হে পৃথিবী, আজিকে বিদায় এ দুর্ভাগা চায়, যদি কভু শুধু ভুল ক’রে মনে রাখো মোরে, বিলুপ্ত সার্থক মনে হবে দুর্ভাগার ! . বিস্মৃত শৈশবে যে আঁধার ছিল চারিভিতে তারে কি নিভৃতে আবার আপন ক’রে পাব, ব্যর্থতার চিহ্ন এঁকে যাব, স্মৃতির মর্মরে ? প্রভাতপাখির কলস্বরে যে লগ্নে করেছি অভিযান, আজ তার তিক্ত অবসান | তবু তো পথের পাশে পাশে প্রতি ঘাসে ঘাসে লেগেছে বিস্ময় ! সেই মোর জয় ||
মৃত্যুকে ভুলেছ তুমি তাই, তোমার অশান্ত মনে বিপ্লব বিরাজে সর্বদাই | প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মৃত্যুকে স্মরণ ক’রো মনে, মুহূর্তে মুহূর্তে মিথ্যা জীবন ক্ষরণে,------ তারি তরে পাতা সিংহাসন, রাত্রি দিন অসাধ্য সাধন | তবুও প্রচন্ড-গতি জীবনের ধারা, নিয়ত কালের কীর্তি দিতেছে পাহারা, জন্মের প্রথম কাল হতে, আমরা বুদ্বুদ মাত্র জীবনের স্রোতে | এ পৃথিবী অত্যন্ত কুশলী, যেখানে কীর্তির নামাবলী, আমাদের স্থান নেই সেথা------ আমরা শক্তের ভক্ত, নহি তো বিজেতা ||
আমার মৃত্যুর পর থেমে যাবে কথার গুঞ্জন, বুকের স্পন্দনটুকু মূর্ত হবে ঝিল্লীর ঝংকারে, জীবনের পথপ্রান্তে ভুলে যাব মৃত্যুর শঙ্কারে, উজ্জ্বল আলোর চোখে আঁকা হবে আঁধার-অঞ্জন | পরিচয়ভারে ন্যুজ অনেকের শোকগ্রস্থ মন, বিস্ময়ের জাগরণে ছদ্মবেশ নেবে বিলাপের মুহূর্তে বিস্মৃত হবে সব চিহ্ন আমার পাপের | কিছুকাল সন্তর্পণে ব্যক্ত হবে সবার স্মরণ | আমার মৃত্যর পর, জীবনের যত অনাদর লাঞ্ছনার বেদনায়, স্পৃষ্ট হবে প্রত্যেক অন্তর ||
মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা যে মুহূর্ত তোমার আমার আর অন্য সকলের মৃত্যুর সূচনা, যে মুহূর্ত এনে দিল আমার কবিতা আর তোমার আগ্রহ | এ মুহূর্তে সূর্যোদয়, ও মুহূর্তে নক্ষত্রের সভা, আর এক মুহূর্তে দেখি কালো ঝড়ে সুস্পষ্ট সংকেত | অনেক মুহূর্ত মিলে পৃথিবীর বাড়াল ফসল, মুহূর্তে মুহূর্তে তারপর সে ফসলে ঘনালো উচ্ছেদ |
এমন মুহূর্তে এল আমার জীবনে, যে মুহূর্ত চিরদিন মনে রাখা যায়----- অথচ আশ্চর্য কথা নতুন মুহূর্ত আর এক সে মুহূর্তে ছড়ালো বিষাদ | অনেক মুহূর্ত গেছে অনেক জীবনে, যে সব মুহূর্ত মিলে আমার কাব্যের শূন্য হাতে ভরে দিত উষ্ণ-দ্বিপ্রহরে আমার মুহূর্ত কাটে কাব্যরচনার দুঃসহ চেষ্টায় | হযতো এ মুহূর্তেই অন্য কোনো কবি কাব্যের অজস্র প্রেরণায় উচ্ছ্বসিত, অথচ বাধার উদ্ধত প্রাচীর মুখোমুখি | অতএব মুহূর্তকে মনে রাখা ভাল যে মুহূর্ত বৃথা ক্ষয় হয় | গোপন মুহূর্ত আজ এক নিশ্ছিদ্র আকাশে অবিরাম পূর্বাচল খুঁজে ক্লান্ত হল অস্ফুট জীবনে, নিঃসঙ্গ স্বপ্নের আসা-যাওয়া ধূলিসাৎ---- তাই আজ দেখি, প্রত্যেক মুহূর্ত অনাগত মুহূর্তের রক্তিম কপোলে তলে ধরে সলজ্জ প্রার্থনা ||
হে নাবিক, আজ কোন্ সমুদ্রে . এল মহাঝড়, তারি অদৃশ্য আঘাতে অবশ . মরু-প্রান্তর | এই ভুবনের পথে চলাবার . শেষ -সম্বল ফুরিয়েছে, তাই আজ নিরুক্ত . প্রাণ চঞ্চল |
