কবি সুরেশ বিশ্বাস - জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৩৮ সালে | বাংলা গণসংগীতের প্রবাদপ্রতিম গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী সুরেশ বিশ্বাস আজ বিস্মৃতপ্রায়। তাঁর জীবদ্দশায় আশির দশকের শেষে একটি মাত্র গানের ক্যাসেট বেরিয়েছিল। শিল্পীর কিছু গুণগ্রাহীর উদ্যোগে “গণমঞ্চে”র পরিবেশনায় “সুপ্ত আগুন আছে ক্রোধে মিশে”। এই ক্যাসেটের নয়টি গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। দুই দশক অতিক্রম করেও গানগুলি আজও গণসংগীতপ্রেমীদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। ক্যাসেটটি এখন দুর্লভ হলেও একালের বিপুল চক্রবর্তী, প্রবীর বল, অসীম গিরি, সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট গণশিল্পীদের কণ্ঠে সেই অমর গানগুলি আজও শোনা যায়। তবু সাধারণ শ্রোতারা সুরেশ বিশ্বাসের নামের সাথে বিশেষ পরিচিত নন। “বাংলা ব্যান্ড” ও “বাংলা রক”- এর নেশাতুর উন্মাদনায় মাতোয়ারা তরুণ প্রজন্ম তাঁকে চেনেন না। কিন্তু তৃতীয় ধারার রাজনৈতিক আন্দোলন ও গণআন্দোলনের কর্মীরা তাঁকে ও তাঁর অবিস্মরণীয় গানগুলিকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় ও নিবিড় মমতায় স্মরণ করেন।
শিল্পীর জন্ম অবিভক্ত ভারতের (অধুনা বাংলাদেশের) ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমার জয়পাড়া গ্রামে। বাবা কালীচরণ বিশ্বাস ও মা অলকারাণী বিশ্বাস। শিল্পীর সঠিক জন্মতারিখ ও সন তাঁর নিজেরেও অজানা ছিল। দমকা বাতাসে শিমুল তুলোর মতো ভেসে বেড়ানো বোহেমিয়ান জীবনের চরম ঘাত-প্রতিঘাত ও অস্থিরতায় অতীতের অনেক স্মৃতিই হারিয়ে গেছিল।
পিতামহ বলাই বিশ্বাস ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও গ্রামের মাতব্বর। শিল্পীর শৈশবকালে বাবা কালীচরণ বিশ্বাস গোপনে আবার বিয়ে করেন। দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী ছিলেন মুসলিম। নাম জামিরুন বিবি। এই বিয়ের কথা পরে জানাজানি হলে প্রথমা স্ত্রী বেঁচে থাকতে দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ ও “বিধর্মী” মেয়েকে বিয়ে করার অপরাধে ঠাকুর্দা বাবাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। তিনি সমাজে জাতিচ্যুতও হন। তখন তিনি প্রথমা স্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ পুত্রকে চিরদিনের মতো ত্যাগ করে ছোটো ছেলে সুরেশ ও তাঁর সৎ-মাকে নিয়ে এপার বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার কাঁচরাপাড়ায় চলে আসেন।
এখানে এসে সুরেশের নতুন নাম রাখেন ফকির। ছেলেবেলায় তিনি জামিরুন বিবিকেই নিজের মা বলে জানতেন। তাঁর আসল নাম যে সুরেশ, তিনি যে হিন্দু মায়ের সন্তান এবং তাঁর মা অলকারাণী ও বড়োভাই দীননাথ যে বাংলাদেশে আছেন, একথা বালক “ফকির”কে জানানো হয়নি। বাবা ওঁকে বলতেন, “পাকিস্তানে যারা আছে, তারা তোর কেউ নয়”।
জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসার সময় বাবা সব স্বর্ণালংকার সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। কাঁচরাপাড়ায় এসে সে সব গয়নাগাটি বেচে বনেজঙ্গলে ভরা গোশালার জমিজমা কিনে জমিদারি খুলে বসেন। সংখ্যালঘু ও নিম্নবর্গের গরিব প্রান্তিক মানুষেরা তাঁর তালুকের প্রজা ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই জমিদারি ধ্বংস হয়ে যায়। ইতিমধ্যে দেশভাগ হয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভিটেমাটি, স্বজন হারানো উদ্বাস্তু জনস্রোত এসে এ বাংলায় আছড়ে পড়েছে। শিল্পীর পারিবারিক অবস্থারও অবনতি হয়েছে। মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ে বাবা প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন। বালক সুরেশ হতশ্রী সংসারের অভাব-অনটন ঘোচাতে দুধ বেচতে শুরু করেন।
কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই তাঁর গানের সাথে ছিল মিতালী। সুরের টানে চলে যেতেন কাঁচরাপাড়ার গণনাট্য সঙ্ঘের আসরে। মুগ্ধ হয়ে শুনতেন সলিল চৌধুরী, সুকান্তের গান। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান তাঁর সবুজ মনে দাগ কেটেছিল। গণনাট্য সঙ্ঘের ছেলেরা ওঁকে খুব স্নেহ করতেন। সঙ্ঘের দায়িত্ব নিতেও অনুরোধ করেন। কিন্তু গানপাগল ছেলেটা তখন ভালো করে গান শিখতে আগ্রহী। কাঁচরাপাড়াতেই মঞ্জুকুমার রায়চৌধুরী ও তাঁর বাবার কাছে সংগীতের প্রথম পাঠ নেন।
ভুবনভরা গানের আনন্দের মাঝেই দেখা দিল হঠাৎ বিপর্যয়। দেশ থেকে তাঁর অগ্রজ দীননাথ এসে হাজির হলেন। সুরেশ জানতে পারলেন তাঁর প্রকৃত জন্মপরিচয়, হারানো মা-ভাইয়ের কথা। দুঃখে-বেদনায় অধীর হয়ে বাবার কাছে অভিযোগ জানালে তিনি রেগে গিয়ে খুব মারধোর করেন। তারপর একদিন বাহারি জুড়িগাড়ীতে চড়িয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে ঘটা করে রাবেয়া খাতুন নামে বছর আটেকের এক ছোট্টো মেয়ের বাড়িতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল। সুরেশ ভাবলেন, বুঝি বা তাঁর নতুন খেলার সাথী। পরে জানলেন, রাবেয়ার সাথে ওঁর বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। নিদারুণ অভিমানে ঘর ছেড়ে পালালেন। সেটা ১৯৫২-৫৩ সাল। পাশের এক ক্রীশ্চান পরিবারের বাড়িতে মাঝেমধ্যে গান শুনতে যেতেন। ওঁদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পাড়ি দিলেন বিহারের জামালপুরে। সেখান থেকে মুঙ্গেরে আলি মীর খাঁ সাহেবের বাসায়। শুরু হল সুরের সন্ধানে সুরসাধকের নিরুদ্দেশের পথচলা।
মুঙ্গেরে এক পাকিস্তানি ওস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধে মার্গ সংগীতের তালিম নেন। ওস্তাদজী যখন করাচীতে ফিরে যান, তখন মীনাক্ষী বাঈজীর কাছে গান শিখতে শুরু করেন। মীনাক্ষী বাঈ লখনৌ (মতান্তরে এলাহাবাদ) থেকে মুঙ্গেরে এসেছিলেন। তিনি এই বাঙালী কিশোরটিকে খুব ভালোবেসে ফেলেন। ওঁর গান শুনে বলেছিলেন, “তোমাকে আমি শেখাতে পারি, কিন্তু আমাকে কিনে নিতে হবে”। এক পয়সা হাতে দিয়ে বলেন, “বলো, আমি তোমায় কিনে নিলাম”। মীনাক্ষী বাঈকে সংগীতগুরু করে নেওয়ার আনন্দে খুশি মনে তিনি তাই বলেন। তখন থেকেই মীনাক্ষী বাঈয়ের কাছে থেকে তিনি হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত শিখতে লাগলেন।
