অতি কিশোরের ছড়া
(  মিঠেকড়া )

তোমরা আমায় নিন্দে ক’রে দাও না যত গালি,
আমি কিন্তু মাখছি আমার গালেতে চুনকালি,
কোন কাজটাই পারি নাকো বলতে পারি ছড়া,
পাশের পড়া পড়ি না ছাই পড়ি ফেলের পড়া |
তেতো ওষুধ গিলি নাকো, মিষ্টি এবং টক
খাওয়ার দিকেই জেনো আমার চিরকালের সখ |
বাবা-দাদা সবার কাছেই গোঁয়ার এবং মন্দ,
ভালো হয়ে থাকার সঙ্গে লেগেই আছে দ্বন্দ্ব |
পড়তে ব’সে থাকে আমার পথের দিকে চোখ,
পথের চেয়ে পথের লোকের দিকেই বেশী ঝোঁক |
হুলের কেয়ার কি নাকো মধুর জন্যে ছুটি,
যেখানে ভিড় সেখানেতেই লাগাই চুটোছুটি |
পন্ডিত ও বিজ্ঞজনের দেখলে মাথা নাড়া,
ভাবি উপদেশের ষাঁড়ে করলে বুঝি তাড়া |
তাইতো ফিরি ভয়ে ভয়ে, দেখলে পরে তর্ক,
বুঝি কেবল গোময় সেটা, ---- নয়কো মধুপর্ক |
ভুল করি ভাই যখন তখন, শোধরাবার আহ্লাদে
খেয়ালমতো কাজ ক’রে যাই,  কষ্ট পাই কি সাধে ?
সোজাসুজি যা হয় বুঝি,  হায় অদৃষ্ট চক্র !
আমার কথা বোঝে না কেউ, পৃথিবীটা বক্র  ||



.            ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
এক যে ছিল
( মিঠেকড়া )

এক যে ছিল আপনভোলা কিশোর,
ইস্কুলে তার ভাল লাগত না,
সহ্য হত না পড়াশুনার ঝামেলা
আমাদের চলতি লেখাপড়া সে শিখল না কোনোকালেই,
অথচ সে ছাড়িয়ে গেল সারা দেশের সবটুকু পান্ডিত্যকে |
কেমন ক’রে ?  সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না ||


বড়মানুষীর মধ্যে গরীবের মতো মানুষ,
তাই বড় হয়ে সে বড় মানুষ না হয়ে
.                মানুষ হিসেবে হল অনেক বড় |
কেমন ক’রে ?  সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না ||


গানসাধার বাঁধা আইন সে মানে নি,
অথচ স্বর্গের বাগান থেকে সে চুরি ক’রে আনল
.                তোমার আমার গান |
কবি সে, ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল না ছোট বয়সে,
অথচ শিল্পী ব’লে সে-ই পেল শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের সম্মান |
কেমন ক’রে  ?  সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না  ||


মানুষ হল না ব’লে যে ছিল তার দিদির আক্ষেপের বিষয়,
অনেক দিন, অনেক বিদ্রূপ যাকে করেছে আহত ;
সে-ই একদিন চমক লাগিয়ে করল দিগ্বিজয় |
কেউ তাকে বলল,  “বিশ্বকবি”, কেউ বা “কবিগুরু”
উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চারিদিক করল প্রণাম |
তাই পৃথিবী আজো অবাক হয়ে তাকিয়ে বলছে :
কেমন ক’রে ?    সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না,
এ প্রশ্নের জবা তোমাদের মতো আমিও খুঁজি ||

.            ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
ভেজাল
( মিঠেকড়া )

ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভোজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায় !
ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা,
‘কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হ্যায় ফয়দা |’
ভেজাল পোশাক ভেজাল খাবার,  ভেজাল লোকের ভাবনা,
ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা |
ভেজাল কথা----- বাংলাতে ইংরাজী ভেজাল চলছে,
ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে |
‘খাঁটি জিনিস’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে,
‘ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে |
কলিতে ভাই ‘ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই,
ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নাই ||


.                  ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
গোপন খবর
(  মিঠেকড়া )

