নিপীড়িত মানুষের শিল্পী সুরেশ বিশ্বাস রাজেশ দত্ত
বাংলা গণসংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী সুরেশ বিশ্বাস [ জন্ম ১৯৩৮ (? ) -- মৃত্যু ৩১শে জানুয়ারী,২০০৩ ] আজ বিস্মৃতপ্রায় | যে মানুষটি একদিন গানের টানে ঘর ছেড়েছিলেন, যৌবন থেকে বার্ধক্য সারা জীবনই কেটেছে জীবনযুদ্ধের গান নিয়ে | দুঃসহ দারিদ্র ও চরম অনিশ্চয়তার সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করেছেন জীবনভর | তবু সংগ্রামী প্রত্যয় আর অদম্য মনোবল নিয়ে অক্লান্তভাবে সুদীর্ঘ পথ হেঁটেছেন | কখনও মানুষের মিছিলে, ককনও একাকী | বোহেমিয়ান চরিত্রের আপনভোলা স্বভাবের এই শিল্পী আজীবন ঘুরে বেরিয়েছেন ছন্নছাড়া যাযাবরের মতো তবু কোন চোরাপথের বাঁকে পথ হারান নি | খ্যাতি, যশ, অর্থের মোহে আচ্ছন্ন পথভ্রষ্ট হন নি | জীবন পথের এই পথিক মানুষের ভালোবাসা আর সংগ্রামের অভিজ্ঞতাকেই পাথেয় করেছেন | আপোসহীন ভাবে দৃপ্ত গদসঞ্চারে দু’চোখে সমাজ পরিবর্তনের কাঙ্খিত স্বপ্ন ও বৈপ্লবিক আদর্শকে বুকের ভেতর আগলে রেখে গণসংগীতকে শস্ত্র করে অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছেন | শেষ জীবনে রোগাতুর মানুষটির দিন কেটেছে কালীঘাটের বস্তির একটি ছোট্ট ঘরে |
নিদারুণ অভাবে প্রায় অর্ধাহারে, অনাহারে থেকেছেন | দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সংস্থানের জন্য বহু বিচিত্র পেশায় জীবন নির্বাহ করেছেন | কিন্তু এই সুরসাধক তাঁর সুরের সাধনা থেকে কখনও বিরত হন নি | তাঁর জীবদ্দশায় একটি মাত্র গানের ক্যাসেট বেরিয়েছিল | গণমঞ্চের পরিবেশনায় ‘সুপ্ত আগুন আছে ক্রোধে মিশে’ | এই ক্যাসেটের নয়টি গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়| দুই দশক অতিক্রম করেও এই ক্যাসেটের গণসংগীতগুলো আজও অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল | সেই ক্যাসেটটি এখন দুর্লভ হলেও বিপুল চক্রবর্তী , অসীম গিরি, প্রবীর বল, সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতো এই প্রজন্মের কয়েকজন আদর্শনিষ্ট গণশিল্পীদের গলায় আজও শোনা যায় | তৃতীয় ধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীরা, গণবিজ্ঞান ও গণ আন্দোলনের কর্মীরা আজও তাঁকে ও তাঁর অবিস্মরনীয় গানগুলিকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় নিবিড় মগ্নতায় স্মরণ করেন | ‘আমি তোমাদের অতি চেনা বন্ধু’, ‘আজ আয়সা রাজ লানা হ্যায়’, ‘বদল ডালো’ , ‘শত শহীদের রক্তে রাঙা পতাকা’, ‘অহল্যা গো মা জননী’, ‘মিলো রে মিলে’, ‘বাউল রে তোর’ ইত্যাদি মনিমুক্তোর মতো গানগুলি আজও গণসংগীত প্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে |
