বিক্ষোভ  
(ঘুম নেই)

দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম,
হে স্বদেশ, ফের সেই কথা জানলাম
জানে না তো কেউ পৃথিবী উঠছে কেঁপে
ধরেছে মিথ্যা সত্যের টুঁটি চেপে,
কখনো কেউ কি ভূমিকম্পের আগে
হাতে শাঁখ নেয়, হঠাৎ সবাই জাগে ?
যারা আজ এত মিথ্যার দায়ভাগী,
আজকে তাদের ঘৃণার কামান দাগি |
ইতিহাস, জানি নীরব সাক্ষী তুমি,
আমরা চেয়েছি স্বাধীন স্বদেশভূমি,
অনেকে বিরূপ, কানে দেয় হাত চাপা,
তাতেই কি হয় আসল নকল মাপা ?
বিদ্রোহী মন ! আজকে ক’রো না মানা,
দেব প্রেম আর পাব কলসীর কানা,
দেব, প্রাণ দেব মুক্তির কোলাহলে,
জীন্ ডার্ক, যীশু, সোক্রোটিসের দলে |
কুয়াশা কাটছে, কাটবে আজ কি কাল,
ধুয়ে ধুয়ে যাবে কুৎসার জঞ্জাল,
ততদিন প্রাণ দেব শত্রুর হাতে,
মুক্তির ফুল ফুটবে সে সংঘাতে |
ইতিহাস ! নেই অমরত্বের লোভ,
আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ ||

.            ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
১লা মে-র কবিতা ’৪৬
( ঘুম নেই )

লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে,
কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকার ?
কতদিন তুষ্ট থাকবে আর
অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে ?
মনের কথা ব্যক্ত করবে
ক্ষীণ অস্পষ্ট কেঁউ-কেঁউ শব্দে ?
ক্ষুদিত পেটে ধুঁকে ধুঁকে চলবে কত দিন ?
ঝুলে পড়া তোমার জিভ,
শ্বাসে প্রশ্বাসে ক্লান্তি টেনে কাঁপতে থাকবে কত কাল ?
মাথায় মৃদ চাপড় আর পিঠে হাতের স্পর্শে
কতক্ষণ নাড়তে থাকবে লেজ ?
তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো,
অস্বীকার করো বশ্যতাকে |
চলো, শুকনো হাড়ের বদলে
সন্ধান করি তাজা রক্তের ,
তৈরি হোক লাল আগুনে ঝল্ সানো আমাদের খাদ্য |
শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক
সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে ||

.            ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
পরিখা
( ঘুম নেই )

স্বচ্ছ রাত্রি এনেছে ল্লাবন, উষ্ণ নিবিড়
ধূলিদাপটের মরুচ্ছায়ায় ঘনায় নীল |
ক্লান্ত বুকের হৃত্স্পন্দন ক্রমেই ধীর
হয়ে আসে তাই শেষ সম্বল তোলো পাঁচিল |
ক্ষণভঙ্গুর জীবনের এই নির্বিরোধ
হতাশা নিয়েই নিত্য তোমার দাদন শোধ ?

শ্রান্ত দেহ কি ভীরু বেদনার অন্ধকূপে
ডুবে যেতে কাঁদে মুক্তি মায়ায় ইতস্তত ;
কত শিখন্ডী জন্ম নিয়েছে নূতন রূপে ?
দুঃস্বপ্নের প্রায়শ্চিত্ত চোরের মতো |
মৃত ইতিহাস অশুচি ঘুচায় ফল্গু-স্নানে ;
গন্ধবিধুর রুধির তবুও জোয়ার আনে |

পথবিভ্রম হয়েছে এবার, আসন্ন মেঘ |
চলে ক্যারাভান ধূসর আঁধারে অন্ধগতি,
সরীসৃপের পথ চলা শুরু প্রমত্ত বেগ
জীবন্ত প্রাণ, বিবর্ণ চোখে অসম্মতি |
অরণ্য মাঝে দাবদাহ কিছু যায় না রেখে
মনকে বাঁচাও বিপন্ন এই মৃত্যু থেকে |

সঙ্গীবিহীন দুর্জয় এই পরিভ্রমণ
রক্তনেশায় এনেছে কেবলই সুখাস্বাদ,
এইবার করো মেরুদুর্গম পরিখা খনন
বাইরে চলুক অযথা অধীর মুক্তিবাদ |
দুর্গম পথে যাত্রী সওয়ার ভ্রান্তিবিহীন
ফুরিয়ে এসেছে তন্দ্রানিঝুম ঘুমন্ত দিন |

পালাবে বন্ধু ? পিছনে তোমার ধূমন্ত ঝড়
পথ নির্জন, রাত্রি বিছানো অন্ধকারে |
চলো, আরো দূরে : ক্ষুধিত মরণ নিরন্তর,
পুরানো পৃথিবী জেগেছে আবার মৃত্যুপারে,
অহেতুক তাই হয়নি তোমার পরিখা-খনন,
থেমে আসে আজ বিড়ম্বনায় শ্রান্ত চরণ |

মরণের আজ সর্পিল গতি বক্রবধির-----
পিছনে ঝটিকা, সামনে মৃত্যু রক্তলোলুপ |
বারুদের ধূম কালো ছায়া আনে,----তিক্ত রুধির ;
পৃথিবী এখনো নির্জন নয়, ---- জ্বলন্ত ধূপ |
নৈঃশব্দ্যের তীরে তীরে আজ প্রতীক্ষাতে
সহস্র প্রাণ বসে আছে ঘিরে অস্ত্র হাতে ||