শোনো একটা গোপন খবর দিচ্ছি আমি তোমায়,
কলকাতাটা যখন খাবি খাচ্ছিল রোজ বোমায়,
সেই সময়ে একটা বোমা গড়ের মাঠের ধারে,
মাটির ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে ছিল এক্কেবারে,
অনেক দিনের ঘটনা তাই ভুলে গেছ্ ল লোকে,
মাটির ভেতর ছিল তাইতো দেখে নি কেউ চোখে,
অনেক বর্ষা কেটে গেল,  গেল অনেক মাস,
যুদ্ধ থামায় ফেলল লোকে স্বস্তির নিঃশ্বাস |
হঠাৎ সেদিন একলা রাতে গড়ের মাঠের ধারে,
বেড়িয়ে ফেরার সময় হঠাৎ চমকে উঠি : আরে !
বৃষ্টি পেয়ে জন্মেছে এক লম্বা বোমার গাছ,
তারই  মাথায় দেথা যাচ্ছে চাঁদের আলোর নাচ,
গাছের ডালে ঝুলছে কেবল বোমা-ই সারি সারি,
তাই না দেখে ভড়কে গিয়ে ফিরে এলাম বাড়ি |
পরের দিনই সকাল বেলা গেলাম সে ময়দানে,
হায়রে! -- গাছটা চুরি গেছে - কোথায় কে তা জানে
গাছটা ছিল |  গড়ের মাঠে খুঁজতে আজো ঘুরি,
প্রমাণ আছে অনেক, কেবল গাছটা গেছে চুরি ||

.                  ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
জ্ঞানী
( মিঠেকড়া )

বরেনবাবু মস্ত জ্ঞানী, মস্ত বড় পাঠক,
পড়েন তিনি দিনরাত্তির গল্প এবং নাটক,
কবিতা আর উপন্যাসের বেজায় তিনি ভক্ত,
ডিটেক্ টিভের কাহিনীতে গরম করেন রক্ত ;   
জানেন তিনি দর্শন আর নানা রকম বিজ্ঞান
জ্যোতিষশাস্ত্র জানেন তিনি,  তাইতো আছে দিক্-জ্ঞান ;
ইতিহাস আর ভূগোলেতে বেজায় তিনি দক্ষ,---
এসব কথা ভাবলেই তাঁর ফুলতে থাকে বক্ষ |
সব সময়েই পড়েন তিনি, সকাল থেকে সন্ধ্যে,
ছুটির দিনে পড়েন তিনি,  পড়েন        পুজোর বন্ধে |
মাঝে মাঝে প্রকাশ করেন গূঢ় জ্ঞানের তত্ত্ব
বিদ্যাখানা জাহির করেন বরেন্দ্রনাথ দত্ত :
হঠাৎ ঢুকে রান্না ঘরে বলেন,  ওসব কী রে ?
ভাইঝি গীতা হেসে বলেন, ওসব কালো জিরে |
বরেনবাবু রেগে বলেন, জিরে তো হয় সাদা,
তিলও কালো, জিরেও কালো ?  পেয়েছিস কি গাধা ?
রান্না করার সময় কেবল পুড়িয়ে হাজার লঙ্কা,
হনুমতী হয়েছিস তুই, হচ্ছে আমার শঙ্কা |
হঠাৎ ছোট্ট খোকাটিকে কাঁদতে দেখে, দত্ত
খোলেন বিরাট বইয়ের পাতা নামটি “মনস্তত্ত্ব” |
খুঁজতে খুঁজতে বরেনবাবু হয়ে গেলেন সারা----
বুঝলেননা, কেন খোকা মাথায় করছে পাড়া |
হঠাৎ এসে ভাইঝি গীতা দুধের বাটি নিয়ে,
খাইয়ে দিয়ে পাঁচ মিনিটে দিল ঘুম পাড়িয়ে |
বরেনবাবু ভাবেন, খোকার কেমনতর ধারা,
আধ ঘন্টার চেঁচামেচি পাঁচ মিনিটেই সারা ?
বরেনবাবুর কাছে আরো বিরাট একটি ধাঁধা,
হলদে চালের রঙ কেন হয় ভাত হলে পর সাদা ?
পাথর বাটির গরম জিনিস ঠান্ডা হয় তা জানি,
পাহাড় দেশে গরম কেন এমন ছটফটানি ?
পথ চলতে ভেবে এসব ভিজে ওঠেন ঘামে,
মানিকতলা যেতে চাপেন ধর্মতলার ট্রামে |
বরেনবাবু জানেন কিন্তু নানা রকম বিজ্ঞান,
জ্যোতিষশাস্ত্র জানেন তিনি তাইতো এমন দিক্-জ্ঞান ||


