নিভৃত  
(ঘুম নেই)

অনিশ্চিত পৃতিবীতে অরণ্যের ফুল
রচে গেল ভুল  ;
তারা তো জানত যারা পরম ঈশ্বর
তাদের বিভিন্ন নয় স্তর,
অনন্তর
তারাই তাদের সৃষ্টিতে
অনর্থক পৃথক দৃষ্টিতে
একই কারুকার্যে নিয়মিত
উত্তপ্ত গলিত
ধাতুদের পরিচয় দিত |
শেষ অধ্যায় এল অকস্মাৎ |
তখন প্রমত্ত প্রতিঘাত
শ্রেয় মেনে নিল ইতিহাস,
অকল্পের পরিহাস
সদূর দিগন্তকোণে সকরুণ বিলাল নিঃশ্বাস |
যেখানে হিমের রাজ্য ছিল,
যেখানে প্রচ্ছন্ন ছিল পশুর মিছিলও
সেখানেও ধানের মঞ্জরী
প্রাণের উত্তাপে ফোটে,  বিচ্ছিন্ন শর্বরী  :
সূর্য-সহচরী !
তাই নিত্যবুভুক্ষিত মন
চিরন্তন
লোভের নিষ্ঠুর হাত বাড়াল চৌদিকে
পৃথিবীকে
একাগ্রতায় নিলো লিখে |
সহসা প্রকম্পিত সুষুপ্ত সত্তায়
কঠিন আঘাত লাগে সুনিরাপত্তায় |
ব্যর্থ হল গুপ্ত পরিপাক,
বিফল চিৎকার তোলে বুভুক্ষার কাক
-------পৃথিবী বিস্ময়ে হতবাক ||

.            ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
বৈশম্পায়ন
( ঘুম নেই )

আকাশের খাপছাড়া ক্রন্দন
নাই আর আষাঢ়ের খেলনা |
নিত্য যে পান্ডুর জড়তা
সাথীহারা পথিকের সঞ্চয় |

রিক্তের বুকভরা নিঃশ্বাস,
আঁধারের বুকফাটা চিৎকার----
এই নিয়ে মেতে আছি আমরা
কাজ নেই হিসেবের খাতাতে |

মিলাল দিনের কোনো ছায়াতে
পিপাসায় আর কূল পাই না ;
হারানো স্মৃতির মৃদু গন্ধে
প্রাণ কভু হয় নাকো চঞ্চল  |

মাঝে মাঝে আনাহূত আহ্বান
আনে কই আলেয়ার বিত্ত ?
শহরের জমকালো খবরে
হাজিরা খাতাটা থাকে শূন্য |

আনমনে জানা পথ চলতে
পাই নাকো মাদকের গন্ধ !
রাত্রিদিনের দাবা চালেতে
আমাদের মন কেন উষ্ণ ?

শ্মশানঘাটেতে ব’সে কখনো
দেখি নাই মরীচিকা সহসা,
তাই বুঝি চিরকাল আঁধারে
আমরাই দেখি শুধু স্বপ্ন  !

বার বার কায়াহীন ছায়ারে
ধরেছিনু বাহুপাশে জড়িয়ে,
তাই আজ গৈরিক মাটিতে
রঙিন বসন করি শুদ্ধ ||

.      ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
নিভৃত
( ঘুম নেই )

বিষণ্ণ রাত, প্রসন্ন দিন আনো
আজ মরণের অন্ধ অনিদ্রায়,
সে অন্ধতায় সূর্যের আলো হানো,
শ্বেত স্বপ্নের ঘোরে যে মৃতপ্রায় |
নিভৃত-জীবন-পরিচর্যায় কাটে
যে দিনের, আজ সেখানে প্রবল দ্বন্দ্ব |
নিরন্ন প্রেম  ফেরে নির্জন হাটে,
অচল চরণ ললাটের নির্বন্ধ ?


