনে আমি প্রশ্ন করি সেই কথা | তুমি কি ক্ষুধিত বন্ধু ? তুমি কি ব্যাধিতে জরোজরো ? তা হোক, তবুও তুমি আর এক মৃত্যুকে রোধ করো | বসন্ত লাগুক আজ আন্দোলিত প্রাণের শাখায়, আজকে আসুক বেগ এ নিশ্চল রথের চাকায়, এ মাটি উত্তপ্ত হোক, এ দিগন্তে আসুক বৈশাখ, ক্ষুধার আগুনে আজ শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক | শত্রুরা নিয়েছে আজ দ্বিতীয় মৃত্যুর ছদ্মবেশ, তবু কেন নিরুত্তর প্রাণের প্রাচুর্যে ভরা দেশ ? এদেশে কৃষক আছে, এদেশে মজুর আছে জানি, এদেশে বিপ্লবী আছে জনরাজ্যে মুক্তির সন্ধানী | দাসত্বের ধুলো ঝেড়ে তারা আজ আহ্বান পাঠাক, ঘোষণা করুক তারা এ মাটিতে আসন্ন বৈশাখ | তাই এই অবরুদ্ধ স্বপ্নহীন নিবিড় বাতাসে শব্দ হয়, মনে হয় রাত্রিশেষে ওরা যেন আসে | ওরা আসে, কান পেতে আমি তার পদধ্বনি শুনি, মৃত্যুকে নিহত ক’রে ওরা আসে উজ্জ্বল আরুণি, পৃথিবী ও ইতিহাস কাঁপে আজ অসহ্য আবেগে, ওদের পায়ের স্পর্শে মাটিতে সোনার ধান, রঙ লাগে মেঘে | এ আকাশ চন্দ্রাতপ, সূর্য আজ ওদের পতাকা, মুক্তির প্রচ্ছদপটে ওদের কাহিনী আজ ঢাকা, আগুন্তুক ইতিহাসে ওরা আজ প্রথম অধ্যায়, ওরা আজ পলিমাটি অবিরামরক্তের বন্যায় ; ওদের দুচোখে আজ বিকশিত অভ্যথর্না | ওদের পতাকা ওড়ে গ্রামে গ্রামে নগরে বন্দরে, মুক্তির সংগ্রাম সেরে ওরা ফেরে স্বপ্নময় ঘরে ||