.            ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
সব্যসাচী
( ঘুম নেই )

অভুক্ত শ্বাপদচক্ষু নিঃস্পন্দ আঁধারে
জ্বলে রাত্রিদিন |
হে বন্ধু , পশ্চাতে ফেলি অন্ধ হিমগিরি
অনন্ত বার্ধক্য তব ফেলুক নিঃশ্বাস ;
রক্তলিপ্ত যৌবনের অন্তিম পিপাসা
নিষ্ঠুর গর্জনে আজ অরণ্য ধোঁয়ায়
উঠুক প্রজ্বলি’ |
সপ্তরথী শোনে নাকো পৃথিবীর শৈশবক্রন্দন,
দেখেনাই নির্বাকের অশ্রুহীন জ্বালা |
দ্বিধাহীন চন্ডালের নির্লিপ্ত আদেশে
আদিম কুক্কুর চাহে
ধরণীর বস্ত্র কেড়ে নিতে |
উল্লাসে লেলিহজিহ্ব লুব্ধ হায়েনারা------
তবু কেন কঠিন ইস্পাত ?
জরাগ্রস্ত সভ্যতার হৃৎপিন্ড জর্জর,
ক্ষুৎপিপাসা চক্ষু মেলে
মরণের উপসর্গ যেন
স্বপ্নলব্ধ উদ্যমের অদৃশ্য জোয়ারে
সংগবদ্ধ বল্মীকের দল |

নেমে এসো ------হে ফাল্গুনী,
বৈশাখের খরতপ্ত তেজে
ক্লান্ত দুবাহু তব লৌহময় হোক
বয়ে যাক শোণিতের মন্দাকিনী স্রোত ;
মুমূর্ষু পৃথিবী উষ্ণ, নিত্য তৃষাতুরা,
নির্বাপিত আগ্নেয় পর্বত
ফিরে চায় অনর্গল বিলুপ্ত আতপ |
আজ কেন সুবর্ণ শৃঙ্খলে
বাঁধা কব রিক্ত বজ্রপাণি,
তুষারের তলে সুপ্ত অবসন্ন প্রাণ ?
তুমি শুধু নহ সব্যসাচী,
বিস্মৃতির অন্ধকার পারে
ধূসর গৈরিক নিত্য প্রান্তহীনল বেলাভূমি ‘পরে
আত্মভোলা, তুমি ধনঞ্জয় ||

.            ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
বিদ্রোহের গান
( ঘুম নেই )

বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি ?
এসো তে আজ বিদ্রোহ করি,
আমরা সবাই যে যার প্রহরী
.                  উঠুক ডাক |
উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে
জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে
কোটি করাঘাত পৌঁছোক দ্বারে ;
.                   ভীরুরা থাক |

মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি,
চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি
রুখবে কে আর এ অগ্রগতি,
.                    সাধ্য কার ?

রুটি দেবে নাকো ?  দেবে না অন্ন ?
এ লড়াইয়ে তুমি নও প্রসন্ন ?
চোখ-রাঙানিকে করি না গণ্য
.                     ধারি না ধার |

খ্যাতির মুখেতে পদাঘাত করি,
গড়ি, আমরা যে বিদ্রোহ গড়ি,
ছিঁড়ি দুহাতের শৃঙ্খলদড়ি,
.                       মৃত্যুপণ |

দিক থেকে দিকে বিদ্রোহ ছোটে,
বসে থাকবার বেলা নেই মোটে,
রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে
.                        পূর্বকোণ |

ছিঁড়ি, গোলামির দলিলকে ছিঁড়ি,
বেপরোয়াদের দলে গিয়ে ভিড়ি
খুঁজি কোনখানে স্বর্গের সিঁড়ি,
.                        কোথায় প্রাণ !

দেখব, এপরে আজো আছে কারা,
খসাব আঘাতে আকাশের তারা,
সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,
.                        ছড়াব ধান |
জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান ||

.            ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
উদ্বীক্ষণ
( ঘুম নেই )

নগরে ও গ্রামে জমেছে ভিড়
ভগ্ননীড়,------
ক্ষুধিত জনতা আজ নিবিড় |
সমুদ্রে জাগে বাড়বানল,
কী উচ্ছল,
তীরসন্ধানী ব্যাকুল জল |
কখনো হিংস্র নিবিড় শোকে ;
দাঁতে ও নখে-----
জাগে প্রতিজ্ঞা অন্ধ চোখে |
তবু সমুদ্র সীমানা রাখে,
দুর্বিপাকে
দিগন্তব্যাপী প্লাবন ঢাকে |
আসন্ন ঝড়ে অরণ্যময়
যে বিস্ময়
ছড়াবে, তার কি অযথা ক্ষয় ?
দেশে ও বিদেশে লাগে জোয়ার,
ঘোড়সোয়ার
চিনে নেবে পথ দৃঢ় লোহার,
যে পথে নিত্য সূর্যোদয়
আনে প্রলয়,
সেই সীমান্তে বাতাস বয় ;
তাই প্রতীক্ষা --ঘনায় দিন
স্বপ্নহীন ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
অভিবাদন
( ঘুম নেই )

হে সাথী, আজকে স্বপ্নের দিন গোনা
ব্যর্ত নয় তো, বিপুল সম্ভাবনা
দিকে দিকে উদ্ যাপন করছে লগ্ন,
পৃথিবী সূর্য-তপস্যাতেই মগ্ন |

আজকে সামনে নিরুচ্চারিত প্রশ্ন,
মনের কোমল মহল ঘিরে কবোষ্ণ ;
ক্রমশ পুষ্ট মিলিত উন্মাদনা,
ক্রমশ সফল স্বপ্নের দিন গোনা  |