জীবন মরণে প্রাণের গভীরে দোলা
কাল রাতে ছিল নিশীথ কসুমগন্ধী,
আজ সূর্যের আলোয় পথকে ভোলো
মনে হয় ভীর মনের দুরভিসন্ধি ||

.                    ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
কবে
( ঘুম নেই )

অনেক স্তব্ধ দিনের এপারে চকিত চতুর্দিক,
আজো বেঁচে আছি, মৃত্যুতাড়িত আজো বেঁচে আছি ঠিক |
দুলে ওঠে দিন :  শপথমুখর কিষাণ শ্রমিকপাড়া,
হাজারে হাজারে মাঠে বন্দরে আজকে দিয়েছে সাড়া |
জ্বলে আলো আজ, আমাদের হাড়ে জমা হয় বিদ্যুৎ,
নিহত দিনের দীর্ঘ শাখায় ফোটে বসন্তদূত |
মূঢ় ইতিহাস ; চল্লিশ কোটি সৈন্যের সেনাপতি |
সংহত দিন, রুখবে কে এই একত্রীভূত গতি ?
জানি আমাদের অনেক যুগের সঞ্চিত স্বপ্নেরা
দ্রুত মুকুলিত তোমার দিন ও রাত্রি দিয়েই ঘেরা |
তাই হে আদিম, ক্ষতবিক্ষত জীবনের বিস্ময়,
ছড়াও প্লাবন, দুঃসহ দিন আর বিলম্ব নয় |
সারা পৃথিবীর দুয়ারে মুক্তি, এখানে অন্ধকার,
এখানে কখন আসন্ন হবে বৈতরণীর পার ?

.                    ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
অলক্ষ্যে
( ঘুম নেই )

আমার মৃত্যুর পর কেটে গেল বত্সর বত্সর ;
ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতির ব্যর্থ প্রচেষ্টাও আজ অগভীর,
এখন পৃথিবী নয় অতিক্রান্ত প্রায়ান্ধ স্থবির :
নিভেছে প্রধূম্রজ্বালা, নিরঙ্কুশ সূর্য অনশ্বর ;
স্তব্ধতা নেমেছে রাত্রে থেমেছে নির্ভীক তীক্ষ্ণস্বর-----
অথবা নিরন্ন দিন, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা ;
উদ্ধত বজ্রের ভয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুর আনাগোনা,
অনন্য মানবসত্তা ক্রমান্বয়ে স্বল্পপরিসর |

গলিত স্মৃতির বাষ্প সেদিনের পল্লব শাখায়
বারম্বার প্রতারিত অস্ফুট কুয়াশা রচনায় ;
বিলুপ্ত বজ্রের ঢেউ নিশ্চিত মৃত্যুতে প্রতিহত |
আমার অজ্ঞাত দিন নগণ্য উদার উপেক্ষাতে
অগ্রগামী শূন্যতাকে লাঞ্ছিত করেছে অবিরত
তথাপি তা প্রস্ফুটিত মৃত্যুর অদৃশ্য দুই হাতে ||

.                    ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মহাত্মাজীর প্রতি

(  ঘুম নেই )

চল্লিশ কোটি জনতার জানি আমিও যে একজন,
হঠাৎ ঘোষণা শুনেছি  :   আমার জীবনে শুভক্ষণ
এসেছে, তখনি মুছে গেছে ভীরু চিন্তার হিজিবিজি |
রক্তে বেজেছে উৎসব, আজ হাত ধরো গান্ধীজী |
এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার,
এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব আজেয় রাজ্য পার |
এসেছে বন্যা, এসেছে মৃত্যু, পরে যুদ্ধের ঝড়,
মন্বন্তর রেখে গেছে তার পথে পথে স্বাক্ষর,
প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি এবার মুছে নেবে ইতিহাস-----
তবু উদ্দাম, মৃত্যু-আহত ফেলি নি দীর্ঘশ্বাস :
নগর গ্রামের শ্মশানে শ্মশানে নিহিত অভিজ্ঞান :
বহু মৃত্যুর মুখোমুখি দৃঢ় করেছি জয়ের ধ্যান |
তাইতোএখানে আজ ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের কাছাকাছি,
মনে হয় শুধু তোমারই মধ্যে আমরা যে বেঁচে আছি-----
তোমাকে পেয়েছি অনেক মৃত্যু উত্তরণের শেষে,
তোমাকে গড়ব প্রাচীর, ধ্বংস-বিকীর্ণ এই দেশে |
দিক্ দিগন্ত প্রসারিত হাতে তুমি যে পাঠালে ডাক,
তাইতো আজকে গ্রামে ও নগরে স্পন্দিত লাখে লাখ ||