.                  ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মেয়েদের পদবী
( মিঠেকড়া )

মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী,
অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি ;
‘আ’কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার
চেষ্টা হাসির |   তাই ভূমিকা ছড়ার |
‘গুপ্ত’ ‘গুপ্তা’ হয় মেয়েদের নামে,
দেখেছি অনেক চিঠি পোস্টকার্ড, খামে |
সে নিয়মে যদি আজ ‘ঘোষ’ হয় ‘ঘোষা’,
তা হলে অনেক মেয়ে করবেই গোসা,
‘পালিত’  ‘পালিতা’ হলে ‘পাল’ হবে ‘পালা’
নির্ঘাৎ বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা ;
‘মল্লিক’  ‘মল্লিকা’ ,  ‘দাস’ হলে ‘দাসা’
শোনাবে পদবীগুলো অতিশয় খাসা ;
‘কর’ যদি ‘করা’ হয়  ‘ধর’ হয় ‘ধরা’,
মেয়েরা দেখবে এই পৃথিবীটা ----- “সরা” |
‘নাগ’ যদি ‘নাগা’ হয়  ‘সেন’ হয় ‘সেনা’,
বড়োই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা ||

.                  ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
বিয়েবাড়ির মজা
( মিঠেকড়া )

বিয়ে বাড়ি : বাজছে সানাই, বাজছে নানন বাদ্য
একটি ধারে তৈরি হচ্ছে নানারকম খাদ্য ;
হৈ-চৈ আর চেঁচামেচি, আসছে লুচির গন্ধ,
আলোয় আলোয় খুশি সবাই, কান্নাকাটি বন্ধ,
বাসরঘরে সাজছে ক’নে, সকলে উৎফুল্ল ,
লোকজনকে আসতে দেখে কর্তার মুত খুলল :
“আসুন, আসুন --- বসুন সবাই, আজকে হলাম ধন্য,
যৎসামান্য এই আয়োজন আপনাদেরই জন্য
মাংস, পোলাও, চপ-কাটলেট, লুচি এবং মিষ্টি
খাবার সময় এদের প্রতি দেবেন একটূ দৃষ্টি |”
বর আসে নি, তাই সকলে ব্যস্ত এবং উৎসুক,
আনন্দে আজ বুক সকলের নাচছে কেবল ধক্-ধুক্,
‘হুল’ দিতে তৈরি সবাই, শাঁখ হাতে সূব প্রস্ত্তত,
সময় চলে যাচ্ছে ব’লে মনটা করছে খুঁত-খুঁত |
ভাবছে সবাই কেমন ক’রে বরকে করবে জব্দ ;
হঠাৎ পাওয়া গেল পথের মোড়ে গাড়ির শব্দ :
হুলুধ্বনি উঠল মেতে, শাঁখ বাজলো জোরে,
বরকে সবাই এগিয়ে নিতে গেল পথের মোড়ে,
কোথায় বরের সাজসজ্জা ? কোথায় ফুলের মালা ?
সবাই হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, পালা, পালা, পালা |
বর নয়কো, লাল-পাগড়ী পুলিশ আসছে নেমে |
বিয়েবাড়ির লোকগুলো সব হঠাৎ উঠল ঘেমে,
বললে পুলিশ :  এই কি কর্তা, ক্ষুদ্র আয়োজন ?
পঞ্চাশ জন কোথায় ? এ যে দেখছি হাজার জন !
এমনি ক’রে চাল নষ্ট দুর্ভিক্ষের কালে ?
থানায় চলো, কাজ কি এখন এইখানে গোলমালে ?
কর্তা হলেন কাঁদো-কাঁদো, চোখেতে জল আসে,
গেটের পাশে জড়ো-হওয়া কাঙালীরা হাসে ||

.                  ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
রেশন কার্ড
( মিঠেকড়া )