স্বপ্নের বীজ বপন করেছি সদ্য,
বিদ্যুৎবেগে ফসল সংঘবদ্ধ !
হে সাথী, ফসলে শুনেছো প্রাণের গান
দুরন্ত হাওয়া ছড়ায় ঐকতান |


বন্ধু , আজকে দোদুল্যমান পৃথ্বী,
আমরা গঠন করব নতুন ভিত্তি ;
তারই সূত্রপাতকে করেছি সাধন,
হে সাথী, আজকে রক্তিম অভিবাদন ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
বিদ্রোহের গান
( ঘুম নেই )

বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি ?
এসো তে আজ বিদ্রোহ করি,
আমরা সবাই যে যার প্রহরী
.                  উঠুক ডাক |
উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে
জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে
কোটি করাঘাত পৌঁছোক দ্বারে ;
.                   ভীরুরা থাক |

মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি,
চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি
রুখবে কে আর এ অগ্রগতি,
.                    সাধ্য কার ?

রুটি দেবে নাকো ?  দেবে না অন্ন ?
এ লড়াইয়ে তুমি নও প্রসন্ন ?
চোখ-রাঙানিকে করি না গণ্য
.                     ধারি না ধার |

খ্যাতির মুখেতে পদাঘাত করি,
গড়ি, আমরা যে বিদ্রোহ গড়ি,
ছিঁড়ি দুহাতের শৃঙ্খলদড়ি,
.                       মৃত্যুপণ |

দিক থেকে দিকে বিদ্রোহ ছোটে,
বসে থাকবার বেলা নেই মোটে,
রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে
.                        পূর্বকোণ |

ছিঁড়ি, গোলামির দলিলকে ছিঁড়ি,
বেপরোয়াদের দলে গিয়ে ভিড়ি
খুঁজি কোনখানে স্বর্গের সিঁড়ি,
.                        কোথায় প্রাণ !

দেখব, এপরে আজো আছে কারা,
খসাব আঘাতে আকাশের তারা,
সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,
.                        ছড়াব ধান |
জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী
( ঘুম নেই )

কত যুগ,  কত বর্ষান্তের শেষে
.                জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী :
আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে
.                বজ্রের কানাকানি |
সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে
.                শান্তি পালাল আজ |
দিন ও রাত্রি হল অস্থির
.                কাজ, আর শুধু কাজ !
জনসিংহের ক্ষুব্ধ নখর
.                হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর
.                ওঠে তার গর্জন-------
প্রতিশোধ, প্রতিশোধ  !

হাজার হাজার শহীদ ও বীর
স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর
.                ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন |
ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধ  :
.                কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্ ঝন্ |
প্রশ্ন নয়কো পারার না পারার,
অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার
.                দ্বার ভাঙা আজ পণ ;
এতদিন ধ’রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্ ঝন্ |

ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়,
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে
গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে
.                আজো রোমাঞ্চকর ;
ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায়
কে আছে আজকে ওদের ফিরায়
.                কে ভাবে ওদের পর ?
ওরা বীর,   ওরা আকাশে জাগাত ঝড় !

নিদ্রায়,  কাজকর্মের ফাঁকে
ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে
.                ওদের ফিরাব কবে ?
কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে
কোটি মানুষের দুর্বার চাপে
.                শৃঙ্খল গত হবে ?
কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে
কোটি জনতার জোয়ারের জলে
.                ভেসে যাবে কারাগার |
কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার ?

মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি ;
ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে,
বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে
.                গোপন করেছে ঋণী |
মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি !
.                হে খাতক নির্বোধ,
রক্ত দিয়েই  সব ঋণ করো শোধ  !
শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো,
.                শোনো স্বদেশের ভাই,
রক্তের বিনিময় হয় হোক
.                আমরা ওদের চাই ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
অনন্যোপায়
( ঘুম নেই )

অনেক গড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হল, ব্যর্থ বহু উদ্যম আমার,
নদীতে জেলেরা ব্যর্থ, তাঁতী ঘরে, নিঃশব্দ কামার,
অর্ধেক প্রাসাদ তৈরি, বন্ধ ছাদ-পেটানোর গান,
চাষীর লাঙল ব্যর্থ, মাঠে নেই পরিপূর্ণ ধান |
যতবার গড়ে তুলি, ততবার চকিত বন্যায়
উদ্যত সৃষ্টিকে ভাঙে পৃথিবীতে অবাধ অন্যায় |
বার বার ব্যর্থ তাই আজ মনে এসেছে বিদ্রোহ,
নির্বিঘ্নে গড়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে ; ছিন্নভিন্ন মোহ |
আজকে ভাঙার স্বপ্ন,----অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙার,
বিপদ ধ্বংসেই মুক্তি, অন্য পথ দেখি নাকো আর  |
তাইতো তন্দ্রাকে ভাঙি, ভাঙি জীর্ণ সংস্কারের খিল,
রুদ্ধ বন্দীকক্ষ ভেঙে মেলে দিই আকাশের নীল |
নির্বিঘ্নে সৃষ্টিকে চাও ? তবে ভাঙো বিঘ্নের বেদীকে,
উদ্দাম ভাঙার অস্ত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে দাও চারিদিকে ||


.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
কবিতার খসড়া
( ঘুম নেই )

আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায়
কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায়
ভরে দিগন্ত দ্রুত সাড়ায়, জানে না কেউ |
দ্যমহীন মূঢ় কারায়
পুরোনো বুলির মাছি তাড়ায়
যারা, তারা নিয়ে ফেরে পাড়ায়, স্মৃতির ফেউ |