.                    ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশে
( ঘুম নেই )

আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ,
আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের |
হতাশায় স্তব্ধ বাক্য ; ভাষা চাই আমরা নির্বাক,
পাঠাব মৈত্রীর বাণী সারা পৃথিবীকে জানি ফের |
রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে আমাদের ভাষা যাবে শোনা
ভেঙে যাবে রুদ্ধশ্বাস নিরুদ্যম সুদীর্ঘ মৌনতা,
আমাদের দুঃখসুখে ব্যক্ত হবে প্রত্যেক রচনা
পীড়নের প্রতিবাদে উচ্চারিত হবে সব কথা |

আমি দিব্যচক্ষে দেখি অনাগত সে রবীন্দ্রনাথ :
দস্যুতায় দৃপ্তকন্ঠ ( বিগত দিনের )
ধৈর্যের বাঁধন যার ভাঙে দুঃশাসনের আঘাত,
যন্ত্রণায় রুদ্ধবাক যে যন্ত্রণা সহায়হীনের |
বিগত দুর্ভিক্ষে যার উত্তেজিত তিক্ত তীব্র ভাষা
মৃত্যুতে ব্যথিত আর লোভের বিরুদ্ধে খরধার,
ধ্বংসের প্রান্তরে বসে আনে দৃঢ় অনাহত আশা ;
তাঁর জন্ম অনিবার্য, তাঁকে ফিরে পাবই আবার |
রবীন্দ্রনাথের সেই ভুলে যাওয়া বাণী
.                অকস্মাৎ করে কানাকানি :
‘দামামা ঐ বাজে,  দিন বদলের পালা
.                এল ঝড়ো যুগের মাঝে’ |

নিষ্কম্প গাছের পাতা, রুদ্ধশ্বাস অগ্নিগর্ভ দিন,
বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে এ আকাশ, গতিরদ্ধ বায়ু ;
আবিশ্ব জিজ্ঞাসা এক চোখে মুখে ছড়ায় রঙিন
সংশয় স্পন্দিত স্বপ্ন, ভীত আশা উচ্চারণহীন
মেলে না উত্তর কোনো, সমস্যায় উত্তেজিত স্নায়ু |
ইতিহাস মোড় ফেরে পদতলে বিধ্বস্ত বার্লিন,
পশ্চিম সীমান্তে শান্তি, দীর্ঘ হয় পৃথিবীর আয়ু,
দিকে দিকে জয়ধ্বনি, কাঁপে দিন রক্তাক্ত আভায় |
রামরাবণের যুদ্ধে বিক্ষত এ ভারতজটায়ু
মৃতপ্রায়, যুদ্ধাহত, পীড়নে-দুর্ভিক্ষে মৌনমূক |
পূর্বাঞ্চল দীপ্ত ক’রে বিশ্বজন--সমৃদ্ধ সভায়
রবীন্দ্রনাথের বাণী তার দাবি ঘোষণা করুক |
এবারে নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর
বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে কন্ঠে গণ-সংগীতের সুর ;
জনতার পাশে পাশে উজ্জ্বল পতাকা নিয়ে হাতে
চলুক নিন্দাকে ঠেলে গ্লানি মুছে আঘাতে আঘাতে |

