অনেক স্তব্ধ দিনের এপারে চকিত চতুর্দিক, আজো বেঁচে আছি, মৃত্যুতাড়িত আজো বেঁচে আছি ঠিক | দুলে ওঠে দিন : শপথমুখর কিষাণ শ্রমিকপাড়া, হাজারে হাজারে মাঠে বন্দরে আজকে দিয়েছে সাড়া | জ্বলে আলো আজ, আমাদের হাড়ে জমা হয় বিদ্যুৎ, নিহত দিনের দীর্ঘ শাখায় ফোটে বসন্তদূত | মূঢ় ইতিহাস ; চল্লিশ কোটি সৈন্যের সেনাপতি | সংহত দিন, রুখবে কে এই একত্রীভূত গতি ? জানি আমাদের অনেক যুগের সঞ্চিত স্বপ্নেরা দ্রুত মুকুলিত তোমার দিন ও রাত্রি দিয়েই ঘেরা | তাই হে আদিম, ক্ষতবিক্ষত জীবনের বিস্ময়, ছড়াও প্লাবন, দুঃসহ দিন আর বিলম্ব নয় | সারা পৃথিবীর দুয়ারে মুক্তি, এখানে অন্ধকার, এখানে কখন আসন্ন হবে বৈতরণীর পার ?
চল্লিশ কোটি জনতার জানি আমিও যে একজন, হঠাৎ ঘোষণা শুনেছি : আমার জীবনে শুভক্ষণ এসেছে, তখনি মুছে গেছে ভীরু চিন্তার হিজিবিজি | রক্তে বেজেছে উৎসব, আজ হাত ধরো গান্ধীজী | এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার, এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব আজেয় রাজ্য পার | এসেছে বন্যা, এসেছে মৃত্যু, পরে যুদ্ধের ঝড়, মন্বন্তর রেখে গেছে তার পথে পথে স্বাক্ষর, প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি এবার মুছে নেবে ইতিহাস----- তবু উদ্দাম, মৃত্যু-আহত ফেলি নি দীর্ঘশ্বাস : নগর গ্রামের শ্মশানে শ্মশানে নিহিত অভিজ্ঞান : বহু মৃত্যুর মুখোমুখি দৃঢ় করেছি জয়ের ধ্যান | তাইতোএখানে আজ ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের কাছাকাছি, মনে হয় শুধু তোমারই মধ্যে আমরা যে বেঁচে আছি----- তোমাকে পেয়েছি অনেক মৃত্যু উত্তরণের শেষে, তোমাকে গড়ব প্রাচীর, ধ্বংস-বিকীর্ণ এই দেশে | দিক্ দিগন্ত প্রসারিত হাতে তুমি যে পাঠালে ডাক, তাইতো আজকে গ্রামে ও নগরে স্পন্দিত লাখে লাখ ||
আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ, আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের | হতাশায় স্তব্ধ বাক্য ; ভাষা চাই আমরা নির্বাক, পাঠাব মৈত্রীর বাণী সারা পৃথিবীকে জানি ফের | রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে আমাদের ভাষা যাবে শোনা ভেঙে যাবে রুদ্ধশ্বাস নিরুদ্যম সুদীর্ঘ মৌনতা, আমাদের দুঃখসুখে ব্যক্ত হবে প্রত্যেক রচনা পীড়নের প্রতিবাদে উচ্চারিত হবে সব কথা |
আমি দিব্যচক্ষে দেখি অনাগত সে রবীন্দ্রনাথ : দস্যুতায় দৃপ্তকন্ঠ ( বিগত দিনের ) ধৈর্যের বাঁধন যার ভাঙে দুঃশাসনের আঘাত, যন্ত্রণায় রুদ্ধবাক যে যন্ত্রণা সহায়হীনের | বিগত দুর্ভিক্ষে যার উত্তেজিত তিক্ত তীব্র ভাষা মৃত্যুতে ব্যথিত আর লোভের বিরুদ্ধে খরধার, ধ্বংসের প্রান্তরে বসে আনে দৃঢ় অনাহত আশা ; তাঁর জন্ম অনিবার্য, তাঁকে ফিরে পাবই আবার | রবীন্দ্রনাথের সেই ভুলে যাওয়া বাণী . অকস্মাৎ করে কানাকানি : ‘দামামা ঐ বাজে, দিন বদলের পালা . এল ঝড়ো যুগের মাঝে’ |