.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
আমরা এসেছি
( ঘুম নেই )

কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে, ভেঙেছে খিল,
মিছিলে আমরা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল |
দুঃখ-যুগের ধারায় ধারায়
যারা আনে প্রাণ, যারা তা হারায়
তারাই ভরিয়ে তুলেছে সাড়ায় হৃদয়-বিল |
তারাই এসেছে মিছিলে, আজকে চলে মিছিল ||

কে যেন ক্ষুব্ধ ভোমরার চাকে ছুঁড়েছে ঢিল,
তাইতো দগ্ধ, ভগ্ন, পুরনো পথ বাতিল |
আশ্বিন থেকে বৈশাখে যারা
হাওয়ার মতন ছুটে দিশেহারা,
হাতের স্পর্শে কাজ হয় সারা, কাঁপে নিখিল |
তারা এল আজ দুর্বারগতি চলে মিছিল ||

আজকে হালকা হাওয়ায় উড়ুক একক চিল,
জনতরঙ্গে আমরা ক্ষিপ্ত ঢেউ ফেনিল |
উধাও আলোর নিচে সমারোহ,
মিলিত প্রাণের এ কী বিদ্রোহ !
ফিরে তাকানোর নেই ভীরু মোহ, কী গতিশীল !
সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল ||

একটি কথায় ব্যক্ত চেতনা :  আকাশে নীল,
দৃষ্টি সেখানে তাইতো পদধ্বনিতে মিল |
সামনে মৃত্যুকবলিত দ্বার,
থাক অরণ্য,  থাক না পাহাড়,
ব্যর্থ নোঙর, নদী হব পার, খুঁটি শিথিল |
আমরা এসেছি মিছিলে, গর্জে ওঠে মিছিল ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
একুশে নভেম্বর : ১৯৪৬
( ঘুম নেই )

আবার এবার দুর্বার সেই একুশে নভেম্বর-----
আকাশে কোণে বিদ্যুৎ হেনে তুলে দিয়ে গেল
.          মৃত্যুকাঁপানো ঝড় |
আবার এদেশে মাঠে, ময়দানে
সুদূর গ্রামেও জনতার প্রাণে
হাসনাবাদের ইঙ্গিত হানে
প্রত্যাঘাতের স্বপ্ন ভয়ঙ্কর |
আবার এসেছে অবাধ্য এক একুশে নভেম্বর ||

পিছনে রয়েছে একটি বছর, একটি পুরনো সাল,
ধর্মঘট আর চরম আঘাতে উদ্দাম, উত্তাল ;
বার বার জিতে, জানি অবশেষে একবার গেছি হেরে-----
বিদেশী ! তোদের যাদুদন্ডকে এবার নেবই কেড়ে |
শোন্ রে বিদেশী শোন্
আবার এসেছে লড়াই জেতার চরম শুভক্ষণ !
আমরা সবাই অসভ্য, বুনো-----
বৃথা রক্তের শোধ নেব দুনো
একপা পিছিয়ে দু’পা এগোনোর
.                আমরা করেছি পণ,

ঠ’কে শিখলাম--------
.           তাই তুলে ধরি দুর্জয় গর্জন |
আহ্বান আসে অনেক দূরের,
হায়দ্রাবাদ আর ত্রিবাঙ্কুরের  ;
আজ প্রয়োজন একটি সুরের
.                 একটি কঠোর স্বর :
“বিদেশী কুকুর !  আবার এসেছে একুশে নভেম্বর |”
ডাক ওঠে, ডাক ওঠে------
আবার কঠোর বহু হরতালে
আসে মিল্লাত, বিপ্লবী ডালে
এখানে সেখানে রক্তের ফুল ফোটে |
এ নভেম্বরে আবারো তো ডাক ওঠে ||

আমাদের নেই মৃত্যু এবং আমাদের নেই ক্ষয়,
অনেক রক্ত বৃথাই দিলুম
তবু বাঁচবার শপথ নিলুম
কেটে গেছে আজ রক্তদানের ভয় !
ল’ড়ে মরি তাই আমরা অমর, আমরাই অক্ষয় ||

আবার এসেছে তেরোই ফেব্রুয়ারি,
.     দাঁতে দাঁত চেপে
.     হাতে হাত চেপে
.                 উদ্যত সারি সারি,
কিছু না হলেও আবার আমরা
.                 রক্ত দিতে তো পারি ?
পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে ফেব্রুয়ারি |
এ নভেম্বরে সংকেত পাই তারি ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
দিনবদলের পালা
( ঘুম নেই )

আর এক যুদ্ধ শেষ,
পৃথিবীতে তবু কিছু জিজ্ঞাসা উন্মুখ |
উদ্দাম ঢাকের শব্দে
সে প্রশ্নের উত্তর কোথায় ?
বিজয়ী বিশ্বের চোখ মুদে আসে,
নামে এক ক্লান্তির জড়তা |
রক্তাক্ত প্রান্তর তার অদৃশ্য দুহাতে
নাড়া দেয় পৃথিবীকে,
সে প্রশ্নের উত্তর কোথায় ?
তুষারখচিত মাঠে,
ট্রেঞ্চে, শূন্যে, অরণ্যে, পর্বতে
অস্থির বাতাস ঘোরে দুর্বোধ্য ধাঁধায়,
ভাঙা কামানের মুখে
ধ্বংসস্তুপে উত্কীর্ণ জিজ্ঞাসা :
কোথায় সে প্রশ্নের উত্তর ?