রঘুবীর একদিন দিতে গিয়ে আড্ডা,
হারিয়ে ফেলল ভুলে রেশেনের কার্ডটা ;
তারপর খোঁজাখুঁজি এখানে ও ওখানে,
রঘু ছুটে এল তার রেশনের দোকানে,
সেখানে বলল কেঁদে, হুজুর, চাই যে আটা-----
দোকানী বলল হেঁকে, চলবে না কাঁদা-কাটা,
হাটে মাঠে ঘাটে যাও, খোঁজো গিয়ে রাস্তায়
ছুটে যাও আড্ডায়, খোঁজো চারিপাশটায় ;
কিংবা অফিসে যাও এ রেশন এলেকার,
আমার মামার পিসে, কাজ করে ছেলে তার,
তার কাছে গেলে পরে সবই ঠিক হয়ে যাবে,
ছ’মাসের মধ্যেই নয়া এক কার্ড পাবে |
রঘুবীর বলে কেঁদে,  ছ’মাস কী করব ?
ছমাস কি উপবাস ক’রে ধুঁকে মরব ?
আমি তার করব কী  ? ---- দোকানী উঠল রেগে-----
যা খুশি তা করো তুমি ---- বলল সে অতি বেগে :
পয়সা থাকে তো খেয়ো হোটেলে কি মেসেতে,
নইলে সটান্ তুমি যেতে পার দেশেতে ||

.                  ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
খাদ্য সমস্যার সমাধান
( মিঠেকড়া )

.            বন্ধু  :
ঘরে আমার চাল বাড়ন্ত
.              তোমার কাছে তাই,
এলাম ছুটে, আমায় কিছু
.               চাল ধার দাও ভাই |


.           মজুতদার :
দাঁড়াও তবে, বাড়ির ভেতর
.              একটু ঘুরে আসি,
চালের সঙ্গে ফাউও পাবে
.              ফুটবে মুখে হাসি |


.           মজুতদার :
এই নাও ভাই, চালকুমড়ো,
.           আমায় খাতির করো,
চালও পেলে কুমড়ো পেলে
.            লাভটা হল বড় ||


.                  ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
পুরনো ধাঁধা
( মিঠেকড়া )

বলতে পার বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে ?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে ?
বড়মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি,
গরীবরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি ?
বলতে পার ধনীর বাড়ি তৈরি যারা করছে,
কুঁড়েঘরেই তারা কেন মাছির মতো মরছে ?
ধনীর মেয়ের দামী পুতুল হরেক রকম খেলনা,
গরীব মেয়ে পায় না আদর, সবার কাছে ফ্যালনা |
বলতে পার ধনীর মুখে যারা যোগায় খাদ্য,
ধনীর পায়ের তলায় তারা থাকতে কেন বাধ্য ?
‘হিং-টিং-ছট্’ প্রশ্ন এসব, মাথার মধ্যে কামড়ায়,
বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায় ||

.                  ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
ব্ল্যাক--মার্কেট
( মিঠেকড়া )

হাত করে মহাজন, হাত করে জোতদার,
ব্ল্যাক-মার্কেট করে ধনা রাম পোদ্দার
গরীব চাষীকে মেরে হাতখানা পাকালো
বালিগঞ্জেতে বাড়ি খান ছয় হাঁকালো |
কেউ নেই ত্রিভুবনে, নেই কিছু অভাবও
তবু ছাড়ল না তার লোক-মারা স্বভাবও |
একা থাকে, তাই হরি চাকরটা রক্ষী
ত্রিসীমানা মাড়ায় না তাই কাক-পক্ষী |
বিশ্বে কাউকে রাম কাছে পেতে চান না,
হরিই বাজার করে, সে-ই করে রান্না |
এমনি ক’রেই বেশ কেটে যাচ্ছিল কাল,
হঠাৎ হিসেবে রাম দেখলেন গোলমাল,
বললেন চাকরকে  : কিরে ব্যাটা কি ব্যাপার ?
এত টাকা লাগে কেন বাজারেতে রোজকার ?
আলু তিন টাকা সের ? পটল পনেরো আনা ?
ভেবেছিস বাজারের কিছু বুঝি নেই জানা ?
রোজ রোজ চুরি তোর ? হতভাগা, বজ্জাত !
হাসছিস ? এক্ষুণি ভেঙে দেব সব দাঁত |
খানিকটা চুপ ক’রে বলল চাকর  হরি :
আপনারই দেখাদেখি ব্ল্যাক-মার্কেট করি ||

.                  ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
ভালখাবার
( মিঠেকড়া )