আজ জীবনেতে নেই অবসাদ ! কেবল ধ্বংস, কেবল বিবাদ------ এই জীবনের একী মহা উত্কর্ষ ! পথে যেতে যেতে পায়ে পায়ে সংঘর্ষ |
. ২ ( ছুটি আজ চাই ছুটি, চাই আমাদের সকালে বিকালে দুটি নুন-ভাত, নয় আধপোড়া কিছু রুটি ! ) ---- একী অবসাদ ক্লান্তি নেমেছে বুকে, তাইতো শক্তি হারিয়েছি আজ . দাঁড়াতে পারি না রুখে | বন্ধু, আমরা হারিয়েছি বুঝি প্রাণধারণের শক্তি, তাইতো নিঠুর মনে হয় এই অযথা রক্তারক্তি | এর চেয়ে ভাল মনে হয় আজ পুরনো দিন, আমাদের ভাল পুরনো, চাই না বৃথা নবীন ||
অসহ্য দিন ! স্নায়ু উদ্বেল ! শ্লথ পায়ে ঘুরি ইতস্তত অনেক দুঃখে রক্ত আমার অসংযত ! মাঝে মাঝে যেন জ্বালা করে এক বিরাট ক্ষত হৃদয়গত |
ব্যর্থতা বুকে, অক্ষম দেহ, বহু অভিযোগ আমার ঘাড়ে দিন রাত শুধু চেতনা আমাকে নির্দয় হাতে চাবুক মারে | এখানে ওখানে, পথে চলতেও বিপদকে দেখি সম্যুদত, মনে হয় যেন জীবনধারণ বুঝি খানিকটা অসঙ্গত ||
আমরা সবাই প্রস্তুত আজ, ভীরু পলাতক ! লুপ্ত অধুনা এদেশে তোমার গুপ্তঘাতক, হাজার জীবন বিকশিত এক রক্ত-ফুলে, পথে-প্রান্তরে নতুন স্বপ্ন উঠেছে দুলে | অভিজ্ঞতার আগুনে শুদ্ধ অতীত পাতক, এখানে সবাই সংগবদ্ধ, যে নবজাতক |
ক্রমশ এদেশে গুচ্ছবদ্ধ, রক্ত-কুসুম, ছড়ায় শত্রু-শবের গন্ধ, ভাঙে ভীত ঘুম | এখানে কৃষক বাড়ায় ফসল মিলিত হাতে, তোমার স্বপ্ন চূর্ণ করার শপথ দাঁতে, যদিও নিত্য মূর্খ বাধার ব্যর্থ জুলুম : তবু শত্রুর নিধনে লিপ্ত বাসনার ধূম | মিলিত ও ক্ষত পায়ের রক্ত গড়ে লালপথ, তাইতো লক্ষ মুঠিতে ব্যক্ত দৃঢ় অভিমত | ক্ষুধিত প্রাণের অক্ষরে লেখা, “প্রবেশ নিষেধ, এখানে সবাই ভুলেছে দ্বন্দ্ব, ভুলেছে বিভেদ |” দুর্ভিক্ষ ও শত্রুর শেষ হবে যুগপৎ, শোণিত ধারার উষ্ণ ঐক্যে ঘনায় বিপদ ||”
জাগবার দিন আজ, দুর্দিন চুপি চুপি আসছে ; যাদের চোখেতে আজো স্বপ্নের ছায়া ছবি ভাসছে------ তাদেরই যে দুর্দিন পরিণামে আরো বেশী জানবে, মৃত্যুর সঙ্গীন তাদেরই বুকেতে শেল হানবে | . আজকের দিন নয় কাব্যের ----- আজকের সব কথা পরিণাম আর সম্ভাব্যের ; শরতের অবকাশে শোনা যায় আকাশের বাঁশরী, কিন্তু বাঁশরী বৃথা, জমবে না আজ কোন আসর-ই | আকাশের প্রান্তে যে মৃত্যুর কালো পাখা বিস্তার---- মৃত্যু ঘরের কোণে, আজ আর নেই জেনো নিস্তার, মৃত্যুর কথা আজ ভাবতেও পাও বুঝি কষ্ট, আজকের এই কথা জানি লাগবেই অস্পষ্ট | . তবুও তোমার চাই চেতনা, চেতনা থাকলে আজ দুর্দিন আশ্রয় পেত না, আজকে যে প্রয়োজনে প্রকৃত দেশপ্রেম অর্জন ; . তাই এসো চেয়ে দেখি পৃথ্বী কোনখানে ভাঙে আর কোনখানে গড়ে তার ভিক্তি | কোনখানে লাঞ্ছিত মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্ব, কোনখানে দানবের ‘মরণ-যজ্ঞ’ চলে নিত্য ; . পণ করো, দৈত্যের অঙ্গে হানবো বজ্রাঘাত, মিলবো সবাই এক সঙ্গে; . সংগ্রাম শুরু করো মুক্তির, . দিন নেই তর্ক ও যুক্তির | . আজকে শপথ করো সকলে বাঁচাব আমার দেশ, যাবে না তা শত্রুর দখলে ; তাই আজ ফেলে দিয়ে তুলি আর লেখনী, . একতাবদ্ধ হও এখনি ||