পূর্বাভাস
( পূর্বাভাস )

সন্ধ্যার আকাশতলে পীড়িত নিঃশ্বাসে
বিশীর্ণ পান্ডুর চাঁদ ম্লান হয়ে আসে |
বুভুক্ষু প্রেতেরা হাসে শাণিত বিদ্রূপে,
প্রাণ চাই শতাব্দীর বিলুপ্ত রক্তের-----
সুষুপ্ত যক্ষেরা নিত্য কাঁদিছে ক্ষুধায়
ধূর্ত দাবাগ্নি আজ জ্বলে চুপে চুপে,
প্রমত্ত কস্তুরীমৃগ ক্ষুব্ধ চেতনায়
বিপন্ন করুণ ডাকে তোলে আর্তনাদ |
ব্যর্থ আজ শব্দভেদী বাণ----
সহস্র তির্যক্ শৃঙ্গ করিছে বিবাদ-----
জীবন-মৃত্যুর সীমানায় |
.                  লাঞ্ছিত সম্মান
ফিরে চায় ভীরু-দৃষ্টি দিয়ে  |
দুর্বল তিতিক্ষা আজ দুর্বাশার তেজে
স্বপ্ন মাঝে উঠেছে বিষিয়ে |

দূর পূর্বাকাশে,
বিহ্বল বিষাণ উঠে বেজে
মরণের শিরায় শিরায় |
মুমূর্যু বিবর্ণ যত রক্তহীন প্রাণ -----
বিস্ফারিত হিংস্র-বেদনায়  |
অসংখ্য স্পন্দনে চলে মৃত্যু অভিযান
লৌহের দুয়ারে পড়ে কুটিল আঘাত,
উত্তপ্ত মাটিতে ঝরে বর্ণহীন শোণিত প্রপাত |
সুপ্তোথ্বিত পিরামিড দুঃসহ জ্বালায়
পৈশাচিক ক্রূর হাসি হেসে
বিস্তীর্ণ অরণ্য মাঝে কুঠার চালায় |
কালো মৃত্যু ফিরে যায় এসে ||


.            ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
হে পৃথিবী
( পূর্বাভাস )

হে পৃথিবী, আজিকে বিদায়
এ দুর্ভাগা চায়,
যদি কভু শুধু ভুল ক’রে
মনে রাখো মোরে,
বিলুপ্ত সার্থক মনে হবে
দুর্ভাগার !
.          বিস্মৃত শৈশবে
যে আঁধার ছিল চারিভিতে
তারে কি নিভৃতে
আবার আপন ক’রে পাব,
ব্যর্থতার চিহ্ন এঁকে যাব,
স্মৃতির মর্মরে ?
প্রভাতপাখির কলস্বরে
যে লগ্নে করেছি অভিযান,
আজ তার তিক্ত অবসান |
তবু তো পথের পাশে পাশে
প্রতি ঘাসে ঘাসে
লেগেছে বিস্ময় !
সেই মোর জয় ||

.            ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
সহসা
( পূর্বাভাস )

আমার গোপন সূর্য হল অস্তগামী
এপারে মর্মরধ্বনি শুনি,
নিস্পন্দ শবের রাজ্য হতে
ক্লান্ত চোখে তাকাল শকুনি |

গোধূলি আকাশ ব’লে দিল,
তোমার মরণ অতি কাছে,
তোমার বিশাল পৃথিবীতে
এখনো বসন্ত বেঁচে আছে |

অদূরে নিবিড় ঝাউবনে
যে কালো ঘিরেছে নীরবতা,
চোখ তারই দীর্ঘায়িত পথে
অস্পষ্ট ভাষায় কয় কথা |

আমার দিনান্ত নামে ধীরে
আমি তো সুদূর পরাহত,
অশ্বথ্বশাখায় কালো পাখি
দুশ্চিন্তা অবিরত |

সন্ধ্যাবেলা, আজ সন্ধ্যাবেলা
নিষ্ঠুর তমিস্রা ঘনাল কী !
মরণ পশ্চাতে বুঝি ছিল
সহসা উদার চোখাচোখি ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
স্মারক
( পূর্বাভাস  )

আজ রাতেযদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায়
তবুও পড়িবে মনে,
চঞ্চল হাওয়া যদি ফেরে কভু হৃদয়ের আঙিনায়
রজনীগন্ধা বনে,
তবুও পড়িবে মনে |
বলাকার পাখা আজও যদি উড়ে সুদূর দিগঞ্চলে
বন্যার মহাবেগে,
তবুও আমার স্তব্ধ বুকের ক্রন্দন যাবে মেলে
মুক্তির ঢেউ লেগে,
বন্যার মহাবেগে,
বাসরঘরের প্রভাতের মতো স্বপ্ন মিলায় যদি
বিনিদ্র কলরবে
তবুও পথের শেষ সীমাটুকু চিরকাল নিরবধি
পার হয়ে যেতে হবে,
বিনিদ্র কলরবে |
মদিরাপাত্র শুষ্ক যখন উত্সবহীন রাতে
বিষণ্ণ অবসাদে
বুঝি বা তখন সুপ্তির তৃষা ক্ষুব্ধ নয়নপাতে
অস্থির হয়ে কাঁদে,
বিষণ্ণ অবসাদে |
নির্জন পথে হঠাৎ হাওয়ার আসক্তহীন মায়া
ধূলিরে উড়ায় দূরে,
আমার বিবাগী মনের কোণেতে কিসের গোপন ছায়া
নিঃশ্বাস ফেলে সুরে ;
ধূলিরে উড়ায়ে দূরে |
কাহার চকিত-চাহনি অধীর পিছনের পানে চেয়ে
কাঁদিয়া কাটায় রাতি,
আলেয়ার বুকে জ্যোত্স্নার ছবিসহসা দেখিতে পেয়ে
জ্বালে নাই তার বাতি,
কাঁদিয়া কাটায় রাতি |
বিরহিণী তারা আঁধারের বুকে সূর্যের কভু হায়
দেখেনিকো কোনো ক্ষণে |
আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায়
হয়তো পড়িবে মনে,
রজনীগন্ধা বনে ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
নিবৃত্তির পূর্বে
( পূর্বাভাস )