ধনপতি পাল, তিনি জমিদার মস্ত ;
সূর্য রাজ্যে তাঁর যায় নাকো অস্ত
তার ওপর ফুলে উঠে কারখানা-ব্যাঙ্কে
আয়তনে হারালেন মোটা কোলা ব্যাঙকে |
সবার “হুজুর” তিনি, সকলের কর্তা,
হাজার সেলাম পান দিনে গড়পরতা |
সদাই পাহারা দেয় বাইরে সেপাই তাঁর,
কাজ নেই, তাই শুধু ‘খাই--খাই’ বাই তাঁর |
এটা খান, সেটা খান, সব লাগে বিদ্ ঘুটে,
টান মেরে ফেলে দেন একটু খাবার খুঁটে ;
খাদ্যে অরুচি তাঁর, সব লাগে তিক্ত,
খাওয়া ফেলে ধমকান শেষে অতিরিক্ত |
দিনরাত চিৎকার : আরো বেশি টাকা চাই,
আরো কিছু তহবিলে জমা হয়ে থাকা চাই |
সব ভয়ে জড়োসড়ো, রোগ বড় প্যাঁচানো  |
খাওয়া ফেলে দিন রাত টাকা ব’লে চ্যাঁচানো |
ডাক্তার কবিরাজ ফিরে গেল বাড়িতে ;
চিন্তা পাকালো জট নায়েবের দাড়িতে |
নায়েব অনেক ভেবে বলে হুজুরের প্রতি :
কী খাদ্য চাই ? কী সে খেতে উত্তম অতি ?
নায়েবের অনুরোধে ধনপতি চারিদিক
দেখে নিয়ে বার কয় হাসলেন ফিক্-ফিক্ ;
তারপর বললেন : বলা ভারি শক্ত,
সব চেয়ে ভালো খেতে গরীবের রক্ত ||


.                  ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
পৃথিবীর দিকে তাকাও
( মিঠেকড়া )

দেখ,  এই মোটা লোকটাকে দেখ
.         অভাব জানে না লোকটা,
যা কিছু পায় সে আঁকড়িয়ে ধরে
.         লোভে জ্বলে তার চোখটা |
মাথা উঁচু করা প্রাসাদের সারি
.         পাথরে তৈরি সব তার,
কত সুন্দর, পুরনো এগুলো !
.         অট্টালিকা এ লোকটার |
উঁচু মাথা তার আকাশ ছুঁয়েছে
.         চেয়ে দেখে না সে নীচুতে,
কত জমির যে মালিক লোকটা
.          বুঝবে না তুমি কিছুতে |
দেখ, চিমনীরা কী ধোঁয়া ছাড়ছে
.          কলে আর কারখানাতে,
মেশিনের কপিকলের শব্দ
.           শোনো, সবাইকে জানাতে |
মজুরেরা দ্রুত খেটেই চলেছে-----
.           খেটে খেটে হল হন্যে ;
ধনদৌলত বাড়িয়ে তুলছে
.           মোটা প্রভুটির জন্যে |
দেখ একজন মজুরকে দেখ
.       ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটছে,
কেনা গোলামের মতোই খাটুনি
.       তাই হাড়ভাঙা খাটছে |
ভাঙা ঘর তার নীচু ও আঁধার
.       স্যাঁতসেঁতে আর ভিজে তা,
এর সঙ্গে কি তুলনা করবে
.      প্রাসাদ বিশ্ব-বিজেতা ?
কুঁড়েঘরের মা সারাদিন খাটে
.      কাজ করে সারা বেলা এ,
পরের বাড়িতে ধোয়া মোছা কাজ-----
.      বাকিটা পোষায় সেলায়ে |
তবুও ভাঁড়ার শূন্যই থাকে,
.      থাকে বাড়ন্ত ঘরে চাল,
বাচ্চা ছেলেরা উপবাস করে
.      এমনি ক’রেই কাটে কাল |
বাবু যত তারা মজুরকে তাড়া
.      করে চোখে চোখে রাখে,
ঘোঁৎ ঘোঁৎ ক’রে মজুরকে ধরে
.      দোকানে যাওয়ার ফাঁকে |
খাওয়ার সময় ভোঁ বাজলে তারা
.      ছুটে আসে পালে পাল,
খায় শুধু কড়কড়ে ভাত আর
.       হয়ত একটু ডাল |
কম-মজুরির দিন ঘুরে এলে
.       খাদ্য কিনতে গিয়ে
দেখে এ টাকায় কিছুই হয় না,
.       বসে গালে হাত দিয়ে |