দিগ্বিজয়ী দুঃশাসন !
বহু দীর্ঘ দীর্ঘতর দিন
তুমি আছো দৃঢ় সিংহাসনে সমাসীন,
হাতে হিসেবের খাতা,
উন্মুখ এই পৃথিবী :
আজ তার শোধ করো ঋণ |
অনেক নিয়েছ রক্ত, দিয়েছ অনেক অত্যাচার,
আজ হোক তোমার বিচার |
তুমি ভাব, তুমি শুধু নিতে পার প্রাণ,
তোমার সহায় আছে নিষ্ঠুর কামান ;
জানো নাকি আমাদেরও উষ্ণ বুক, রক্ত গাঢ় লাল,
পেছনে রয়েছে বিশ্ব, ইঙ্গিত দিয়েছে মহাকাল,
স্পীডোমিটারের মতো আমাদের কী দুঃখ নিঃসীম,
দেখ ঘরে ঘরে আজ জেগে ওঠে এক এক ভীম |
তবুও যে তমি আজো সিংহাসনে আছ |
সে কেবল আমাদের বিরাট ক্ষমায় |
এখানে অরণ্য স্তব্ধ, প্রতীক্ষা-উত্কীর্ণ চারিদিক,
গঙ্গায় প্লাবন নেই, হিমালয় ধৈর্যের প্রতীক ;
এ সুযোগে খুলে দাও ক্রুর শষাসনের প্রদর্শনী,
আমরা প্রহর শুধু গণি |

পৃথিবীতে যুদ্ধ শেষ, বন্ধ সৈনিকের রক্ত ঢালা :
ভেবেছো তোমার জয়, তোমার প্রাপ্য এ জয়মালা ;
জানো না এখানে যুদ্ধ------ শুরু দিনদলের পালা ||


.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মুক্ত বীরদের প্রতি
(  ঘুম নেই )

তোমরা এসেছ, বিপ্লবী বীর ! অবাক অভ্যুদয় !
যদিও রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে সারা কলকাতাময় |
তবু দেখ আজ রক্তে রক্তে সাড়া ----
আমরা এসেছি উদ্দাম ভয়হারা  |
আমরা এসেছি চারিদিক থেকে, ভুলতে কখনো পারি !
একসূত্রে যে বাঁধা হয়ে গেছে কবে কোন্ যুগে নাড়ী |
আমরা যে বারে বারে
তোমাদের কথা পৌঁছে দিয়েছি এদেশের দ্বারে দ্বারে,
মিছিলে মিছিলে সভায় সভায় উদাত্ত আহ্বানে,
তোমাদের স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছি জনতার উথ্বানে |
উদ্দাম ধ্বনি মুখরিত পথেঘাটে,
পার্কের মোড়ে, ঘরে, ময়দানে, মাঠে
মুক্তির দাবি করেছি তীব্রতর
সারা কলকাতা শ্লোগানেই থরোথরো |
এই সেই কলকাতা !
একদিন যার ভয়ে দরু দুরু বৃটিশ নোয়াত মাথা |
মনে পড়ে চব্বিশে ?
সেদিন দুপুরে সারা কলকাতা হারিয়ে ফেলেছে দিশে ;
হাজার হাজার জনসাধারণ ধেয়ে চলে সম্মুখে
পরিষদ-গেটে হাজির সকলে, শেষ প্রতিজ্ঞা বুকে
গর্জে উঠল হাজার হাজার ভাই :
রক্তের বিনিময়ে হয় হোক, আমরা ওদের চাই |
সফল !   সফল  !  সেদিনের কলকাতা-----
হেঁট হয়েছিল অত্যাচারী ও দাম্ভিকের মাথা |
জানি বিকৃত আজকের কলকাতা
বৃটিশ এখন এখানে জনত্রাতা !

গৃহযুদ্ধের ঝড় বয়ে গেছে------
ডেকেছে এখানে কালো রক্তের বান ;
সেদিনের কলকাতা এ আঘাতে ভেঙে চুরে খান্ খান্ |
দিকে দিকে আজ বিদেশী প্রহরী, সঙ্গিন উদ্যত,
তোমরা এসেছ বীরের মতন, আমরা চোরের মতো  |

তোমরা এসেছ, ভেঙেছ অন্ধকার-----
তোমরা এসেছ, ভয় করি নাকো আর |
পায়ের স্পর্শে মেঘ কেটে যাবে, উজ্জ্বল রোদ্দুর
ছড়িয়ে পড়বে বহু দূর------বহুদূর |
তোমরা এসেছ,  জেনো এইবার নির্ভর কলকাতা----
অত্যাচারের হাত থেকে জানি তোমরা মুক্তিদাতা |
তোমরা এসেছ, শিহরণ ঘাসে ঘাসে :
পাখির কাকলি উদ্দাম উচ্ছ্বাসে,
মর্মরধ্বনি তরুপল্লবে শখায় শাখায় লাগে ;
হঠাৎ মৌন মহাসমুদ্র জাগে
অস্থির হাওয়া অরণ্যপর্বতে,
গুঞ্জন ওঠে তোমরা যাও যে-পথে |

আজতোমাদের মুক্তিসভায় তোমাদের সম্মুখে,
শপথ নিলাম আমরা হাজার মুখে :
যতদিন আছে আমাদের প্রাণ, আমাদের সম্মান,
আমরা রুখব গৃহযুদ্ধের কালো রক্তের বান |
অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা, বুঝি আরো দিতে হবে
এগিয়ে চলার প্রত্যেক উৎসবে |
তবুও আজকে ভরসা, যেহেতু তোমরা রয়েছ পাশে,
তোমরা রয়েছ এদেশের নিঃশ্বাসে |