মীনাক্ষী ওঁকে স্নেহে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে খুব আদর যত্নে রাখতেন। কিন্তু বাঈজীদের সমাজে এই “কিনে নেওয়া”র ব্যাপারটা তিনি আদৌ জানতেন না। সরল কিশোর মনে কোনো প্রশ্নও দেখা দেয়নি। পরে জানলেন, এটা বাঈজীদের বিবাহ রীতি। ওঁর অজ্ঞাতেই মীনাক্ষীর সাথে ঘর বেঁধে ফেলেছেন। এই নিয়ে মনোমালিন্য হয়।বাঈজীর সাথে আর থাকবেন না বলায় মীনাক্ষী রেগে গিয়ে ওঁর ভরণপোষণ নিয়ে গঞ্জনা দেন। মনের দুঃখে এক সকালে তিনি বাড়ি ছেড়ে আবার পথে বেরিয়ে পড়লেন। দিশেহারা হয়ে এখানে সেখানে ঘুরে কোথায় থাকবেন ভেবে না পেয়ে সন্ধ্যেবেলা ফিরে এলেন মীনাক্ষীর বাসায়। কিন্তু এসে দেখেন বাঈজী অভিমান করে চলে গেছেন। কোথায় গেছেন কেউ জানে না। মীনাক্ষী বাঈয়ের বেনারসের একটা ঠিকানা পেলেন। অনুতপ্ত হয়ে ওঁকে খুঁজে পেতে কাশীতে গেলেন। কিন্তু সেখানেও তাঁর সন্ধান পেলেন না। ওখানে দিন সাতেক ছিলেন। কাশীর গঙ্গার ঘাটে রোজ সাঁঝবেলায় এক অন্ধ গায়ক ভজন গাইতেন। ওঁর সাথে আলাপ জমিয়ে বেশ কিছু ভজন শেখেন।
যিনি তাঁকে “মনের মানুষ” করে সুরের দীক্ষা দিয়ে নবজীবন দান করেছিলেন, সেই গানের গুরুকে হারিয়ে ফেলে কষ্টে বেদনায় মন ভরে উঠেছিল। জীবনপুরের পথিক তাই কোনো দেশে সাকিন না পেয়ে ব্যথাতুর মনে ফিরে এলেন ঘরে। কাঁচরাপাড়ায় এসে দেখলেন সংসারের তখন আরও ভগ্নদশা। হতাশা, গ্লানি ও ব্যর্থতার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কিশোর বয়সের বাঁধভাঙা আবেগে রেলগাড়ির নীচে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করতে যান। গণআন্দোলন কর্মী বিশ্বনাথ মুখার্জি এসে তাঁকে বাঁচান। তিনি ওঁকে হতাশ না হয়ে লড়াই করে বাঁচতে বলেন। সার্থক শিল্পী হতে উৎসাহ ও প্রেরণা দেন। ওঁর হাত ধরেই সুরেশ বিশ্বাস কলকাতায় আসেন। অনেকদিন যাবৎ বিশ্বনাথ মুখার্জির বাসাতেই ছিলেন।
কলকাতায় এসে বহু গুণীজনের সান্নিধ্য লাভ করেন। গণনাট্য আন্দোলনের তখন স্বর্ণযুগ। জ্ঞানেশ মুখার্জি, শম্ভু ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য, বীরেন মুখার্জি প্রমুখ গণনাট্য সঙ্ঘের পুরোধা ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৯৬২-৬৩ সালে গণসংগীতের প্রবাদপুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাথে আলাপ হয়। সুরেশ বিশ্বাসের গান শুনে প্রশংসায় মুখর হয়ে তিনি বলেন, “আরে, তুমি ভালো গাও তো! ভালো করে গান করো। তুমি ভালো লোকসংগীত গাইতে পারবে”। তখন থেকেই শিল্পী তাঁর হৃদয়ে মননে লোকগানকে আত্মস্থ করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তিনি “মতিলাল দাশ সম্প্রদায়” নামে বেতারে অনুষ্ঠান করতেন। সেইসব লোকসংগীতের পুরনো রেকর্ড কি আকাশবাণীর সংগ্রহশালায় এখনও আছে? নাকি তাঁর অসংখ্য গানের মতো সেগুলিও কালের অতল গর্ভে তলিয়ে গেছে?