দুর্বল পৃথিবী কাঁদে জটিল বিকারে,
মৃত্যুহীন ধমনীর জ্বলন্ত প্রলাপ ;
অবরুদ্ধ বক্ষে তার উন্মাদ তড়িৎ ;
নিত্য দেখে বিভীষিকা পূর্ব অভিশাপ |

ভয়ার্ত শোণিত-ছক্ষে নামে কালোছায়া,
রক্তাক্ত ঝটিকা আনে মূর্ত শিহরণ-----
দিক্ প্রান্তে শোকাতুরা হাসে ক্রুর হাসি :
রোগগ্রস্ত সন্তানের অদ্ভুত মরণ |

দৃষ্টিহীন আকাশের নিষ্ঠুর সান্ত্বনা ;
ধূ--ধূ করে চেরাপুঞ্জি----সহিষ্ণু হৃদয় |
ক্লান্তিহারা পথিকের অরণ্য ক্রন্দন :
নিশীথে প্রেতের বুকে জাগে মৃত্যুভয় ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
স্বপ্নপথ
( পূর্বাভাস )

আজ রাত্রে ভেঙে গেল ঘুম
চারিদিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম,
তন্দ্রাঘোরে দেখিলাম চেয়ে
অবিরাম স্বপ্নপথ বেয়ে
চলিয়াছে দুরাশার স্রোত,
বুকে তার বহু ভগ্ন পোত |
বিফল জীবন যাহাদের,
তারাই টানিছে তার জের ;
অবিশ্রান্ত পৃথিবীর পথে,
জলে স্থলে আকশে পর্বতে |
একদিন পথে যেতে যেতে
উষ্ণ বক্ষ উঠেছিল মেতে
যাহাদের, তারাই সংঘাতে
মৃত্যুমুখী, ব্যর্থ রক্তপাতে ||


.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
সুতরাং
( পূর্বাভাস )

এত দিন ছিল বাঁধা সড়ক,
আজ চোখে দেখি শুধু নরক !
.    এত আঘাত কি সইবে,
.       যদি না বাঁচি দৈবে  ?
.          চারি পাশে লেগে গেছে মড়ক |
বহুদিনকার উপার্জন,
আজ দিতে হবে বিসর্জন |
.   নিষ্ফল যদি পন্থা  ;
.      সুতরাং ছেঁড়া কন্থা
.         মনে হয় শ্রেয় বর্জন ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
বুদ্বুদ মাত্র
( পূর্বাভাস )

মৃত্যুকে ভুলেছ তুমি তাই,
তোমার অশান্ত মনে বিপ্লব বিরাজে সর্বদাই |
প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মৃত্যুকে স্মরণ ক’রো মনে,
মুহূর্তে মুহূর্তে মিথ্যা জীবন ক্ষরণে,------
তারি তরে পাতা সিংহাসন,
রাত্রি দিন অসাধ্য সাধন |
তবুও প্রচন্ড-গতি জীবনের ধারা,
নিয়ত কালের কীর্তি দিতেছে পাহারা,
জন্মের প্রথম কাল হতে,
আমরা বুদ্বুদ মাত্র জীবনের স্রোতে |
এ পৃথিবী অত্যন্ত কুশলী,
যেখানে কীর্তির নামাবলী,
আমাদের স্থান নেই সেথা------
আমরা শক্তের ভক্ত, নহি তো বিজেতা ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
আলো -- অন্ধকার
( পূর্বাভাস )

দৃষ্টিহীন সন্ধ্যাবেলা শীতল কোমল অন্ধকার
স্পর্স ক’রে গেল মোরে | স্বপনের গভীর চুম্বন,
ছন্দ-ভাঙা স্তব্ধতায় ভ্রান্তি এনে দিল চিরন্তন |
অহর্নিশি চিন্তা মোর বিক্ষুব্ধ হয়েছে ; প্রতিবার
স্নায়ুতে স্নায়ুতে দেখি অন্ধকারে মৃত্যুর বিস্তার |
মুহূর্ত-কম্পিত-আমি বন্ধ করি অলৌকিক গান,
প্রচ্ছন্ন স্বপন মোর আক্ষরিক মিথ্যার পাষাণ ;
কঠিন প্রলুব্ধ চিন্তা নগরীতে নিষ্ফল আমার |
তবু চাই রুদ্ধতায় আলোকের আদিম প্রকাশ,
পৃথিবীর গন্ধ নেই এমন দিবস বারোমাস |
আবার জাগ্রত মোর দুষ্ট চিন্তা নিগূঢ় ইঙ্গিতে ;
ভুঁইচাঁপা সুরভির মরণ অস্তিত্বময় নয়,
তার সাথে কল্পনার কখনো হবে না পরিচয় ;
তবু  যেন আলো আর অন্ধকার মোর চারিভিতে ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
প্রতিদ্বন্দ্বী
( পূর্বাভাস )

গন্ধ এনেছে তীব্র নেশায় ফেনিল মদির,
জোয়ার কি এল রক্ত নদীর ?
নইলে কখনো নিস্তার নেই বন্দীশালায় |
সচরাচর কি সামনা সামনি ধূর্ত পালায় ?
কাজ নেই আর বল্লাল সেন-ই আমলে,
মুক্তি পেয়েছি ধোঁয়াতে নিবিড় শ্যামলে |
তোমাতে আমাতে চিরদিন চলে দ্বন্দ্ব |
ঠান্ডা হাওয়ায় তীব্র বাঁশীর ছন্দ
মনেরে জাগায় সাবধান হুঁশিয়ার !
খুঁজে নিতে হবে পুরাতন হাতিয়ার
পান্ডুর পৃথিবীতে |
আফিঙের ঘোর মেরু-বর্জিত শীতে
বিষাক্ত আর শিথিল আবেষ্টনে
তোমারে স্মরিছে মনে |
সন্ধান করে নিত্য নিভৃত রাতে
প্রতিদ্বন্দ্বী,-----উচ্ছল মদিরাতে ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
আমার মৃত্যুর পর
( পূর্বাভাস )