যদিও সে অনাগত, তবু যেন শুনি তার ডাক
আমাদেরই মাঝে তাকে জন্ম দাও পঁচিশে বৈশাখ ||

.                    ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
পরিশিষ্ট
( ঘুম নেই )

অনেক উল্কার স্রোত বয়েছিল হঠাৎ প্রত্যুষে,
বিনিদ্র তারার বক্ষে পল্লবিত মেঘ
ছুঁয়েছিল রশ্মিটুকু প্রথম আবেগে |
অকস্মাৎ কম্পমান অশরীরী দিন,
রক্তের বাসরঘরে বিবর্ণ মৃত্যুর বীজ
ছড়াল আসন্ন রাজপথে |
তবু স্বপ্ন নয় :
গোধূলির প্রত্যহ ছায়ায়
গোপন স্বাক্ষর সৃষ্টি কক্ষচ্যূত গ্রহ-উপবনে :
দিগন্তের নিশ্চল আভাস
ভস্মীভূত শ্মশানক্রন্দনে,
রক্তিম আকাশচিহ্ন সবেগে প্রস্থান করে
যূথ ব্যঞ্জনায়  |

নিষিদ্ধ কল্পনাগুলি বন্ধ্যা তবু
অলক্ষ্যে প্রসব করে অব্যক্ত যন্ত্রণা,
প্রথম যৌবন তার রক্তময় রিক্ত জয়টীকা
স্তম্ভিত জীবন হতে নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন ক’রে দিল  |
তারপর :
প্রান্তিক যাত্রায়
অতৃপ্ত রাত্রির স্বাদ,
বাসর শয্যায়
অসম্বৃত দীর্ঘশ্বাস
বিস্মরণী সুরাপানে নিত্য নিমজ্জিত
স্বগত জাহ্নবীজলে |
তৃষ্ণার্ত কঙ্কাল
অতীত অমৃত পানে দৃষ্টি হানে কত !
সর্বগ্রাসী প্রলব্ধ চিতার অপবাদে
সভয়ে সন্ধান করে ইতিবৃত্ত দগ্ধপ্রায় মনে |
প্রেতাত্মার প্রতিবিম্ব বার্ধক্যের প্রকম্পনে লীন,
অনুর্বর জীবনের সূর্যোদয় :
ভষ্মশেষ চিতা |
কুজ্ঝটিকা মূর্ছা গেল আলোক সম্পাতে,
বাসনা-উদ্ গ্রীব চিন্তা
উন্মুখ ধ্বংসের আর্তনাদে |

সরীসৃপ বন্যা যেন জড়তার স্থির প্রতিবাদ,
মানবিক অভিযানে নিশ্চিন্ত উষ্ণীষ !
প্রচ্ছন্ন অগ্ন্যুৎপাতে সংজ্ঞাহীন মেরুদন্ড-দিন
নিতান্ত ভঙ্গুর, তাই উদ্যত সৃষ্টির ত্রাসে কাঁপে :
পণ্যভারে জর্জরিত পাথেয় সংগ্রাম,
চকিত হরিণদৃষ্টি অভুক্ত মনের পুষ্টিকর :
অনাসক্ত চৈতন্যের অস্থায়ী প্রয়াণ |
অথবা দৈবাৎ কোন নৈর্ব্যক্তিক আশার নিঃশ্বাস
নগণ্য অঙ্গারতলে খুঁজেছে অন্তিম |
রুদ্ধশ্বাস বসন্তের আদিম প্রকাশ,
বিপ্রলব্ধ জনতার কুটিল বিষাক্ত পরিবাদে
প্রত্যহ লাঞ্ছিত স্বপ্ন,
স্পর্ধিত আঘাত !
সুষুপ্ত প্রকোষ্ঠতলে তন্দ্রাহীন দ্বৈতাচারী নর
নিজেরে বিবষ্ট করে উত্সারিত ধূমে,
অদ্ভুত ব্যাধির হিমছায়া
দীর্ণ করে নির্যাতিত শুদ্ধ কল্পনাকে ;
সদ্যমৃত-পৃথিবীর মানুষের মতো
প্রত্যেক মানবমনে একই উত্তাপ অবসাদে |
তবুও শার্দুলমন অন্ধকারে সন্ধ্যার মিছিলে
প্রথম বিস্ময়দৃষ্টি মেলে ধরে বিষাক্ত বিশ্বাসে |