নিষ্কম্প গাছের পাতা, রুদ্ধশ্বাস অগ্নিগর্ভ দিন, বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে এ আকাশ, গতিরদ্ধ বায়ু ; আবিশ্ব জিজ্ঞাসা এক চোখে মুখে ছড়ায় রঙিন সংশয় স্পন্দিত স্বপ্ন, ভীত আশা উচ্চারণহীন মেলে না উত্তর কোনো, সমস্যায় উত্তেজিত স্নায়ু | ইতিহাস মোড় ফেরে পদতলে বিধ্বস্ত বার্লিন, পশ্চিম সীমান্তে শান্তি, দীর্ঘ হয় পৃথিবীর আয়ু, দিকে দিকে জয়ধ্বনি, কাঁপে দিন রক্তাক্ত আভায় | রামরাবণের যুদ্ধে বিক্ষত এ ভারতজটায়ু মৃতপ্রায়, যুদ্ধাহত, পীড়নে-দুর্ভিক্ষে মৌনমূক | পূর্বাঞ্চল দীপ্ত ক’রে বিশ্বজন--সমৃদ্ধ সভায় রবীন্দ্রনাথের বাণী তার দাবি ঘোষণা করুক | এবারে নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে কন্ঠে গণ-সংগীতের সুর ; জনতার পাশে পাশে উজ্জ্বল পতাকা নিয়ে হাতে চলুক নিন্দাকে ঠেলে গ্লানি মুছে আঘাতে আঘাতে |
যদিও সে অনাগত, তবু যেন শুনি তার ডাক আমাদেরই মাঝে তাকে জন্ম দাও পঁচিশে বৈশাখ ||
আজকে হঠাৎ সাত-সমুদ্র তেরো নদী পার হতে সাধ জাগে মনে, হায় তবু যদি পক্ষপাতের বালাই না নিয়ে পক্ষীরাজ প্রস্রবণের মতো এসে যেত হঠাৎ আজ----- তাহলে না হয় আকশ বিহার হত সফল, টুকরো মেঘেরা যেতে যেতে ছুঁয়ে যেত কপোল | আক আমি বুঝি দৈত্যদলনে সাগর পার হতাম ; সেখানে দানবের দায়ে সব আঁধার | মত্ত যেখানে দৈত্যে দৈত্যে বিবাদ ভারি ; হানাহানি নিয়ে সুন্দরী এক রাজকুমারী | ( রাজকন্যার লোভ নেই,----লোভ অলঙ্কারে, দৈত্যেরা শুধু বিবস্ত্রা ক’রে চায় তাহারে | ) আমি একজন লুপ্তগর্ব রাজাকর তনয় এত অন্যায় সহ্য করব কোনোমতে নয়----- তাই আমি যেতে চাই সেখানেই যেখানে পীড়ন, যেখানে ঝল্ সে উঠবে আমাক অসির কিরণ |
ভাঙাচোরা এক তলোয়ার আছে, ( নয় দু’ধারী ) তাও হ’ত তবে পক্ষীরাজেরই অভাব ভারি | তাই ভাবি আজ, তবে আমি খুঁজে নেব কৌপীন নেব কয়েকটি বেছে জানা বুলি সৌখীন ||
নীল সমুদ্রে ইশারা------ অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর ছোট ছোট দ্বীপ, আর সূর্যময় দিনের স্তব্ধতা ; নিঃশব্দ দিনের সেই ভীর অন্তঃশীল মত্ততাময় পদক্ষেপ : এ সবের ম্লান আধিপত্য বুঝি আর জীবনের উপর কালের ব্যবচ্ছেদ-ভ্রষ্ট নয় তাই রক্তাক্ত পৃথিবীর ডাকঘর থেকে ডাক এল------ সভ্যতার ডাক নিষ্ঠুর ক্ষুধার্ত পরোয়ানা আমাকে চিহ্নিত ক’রে গেল | আমার একক পৃথিবী ভেসে গেল জনতার প্রবল জোয়ারে | মনের স্বচ্ছতার উপর বিরক্তির শ্যাওলা গভীরতা রচনা করে, আর শঙ্কিত মনের অস্পষ্টতা ইতস্ততঃ ধাবমান | নির্ধারিত জীবনেও মাটির মাশুল পূর্ণতায় মূর্তি চায় ; আমার নিষ্ফল প্রতিবাদ, আরো অনেকের বিরুদ্ধ বিবক্ষা তাই পরাহত হল | কোথায় সেই দূর সমুদ্রের ইশারা আর অন্ধকারের নির্বিরোধ ডাক ! দিনের মুখে মৃত্যুর মুখোস | যে সব মুহূর্ত-পরমাণু গেঁথেছিল অস্থায়ী রচনা, সে সব মুহূর্তে আজ প্রাণের অস্পষ্ট প্রশাখায় অজ্ঞাত রক্তিম ফুল ফোটে ||