আমার মৃত্যুর পর থেমে যাবে কথার গুঞ্জন,
বুকের স্পন্দনটুকু মূর্ত হবে ঝিল্লীর ঝংকারে,
জীবনের পথপ্রান্তে ভুলে যাব মৃত্যুর শঙ্কারে,
উজ্জ্বল আলোর চোখে আঁকা হবে আঁধার-অঞ্জন |
পরিচয়ভারে ন্যুজ অনেকের শোকগ্রস্থ মন,
বিস্ময়ের জাগরণে ছদ্মবেশ নেবে বিলাপের
মুহূর্তে বিস্মৃত হবে সব চিহ্ন আমার পাপের |
কিছুকাল সন্তর্পণে ব্যক্ত হবে সবার স্মরণ |
আমার মৃত্যর পর, জীবনের যত অনাদর
লাঞ্ছনার বেদনায়, স্পৃষ্ট হবে প্রত্যেক অন্তর ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
স্বতঃসিদ্ধ
( পূর্বাভাস )

মৃত্যুর মৃত্তিকা ‘পরে ভিত্তি প্রতিকূল------
সেখানে নিয়ত রাত্রি ঘনায় বিপুল ;
সহসা চৈত্রের হাওয়া ছড়ায় বিদায় :
স্তিমিত সূর্যের চোখে অন্ধকার ছায় |
বিরহ-বন্যার বেগে প্রভাতের মেঘ
রাত্রির সীমায় এসে জানায় আবেগ,
ধূসর প্রপঞ্চ-বিশ্ব উন্মুখ আকাশে
অনেক বিপন্ন স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে |
তবু তো প্রাণের মর্মে প্রচ্ছন্ন জিজ্ঞাসা
অজস্র ফুলের রাজ্যে বাঁধে লঘু বাসা ;
রাত্রির বিবর্ণ স্মৃতি প্রভাতের বুকে
ছড়ায় মলিন হাসি নিরর্থ কৌতুকে ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মুহূর্ত ( ক )
( পূর্বাভাস )

এমন মুহূর্ত এসেছিল
একদিন আমার জীবনে
যে মুহূর্তে মনে হয়েছিল
সার্থক ভুবনে বেঁচে থাকা :
কালের আরণ্য পদপাত
ঘটেছিল আমার গুহায় |
জরাগ্রস্ত শীতের পাতারা
উড়ে এসেছিল কোথা থেকে,
সব কিছু মিশে একাকার
কাল-বোশেখীর পদার্পণে !
সেদিন হাওয়ায় জমেছিল
অদ্ভুত রোমাঞ্চ দিকে দিকে ;
আকাশের চোখে আশীর্বাদ,
চুক্তি ছিল আমৃত্য জীবনে |
সে সব মুহূর্তগুলো আজো
প্রাণের অস্পষ্ট প্রশাখায়
ফোটায় সবুজ ফুল,
উড়ে আসে কাব্যের মৌমাছি |
অসংখ্য মহূর্তে গ’ড়ে তোলা
স্বপ্ন-দুর্গ মহূর্তে চুরমার |
আজ কক্ষচ্যুত ভাবি আমি
মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা ;-----
যে মুহূর্ত অদৃশ্য প্লাবনে
টেনে নিয়ে যায় কক্ষান্তরে |
আজ আছি নক্ষত্রের দলে,
কাল জানি মুহূর্তের টানে
ভেসে যাব সূর্যের সভায়,
ক্ষুব্ধ কালো ঝড়ের জাহাজে ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মুহূর্ত ( খ )
( পূর্বাভাস )

মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা
যে মুহূর্ত
তোমার আমার আর অন্য সকলের
মৃত্যুর সূচনা,
যে মুহূর্ত এনে দিল আমার কবিতা
আর তোমার আগ্রহ |
এ মুহূর্তে সূর্যোদয়,
ও মুহূর্তে নক্ষত্রের সভা,
আর এক মুহূর্তে দেখি কালো ঝড়ে
সুস্পষ্ট সংকেত |
অনেক মুহূর্ত মিলে পৃথিবীর
বাড়াল ফসল,
মুহূর্তে মুহূর্তে তারপর
সে ফসলে ঘনালো উচ্ছেদ |


এমন মুহূর্তে এল আমার জীবনে,
যে মুহূর্ত চিরদিন মনে রাখা যায়-----
অথচ আশ্চর্য কথা
নতুন মুহূর্ত আর এক
সে মুহূর্তে ছড়ালো বিষাদ |
অনেক মুহূর্ত গেছে অনেক জীবনে,
যে সব মুহূর্ত মিলে
আমার কাব্যের শূন্য হাতে
ভরে দিত উষ্ণ-দ্বিপ্রহরে
আমার মুহূর্ত কাটে কাব্যরচনার
দুঃসহ চেষ্টায় |
হযতো এ মুহূর্তেই অন্য কোনো কবি
কাব্যের অজস্র প্রেরণায়
উচ্ছ্বসিত, অথচ বাধার
উদ্ধত প্রাচীর মুখোমুখি |
অতএব মুহূর্তকে মনে রাখা ভাল
যে মুহূর্ত বৃথা ক্ষয় হয় |
গোপন মুহূর্ত আজ এক
নিশ্ছিদ্র আকাশে
অবিরাম পূর্বাচল খুঁজে
ক্লান্ত হল অস্ফুট জীবনে,
নিঃসঙ্গ স্বপ্নের আসা-যাওয়া
ধূলিসাৎ---- তাই আজ দেখি,
প্রত্যেক মুহূর্ত অনাগত
মুহূর্তের রক্তিম কপোলে
তলে ধরে সলজ্জ প্রার্থনা ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
তরঙ্গ ভঙ্গ
( পূর্বাভাস )

হে নাবিক, আজ কোন্ সমুদ্রে
.        এল  মহাঝড়,
তারি অদৃশ্য আঘাতে অবশ
.        মরু-প্রান্তর |
এই ভুবনের পথে চলাবার
.        শেষ -সম্বল
ফুরিয়েছে,  তাই আজ নিরুক্ত
.        প্রাণ চঞ্চল |