বহ্নিমান তপ্তশিখা উন্মেষিত প্রথম স্পর্ধায়-----
বিষকন্যা পৃথিবীর চক্রান্তে বিহ্বল
উপস্থিত প্রহরী সভ্যতা |
ধূসর অগ্নির পিন্ড :  উত্তাপবিহীন
স্তিমিত মত্ততাগুলি স্তব্ধ নীহারিকা,
মৃত্তিকার ধাত্রী অবশেষে ||

.                    ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মীমাংসা
( ঘুম নেই )

আজকে হঠাৎ সাত-সমুদ্র তেরো নদী
পার হতে সাধ জাগে মনে, হায় তবু যদি
পক্ষপাতের বালাই না নিয়ে পক্ষীরাজ
প্রস্রবণের মতো এসে যেত হঠাৎ আজ-----
তাহলে না হয় আকশ বিহার হত সফল,
টুকরো মেঘেরা যেতে যেতে ছুঁয়ে যেত কপোল |
আক আমি বুঝি দৈত্যদলনে সাগর পার
হতাম ;  সেখানে দানবের দায়ে সব আঁধার |
মত্ত যেখানে দৈত্যে দৈত্যে বিবাদ ভারি ;
হানাহানি নিয়ে সুন্দরী এক রাজকুমারী |
( রাজকন্যার লোভ নেই,----লোভ অলঙ্কারে,
দৈত্যেরা শুধু বিবস্ত্রা ক’রে চায় তাহারে | )
আমি একজন লুপ্তগর্ব রাজাকর তনয়
এত অন্যায় সহ্য করব কোনোমতে নয়-----
তাই আমি যেতে চাই সেখানেই যেখানে পীড়ন,
যেখানে ঝল্ সে উঠবে আমাক অসির কিরণ |

ভাঙাচোরা এক তলোয়ার আছে, ( নয় দু’ধারী )
তাও হ’ত তবে পক্ষীরাজেরই অভাব ভারি |
তাই ভাবি আজ, তবে আমি খুঁজে নেব কৌপীন
নেব কয়েকটি বেছে জানা বুলি সৌখীন ||


.                    ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
অবৈধ
( ঘুম নেই )

আজ মনে হয় বসন্ত আমার জীবনে এসেছিল
উত্তর মহাসাগরের কূলে
আমার স্বপ্নের ফুলে
তারা কথা কয়েছিল
.        অস্পষ্ট পুরনো ভাষায় |
অস্ফুট স্বপ্নের ফুল
অসহ্য সূর্যের তাপে
অনিবার্য ঝরেছিল
.        মরেছিল নিষ্ঠুর প্রগল্ ভ হতাশায় |
হঠাৎ চমকে ওঠে হাওয়া
সেদিন আর নেই----
নেই আর সূর্য-বিকিরণ
আমার জীবনে তাই ব্যর্থ হল বাসন্তীমরণ !
শুনি নি স্বপ্নের ডাক :
থেকেছি আশ্চর্য নির্বাক
বিন্যস্ত করেছি প্রাণ বুভুক্ষার হাতে |
সহসা একদিন
আমার দরজায় নেমে এল
নিঃশব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা |
সেইদিন সন্তের পাখি
উড়ে গেল
যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত !

আজ মনে হয়
হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুরে,
কী ক’রে সম্ভব হল
আমার রক্তকে ভালবাসা !
সূর্যের কুয়াশা
এখনো কাটে নি
ঘোচে নি অকাল দুর্ভাবনা |
মুহূর্তের সোনা
এখনো সভয়ে ক্ষয় হয়,
এরই মধ্যে হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুর
কঠিন কাস্তেতে দেয় সুর,
অন্যমনে এ কী দুর্ঘটনা-------
হেমন্তেই বসন্তের প্রস্তাব রটনা ||

.                    ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
১৯৪১ সাল
( ঘুম নেই )

নীল সমুদ্রে ইশারা------
অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর ছোট ছোট দ্বীপ,
আর সূর্যময় দিনের স্তব্ধতা ;
নিঃশব্দ দিনের সেই ভীর অন্তঃশীল
মত্ততাময় পদক্ষেপ :
এ সবের ম্লান আধিপত্য বুঝি আর
জীবনের উপর কালের ব্যবচ্ছেদ-ভ্রষ্ট নয়
তাই রক্তাক্ত পৃথিবীর ডাকঘর থেকে
ডাক এল------
সভ্যতার ডাক
নিষ্ঠুর ক্ষুধার্ত পরোয়ানা
আমাকে চিহ্নিত ক’রে গেল |
আমার একক পৃথিবী
ভেসে গেল জনতার প্রবল জোয়ারে |
মনের স্বচ্ছতার উপর বিরক্তির শ্যাওলা
গভীরতা রচনা করে,
আর শঙ্কিত মনের অস্পষ্টতা
ইতস্ততঃ ধাবমান |
নির্ধারিত জীবনেও মাটির মাশুল
পূর্ণতায় মূর্তি চায় ;
আমার নিষ্ফল প্রতিবাদ,
আরো অনেকের বিরুদ্ধ বিবক্ষা
তাই পরাহত হল |
কোথায় সেই দূর সমুদ্রের ইশারা
আর অন্ধকারের নির্বিরোধ ডাক !
দিনের মুখে মৃত্যুর মুখোস |
যে সব মুহূর্ত-পরমাণু
গেঁথেছিল অস্থায়ী রচনা,
সে সব মুহূর্তে আজ
প্রাণের অস্পষ্ট প্রশাখায়
অজ্ঞাত রক্তিম ফুল ফোটে ||

.         ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
রোম : ১৯৪৩
( ঘুম নেই )

ভেঙেছে সাম্রাজ্যস্বপ্ন,  ছত্রপতি হয়েছে উধাও ;
শৃঙ্খল গড়ার দুর্গ ভূমিসাৎ বহু শতাব্দীর |
‘সাথী, আজ দৃঢ় হাতে হাতিয়ার নাও’------
রোমোর প্রত্যেক পথে ওঠে ডাক ক্রমশ অস্থির |
উদ্ধত ক্ষমতালোভী দস্যুতার ব্যর্থ পরাক্রম,
মুক্তির উত্তপ্ত স্পর্শে প্রকম্পিত যুগ যুগ অন্ধকার রোম |
হাজার বছর ধ’রে দাসত্ব বেঁধেছে বাসা রোমের দেউলে,
দিয়েছে অনেক রক্ত রোমের শ্রমিক-----
তাদের শক্তির হাওয়া মুক্তির দুয়ার দিল খুলে,
আজকে রক্তাক্ত পথ ;  উদ্ভাসিত দিক |
শিল্পী আর মজুরের বহু পরিশ্রম
একদিন গড়েছিল রোম,
তারা আজ একে একে ভেঙে দেয় রোমের সে সৌন্দর্যসম্ভার,
ভগ্নস্তূপে ভবিষ্যৎ মুক্তির প্রচার |
রোমের বিপ্লবী হৃৎস্পন্দনে ধ্বনিত
মুক্তির সশস্ত্র ফৌজ আসে অগণিত,
দুচোখে সংহার-স্বপ্ন, বুকে তীব্র ঘৃণা
শত্রুকে বিধ্বস্ত করা যেতে পারে কিনা
রাইফেলের মুখে এই সংক্ষিপ্ত জিজ্ঞাসা |
ষদিও উদ্বেগ মনে, তবু দীপ্ত আশা------
পথে পথে জনতার রক্তাক্ত উথ্বান,
বিস্ফোরণে বিস্ফোরণে ডেকে ওঠে বান |