তবু সাধারণ শ্রোতারা সুরশ বিশ্বাসের নামের সাথে পরিচিত নন | ‘বাংলা ব্যান্ড’ ও ‘বাংলা রক’ গানের উচ্চকিত যন্ত্র--দুষণের বাহুল্যে, পশ্চিমী রক, জ্যাজ ও পশের অন্ধ অক্ষম অনুকরণে আনন্দ বাদ্যের তালে নৃত্যচঞ্চল উন্মাদনা ও প্রগল্ ভ দুরন্ত স্বেচ্ছাচারী সুর সঞ্চারের নেশাতুর মত্বতায় মোহিত আজ-কের তরুন তরুনীরা সুরেশ বিশ্বাসকে চেনেন না | তিনি গোলাপ- রজনীগন্ধায় সাজানো আলোর আলোর রোশনাই মাখা মখমলি মঞ্চের শিল্পী ছিলেন না | এসট্যাবলিশমেন্টের সাথে সমঝোতা করা পেশাদার বা ‘শৌখিন প্রগতিশীল’ গায়কও ছিলেন না | গণমাধ্যমের ক্যামেরার ফ্ল্যাশগানের আলোর বিদ্যুত্প্রভায় ঝলকিত হয়নি তার গানের আসর | আমৃত্যু জীবন সংগ্রাম ও লোকায়ত জনজীবনের গান গেয়েও এইচ এম ভি ব্যান্ডেড ‘জীবনমুখী’ গানের শিল্পী তালিকায় ঠাঁই পান নি | সত্তরের দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের যুগসন্ধিক্ষণে এবং এই ক্রান্তিকালের উত্তরপর্বে সশস্ত্র গণমুক্তি সংগ্রামের ভাবধারা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন বলে প্রতিষ্ঠানিক মহলে চিরকালই বাত্য ছিলেন |
১৯৯৮ সালে ভারতের মানবতাবাদী সমিতির পক্ষ থেকে প্রদত্ত ‘হিউম্যানিস্টিস্ এওয়ার্ড’ ছাড়া আরও কোনও সন্মাননা বা পুরস্কার এই প্রবীণ কিংবদন্তী শিল্পীকে দেওয়া হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই | প্রাতিষ্ঠানিকতার সাথে আপোস করা তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল | তাই লাইমলাইটের উজ্জ্বলতায় নয়, প্রচার বিমুখ এই গণশিল্পীর হীরের মতো নিখাদ কন্ঠস্বর নিজের দ্যুতিতেই ছিল ভাস্বর, প্রদীপ্ত | তাঁর সৃষ্ট গানই ছিল এই অমর স্রষ্টার একমাত্র ও শ্রেষ্ট পরিচয় |
প্রায় ৪৫ বছর দীর্ঘ সংগীত জীবনে আনুমানিক তিন শতাধিক গান তিনি লিখেছিলেন | হাটে-বাটে-মাঠে, গ্রামে গঞ্জে, কলকারখানার গেট থেকে মহানগরীর রাজপথের মিছিল---সর্বত্রই ধ্বনিত হত তাঁর জলদগম্ভীর অথচ কোমল মাধুর্য মাখা প্রতিবাদী কন্ঠস্বর | যাটের দশকের গোড়ায় গনসংগীতের প্রবাদপুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর গান শুনে সস্নেহে বলেন----“আরে তুমি ভালো গাও তো, তুমি ভালো করে গান কর | তুমি ভালো লোকসংগীত গাইতে পারবে |”
৬০-এর দশকের মাঝামাঝি তিনি ‘তিনি মতিলাল দাশ সম্প্রদায়’ নামে আকাশবাণীতে গান করতেন | সেইসব লোকসংগীতের পুরোনো রেকর্ড কি আকাশবাণীর সংগ্রহশালায় আছে ? নাকি তাঁর অসংখ্য গণসংগীতের মতো সেগুলিও নির্দয় কালের নিতল গর্ভে তলিয়ে গেছে ? হায়, কেউ কি ডুবুরী হয়ে সেইসব মহার্ঘ রত্নের সন্ধান করবে না ?