আজ জীবনেতে নেই অবসাদ !
কেবল ধ্বংস, কেবল বিবাদ------
এই জীবনের একী মহা উত্কর্ষ !
পথে যেতে যেতে পায়ে পায়ে সংঘর্ষ |

.        ২
( ছুটি আজ চাই ছুটি,
চাই আমাদের সকালে বিকালে দুটি
নুন-ভাত, নয় আধপোড়া কিছু রুটি ! )
---- একী অবসাদ ক্লান্তি নেমেছে বুকে,
তাইতো শক্তি হারিয়েছি আজ
.    দাঁড়াতে পারি না রুখে |
বন্ধু, আমরা হারিয়েছি বুঝি প্রাণধারণের শক্তি,
তাইতো নিঠুর মনে হয় এই অযথা রক্তারক্তি |
এর চেয়ে ভাল মনে হয় আজ পুরনো দিন,
আমাদের ভাল পুরনো, চাই না বৃথা নবীন ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
আসন্ন আঁধারে
( পূর্বাভাস )

নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে----
দুনিয়ার ক্লান্তি আজ কোথা  ?
নিঃশব্দে তিমির স্রোত বিরক্ত-বিস্বাদে
প্রগল্ ভ আলোর বুকে ফিরে যেতে চায় |
----তবে কেন কাঁপে ভীরু বুক ?
স্বেদ-সিক্ত ললাটের শেষ বিন্দটুকু
প্রখর আলোর সীমা হতে
বিচ্ছিন্ন করেছে যেন সাহারার নীরব ইঙ্গিতে |
কেঁদেছিল পৃথিবীর বুক |
গোপন নির্জনে
ধাবমান পুঞ্জ পুঞ্জ নক্ষত্রের কাছে
পেয়েছিল অতীত বারতা ?
মেরুদন্ড জীর্ণ তবু বিকৃত ব্যথায়
বার বার আর্তনাদ করে
আহত বিক্ষত দেহ, --- মুমূর্ষ চঞ্চল,
তবুও বিরাম কোথা  ব্যগ্র আঘাতের |

প্রথম পৃথিবী আজ জ্বলে রাত্রিদিন
আবাল্যের সঞ্চিত দাহনে |
চিরদিন দ্বন্দ্ব চলে জোয়ার ভাঁটায় :
আষাঢ়ের ক্ষুব্ধ-ছায়া বসন্তের বুকে
এসে পড়েছিল একদিন-----
উদ্ ভ্রান্ত পৃথিবী তাই ছুটেছে পিছনে
আলোরে পশ্চাতে ফেলি, দূরে ----বহু দূরে
যত দূরে দৃষ্টি যায়----
চেয়ে দেখি ঘিরেছে কুয়াশা |
উড়ন্ত বাতাসে আজ কমেরু কঠিন
কোথা হতে নিয়ে এল জড় অন্ধকার---
-----এই কি পৃথিবী ?
একদিন জ্বলেছিল বুকের জ্বালায়-------
আজ তার শব দেহ নিঃস্পন্দ অসাড় ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
পরিবেশন
( পূর্বাভাস )

সান্ধ্য ভিড় জমে ওঠে রেস্তোঁরার দুর্লভ আসরে,
অর্থনীতি, ইতিহাস, সিনেমার পরিচ্ছন্ন পথে---
খুঁজে ফেরে অনন্তের বিলুপ্ত পর্যায় |
গন্ধহীন আনন্দের অন্তিম নির্যাস
এক কাপ চা-এ আর রঙিন সজ্জায় |
সম্প্রতি নিরব হল ; বিনিদ্র বাসরে
ধূমপান চলে : তবে ভবতরী তাস |
স্মৃতি-ভ্রষ্ট উঞ্ছজীবী চলে কোন মতে |

জড়-ভরতের দল বসে আছে পার্কের বেঞ্চিতে,
পবিত্র জাহ্নবী-তীরে প্রার্থী যত বেকার যুবক |
কতক্ষণ ? গঞ্জনার বড় তীব্র জ্বালা---
বিবাগী প্রাণের তবু গৃহগত টান |
ক্রমে গোঠে সন্ধ্যৈ নামে : অন্তরও নিরালা,
এইবার ফিরে চল, ভাগ্য সবই মিতে ;
দূরে বাজে একটানা রেডিওর গান |
এখনো হয়নি শূণ্য, ক্রমাগত বেড়ে চলে সখ |

ক্ষীণ শব্ দ  ভেসে আসে, আগমনী পশ্চিমা হাওয়ায়,
সুপ্রাচীন গুরুভক্তি আজো আনে উন্মত্ত লালসা |
চুপ করে বসে থাকো অন্ধকার ঘরে এক কোণে :--
রাম আর রাবণের উভয়েরই হাতে তীক্ষ্ণ কশা ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
অসহ্য দিন
( পূর্বাভাস )

অসহ্য দিন ! স্নায়ু উদ্বেল ! শ্লথ পায়ে ঘুরি ইতস্তত
অনেক দুঃখে রক্ত আমার অসংযত  !
মাঝে মাঝে যেন জ্বালা করে এক বিরাট ক্ষত
হৃদয়গত |

ব্যর্থতা বুকে, অক্ষম দেহ, বহু অভিযোগ আমার ঘাড়ে
দিন রাত শুধু চেতনা আমাকে নির্দয় হাতে চাবুক মারে |
এখানে ওখানে, পথে চলতেও বিপদকে দেখি সম্যুদত,
মনে হয় যেন জীবনধারণ বুঝি খানিকটা অসঙ্গত ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
উদ্যোগ
( পূর্বাভাস )

