সূর্যদেব, আজি এই বৈশাখের খরতপ্ত তেজে পৃথিবী উন্মত্ত যবে তুমি এলে সেজে কনক-উদয়াচলে প্রথম আবেগে ফেলিল চরণচিহ্ন, তার স্পর্শ লেগে ধরণী উঠিল কাঁপি গোপন স্পন্দনে সাজাল আপন দেহ পুষ্প ও চন্দনে তব পূজা লাগি | পৃথিবীর চক্ষুদান হল সেই দিন | অন্ধকার অবসান, যবে দ্বার খুলে প্রভাতের তীরে আসি বলিলে, হে বিশ্বলোক তোরে ভালবাসি, তখনি ধরিত্রী তার জয়মাল্যখানি আশীর্বাদসহ তব শিরে দিল আনি---- সস্মিত নয়নে | তারে তুমি বলেছিলে, জানি এ যে জয়মাল্য, মোরে কেন দিলে ? কতবার তব কানে পঁচিশে বৈশাখ সুদূরের তরে শুধু দিয়ে গেল ডাক, তুমি বলেছিলে চেয়ে সম্মুখের পানে “হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে |”
বরণ ( বর্ণনা )
হঠাৎ আলোর আভাস পেয়ে কেঁপে উঠল ভোরবেলা, কোন্ পুলকে, কোন্ অজানা সম্ভাবনায় ? রূদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করে অন্ধকার | শিউলি বকুল ঝ’রে পড়ে শেষ রাত্রির কান্নার মতো, হেমন্ত-ভোরের শিশিরের মতো | অস্পষ্ট হল অন্ধকার; স্বচ্ছ, আরো স্বচ্ছ মৃতপ্রায়ের আগ্রহের মতো পান্ডুর আলো এসে পড়ে আশীর্বাদের মতো ঝরা ফুলের মরা চোখে, শুভ্র কপোলে, ----ঘুমন্ত হাসির মতো তার মায়া | পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা এল উচ্ছ্বেসিত বন্যার বেগে, হাতে তাদের আহরণী-ডালা ; তারা অবাক হয়ে দেখলে একী ! নতুন ফুল ফুটেছে তাদের আঙিনায় রির প্রথম আলো এসে পড়েছে তার মুখে, ওরা বললে, ওতো সূর্যমুখী | পিলু-বারোয়াঁর সুর তখনও রজনীগন্ধার বনে দীর্ঘশ্বাসের মতো সুরভিত-মত্ততায় হা-হা করছে ; কিন্তু তাও গেল মিলিয়ে | শুধু জাগিয়ে দিয়ে গেল হাজার সূর্যমুখীকে | সূর্য উঠল | অচেতন জড়তার বুকে ঠিকরে পড়তে লাগল, বন্ধ জানলায় তার কোমল আঘাত, অজস্র দীপ্তিতে বিহ্বল | পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা ফিরে গেল উজ্জ্বল, উচ্ছল হয়ে বুকে তাদের সূর্যমুখীর অদৃশ্য সুবাস |
মঙ্গলাচরণ ( গান )
ওগো কবি, তুমি আপন ভোলা--- আনিলে তুমি নিথর জলে ঢেউয়ের দোলা, মালিকাটি নিয়ে মোর একী বাঁধিলে অলখ-ডোর | নিবেদিত প্রাণে গোপনে তোমার কী সুর তোলা, জেনেছ তো তুমি সকল প্রাণের নীরব কথা, তোমার বাণীতে আমার মনের এ ব্যাকুলতা পেয়েছ কি তুমি সাঁঝের বেলাতে যখন ছিলাম কাজের খেলাতে তখন কি তুমি এসেছিলে, ছিল যে দুয়ার খোলা ?