তোমাদের পথ যদিও কুয়াশাময়,
উদ্দাম জয়যাত্রার পথে জেনো ও কিছুই নয় |
তোমরা রয়েছ, আমরা রয়েছি, দুর্জয় দুর্বার,
পদাঘাতে পদাঘাতেই ভাঙব মুক্তির শেষ দ্বার |
আবার জ্বালাব বাতি,
হাজার সেলাম তাই নাও আজ, শেষযুদ্ধের সাথী  ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
প্রিয়তমাসু
( ঘুম নেই )

সীমান্তে আজ আমি প্রহরী |
অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রান্ত ক’রে
আজ এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছি------
স্বদেশের সীমানায় |

ধূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী,
স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে
নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো
দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে :
-----ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও |

আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক,
হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল,
রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ,
আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি |
আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ,
স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ,
চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠি :
কিছুতেই বুঝি না কী ক’রে এড়াব তাকে ?

কী ক’রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক ?
যুদ্ধ শেষ | মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি,
চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া,
প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল,
গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক,
রাত্রে চাঁদ ওঠে :  আমার চোখে ঘুম নেই |

তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে,
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে |
কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে
কতবার হৃদয় জ্লেছে অনুশোচনার অঙ্গারে
তোমার আর তোমাদের ভাবনায়  |
তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্রের মধ্যে
ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,
ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুসঃহ আঘাতে
বার বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব |
আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্রে |
জানি না আজো, আছ কি নেই,
দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে
জানি না তাও |

তবু লিখছি তোমাকে আজ :  লিখছি আত্মম্ভর আশায়
ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে |
জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক’রে নেই
মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে ;        
জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে,
মিলিত খুশিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার |
তবু,  একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে
সে তোমার হৃদয় |
যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে ;
পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায় |
আর সামনে নয়,
এবার পেছন ফেরার পালা |

পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,
এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে |
প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক’রে পেলাম কী ? উত্তর তার----
তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়
ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব,
ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র ;
আর নিষ্কন্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা |
আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
ছুরি
( ঘুম নেই )

বিগত শেষ-সংশয় ;   স্বপ্ন  ক্রমে ছিন্ন,
আচ্ছাদন উন্মোচন  করেছে যত ঘৃণ্য,
শঙ্কাকুল শিল্পীপ্রাণ, শঙ্কাকুল কৃষ্টি,
দুর্দিনে অন্ধকারে ক্রমশ খোলে দৃষ্টি |
হত্যা চলে শিল্পীদের, শিল্প আক্রান্ত,
দেশকে যারা অস্ত্র হানে, তারা তো নয় ভ্রান্ত |
বিদেশী--চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদ্-বৃন্তে
সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছি তাই চিনতে |
শিল্পীদের রক্তস্রোতে এসেছে চৈতন্য
গুপ্তঘাতী শত্রুদের করি না আজ গণ্য |
ভুলেছে যারা সভ্য-পথ, সম্মুখীন যুদ্ধ,
তাদের আজ মিলিত মুঠি করুক শ্বাসরুদ্ধ,
শহীদ্-খুন আগুন জ্বালে, শপথ অক্ষুণ্ণ  :
এদেশে অতি শীঘ্র হবে বিদেশী-চর শূন্য |
বাঁচাব দেশ, আমার দেশ, হানবো প্রতিপক্ষ,
এ জনতার অন্ধচোখে আনবো দৃঢ় লক্ষ্য |
বাইরে নয় ঘরেও আজ মৃত্যু ঢালে বৈরী,
এদেশে জন-বাহিনী তাই নিমেষে হয় তৈরি ||


.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
সূচনা
(  ঘুম নেই )

ভারতবর্ষে পাথরের গুরুভার :
এহেন অবস্থাকেই পাষাণ বলো,
প্রস্তরীভূত দেশের নীরবতার
একফোঁটা নেই অশ্রুও সম্বল |

অহল্যা হল এই দেশ কোন্ পাপে
ক্ষুধার কান্না কঠিন পাথরে ঢাকা,
কোনো সাড়া নেই আগুনের উত্তাপে
এ নৈঃশব্দ্য ভেঙেছে কালের চাকা |

ভারতবর্ষ !  কার প্রতীক্ষা করো,
কান পেতে কান শুনেছ পদধ্বনি ?
বিদ্রোহের হবে পাথরেরা থরোথরো,
কে দেখা দেবে লক্ষ প্রাণের খনি ?

ভারতী, তোমার অহল্যারূপ চিনি
রামের প্রতীক্ষাতেই কাটাও কাল,
যদি তুমি পায়ে বাজাও ও--কিঙ্কিনী,
তবে জানি বেঁচে উঠবেই কঙ্কাল  |

কত বসন্ত গিয়েছে অহল্যা গো------
জীবনে ব্যর্থ তুমি বার  বার,
দ্বারে বসন্ত,  একবার শুধু জাগো
দুহাতে সরাও পাষাণের গুরুভার

অহল্যা-দেশ, তোমার মুখের ভাষা
অনুচ্চারিত,  তবু অধৈর্যে ভরা ;
পাষাণ ছদ্মবেশকে ছেঁড়ার আশা
ক্রমশ তোমার হৃদয় পাগল করা |

ভারতবর্ষ, তন্দ্রা ক্রমশ ক্ষয়
অহল্যা ! আজ শাপমোচনের দিন ;
তুষার-জনতা বুঝি জাগ্রত হয়------
গা-ঝাড়া দেবার প্রস্তাব দ্বিধাহীন |


অহল্যা,  আজ কাঁপে কি পাষাণকায় !
রোমাঞ্চ লাগে পাথরের প্রত্যঙ্গে ;
রামের পদস্পর্শ কি লাগে গায় ?
অহল্যা, জেনো আমরা তোমার সঙ্গে ||


.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
অদ্বৈধ
( ঘুম নেই )

নরম ঘুমের ঘোর ভাঙল  ?
দেখ চেয়ে অরাজক রাজ্য ;
ধ্বংস সমুখে কাঁপে নিত্য
এখনো বিপদ অগ্রাহ্য ?