বন্ধু, তোমার ছাড় উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ কর চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ব |
মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে কর ছিন্ন,
একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন |
ঘরে তোল ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখো কাস্তে,
গাও সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে |
আজ দৃঢ় দাঁতে পুঞ্জিত হাতে প্রতিরোধ কর শক্ত,
প্রতি ঘাসে ঘাসে বিদ্যুত্ আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত |
আজকে মজুর হাতুড়ির সুর ক্রমসই করে দৃপ্ত,
আসে সংহতি ; শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত |
ভীরু অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেন আজ উচ্ছেদ্য,
বিপন্ন দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য |
সব প্রস্তুত যুদ্ধের দূত হানা দেয় পূব-দরজায়,
ফেণী ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষিপ্ত জনতা গর্জায় |
বন্ধু, তোমার ছাড় উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ কর চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ব ||

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
পরাভব
( পূর্বাভাস )

হঠাৎ ফাল্গুনী হাওয়া ব্যধিগ্রস্ত কলির সন্ধ্যায় :
নগরে নগররক্ষী পদাতিক পদধ্বনি শুনি ;------
দূরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন,------ মহামারী, অন্তরে বিক্ষোভ----
অবসন্ন বিলাসের সংকুচিত প্রাণ |
ব্যক্তিত্বের গাত্রদাহ  ;  রন্ধ্রহীন স্বধর্ম বিকাশ,
অতীতের ভগ্ননীড় এইবার সুপুষ্ট সন্ধ্যায় |
বণিকের চোখে আজ কী দুরন্ত লোভ ঝ’রে পড়ে,----
বৈশাখের ঝড়ে তারই অস্পষ্ট চেতনা |
ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়-----
নশ্বর পৌষের দিন চারিদিকে ধূর্তের সমতা :
জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন |
গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভাণ,----
প্রকাশ্য ভিক্ষার ঝুলি কালক্রমে অত্যন্ত উদার ;
সংক্রামিত রক্ত-রোগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতে |
শোকাচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন,
পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যুতে,
দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর |
বিজিগীষা ?---- সন্দিহান আগামী দিনেরা :
দৃষ্টিপথ অন্ধকার, ( লাল-সূর্য মুক্তির প্রতীক ?
---- আজ তবে প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর | )


.                  ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
বিভীষণের প্রতি
( পূর্বাভাস )

আমরা সবাই প্রস্তুত আজ, ভীরু পলাতক !
লুপ্ত অধুনা এদেশে  তোমার গুপ্তঘাতক,
হাজার জীবন বিকশিত এক রক্ত-ফুলে,
পথে-প্রান্তরে নতুন স্বপ্ন উঠেছে দুলে |
অভিজ্ঞতার আগুনে শুদ্ধ অতীত পাতক,
এখানে সবাই সংগবদ্ধ, যে নবজাতক |

ক্রমশ এদেশে গুচ্ছবদ্ধ, রক্ত-কুসুম,
ছড়ায় শত্রু-শবের গন্ধ, ভাঙে ভীত ঘুম |
এখানে কৃষক বাড়ায় ফসল মিলিত হাতে,
তোমার স্বপ্ন চূর্ণ করার শপথ দাঁতে,
যদিও নিত্য মূর্খ বাধার ব্যর্থ জুলুম :
তবু শত্রুর নিধনে লিপ্ত বাসনার ধূম |
মিলিত ও ক্ষত পায়ের রক্ত গড়ে লালপথ,
তাইতো লক্ষ মুঠিতে ব্যক্ত দৃঢ় অভিমত |
ক্ষুধিত প্রাণের অক্ষরে লেখা, “প্রবেশ নিষেধ,
এখানে সবাই ভুলেছে দ্বন্দ্ব, ভুলেছে বিভেদ |”
দুর্ভিক্ষ ও শত্রুর শেষ হবে যুগপৎ,
শোণিত ধারার উষ্ণ ঐক্যে ঘনায় বিপদ ||”

.       ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
জাগবার দিন আজ
( পূর্বাভাস )

জাগবার দিন আজ, দুর্দিন চুপি চুপি আসছে ;
যাদের চোখেতে আজো স্বপ্নের ছায়া ছবি ভাসছে------
তাদেরই যে দুর্দিন পরিণামে আরো বেশী জানবে,
মৃত্যুর সঙ্গীন তাদেরই বুকেতে শেল হানবে |
.        আজকের দিন নয় কাব্যের -----
আজকের সব কথা পরিণাম আর সম্ভাব্যের ;
শরতের অবকাশে শোনা যায় আকাশের বাঁশরী,
কিন্তু বাঁশরী বৃথা, জমবে না আজ কোন আসর-ই |
আকাশের প্রান্তে যে মৃত্যুর কালো পাখা বিস্তার----
মৃত্যু ঘরের কোণে, আজ আর নেই জেনো নিস্তার,
মৃত্যুর কথা আজ ভাবতেও পাও বুঝি কষ্ট,
আজকের এই কথা জানি লাগবেই অস্পষ্ট |
.        তবুও তোমার চাই চেতনা,
চেতনা থাকলে আজ দুর্দিন আশ্রয় পেত না,
আজকে যে প্রয়োজনে প্রকৃত দেশপ্রেম অর্জন ;
.        তাই এসো চেয়ে দেখি পৃথ্বী
কোনখানে ভাঙে আর কোনখানে গড়ে তার ভিক্তি |
কোনখানে লাঞ্ছিত মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্ব,
কোনখানে দানবের ‘মরণ-যজ্ঞ’ চলে নিত্য ;
.        পণ করো, দৈত্যের অঙ্গে
হানবো বজ্রাঘাত, মিলবো সবাই এক সঙ্গে;
.        সংগ্রাম শুরু করো মুক্তির,
.        দিন নেই তর্ক ও যুক্তির |
.        আজকে শপথ করো সকলে
বাঁচাব আমার দেশ, যাবে না তা শত্রুর দখলে ;
তাই আজ ফেলে দিয়ে তুলি আর লেখনী,
.        একতাবদ্ধ হও এখনি ||

.                ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
ঘুমভাঙার গান
( পূর্বাভাস )