ভেঙে পড়ে দস্যুতার,  পশুতার প্রথম প্রাসাদ
বিক্ষুদ্ধ অগ্ন্যুৎপাতে উচ্চারিত শোষণের বিরপদ্ধে জেহাদ |
যে উদ্ধত একদিন দেশে দেশে দিয়েছে শৃঙ্খল
আবিসিনিয়ার চোখে আজ তার সে দম্ভ নিষ্ফল |
এদিকে ত্বরিত সূর্য রোমের আকাশে
যদিও কুয়াশাঢাকা আকাশের নীল,
তবুও বিপ্লবী জানে, সোভিয়েট পাশে ||

.         ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
জনরব
( ঘুম নেই )

পাখি সব করে রব,  রাত্রি শেষ ঘোষণা  চৌদিকে,
ভোরের কাকলি শুনি ;  অন্ধকার হয়ে আসে ফিকে,
আমারও ঘরেও রুদ্ধ অন্ধকার , স্পষ্ট নয় আলো,
পাখিরা  ভোরের বার্তা অকস্মাৎ আমাকে শোনালো |
স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি, অন্ধকারে খাড়া করি কান-----
পাখিদের মাতামাতি, শুনি মুখরিত ঐকতান ;
আজ এই রাত্রিশেষে বাইরে পাখির কলরবে
রুদ্ধ ঘরে ব’সে ভাবি, হয়তো কিছ বা শুরু হবে,
হয়তো এখনি কোনো মুক্তিদূত দুরন্ত রাখাল
মুক্তির অবাধ মাঠে নিয়ে যাবে জনতার পাল ;
স্বপ্নের কুসুমকলি হয়তো বা ফুটেছে কাননে ,
আমি কি খবর রাখি ?  আমি বদ্ধ থাকি গৃহকোণে,
নির্বাসিত মন নিয়ে চিরকাল অন্ধকারে বাসা,
তাইতো মুক্তির স্বপ্ন আমাদের নিতান্ত দুরাশা |
জন-পাখিদের কন্ঠে তবুও আলোর অভ্যর্থনা,
দিকে দিকে প্রতিদিন অবিশ্রান্ত শুধু যায় শোনা ;
এরা তো নগণ্য জানি, তুচ্ছ ব’লে ক’রে থাকি ঘৃণা,
আলোর থবর এরা কি ক’রে যে পায় তা জানি না |
এদের মিলিত সরে কেন যেন বুক ওঠে দুলে,
অকস্মাৎ পূর্বদিকে মনের জানালা দিই খুলে :
হঠাৎ বন্দর ছাড়া বাঁশি বুঝি বাজায় জাহাজ,
চকিতে আমার মনে বিদ্যুৎ বিদীর্ণ হয় আজ |
অদূরে হঠাৎ বাজে কারখানার পাঞ্চজন্যধ্বনি,
দেখি দলে দলে লোক ঘুম ভেঙে ছুটেছে তখনি,
মনে হয়, যদি বাজে মুক্তি-কারখানার তীব্র শাঁখ
তে কি হবে না জমা সেখানে জনতা লাখে লাখ ?
জন-পাখিদের গানে মুখরিত হবে কি আকাশ ?
-----ভাবে নির্বাসিত মন, চিরকাল অন্ধকারে বাস |

পাখিদের মাতামাতি : বুঝি মুক্তি নয় অসম্ভব,
যদিও ওঠে নি সূর্য, তবু আজ শুনি জনরব ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
রৌদ্রের গান
( ঘুম নেই )