পুরুত শেখায়, ভগবানই জেনো প্রভু
( সুতরাং চুপ ; কথা বলবে না কভু )
সকলেরই প্রভু---ভালোব আর খারাপের
তাঁরই ইচ্ছায় এ ; চপ কর সব ফের |
শিক্ষক বলে, শোন সব এই দিকে,
চালাকি ক’রো না, ভালো কথা যাও শিখে |
এদের কথায় ভরসা হয় না তবু ?
সরে এসো তবে, দেখ সত্যি কে প্রভু |
ফ্যাকাশে শিশুরা, মুখে শাস্তির ভীতি,
আগের মতোই মেনে চলে সব নীতি |
যদি মজুরেরা কখনো লড়তে চায়
পুলিশ প্রহারে জেলে টেনে নিয়ে যায় |
মজুরের শেষ লড়াইয়ের নেতা যত
এলোমেলো সব মিলায় ইতস্তত----
কারাপ্রাচীরের অন্ধকারের পাশে |
সেখানেও স্বাধীনতার বার্তা আসে |
রাশিয়াই, শুধু রাশিয়া মহান দেশ ;
যেখানে হয়েছে গোলামির দিন শেষ ;
রাশিয়া, যেখানে মজুরের আজ জয়,
লেনিন গড়েছে রাশিয়া  !  কি বিস্ময় !
রাশিয়া যেখানে ন্যায়ের রাজ্য স্থায়ী,
নিষ্ঠুর ‘জার’ যেই দেশে ধরাশায়ী,
সোভিয়েট-‘তারা’ যেখানে দিচ্ছে আলো,
প্রিয়তম সেই মজুরের দেশ ভাল |
মজুরের দেশ, কল-কারখানা,
প্রাসাদ,  নগর,  গ্রাম,
মজুরের খাওয়া, মজুরের হাওয়া,
শুধু মজুরের নাম |
মজুরের ছুটি, বিশ্রাম আর
গরমে সাগর-ধার,
মজুরের কত স্বাধীনতা !  আর
অজস্র অধিকার |
মজুরের ছেলে ইস্কুলে যায়
জ্ঞানের পিপাসা নিয়ে,
ছোট ছোট মন ভরে নেয় শুধু
জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে |
মজুরের সেনা ‘লাল ফৌজ’ দেয়
পাহারা দিন ও রাত,
গরিবের দেশে সইবে না তারা
বড়লোকের হাত |
শান্ত-স্নিগ্ধ, বিবাদ-বিহীন
জীবন সেখানে, তাই
সকলেই সুখে বাস করে আর
সকলেই ভাই-ভাই ;
এক মনেপ্রাণে কাজ করে তারা
বাঁচাতে মাতৃভূমি,
তোমার জন্যে আমি, সেই দেশে,
আমার জন্যে তুমি ||

.        ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
সিপাহী বিদ্রোহ
( মিঠেকড়া )

হঠাৎ দেশে উঠল আওয়াজ ------“ হো--হো, হো--হো, হো--হো”
চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে ------ সিপাহী বিদ্রোহ !
আগুন হয়ে সারাটা দেশ ফেটে পড়ল রাগে,
ছেলে বুড়ো জেগে উঠল নব্বই সন আগে :
একশো বছর গোলামিতে সবাই তখন ক্ষিপ্ত,
বিদেশীদের রক্ত পেলেই তবেই হবে তৃপ্ত !
নানাসাহেব, তাঁতিয়াটোপি, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্ণী----
সবার হাতে অস্ত্র, নাচে বনের পশু-পক্ষী  |
কেবল ধনী, জমিদার, আর আগের রাজার ভক্ত
যোগ দিল, তা নয়কো, দিল গরীবেরাও রক্ত !
সবাই জীবন তচ্ছ করে, মুসলমান ও হিন্দু,
সবাই দিতে রাজি তাদের প্রতি রক্তবিন্দু ;
ইতিহাসের পাতায় তোমরা পড় কেবল মিথ্যে,
বিদেশীরা ভুল বোঝাতে চায় তোমাদের চিত্তে |
অত্যাচারী নয়কো তারা, অত্যাচারীর মুন্ড
চেয়েছিল ফেলতে ছিঁড়ে জ্বালিয়ে অগ্নিকুন্ড |
নানা জাতের নানান সেপাই গরীব এবং মূর্খ :
সবাই তারা বুঝেছিল অধীনতার দুঃখ ;
তাইতো তারা স্বাধীনতার প্রথম লড়াই লড়তে
এগিয়েছিল,  এগিয়েছিল মরণ বরণ করতে !