মাথা তোল তুমি বিন্ধ্যাচল,
.      মোছ উদ্ গত অশ্রুজল
যে গেল সে গেল, ভেবে কি ফল ?
.      ভোল ক্ষত !
তুমি প্রতারিত বিন্ধ্যাচল,
বোজ নি ধূর্ত চতুর ছল,
হাসে যে আকাশচারীর দল,
.        অনাহত |
শোন অবনত বিন্ধ্যাচল,
.       তুমি নও ভীরু বিগত বল
কাঁপে অবাধ্য হৃদয়বল
.        অবিরত |
কঠিন, কঠোর, বিন্ধ্যাচল,
.        অনেক ধৈর্যে আজো অটল
ভাঙো বিঘ্নকে  :  করো শিকল
.        পদাহত |
বিশাল, ব্যাপ্ত বিন্ধ্যাচল,
.       দেখ সূর্যের দর্পানল ;
ভুলেছে তোমার দৃঢ় কবল
.       বাধা যত |
সময় যে হল বিন্ধ্যাচল
.        ছেঁড় আকাশের উঁচু ত্রিপল
দ্রুত বিদ্রোহে হানো উপল
.        শত শত ||


.        ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
হদিশ
( পূর্বাভাস )

আমি সৈনিক,  হাঁটি যুগ থেকে যুগান্তরে
প্রভাতী আলোয়, অনেক ক্লান্ত দিনের পরে,
.       অজ্ঞাত এক প্রাণের ঝড়ে |

বহ শতাব্দী ধরে লাঞ্ছিত, পাই নি ছাড়া
বহ বিদ্রোহ দিয়েছে মনের প্রান্ত নাড়া
.        তবু হতবাক্ দিই নি সাড়া |

আমি সৈনিক, দাসত্ব কাঁধে যুদ্ধে যেতে
দেখেছি প্রাণের উচ্ছাস দূরে ধানের ক্ষেতে
.         তবু কেন যেন উঠি নি মেতে |


কত সান্ত্বনা খুঁজেছি আকাশে গভীর নীলে
শুধু শূন্যতা এনেছে বিষাদ এই নিখিলে
.         মূঢ় আতঙ্ক জন-মিছিলে |


ক্ষতবিক্ষত চলেছি হাজার, তবুও একা
সামনে বিরাট শত্রু পাহাড় আকাশ-ঠেকা
.         কোন সূর্যের পাই নি দেখা |

অনেক রক্ত দিয়েছি বিমূঢ় বিনা কারণে
বিরোধী স্বার্থ করেছি পুষ্ট অযথা রণে ;
.         সঙ্গীবিহীন প্রাণধারণে |


ভীরু সৈনিক করেছি দলিত কত বিক্ষোভ
ইন্ধন চেয়ে যখনি জ্বলেছে কুবেরীর লোভ
.           চঞ্চল দিন ঘোড়ার খুরে |


উঠি উদ্ধত প্রাণের শিখরে, চারিদিকে চাই
এল আহ্বান জন-পুঞ্জের শুনি রোশনাই
.           দেখি ক্রমাগত কাছে উৎরাই |


হাতছানি দিয়ে গেল শস্যের উন্নত শীষ,
.           জনযাত্রায় নতুন হদিশ-----
সহসা প্রাণের সবুজে সোনার দৃঢ় উষ্ণীষ ||

.        ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
দেয়ালিকা
( পূর্বাভাস )

এক

দেয়ালে  দেয়ালে  মনের  খেয়ালে
.          লিখি কথা |
আমি  যে  বেকার,  পেয়েছি লেখার
.          স্বাধীনতা ||


দুই

সকালে বিকালে মনের খেয়ালে
.           ইঁদারায়
দাঁড়িয়ে থাকলে অর্থটা তার
.          কি দাঁড়ায় ?


তিন

কখন বাজল ছ’টা
প্রাসাদে প্রাসাদে ঝল্ সায় দেখি
শেষ সূর্য়ের ছটা-----
স্তিমিত দিনের উদ্ধত ঘনঘটা ||


চার

বেজে চলে রেডিও
সর্বদা গোলমাল করতেই
.         ‘ রেডি’  ও ||


পাঁচ

জাপানী  গো  জাপানী
ভারতবর্ষে আসতে কি শেষ
ধরে গেল হাঁপানী ?


ছয়

জামার্নী  গো জামার্নী
তুমি ছিলে অজেয় বীর
এ কথা আজল আর মানি ?


সাত

হে  রাজকন্যে
তোমার  জন্যে
এ জনারণ্যে
নেইকো ঠাঁই-----
জানাই তাই ||

আট

আঁধিয়ারে কেঁদে কয় সল্ তে :
‘চাইনে চাইনে আমি জ্বলতে ||’

.        ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
প্রথম বার্ষিকী
( পূর্বাভাস )