আহ্বান ( সমবেত গান )
আমাদের ডাক এসেছে এবার পথে চলতে হবে, ডাক দিয়েছে গগন-রবি ঘরের কোণে কেই বা রবে | ডাক এসেছে চলতে হবে আজ সকালে বিশ্বপথে সবার সাথে সমান তালে, পথের সাথী আমরা রবির সাঁঝ সকালে চলরে সবে | ঘুম থেকে আজ সকালবেলা ওঠ রে ডাক দিল কে পথের পানে ছোট রে, পিছন পানে তাকাস নি আজ চল সমুখে জয়ের বাণী নূতন প্রাতে বল ও-মুখে তোদের চোখে সোনারআলো সফল হয়ে ফুটবে কবে ||
স্তব ( আবৃত্তি )
কবিগুরু আজ মধ্যাহ্নের অর্ঘ্য দিলাম তোমায় সাজায়ে, পৃথিবীর বুকে রচেছ শান্তিস্বর্গ মিলনের সুর বাজায়ে | যুগে যুগে যত আলোক-তীর্থযাত্রী মিলিবে এখানে আসিয়া, তোমার স্বর্গ এনে দেবে মধুরাত্রি তাহাদের ভালবাসিয়া | তারা দেবে নিতি শান্তির জয়মাল্য তোমার কন্ঠে পরায়ে, তচোমার বাণী যে তাহাদের প্রতিপাল্য, মর্মেতে যাবে জড়ায়ে | তুমি যে বিরাট দেবতা শাপভ্রষ্ট ভুলিয়া এসেছ মর্তে ; পৃথিবীর বিষ পান করে নাই এখনো তোমার ওষ্ঠ ঝঞ্ঝা-প্রলয়-আবর্তে | আজিকার এই ধূলিময় মহাবাসরে তোমারে জানাই প্রণতি, তোমনার পূজা কি শঙ্খ ঘন্টা কাঁসরে ? ধূপ-দীপে তব আরতি ? বিশ্বের আজ শান্তিতে অনাসক্তি, সভ্য মানুষ যোদ্ধা, চলেছে যখন বিপুল রক্তারক্তি, তোমারে জানাই শ্রদ্ধা |
অবশেষ ( বর্ণনা )
কিন্তু মধ্যান্হ তো পেরিয়ে যায় সন্ধ্যার সন্ধানে, মেঘের ছায়ায় বিশ্রাম করতে করতে, আকাশের সেই ধূ-ধূ করা তেপান্তরের মাঠ | আর সূর্যও তার অবিরাম আলোকসম্পাত ক’রে ঢলে পড়ল সাঁঝ-গগনে | সময়ের পশ্চাতে বাঁধা সূর্য়ের গতি কী সূর্যের পিছনে বাঁধা সময়ের গতি তা বোঝা যায় না | দিন যায় ভাবীকালকে আহ্বান করতে | একটা দিন আর একটা ঢেউ, তবু দিন যায় সূর্য়ের পিছনে, অন্ধকারে অবগাহন করতে করতে |
যেতে হবে | প্রকৃতির কাছে এই পরাভবের লজ্জায় আর বেদনায় রক্তিম হল সূর্যের মুখ, আর পৃথিবীর লোকেরা ; তাদের মুখ পুব-আকাশের মতো কালো হয়ে উঠল |
মিনতি ( সমবেত গান )
দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে যেও না চলে, অরুণ-আলো কে যে দেবে যাও গো বলে | ফেরো তুমি যাবার বেলা ; সাঁঝ-আকাশে রঙের মেলা---- দেখছ কী কেমন ক’রে আগুন হয়ে উঠল জ্বলে | পুব-গগনের পানে বারেক তাকাও বিরহেরই ছবি কেন আঁকাও আঁধার যেন দৈত্য সম আসছে বেগে, শেষ হয়ে যাক তারা তোমার ছোঁয়াচ লেগে | থামো ওগো, যেও না হয় সময় হলে ||