মহানগরীতে এসেও দারিদ্রের জ্বালা থেকে তিনি মুক্তি পাননি। রুজিরোজগার ও আশ্রয়ের খোঁজে ছন্নছাড়া যাযাবরের মতো পথে পথে ঘুরে বেরিয়েছেন। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক ও গান রেকর্ড করে খ্যাতি কুড়িয়ে পেশাদার গায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে রুপোলি পর্দার জগতে, রেকর্ড কোম্পানীতেও বহুদিন ঘোরাঘুরি করেন। লোকগানের পাশাপাশি মান্না দে, শ্যামল মিত্র প্রমুখ সেকালের জনপ্রিয় শিল্পীদের গাওয়া আধুনিক বাংলা গানও গাইতেন। গণনাট্য সঙ্ঘের বিভিন্ন দলের সাথে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে গণসংগীত গাইতেন। বিবাহোত্তর জীবনে খরচা আরো বাড়ে। মাঠে-ময়দানে গান গেয়ে সংসার চালানোর মতো পয়সা জুটত না। তাই রেলের খালাসি থেকে মুটে-মজদুরি, ঠোঙা বানিয়ে বিক্রি করা থেকে মুরগীর মাংস, ডিম বেচা, হকারি করা, টিউশনি করা - বহু বিচিত্র পেশায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে জীবন নির্বাহ করেছেন।
পঞ্চাশের দশকের শেষলগ্নে শহর কলকাতা যখন খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল, শিল্পী তখন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বাম রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট নৃশংস গণহত্যা (খাদ্য মিছিলে লাঠিচার্জে শিশু-বৃদ্ধসহ ৮০ জনের মৃত্যু)-র পর তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হন। ওই সময় থেকেই তিনি গণসংগীত রচনা করতে থাকেন। প্রথিতযশা শিল্পী সলিল চৌধুরীর গানের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। তাই প্রথম জীবনে কথা, সুর ও গানের আঙ্গিকে সলিল চৌধুরীকেই অনুসরণ করতেন।
বাম রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও তখনও তাঁর রাজনীতির মত ও পথ নিয়ে দ্বিধাদন্দ্ব কাটেনি। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময় চরম রাজনৈতিক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন। একদিকে সারা দেশজুড়ে “দেশপ্রেমে”র বান ডেকে ভারতরক্ষা আইনের নানারকম বেআইনি প্রতিহিংসাত্মক প্রয়োগে কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, অন্যদিকে রাষ্ট্রের দমনপীড়নের ভয়ে অনেক নামীদামী বামপন্থী শিল্পী- সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবিদের আপোস আরো অনেকের মতো সুরেশ বিশ্বাসকেও দিগ্ভ্রান্ত করেছিল। পরবর্তীকালে তিনি পরম সততার সঙ্গে নিঃসংকোচে স্বীকার করেন যে ওই নবীন বয়সে রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর কোনও ধ্যানধারণা ছিল না। শিল্পীর অকপট স্বীকারোক্তি- “তখন একটা প্রচণ্ড নামের মোহ ছিল”। তাই কংগ্রেস নেত্রী মায়া ব্যানার্জি তাঁকে খ্যাতি, যশ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার লোভ দেখিয়ে দলে টেনে নেন। কিন্তু অচিরেই মোহভঙ্গ হয়। পার্টির আদর্শহীনতা এবং নেতানেত্রীদের দ্বিচারিতা ও ভ্রষ্টাচার দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কংগ্রেসের সংস্রব ত্যাগ করেন।
১৯৬৬ সালে আবার দেখা দিল চরম খাদ্যসংকট। জেলায় জেলায় “চাল চাই”, “কেরোসিন চাই” বলে গরিবের আর্তনাদ উঠল। আবার শুরু হল পুলিশি নিপীড়ন। গুলি চলল দু’মুঠো ভাতের দাবিতে আন্দোলনরত অভুক্ত জীর্ণশীর্ণ নিরীহ মানুষের উপর। ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বসিরহাটের স্বরূপনগরে গরিব রাজমিস্ত্রীর ১১ বছরের তরতাজা ছেলে নুরুল ইসলাম শহীদ হলেন। রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ প্রতিবাদের ঝড় উঠল। সুরেশ বিশ্বাস তাঁর কন্ঠের প্রতিবাদী গান নিয়ে খাদ্য আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামিল হলেন। শিল্পীর নিজের দু’টি প্রিয় গান- “বিদ্রোহ করি আয়” এবং “আয়না রে গাই দিনবদলের গান” এই সময়কালেই রচিত। উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাতে খাদ্য মিছিলে স্থানীয় গ্রামবাসীদের দাবিতে গান বাঁধলেন- “আয়না রে গাই দিনবদলের গান / আয়রে দেশের চাষী মজুর, গাইরে বাঁচার গান”। মাদলের নৃত্যচঞ্চল ছন্দে গানটি সবার সঙ্গে নেচে নেচে গাইতেন।