আরবার ফিরে এল বাইশে শ্রাবণ |
আজ বর্ষশেষ হে অতীত,
.               কোন সম্ভাষণ
জানাব অলক্ষ্য পানে ?
ব্যথাক্ষুব্ধ গানে
.               ঝরাব শ্রাবণ বরিষণ !
দিনে দিনে, তিলে তিলে যে বেদনা
.              উদাস মধুর
.        হয়েছে নিঃশব্দ প্রাণে,
.        ভরেছে বিপুল টানে,
.              তারে আজ দে কোন সুর ?
তোমার ধূসর স্মৃতি, তোমার কাব্যের সুরভিতে
লেগেছে সন্ধ্যার ছোঁওয়া, প্রাণ ভরে দিতে
.        হেমন্তের শিশিরের কণা
.        আমি পারিব না |
প্রশান্ত সূর্যাস্ত পরে দিগন্তের যে রাগ-রক্তিমা,
.        লেগেছে প্রাণের  ‘পরে,
.        সহসা স্মৃতির ঝড়ে
.                মুছিয়া যাবে কী তার সীমা !
তোমার সন্ধ্যার ছায়াখানি
.        কোন পথ হতে মোরে
কোন পথে নিয়ে যাবে টানি’
.        অমর্ত্যের আলোক সন্ধানী
.             আমি নাহি জানি |
একদা শ্রাবণ দিনে গভীর চরণে,
নীরবে নিষ্ঠুর সরণিতে
.        পাদস্পর্শ দিতে
.                ভিক্ষুক মরণে
পেয়েছ পথের মধ্যে দিয়েছ অক্ষয়
.           তব দান,
.        হে বিরাট প্রাণ |
তোমার চরণ স্পর্শে রোমাঞ্চিত পৃথিবীর ধূলি
.        উঠিছে আকুলি’,
আজিও স্মৃতির গন্ধে ব্যথিত জনতা
কহিছে নিঃশব্দ স্বরে একমাত্র কথা,
.        “তুমি হেথা নাই” |
বিস্ময়ের অন্ধকারে মূহ্যমান জলস্থল তাই
আধো তন্দ্রা, আধো জাগরণে
দক্ষিণ হাওয়ায় ক্ষণে ক্ষণে
.        ফেলিছে নিঃশ্বাস |
ক্লাদক্লিষ্ট পৃথিবীতে একী পরিহাস !
তুমি চলে গেছ তবু আজিও বহিছে বারোমাস
.        উদ্দাম বাতাস,
এখনো বসন্ত আসে
.        সকরুণ বিষণ্ণ নিঃশ্বাসে,
এখনো শ্রাবণ ঝরোঝর
.        অবিশ্রান্ত মাতায় অন্তর |
এখনো কদম্ব বনে বনে
লাগে দোলা মত্ত সমীরণে,
.        এখনো উদাসি’
শরতে কাশের ফোটে হাসি |
জীবনে উচ্ছাস, হাসি গান
.        এখনো হয় নি অবসান |
এখনো ফুটিছে চাঁপা হেনা,
.        কিছুই তো তুমি দেখিলে না |
তোমার কবির দৃষ্টি দিয়ে
.        কোনো কিছু দিলে না চিনিয়ে |
এখন আতঙ্ক দেখি পৃথিবীর অস্থিতে মজ্জায়,
.        সভ্যতা কাঁপিছে লজ্জায় ;
স্বার্থের প্রাচীরতলে মানুষের সমাধি রচনা,
.        অযথা বিভেদ সৃষ্টি, হীন প্ররোচনা
.        পরস্পর বিদ্বেষ সংঘাতে.
.                মিথ্যা ছলনাতে-----
.        আজিকার মানুষের জয় ;
প্রসন্ন জীবন মাঝে  বিসর্পিল, বিভীষিকাময়  ||

.        ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
তারুণ্য
( পূর্বাভাস )