পৃথিবী, এ পুরাতন পৃথিবী
দেখ আজ অবশেষে নিঃস্ব,
স্বপ্ন-অলস যত ছায়ারা
একে একে সকলি অদৃশ্য |

রুক্ষ মরুর দুঃস্বপ্ন
হৃদয় আজকে শ্বাসরুদ্ধ,
অকলা গহন পথে চলতে
জীবন সহসা বিক্ষব্ধ |

জীবন ললিত নয় আজকে
ঘুচেছে সকল নিরাপত্তা,
বিফল স্রোতের পিছটানকে
শরণ করেছে ভীরু সত্তা |

তবু আজ রক্তের নিদ্রা,
তবু ভীরু স্বপ্নের সখ্য :
সহসা চমক লাগে চিত্তে
দুর্জয় হল প্রতিপক্ষ !

নিরুপায় ছিঁড়ে গেল দ্বৈধ
নির্জনে মুখ তোলে অঙ্কুর,
বুঝে নিল উদ্যোগী আত্মা
জীবন আজকে ক্ষণভঙ্গুর |

দলিত হৃদয় দেখে স্বপ্ন
নতন, নতুনতর বিশ্ব,
তাই আজ স্বপ্নের ছায়ারা
একে একে সকলি অদৃশ্য ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মণিপুর        
( ঘুম নেই )

এ আকাশ, এ দিগন্ত, এই মাঠ, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি,        
সহস্র বছর ধ’রে একে আমি জানি পরিপাটি,
জানি এ আমার দেশ অজস্র ঐতিহ্য দিয়ে ঘেরা,
এখানে আমার রক্তে বেঁচে আছে পূর্বপুরুষেরা |
যদিও দলিত দেশ, তবু মুক্তি কথা কয় কানে,
যুগ যুগ আমরা যে বেঁচে থাকি পতনে উথ্বানে !
যে চাষী কেটেছে ধান, এ মাটিতে নিয়েছে কবর,
এখনো আমার মধ্যে ভেসে আসে তাদের খবর |
অদৃশ্য তাদের স্বপ্নে সমাচ্ছন্ন এদেশের ধূলি,
মাটিতে তাদের স্পর্শ, তাদের কেমন ক’রে ভুলি ?
আমার সম্মুখে ক্ষেত, এ প্রান্তরে দয়াস্ত খাটি,
ভালবাসি এ দিগন্ত, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি |
এখানে রক্তের দাগ রেখে গেছে চেঙ্গিস্ , তৈমুর,
সে চিহ্নও মুছে দিল কত উচ্চৈঃশ্রবাদের খুর |
কত যুদ্ধ হয়ে গেছে, কত রাজ্য হয়েছে উজাড়,
উর্বর করেছে মাটি কত দিগ্বিজয়ীর হাড় |
তবুও অজেয় এই শতাব্দীগ্রথিত হিন্দুস্থান,
এরই মধ্যে আমাদের বিকশিত স্বপ্নের সন্ধান |
আজন্ম দেখেছি আমি অদ্ভুত নতুন এক চোখে,
আমার বিশাল দেশ আসমুদ্র ভারতবর্ষকে |
এ ধুলোয় প্রতিরোধ, এ হাওয়ায় ঘুর্ণিত চাবুক,
এখানে নিশ্চিহ্ন  হল কত শত গর্বোদ্ধত বুক |
এ মাটির জন্যে প্রাণ দিয়েছি তো কত যুগ ধ’রে,
রেখেছি মাটির মান কতবার কত যুদ্ধ ক’রে  |
আজকে যখন এই দিক্ প্রান্তে ওঠে রক্ত-ঝড়,
কোমল মাটিতে রাখে শত্রু তার পায়ের স্বাক্ষর,
তখন চিৎকার ক’রে রক্ত বলে ওঠে ‘ধিক্ ধিক্,
এখনো দিল না দেখা দেহে দেহে নির্ভয় সৈনিক !
দাসত্বের ছদ্মবেশ দীর্ণ ক’রে উন্মোচিত হোক
একবার বিশ্বরূপ ---- হে উদ্দাম, হে অধিনায়ক !’
এদিকে উৎকর্ণ দিন, মণিপুর,  কাঁপে  মণিপুর
চৈত্রের হাওয়ায় ক্লান্ত, উৎকন্ঠায় অস্থির দুপুর-----
কবে দেখা দেবে, কবে প্রতীক্ষিত সেই শুভক্ষণ
ছড়াবে ঐশ্বর্য পথে জনতার দুরন্ত যৌবন ?
দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে অতর্কিতে শত্রু তার পদচিহ্ন রাখে-----
এখনো শত্রুকে ক্ষমা ? শত্রু কি করেছে ক্ষমা
.                                 বিধ্বস্ত বাংলাকে ?