১৯৬৭ সালের ২৫ মে নকশালবাড়ির হত্যাকাণ্ড (১১ জন শিশু ও কৃষক রমণী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়) গণশিল্পী সুরেশ বিশ্বাসের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দিল। নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহের আগুন দাবানল হয়ে সারা ভারতের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল। ছাত্র-যুব আন্দোলনে এক নতুন জোয়ার এল। এই ক্রান্তিকালেই মাও সে-তুং-এর রচনা পড়ে শিল্পী বৈপ্লবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। আগুন জ্বলল প্রাণে। তুফান উঠল গানে। উদ্দীপিত তারুণ্যের আবেগে একের পর এক গান লিখলেন। রেডিও-সিনেমায় যশস্বী ও খ্যাতকীর্তি হবার মোহ বিসর্জন দিয়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁর নিজের কথায়, “ আমার মনে এমন ভাব এল যে তখনই বোধহয় সব ভেঙেচুরে তছনছ করে দেব”। এই যুগসন্ধিক্ষণেই তাঁর অসামান্য সংগীত প্রতিভার সর্বোচ্চ সৃজনশীন বিস্ফুরণ ঘটে। নকশালবাড়িতে পুলিশের গুলিচালনায় শহীদ কৃষক রমণীদের স্মৃতিতে লেখেন সেই অবিস্মরণীয় গান - “অহল্যা গো মা জননী”। রচিত হয় “শত শহীদের রক্তে রাঙা পতাকা”, “মজদুঁরো চাহে তো” ইত্যাদি আরো অনেক জনপ্রিয় গান।
জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলনকে নিষ্পেষিত করতে বর্বর ও পৈশাচিক আক্রমণ চালালো রাষ্ট্রশক্তি। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর “বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ” স্তব্ধ হল। নৈরাশ্যপীড়িত না হয়ে ১৯৭২ সাল থেকে শিল্পী আরো গভীরভাবে রাজনৈতিক পঠনপাঠনে মনোনিবেশ করেন। ১৯৭৫-এর জরুরী অবস্থার পর কোনও পার্টি বা গ্রুপে না গিয়ে গান, আলোচনা, মতাদর্শগত বিতর্ক, অধ্যয়ন ও মেহনতী মানুষের আন্দোলনের মধ্যেই আত্মনিয়োগ করলেন।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের উত্তরকালে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে আন্দোলনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় জারিত করে এক নতুন সংগ্রামী জীবনবোধে তাঁর শিল্পী সত্তা ও সংগীত শৈলীর উত্তরন ঘটান। শিল্পীর নিজের কথায়, তাঁর “চেতনার Growth হতে আরম্ভ হল”। অতীত যৌবনের আবেগমথিত “Heroism” নয়, শ্রেণীশোষণের বিরুদ্ধে সমষ্টিগত লড়াইকেই জীবনের সবচেয়ে বড়ো আদর্শ বলে গ্রহণ করলেন। আপোসহীন অদম্য প্রত্যয়ে আমৃত্যু তিনি এই আদর্শে অবিচল থেকেছেন। তাঁর নিজের কথায়-“আমি তখন ঠিক করলাম যে সুরেশ বিশ্বাস হতে হবে, সলিল চৌধুরী হলে চলবে না, কারুর ছাপ থাকবে না। এবং শুধু তাই নয় এই সময় সচেতনতার ফলে একটা দর্শন আমাকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দিল যে আমি বুঝতে পারলাম গান কীভাবে হওয়া উচিত”।
তিনি ছিলেন চারণকবি মুকুন্দ দাসের মন্ত্রশিষ্য। মুকুন্দ দাসের স্বদেশী গানের বলিষ্ঠ কথা, ভাবের গাম্ভীর্য, গায়কীর তেজঃপূর্ণ দৃপ্ততা অথচ দেশজ গ্রামীণ মেঠো সুরের আশ্চর্য কোমল মাধুর্য শিল্পীকে আকৃষ্ট করে। লোকগানকে ভেঙে নিয়ে কিছুটা মূল সুরের ছাঁচ রেখে বাকিটা ভেঙেগড়ে মিশিয়ে লোকগণসংগীত বা বাউল গণসংগীতের অভিনব ফর্মটা তৈরি করেন। একটা সময় তিনি “সুরেশ বাউল” নামে জনপ্রিয় হন। মাটির মানুষের মন ছুঁয়ে যেতে বাউলের পোশাক পরে, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নেচে নেচে গান গাইতেন। শেষ জীবনে পক্ষাঘাতগ্রস্ততার দরুন নাচতে পারতেন না।