বেলাশেষে শান্তছায়া সন্ধ্যার আভাসে বিষন্ন মলিন হয়ে আসে, তারি মাঝে বিভ্রান্ত পথিক তৃপ্তিহীন খুঁজে ফেরে পশ্চিমের দিক | পথপ্রান্তে প্রাচীন কদম্বতরুমূলে, ক্ষণতরে স্তব্ধ হয়ে যাত্রা যায় ভুলে | আবার মলিন হাসি হেসে চলে নিরুদ্দেশে | রজনীর অন্ধকারে একটি মলিন দীপ হাতে কাদের সন্ধান করে উষ্ণ অশ্রুপাতে কালের সমাধিতলে | স্মৃতির সঞ্চয় করে জীবন-অঞ্চলে ; মাঝে মাঝে চেয়ে রয় ব্যথা ভরা পশ্চিমের দিকে, নির্নিমিখে | যেথায় পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে অমর অক্ষরে সেথায় কাদের আর্তনাদ বারংবার বৈশাখীর ঝড়ে | আবার সম্মুখপানে যাত্রা করে রাত্রির আহ্বানে | ক্ষীণদীপ উর্বর আলোতে চিরন্তন পথের সংকেত রেখে যায় প্রভাতের কানে | অকস্মাৎ আত্মিস্মৃতির অন্তঃপুরে, ভেসে ওঠে মানসমুকুরে উত্তরকালের আর্তনাদ,---- “ কবিগুরু আমাদের যাত্রা শুরু কালের অরণ্য পথে পথে পরিত্যক্ত তব রাজ-রথে আজি হতে শতবর্ষ আগে অস্ত গোধূলির সন্ধ্যারাগে যে দিগন্ত হয়েছে রক্তিম, সেথা আজ কারো চিত্তবীণা তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বাজে কিনা সে কথা শুধাও ? শুধু দিয়ে যাও ক্ষণিকের দক্ষিণ বাতাসে তোমার সুবাস বাণীহীন অন্তরের অন্তিম আভাস | তাই আজ বাধামুক্ত হিয়া অজস্র উপেক্ষাভরে বিস্মৃতিরে পশ্চাতে ফেলিয়া ছিন্নবাধা বলাকার মতো মত্ত অবিরত, পশ্চাতের প্রভাতের পুষ্-কুঞ্জবনে আজ শূন্য মনে |” তাই চ্চকিত পথিকের মন অকারণ উচ্ছলিত চঞ্চল পবনে অনাগত গগনে গগনে | ক্লান্ত আজ প্রভাতের উৎসবের বাঁশি ; পুরবাসী নবীন প্রভাতে পুরাতন জয়মাল্য হাতে অস্তাচলে পথিকের মুখে মূর্ত হাসি ||
শেষ মিনতি ( গান )
ও কে যায় চলে কথা না বলে, দিও না যেতে তাহারই তরে আসন রেখেছি পেতে | কত কথা আছে তার মনেতে সদাই, তবু কেন রবি কহে আমি চলে যাই ; রামধনু রথে বিদায়ের পথে উঠিল মেতে | রঙে রঙে আজ গোধূলি গগন রঙিন কি হল , বিলাপে মগন | আমি কেঁদে কই যেও না কোথাও , সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও বাড়ায়ে বাহু মরণ-বাহু চাহিছে পেতে ||
আয়োজন ( বর্ণনা )
হঠাৎ বুঝি তোমার রথের সাতটি ঘোড়া উঠল হ্রেষা-রবে চঞ্চল হয়ে, যাবার ডাক শুনি ? অস্তপথ আজ তোমারই প্রত্যাশায় উন্মুখ, হে কবি, কখন তুমি আসবে ? কবে, কখন তুমি এসে দাঁড়ালে অস্তপথের সীমানায়, কেউ জানল না ; এমন কী তুমিও না ! একবার ভেবে দেখেছ কি, হে ভাবুক, তোমার চলমান ঘোড়ার শেষ পদক্ষেপের আঘাতে কেমন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উঠবে আমাদের অন্তরলোক ? তোমার রচিত বাণীর মন্দিরে কোন্ নূতন পূজারী আসবে আজি না, তবু তোমার আসন হবে শূন্য আর তোমার নিত্য-নূতন পাজাপদ্ধতি, অর্ঘ্য-উপাচার আর মন্দিরের বেদী স্পর্শ করবে না | দেউলের ফাটল দিয়ে কোন্ অশ্বথ্ব-তরু চাইবে আকাশ, চাইবে তোমার মন্দিরে তার প্রতিষ্ঠা, জানি না | তবু একদিন তা সম্ভব, তুমিও জানো | সেই দিনকার কথা ভেবে দেখেছ কি, হে দিগন্ত-রবি ? তোমার বেণুতে আজ শেষ সুর কেঁপে উঠল | তুমি যাবে আমাদের মথিত করে | কোন্ মহাদেশের কোন্ আসনে হবে তোমার স্থান ? বিশ্ববীণার তারে আজ কোন্ সুর বেজে উঠেছে, জানো ? সে তোমারই বিদায় বেদনায় সকরুণ ওপারের সুর | এই সুরই চিরন্তন, সত্য এবং শাশ্বত | যুগের পর যুগ সে সুর ধ্বনিত হয়ে আসছে, আবহমানকালের সেই সুর | সৃষ্টি-সুরের প্রত্যুত্তর এই সুরের নাম লয় | তান-লয় নিয়ে তোমার খেলা চলেছে কতকাল, আজ সেই লয়ের তান রণরণিত হচ্ছে কোন্ অদৃশ্য তন্ত্রীতে, জানি না | কোন্ যুগান্তরের পারেও ধ্বনিত হবে সেই সুর কতদূর-------তা কে জানে |
যাত্রা ( আবৃত্তি )
অমৃতলোকের যাত্রী হে অমর কবি, কোন্ প্রস্থানের পথে তোমার একাকী অভিযান | প্রতিদিন তাই নিজেরে করেছ মুক্ত, বিদায়ের নিত্য আশঙ্কায় পৃথ্বীর বন্ধন ভিত্তি নিশ্চিহ্ন করিতে বিপুল প্রয়াস তব দিনে দিনে হয়েছে বর্ধিত | এই হাসি গান, ক্ষণিকের অনিশ্চিত বুদ্বুদের মতো ; নশ্বর জীবন অনন্ত কালের তুচ্ছ কণিকার প্রায় হাসি ও ক্রন্দনে ক্ষয় হয়ে যায় তাই ওরা কিছ নয়, তুমিও জানিতে, ‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন-যৌবন-ধন-মান’, তবু তুমি শিল্পীর তুলিকা নিয়ে করেছ অঙ্কিত সভ্যতার প্রত্যেক সম্পদ, সুন্দরের সুন্দর অর্চনা | বিশ্বপ্রদর্শনী মাঝে উজ্জ্বল তোমার সৃষ্টিগুলি পৃথিবীর বিরাট সম্পদ | স্রষ্টা তুমি, দ্রষ্টা তুমি নূতন পথের | সেই তুমি আজ পথে পথে, প্রয়াণের অস্পষ্টপরিহাসে আমাদের করেছ উন্মাদ | চেয়ে দেখি চিতা তব জ্বলে যায় অসহ্য দাহনে, জ্বলে যায় ধীরে ধীরে প্রত্যেক অন্তর | তুমি কবি, তুমি শিল্পী, তুমি যে বিরাট, অভিনব সবারে কাঁদায়ে যাও চুপি চুপি এ কী লীলা তব ||
বিদায় ( গান )
ঝুলন-পূর্ণিমাতে নীরব নিঠুর মরণ সাথে কে তুমি ওগো মিলন-রাখী বাঁধিলে হাতে ? শ্রাবণদিনে উদাস হাওয়া কাঁদিল এ কী, পথিক রবির চলে যাওয়া চাহিয়া দেখি, ব্যাকুল প্রাণে সজলঘন নয়ন পাতে || বিদায় নিতে চায় কে ওরে বাঁধরে তারে বজ্রডোরে আলোর স্বপন ভেঙেছে মোর, আঁধার যেথায় শ্রাবণ-ভোর ঘুম টুটে মোর সকল-হারা এই প্রভাতে ||