শুধু লোকগান নয়, শাস্ত্রীয় সংগীতও তিনি সমান কুশলতায় অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে গাইতে পারতেন | মুঙ্গেরের একজন পাকিস্থানী ওস্তাদ ও লক্ষ্ণৌ ঘরানার ধ্রুপদী গায়িকা মীনাক্ষী বাঈ-এর কাছে নাড়া বেঁধে উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সংগীত শেখেন | গননাট্য সংঘ ও সলিল চৌধুরীর প্রভাবে গণসংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন | সংঘের ছেলেদের সাথে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছেন পঞ্চাশ- যাটের দশকে খাদ্য আন্দোলনের সময় | পরে নকশাল আন্দোলনে প্রাণিত হয়ে সত্তর দশকে ও তার উত্তরকালে সলিল চৌধুরীর প্রভাব কাটিয়ে নিজস্ব স্বতন্ত্র আঙ্গিকে গান সৃষ্টি করেন | এই সময়কালেই তাঁর অসামান্য সংগীত প্রতিভার সর্বোচ্চ সৃজনশীল বিস্ফুরণ ঘটে | সমাজ বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শোষিত-নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যে গান তিনি সৃষ্টি করেন, তার আবেদন দেশ-কালের সীমানা ডিঙিয়ে পরিব্যপ্ত হয়ে সার্থকভাবে আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে | হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথায়, “স্বদেশিকতার ধারা যেখানে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার সাগরে গিয়ে মিশেছে, সেই মোহনায় গণসংগীতের জন্ম |” সুরেশ বিশ্বাসের গান যথার্থ ভাবেই এই সংজ্ঞায়সংজ্ঞায়িত গণসংগীতের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত |
বিদেশী সুরের ছাঁচে ফেলা স্লোগানসর্বস্ব গণসংগীতের ধারা থেকে সরে এসে মার্গ সংগীত, দেশজ লোকগান আর পশ্চিমী সুরের সমন্বয় ও সংমিশ্রণে এক নতুন ফর্মে গান তৈরি করেন | এই আঙ্গিকে ছিল ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের রাগ বিস্তারের রস, লোকসংগীতের মাটির গন্ধমাখা মধুর সুর ও ছন্দোময় দোলা, আবার পাশ্চাত্য ক্ল্যাসিকাল সিম্ফনিক স্টাইলের সুরেলা মাধুর্য বা কখনো কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনিদের যৌবনদীপ্ত গানের মাদকতা | মাটির মানুষের মন ছুঁয়ে যেতে তিনি বাউল গণসংগীত বা লোকসংগীতের ফর্ম গ্রহণ করেন | এ ব্যাপারে তিনি চারণকবি মুকুন্দ দাসের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন | একটা সময় ‘সুরেশ বাউল’ নামে জনপ্রিয় হন | অন্ধ্রপ্রদেশের বিপ্লবী চারণকবি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট গণসংগীত শিল্পী গদরের মতোই পায়ে ঘুঙুর বেঁধে গানের তালে তালে নেচে নেচে বাউলের বেশে গান গাইতেন | শেষ জীবনে পক্ষাঘাতগ্রস্ততার দরুন নাচতে পারতেন না | সংসারের অভাব-অনটনের জ্বালা মেটাতে জীবিকার সন্ধানে পথে পথে ঘুরতেন | টিউশনি করতেন | ‘কেয়া’সাবান ফেরি করতেন | যৎকিঞ্চিৎ সন্মানদক্ষিণা কখনও মিলত, কখনও তাও মিলত না | অসুস্থা স্ত্রী ও ছেলের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার দায়বদ্ধতায় সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে গানের রেওয়াজ করার সময় পেতেন না |
দৈন্যদীর্ণ সংসারের চাপে, নিয়মিত স্বরসাধনার অভাবে ভগ্নস্বাস্থ্য ও রোগগ্রস্ততার দরুন জীবনের শেষের দিকে ওঁর গলা অনেকটাই খারাপ হয়ে গেছিল | একবার গণআন্দোলনের মঞ্চে জড়িত এক স্বনামী চিকিত্সক ওঁর গান সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘সুরেশদার কোয়ালিটি অফ্ টোন ভালো নয় !’ হেমাঙ্গ বিশ্বাস স্বয়ং যাঁর কন্ঠের আপ্লুত প্রশংসা করেছেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে নয়, বাংলার আঙিনা ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের নানা জায়গায়, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, ছত্তিশগড় যেখানে চলমান সশস্ত্র জনযুদ্ধ চলেছে --- সর্বত্রই যে বিপ্লবী গায়ক তাঁর গানের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছেন, সুর সৌভিকের জাদুকন্ঠে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছেন আপামর জনতা, বৈপ্লবিক আদর্শ ও আবেগে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন তাঁর গানে, সেই মানুষটির ‘quality of tone’ নাকি ‘ভাল নয়’ ! একি প্রাতিষ্ঠানিক দম্ভ ও ঔদ্ধত্য ? নাকি মধ্যবিত্ত পাতি বুর্জোয়া মননের শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা ?