হে তারুণ্য, জীবনের প্রত্যেক প্রবাহ
অমৃতের স্পর্শ চায় ;   অন্ধকারময়
ত্রিকালের কারাগৃহ ছিন্ন করি’
উদ্দাম গতিতে বেদনা-বিদ্যুৎ--শিখা
জ্বালাময় আত্মার আকাশে, ঊর্ধ্বমুখী
আপনারে দগ্ধ করে প্রচন্ড বিস্ময়ে |
জীবনের প্রতি পদক্ষেপ তাই বুঝি
ব্যথাবিদ্ধ বিষণ্ণ বিদায়ে | রক্তময়
দ্বিপ্রহরে অনাগত সন্ধ্যার আভাসে
তোমার অক্ষয় বীজ অঙ্কুরিত যবে
বিষ-মগ্ন রাত্রিবেলা কালের হিংস্রতা
কন্ঠরোধ করে অবিশ্বাসে | অগ্নিময়
দিনরাত্রি মোর ;আমি যে প্রভাতসূর্য
স্পর্শহীন অন্ধকারে চৈতন্যের তীরে
উন্মাদ, সন্ধান করি বিশ্বের বন্যায়
সৃষ্টির প্রথম সুর | বজ্রের ঝংকারে
প্রচন্ড ধ্বংসের বার্তা আমি যেন পাই |
মুক্তির পুলক-লুব্ধ বেগে একী মোর
প্রথম স্পন্দন ! আমার বক্ষের মাঝে
প্রভাতের অস্ফুট কাকলি, হে তারণ্য,
রক্তে মোর আজিকার বিদ্যুৎ-বিদায়
আমার প্রাণের কন্ঠে দিয়ে গেল গান ;
বক্ষে মোর পৃথিবীর সুর | উচ্ছসিত
প্রাণে মোর রোমাঞ্চিত আদিম উল্লাস |
আমি যেন মৃত্যুর প্রতীক | তান্ডবের
সুর যেন নৃত্যময় প্রতি অঙ্গে মোর,
সম্মুখীন সৃষ্টির আশ্বাসে |  মধ্যাহ্নের
ধ্যান মোর মুক্তি পেল তোমার ইঙ্গিতে |
তারুণ্যের ব্যর্থ বেদনায় নিমজ্জিত
দিনগুলি যাত্রা করে সম্মুখের টানে |
নৈরাশ্য নিঃশ্বাসে ক্ষত তোমার বিশ্বাস
প্রতিদিন বৃদ্ধ হয় কালের কর্দমে |
হৃদয়ের সূক্ষ্ণ তন্ত্রী সঙ্গীত বিহীন,
আকাশের স্বপ্ন মাঝে রাত্রির জিজ্ঞাসা
ক্ষয় হয়ে যায় | নিভৃত ক্রন্দনেতাই
পরিশ্রান্ত সংগ্রামের দিন | বহ্নিময়
দিনরাত্রি চক্ষে মোর এনেছে অন্তিম |
ধ্বংস হোক, লুপ্ত হোক ক্ষুধিত পৃথিবী
আর সর্পিল সভ্যতা | ইতিহাস
স্তুতিময় শোকের উচ্ছাস, তবু আজ
তারুণ্যের মুক্তি নেই, মুমূর্ষু মানব |
প্রাণে মোর অজানা উত্তাপ অবিরাম
মুগ্ধ করে পুষ্টিকর রক্তের সঙ্কেতে !
পরিপূর্ণ সভ্যতা সঞ্চয়ে আজ যারা
রক্তলোভী বর্ধিত প্রলয় অন্বেষণে,
তাদের সংহার করো মৃতের মিনতি |
অন্ধ তমিস্রার স্রোতে দূরগামী দিন
আসন্ন রক্তের গন্ধে মূর্ছিত সভয়ে |
চলেছে রাত্রির যাত্রী আলোকের পানে
দূর হতে দূরে |  বিফল তারুণ্য-স্রোতে
জরাগ্রস্ত কিশলয় দিন |  নিত্যকার
আবর্তনে তারুণ্যের উদগত উদ্যম
বার্ধক্যের বেলাভূমি ‘পরে অতর্কিতে
স্তব্ধ হয়ে যায় | তবু, হায়রে পৃথিবী,
তারণ্যের মর্মকথা কে বুঝাবে তোরে !
কালের গহ্বরে খেলা করে চিরকাল
বিস্ফোরণহীন | স্তিমিত বসন্তবেগ
নিরুদ্দেশ যাত্রা করে জোয়ারের জলে |
অন্ধকার, অন্ধকার, বিভ্রান্ত বিদায় ;
নিশ্চিত ধ্বংসের পথে ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবী |
বিকৃত বিশ্বের বুকে প্রকম্পিত ছায়া
মরণের, নক্ষত্রের আহ্বানে বিহ্বল
তারুণ্যের হৃৎপিন্ডে বিদীর্ণ বিলাস |
ক্ষুব্ধ অন্তরের জ্বালা, তীব্র অভিশাপ ;
পর্বতের বক্ষমাঝে নির্ঝর-গুঞ্জনে
উত্স হতে ধামান দিক্-চক্রবালে |
সম্মুখের পানপাত্রে কী দুর্বার মোহ,
তবু হায় বিপ্রলব্ধ রিক্ত হোমশিখা !
মত্ততায় দিক্ ভ্রান্তি, প্রাণের মঞ্জরী
দক্ষিণের গুঞ্জরণে নিষ্ঠুর প্রলাপে
অস্বীকার করে পৃথিবীরে | অলক্ষিতে
ভূমিলগ্ন আকাশকুসুম ঝরে যায়
অস্পষ্ট হাসিতে |  তারুণ্যের নীলরক্ত
সহস্র সূর্যের সেরোতে মৃত্যুর স্পর্ধায়
ভেসে যায় দিগন্ত আঁধারে | প্রত্যূষের
কালো পাখি গোধূলির রক্তিম ছায়ায়
আকাশের বার্তা নিয়ে বিনিদ্র তারার
বুকে ফিরে গেল নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় |
দিনের পিপাসু দৃষ্টি, রাত্রি ঝরে
বিবর্ণ পথের চারিদিকে | ভয়ঙ্কর
দিনরাত্রিপ্রলয়ের প্রতিদ্বন্দ্বে লীন ;
তারুণ্যের প্রত্যেক আঘাতে কম্পমান
উর্বর-উচ্ছেদ | অশরীরী আমি আজ
তারুণ্যের তরঙ্গের তলে সমাহিত
উত্তপ্ত শয্যায় | ক্রমাগত শতাব্দীর
বন্দী আমি অন্ধকারে যেন খুঁজে ফিরি
অদৃশ্য সূর্যের দীপ্তি উচ্ছিষ্ট অন্তরে |
বিদায় পৃথিবী আজ, তারুণ্যের তাপে
নিবদ্ধ পথিক-দৃষ্টি উদ্বুদ্ধ আকাশে
সার্থক আমার নিত্য-লুপ্ত পরিক্রমা
ধ্বনিময় অনন্ত প্রান্তরে |  দূরগামী
আমি আজ উদ্বেলিত পশ্চাতের পানে
উদাস উদ্ ভ্রান্ত দৃষ্টি রেখে যাই
সম্মুখের ডাকে | শ্বাশত ভাস্বর পথে
আমার নিষিদ্ধ আয়োজন, হিমাচ্ছন্ন
চক্ষে মোর জড়তার ঘন অন্ধকার |
হে দেবতা আলো চাই, সূর্যের সঞ্চয়
তারুণ্যের রক্তে মোর কী নিঃসীম জ্বালা !
অন্ধকার-অরণ্যের উদ্দাম উল্লাস
লুপ্ত হোক আশঙ্কায় উদ্ধত মৃত্যুতে ||

.            ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
মৃত পৃথিবী
( পূর্বাভাস )

পৃথিবী কি আজ শেষে নিঃস্ব
ক্ষুধাতুর কাঁদে সারা বিশ্ব,
চারিদিকে ঝরে পড়া রক্ত,
জীবন আজকে উত্যক্ত |
আজকের দিন নয় কাব্যের
পরিণাম আর সম্ভাব্যের
ভয় নিয়ে দিন কাটে নিত্য,
জীবনে গোপন-দুর্বৃত্ত  |
তাইতো জীবন আজ রিক্ত,
অলস হৃদয় স্বেদসিক্ত ;
আজকে প্রাচীর গড়া ভিন্ন
পৃথিবী ছড়াবে ক্ষতচিহ্ন |
অগোচরে নামে হিম-শৈত্য,
কোথায় পালাবে মরু দৈত্য ?
জীবন যদিও উৎক্ষিপ্ত,
তবু তো হৃদয় উদ্দীপ্ত,
বোধহয় আগামী কোনো বন্যায়,
ভেসে যাবে আনশন, অন্যায় ||

.            ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*
দুর্মর
( পূর্বাভাস )

হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলা দেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছাসে,
সে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ
জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে |

হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন
জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান,
গত আকালের মৃত্যুকে মুছে
আবার এসেছে বাংলা দেশের প্রাণ |

“হয় ধান নয় প্রাণ” এ শব্দে
সারাদেশ দিশাহারা,
একবার মরে ভুলে গেছে আজ
মৃত্যুর ভয় তারা |

সাবাস, বাংলা দেশ, এ পৃথিবী
আবাক তাকিয়ে রয় :
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয় |

এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে
সোনালি নয়কো, রক্তে রঙিন ধান,
দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে
দাউ দাউ করে বাংলা দেশের প্রাণ ||

.            ***************     

.                                                                        
পূর্বাভাস-র সূচিতে. . .   
.                                                                        
সুকান্ত-র মূল সূচিতে. . .   


মিলনসাগর
*