আজকে যখন স্বাধীন হবার শেষ লড়াইয়ের ডঙ্কা
উঠছে বেজে, কোনোদিকেই নেইকো কোনো শঙ্কা ;
জব্বলপুরে সেপাইদেরও উঠছে বেজে বাদ্য
নতুন ক’রে বিদ্রোহ আজ, কেউ নয়কো বাধ্য,
তখন এঁদের স্মরণ করো, স্মরণ করো নিত্য---
এঁদের নামে, এঁদের পণে শানিয়ে তোলো চিত্ত |
নানাসাহেব, তাঁতিয়াটোপি, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্ণী,
এঁদের নামে, দৃপ্ত কিশোর, খুলব তোমার চোখ কি ?


.                   ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
আজব লড়াই
( মিঠেকড়া )

ফেব্রারী মাসে ভাই, কলকাতা শহরে
ঘটল ঘটনা এক, লম্বা সে বহরে !
লড়াই লড়াই খেলা শুরু হল আমাদের,
কেউ রইল না ঘরে রামাদের শ্যামাদের ;
রাস্তার কোণে কোণে জড়ো হল সকলে,
তফাৎ রইল নাকো আসলে ও নকলে,
শুধু শুনি ‘ধর’  ‘ধর’   ‘মার’ ‘মার’ শব্দ
যেন খাঁটি যুদ্ধ এ, মিলিটারী জব্দ |
বড়রা কাঁদুনে গ্যাসে কাঁদে, চোখ ছল ছল
হাসে ছিঁচকাঁদুনেরা বলে,  ‘সব ঢাল জল’ |
ঐ বুঝি ওরা সব সঙ্গীন উঁচোলো,
ভয় নেই, যত হোক বেয়নেট ছুঁচোলো,
ইঁট-পাটকেল দেখি রাখে এরা তৈরি,
এইবারে যাবে কোথা বাছাধন বৈরী  !
ভাবো বুঝি ছোট ছেলে, একেবারে বাচ্চা  !
এদের হাতেই পাবে শিক্ষাটা আচ্ছা ;
ঢিল খাও, তাড়া খাও, পেট ভরে কলা খাও,
গালাগালি খাও আর খাও কানমলা খাও |
জালে ঢাকা গাড়ি চড়ে বীরত্ব কি যে এর
বুঝবে কে, হরদম সামলায় নিজেদের |
বার্মা-পালানো সব বীর এরা বঙ্গে
যুদ্ধ করছে ছোট ছেলেদের সঙ্গে ;
ঢিলের ভয়েতে ওরা চালায় মেশিনগান,
“বিশ্ববিজয়ী”  তাই রাখে জান, বাঁচে মান |
খালি হাত ছেলেদের তেড়ে গিয়ে করে খুন ;
সাবাস !  সাবাস  ! ওরা খেয়েছে রাজার নুন |

ডাংগুলি খেলা নয়, গুলির সঙ্গে খেলা,
রক্ত-রাঙানো পথে দু পাশে ছেলের মেলা ;
দুর্দম খেলা চলে, নিষেধে কে কান দেয় ?
ও--বাড়ি ও ও--পাড়ার কালো, ছোটু প্রাণ দেয় |
স্বচক্ষে দেখলাম বস্তির আলী জান,
‘আংরেজ চলা যাও’ বলে ভাই দিল প্রাণ |

এমন বিরাট খেলা শেষ হল চটপট
বড়দের বোকামিতে আজো প্রাণ ছটফট ;
এইবারে আমি ভাই হেরে গেছি খেলাতে,
ফিরে গেছি দাদাদের বকুনির ঠেলাতে ;
পরের বারেতে ভাই শুনব না কারো মানা,
দেবই, দেবই আমি নিজের জীবনখানা ||

.               ***************     

.                                                                        
মিঠেকড়া-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*