আরেক প্রখ্যাত গণশিল্পী দিলীপ বাগচীতো এঁদের সম্পর্কেই বলেন, “গণসংগীত তার গণভিত্তি ভূমি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে শহরে বুদ্ধিজীবীর পেলব বাহুলতা ধরে তার ড্রইংরুমের আসবাব হয়ে যায়” | গণসংগীতকে ধুলোমাখা মাটির পৃথিবী থেকে ছিন্নমূল করে এঁরাই তাঁদের সংগ্রামবিমুখ জীবনে অর্থ-কীর্তি-স্বাচ্ছন্দ্য-স্বচ্ছলতা পরিপূর্ণ ‘সুখী গৃহকোণে’-র শোভাবর্ধনের জন্য রাখা দামী ‘হাই-ফাই’ মিউজিক সিস্টেমে বাজিয়ে অবসর বিনোদন করেন | স্বভাবভীরু আপোসকামী নাগরিক বুদ্ধিজীবীদের ‘বিপ্লবী’ আস্ফালন তাই আজও তাত্ত্বিক আলোচনার ঘেরাটোপেই রইল, কলেজস্ট্রিটের কফি হাউসের দরজা ডিঙিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ধূলিধূসরিত পথে শ্রমিক-কৃষক-সর্বহারার সংগ্রামী সত্তার সাথে একাত্ম হয়ে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে যেতে পারলো না | সমাজ বিপ্লবের আঁচ থেকে গা বাঁচিয়ে চলা এইসব প্রাতিষ্ঠানিক ‘প্রগতিশীলতা’ র ধ্বজাধারী বুদ্ধিজীবীরা তো সশস্ত্র গণসংগ্রামের আদর্শের কথা সোচ্চারে বলা সুরেশ বিশ্বাসকে উপেক্ষা করবেনই |
তাই খ্যাতির কাঙাল অর্বাচীন গণসংগীত শিল্পীরা প্রচারের লোভে মিডিয়ার লাইমলাইটের আলোয় আমার জন্য শ্রেণী সংগ্রামের আদর্শের কথা ভুলে গিয়ে, মেহনতী জনসমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের সৃষ্ট ভোগবাদী সংস্কৃতির ফাঁদে পড়ে পারস্পরিক অসুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জড়িয়ে পড়েছেন | আন্তনিও গ্রামশ্চির ‘বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা’ আজ সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়োতে প্রতিষ্ঠানের দাসে পরিণত হচ্ছেন | তাই অতীতের লোককবি রমেশ শীল, গণকবিয়াল গুরুদাস পাল, নিবারণ পন্ডিত, শহীদ কবি ব্রজলাল অধিকারী, কবিয়াল রাইগোপাল দাস, শেখ গুমানী, বিনয় রায়, সনাতন মন্ডল প্রমুখ খ্যাতানামা গণশিল্পীর মতোই পরবর্তী কালের পরেশ ধর, দিলীপ বাগচী, সুরেশ বিশ্বাস , শহীদ কালাচাঁদ দালাল বা ৬০--৭০ দশকেরই সাগর চক্রবর্তী, পৃথ্বীশ দাশগুপ্ত (মেঘনাদ ) ও আরও অনেক প্রতিভাবান গণসংগীতকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজের উপেক্ষা, উদাসীনতা অবহেলায় বাঙালীর স্মৃতি থেকে মুছে যাচ্ছেন |
‘জীবনমুখী’ গানের লেবেলে বাজারমুখী গান এবং লোকায়ত ঐতিহ্যের শেকড়ছেঁড়া উচ্ছঙ্খল বাংলা ব্যান্ডের উন্মত্ত তান্ডবে সুরেশ বিশ্বাসেরা চিরতরে হারিয়ে যাবেন | হারিয়ে যাবে ইতিহাস | হারিয়ে যাবে বীজ মাটি-শেকড়ের গান | বাংলা ফোক- রকের বানিজ্যিক আগ্রাসনে পশ্চিমী সংস্কৃতির বহিরঙ্গের অন্ধ অনুকরণে অসম্ভব সম্ভাবনাময় ও প্রতিভাধর গায়ক হওয়া সত্ত্বেও দিগভ্রান্ত রূপম ইসলামের হাতে বাংলা লোকগান ও বাউলগান ক্রমশ ধ্বংস হয়ে “ফসিলে” পরিণত হবে | ক্রমবর্ধমান বেকারিত্ব, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, পন্যমুখী ভোগবাদী সমাজে use and throw commodity-র মতো মূল্যবোধকেও ছুঁড়ে ফেলা অস্থির জীবন মানবিক সম্পর্কেও জটিলতা ও ভাঙন ধরাচ্ছে | পুঁজির বিশ্বায়নে সৃষ্ট ভোগের কৃত্রিম