আজকের এ মুহূর্তে অবসন্ন শ্মশানস্তব্ধতা,
কেন তাই মনে মনে আমি প্রশ্ন করি সেই কথা |
তুমি কি ক্ষুধিত বন্ধু ?   তুমি কি ব্যাধিতে জরোজরো ?
তা হোক, তবুও তুমি আর এক মৃত্যুকে রোধ করো |
বসন্ত লাগুক আজ আন্দোলিত প্রাণের শাখায়,
আজকে আসুক বেগ এ নিশ্চল রথের চাকায়,
এ মাটি উত্তপ্ত হোক, এ দিগন্তে আসুক বৈশাখ,
ক্ষুধার আগুনে আজ শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক |
শত্রুরা নিয়েছে আজ দ্বিতীয় মৃত্যুর ছদ্মবেশ,
তবু কেন নিরুত্তর প্রাণের প্রাচুর্যে ভরা দেশ ?
এদেশে কৃষক আছে, এদেশে মজুর আছে জানি,
এদেশে বিপ্লবী আছে জনরাজ্যে মুক্তির সন্ধানী |
দাসত্বের ধুলো ঝেড়ে তারা আজ আহ্বান পাঠাক,
ঘোষণা করুক তারা এ মাটিতে আসন্ন বৈশাখ |
তাই এই অবরুদ্ধ স্বপ্নহীন নিবিড় বাতাসে
শব্দ হয়, মনে হয় রাত্রিশেষে ওরা যেন আসে |
ওরা আসে, কান পেতে আমি তার পদধ্বনি শুনি,
মৃত্যুকে নিহত ক’রে ওরা আসে উজ্জ্বল আরুণি,
পৃথিবী ও ইতিহাস কাঁপে আজ অসহ্য আবেগে,
ওদের পায়ের স্পর্শে মাটিতে সোনার ধান, রঙ লাগে মেঘে |
এ আকাশ চন্দ্রাতপ, সূর্য আজ ওদের পতাকা,
মুক্তির প্রচ্ছদপটে ওদের কাহিনী আজ ঢাকা,
আগুন্তুক ইতিহাসে ওরা আজ প্রথম অধ্যায়,
ওরা আজ পলিমাটি অবিরামরক্তের বন্যায় ;
ওদের দুচোখে আজ বিকশিত অভ্যথর্না |
ওদের পতাকা ওড়ে গ্রামে গ্রামে নগরে বন্দরে,
মুক্তির সংগ্রাম সেরে ওরা ফেরে স্বপ্নময় ঘরে ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
দিক্প্রান্তে   
( ঘুম নেই )

ভাঙন নেপথ্যে পৃথিবীতে ;
অদৃশ্য কালের শত্রু প্রচ্ছন্ন জোয়ারে,
অনেক বিপন্ন জীব ক্ষয়িষ্ণু খোঁয়াড়ে
উন্মুখ নিঃশেষে কেড়ে নিতে,
দুর্গম বিষণ্ণ শেষ শীতে |

বীভত্স প্রাণের কোষে কোষে
নিঃশ্ ব্দে ধ্বংসের বীজ নির্দিষ্ট আয়ুতে
পশেছে আঁধার রাত্রে---- প্রত্যেক স্নায়ুতে-----
গোপনে নক্ষত্র গেছে খসে
আরক্তিম আদিম প্রদোষে |
দিনের নীলাভ শেষ আলো
জানাল আসন্ন রাত্রি দুর্লক্ষ্য সংকেতে |
অনেক কাস্তের শব্দ নিঃস্ব ধানক্ষেতে
সেই রাত্রে হাওয়ায় মিলাল :
দিক্ প্রান্তে সূর্য চমকাল ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
চিরদিনের
( ঘুম নেই )

এখানে বৃষ্টিমুখর লাজুক গাঁয়ে
এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা,
সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে
পথ নেই, তবু  এখানে যে পথ হাঁটা  |

জোড়া দীঘি, তার পাড়েতে তালের সারি
দূরে বাঁশঝাড়ে আত্মদানের সাড়,
পচা জল আর মশার অহংকারী
নীরব এখানে অমর কিষাণপাড়া |

এ গ্রামের পাশে মজা নদী বারো মাস
বর্ষায় আজ বিদ্রোহ বুঝি করে,
গোয়ালে পাঠায় ইশারা সবুজ ঘাস
এ গ্রাম নতুন সবুজ ঘাগরা পরে |

রাত্রি এখানে স্বাগত সান্ধ্য শাঁখে
কিষাণকে ঘরে পাঠায় যে আল-পথ ;
বুড়ো বটতলা পরস্পরকে ডাকে
সন্ধ্যা সেখানে জড়ো করে জনমত |

দুর্ভিক্ষের আঁচল জড়ানো গায়ে
এ গ্রামের লোক আজো সব কাজ করে,
কৃষক-বধূরা ঢেঁকিকে নাচায় পায়ে
প্রতি সন্ধ্যায় দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে |

রাত্রি হলেই দাওয়ার অন্ধকারে
ঠাকুমা গল্প শোনায় যে নাতনীকে,
কেমন ক’রে সে আকালেতে গতবার
চলে গেল লোক দিশাহারা দিকে দিকে |

এখানে সকাল ঘোষিত পাখির গানে
কামার, কুমোর, তাঁতী তার কাজে জোটে,
সারাটা দুপুর ক্ষেতের চাষীর কানে
একটানা আর বিচিত্র ধ্বনি ওঠে |

হঠাৎ সেদিন জল আনবার পথে
কৃষক-বধূ সে থমকে তাকায় পাশে,
ঘোমটা তুলে সে দেখে নেয় কোনোমতে,
সবুজ ফসলে সুবর্ণ  যুগ আসে ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*