এখানে সূর্য ছড়ায় অকৃপণ
দুহাতে তীব্র সোনার মতন মদ,
যে সোনার মদ পান ক’রে ধান ক্ষেত
দিকে দিকে তার গড়ে তোলে জনপদ |
ভারতী ! তোমার লাবণ্য দেহ ঢাকে
রৌদ্র তোমার পরায় সোনার হার,
সূর্য তোমার শকায় সবুজ চুল
প্রেয়সী, তোমার কতো না অহংকার |

সারাটা বছর সূর্য এখানে  বাঁধা
রোদে ঝলসায় মৌন পাহাড় কোনো,
অবাধ রৌদ্রে তীব্র দহন ভরা
রৌদ্রে জ্বলুক তোমার আমার মনও |

বিদেশকে আজ ডাকো রৌদ্রে ভোজে
মঠো মুঠো দাও কোষাগার-ভরা সোনা,
প্রান্তর বন ঝলমল করে রোদে
কী মধুর আহা রৌদ্রে প্রহর গোনা  !

রৌদ্রে কঠিন ইস্পাত উজ্জ্বল
ঝকমক করে ইশারা যে তার বুকে,
শূন্য নীরব মাঠে রৌদ্রের প্রজা
স্তব করে জানি সূর্যের সম্মুখে |

পথিক-বিরল রাজপথে সূর্যের
প্রতিনিধি হাঁকে আসন্ন কলরব,
মধ্যাহ্নের কঠোর ধ্যানের শেষে
জানি আছে এক নির্ভয় উত্সব |

তাইতো এখানে সূর্য তাড়ায় রাত
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘভয়ে আজ ভীত ?
কৌতুকছলে এ মেঘ দেখায় ভয়,
এ ক্ষণিক মেঘ কেটে যাবে নিশ্চিত |

সূর্য, তোমায় আজকে এখানে ডাকি-----
দুর্বল মন, দুর্বলতর কায়া,
আমি যে পুরোনো অচল দীঘির জল
আমার এ বুকে জাগাও প্রতিচ্ছায়া ||


.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
দেওয়ালী
( ঘুম নেই )

শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-কে

তোর সেই ইংরাজীতে দেওয়ালীর শুভেচ্ছা কামনা
পেয়েছি, তবুও আমি নিরুত্সাহে আজ অন্যমনা,
আমার নেইকো সুখ, দীপান্বিতা লাগে নিরুত্সব,
রক্তের কুয়াশা চোখে, স্বপ্নে দেখি শব আর শব |
এখানে শুয়েই আমি কানে শুনি আর্তনাদ খালি,
মুমূর্ষু কলকাতা কাঁদে, কাঁদে ঢাকা, কাঁদে নোয়াখালী,
সভ্যতাকে পিষে ফেলে সাম্রাজ্য ছড়ায় বর্বরতা :
এমন দুঃসহ দিনে ব্যর্থ লাগে শুভেচ্ছার কথা ;
তবু তোর রঙচঙে সুমধুর চিঠির জবাবে
কিছু আজ বলা চাই, নইলে যে প্রাণের অভাবে
পৃথিবী শুকিয়ে যাবে, ভেসে যাবে রক্তের প্লাবনে |
যদিও সর্বদা তোর শুভ আমি চাই মনে মনে,
তবুও নতুন ক’রে আজ চাই তোর শান্তিসুখ,
মনের আঁধারে তোর শত শত প্রদীপ জ্বলুক,
এ দুর্যোগ কেটে যাবে রাত আর কতক্ষণ থাকে ?
আবার সবাই মিলবো প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের ডাকে,
আমার ঐশ্বর্য নেই, নেই রঙ, নেই রোশনাই------
শুধু মাত্র ছন্দ আছে, তাই দিয়ে শুভেচ্ছা পাঠাই ||

.                  ***************     

.                                                                        
ঘুম নেই-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*