চাহিদার মরীচিকার টানে আবিষ্ট হয়ে মৃত্যুবিলাসী প্রাচীন রোমের গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতার প্রাণঘাতি লড়াইয়ে বৈরাগ্য, অবক্ষয়, গ্লানি, ও অবসাদে বিধ্বস্ত মধ্যবিত্ত সমাজে রাজনৈতিক দিশাহীনতা জন্ম নিচ্ছে শ্রমজীবী জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেরিয়ার-সর্বস্ব সমাজভাবনাহীন নির্লিপ্ত স্বার্থপরতায় অন্ধ তরুণ-তরুণীরা গাইছেন “ আমাকে আমার মতো থাকতে দাও / আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি” | এই “এলিয়েনেশন্” বা বিচ্ছিন্নতাবোধের অবক্ষয়ী সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেয়ে আজকের তরুণ সমাজের সুরেশ বিশ্বাসের সেই আলোকোজ্জল জীবনবোধের গান শোনা বড়ো প্রয়োজন | “আমি তোমাদের অতি বন্ধু / আমি নিপীড়িত মানুষের শিল্পী / আমি জনতার মাঝে গিয়া গাই গান / আমি লড়াইয়ের সুরেতে মেলাই প্রাণ“ |
দিন বদলের স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া আত্মবিস্মৃত এই নবীন প্রজন্ম অসুস্থ প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় তীব্র হাহাকার ও নৈরাজ্যের বেদনায় রূপমের সাথে গাইছেন --- “আমি জানি, চোরাবালি কতখানি গিলেছে আমাদের রোজ” | এই “চোরাবালি” র ঘগ্রাস থেকে কে মুক্তি দেবে ? হতাশার অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরাবে কে ? কে খুঁজে এনে দেবে রূপম- অনুপমের “হারানো স্বপ্নের খোঁজ” ? তাই ওঁরা জীবন সংকট থেকে অলীক মুক্তির পথ খুঁজছে মানুশ্রী প্রেমের বুর্জোয়া রোম্যান্টিকতায়, মন হারিয়ে শুধু নারীর শরীরী সহসুখে ওঁরা বেঁচে থারকতে চাইছে শয্যাসঙ্গিনীর সুখের চাদরে পরিচিত হাতের আদরে কিংবা ‘নরম বালিশে, প্রেয়সীর চোখের নালিশে মায়াবী রাতপরীদের ম্লান’ -এ | আজ সুরেশ বিশ্বাস বেঁচে থাকলে এই দিশাহীন নবীনদের পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়ে ওঁদের হাত ধরে গেয়ে উঠতেন সত্যিকারের বেঁচে থাকার গান--- “ বদল ডালো ইয়ে দুনিয়া / অব না রোনা , মরনা হ্যায়” | কান্না নয় মৃত্যু নয়, দুনিয়াটাকেই বদলে দাও | এমনই তো ছিলেন আমাদের সুরেশদা-- গণসংগীত প্রেমীদের সুরেশ বাউল | উপেক্ষা, অবহেলা, অপমান সয়েও , দারিদ্রের আঁধার ঘেরা জীবনেও আলো জ্বালানোর স্বপ্ন দেখেছেন আমৃত্যু |
আজ থেকে আট আগে দীর্ঘ রোগভোগের পর ৩১ শে জানুয়ারী ২০০৩ ‘ আলোর পথযাত্রী’ এই মানুষটির জীবনদীপ নিভে যায় কালীঘাটের বস্তির সেই ছোট্ট অন্ধকার ঘরটায় | তবু রবীন্দ্রনাথের কথায়, “শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে ? আঘাত হয়ে দেখা দিলে, আগুন হয়ে জ্বলবে |” মরণোত্তর দেহদানে অমর হয়ে সুরেশদা তাঁর মৃত্যুর পরেও অমৃতের বার্তা পেল | তাঁর গানে গানে ছড়ানো আগুন শহর থেকে দূরে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী গাঁয়ে গাঁয়ে গণমুক্তি সংগ্রামের অনির্বাণ দীপশিখা হয়ে আজও প্রজ্জ্বলিত |
রাজেশ দত্ত, মার্চ ২০১১, চন্দন নগর মোবাইল : ৯৪৩৩৫৬৬৩০২ ই-মেল : rajeshdattain@yahoo.com , rajeshdattain@gmail.com
********************************************
...
|
|