বিদেশী সুরের ছাঁচে ফেলা প্রচলিত স্লোগানধর্মী গানের ধারার প্রভাব কাটিয়ে ধ্রূপদী সংগীত, লোকগান ও পাশ্চাত্য গানের সুরের সার্থক সমন্বয় ও সংমিশ্রণে বাংলার গণসংগীতের ধারায় এক উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্য এনেছিলেন। সমাজ বিপ্লবের মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রেণীসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পাল্টা সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার সপক্ষে এই নিজস্ব আঙ্গিকে তিনি প্রচুর গান তৈরি করেন। দীর্ঘ চার দশক ধরে তিনি বাংলা ও হিন্দীতে প্রায় তিনশতাধিক গান লিখেছিলেন। অরুণ মিত্র, সরোজ দত্ত প্রমুখ কবির কবিতায়ও সুর দিয়েছেন। গ্রামেগঞ্জে, হাটেমাঠে, খেতেখামারে, কলকারখানা থেকে রাজপথের মিছিল -সর্বত্রই প্রতিধ্বনিত হত তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠ। যেখানে খেটে খাওয়া মানুষের লড়াই, সেখানেই ছিল তাঁর দৃপ্ত উপস্থিতি। ক্যামেরার ফ্ল্যাশগানের বিদ্যুৎপ্রভায় ঝলসিত নাগরিক জলসা নয়, ধুলোমাখা মাটির পৃথিবীই ছিল তাঁর গানের মঞ্চ। প্রাতিষ্ঠানিকতার সাথে আপোস করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। তাই সমকালীন প্রখ্যাত শিল্পীদের মতো আত্মপ্রচারে ব্যাপৃত না হয়ে, “সুরের রাজা” সুরেশ নিভৃত সুরসাধনায় মগ্ন থেকেছেন। মিডিয়ার লাইমলাইটে নয়, প্রচারবিমুখ এই শিল্পীর হীরের মতো নিখাদ কণ্ঠস্বর স্বদ্যুতিতেই ছিল ভাস্বর, প্রদীপ্ত। তাঁর সৃষ্ট অম্লান গানগুলিই ছিল এই অমর স্রষ্টার একমাত্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয়। তাই তিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী গণশিল্পী।
১৯৯৮ সালের ১২ ডিসেম্বর কলেজ স্কোয়ার স্টুডেন্টস্ হলে “বিশ্ব মানবাধিকার দিবস” উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে “ভারতের মানবতাবাদী সমিতি”র পক্ষ থেকে এই মহান গণসংগীতশিল্পীকে “Humanists’ Award” পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।
যে মানুষটি একদিন গানের টানে ঘর ছেড়েছিলেন, কৈশোর থেকে বার্ধক্য সারা জীবনই তাঁর কেটেছে জীবনযুদ্ধের গান নিয়ে। জীবন-জীবিকার চরম অনিশ্চয়তায় দুর্বিষহ দারিদ্রের সাথে জীবনভর লড়াই করেছেন। জীবন সায়াহ্নে ভগ্নস্বাস্থ্য ও রোগগ্রস্ত মানুষটি অসুস্থা স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে সুমনকে নিয়ে কালীঘাটের বস্তির একটি ছোট্ট ঘরে দিন কাটিয়েছেন। ছেলে পেশাদার গীটারবাদক হলেও উপার্জনের কোনো নিশ্চিত সংস্থান ছিল না। নিদারুণ অভাবে প্রায় অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হয়েছে। শেষের দিনগুলিতে শিল্পীর এই দুঃসময়ে তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সহযোদ্ধা ও অনুরাগীরা অনেকেই বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে বাঁচানো যায়নি।
দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০০৩ সালের ৩১ জানুয়ারি, শুক্রবার এই “আলোর পথযাত্রী”র জীবনদীপ নিভে যায় কালীঘাট বস্তির সেই ছোট্ট অন্ধকার ঘরটিতে। তাঁর মরদেহ নিয়ে শোকমিছিলে সম্মিলিত কন্ঠে “শত শহীদের রক্তে রাঙা পতাকা” গানে রাজপথ মুখরিত করে সামিল হন শিল্পী-কবি-বুদ্ধিজীবি-রাজনৈতিককর্মী- গণআন্দোলনকর্মী ও অনুরাগীরা। শোকযাত্রা শেষে শিল্পীর অন্তিম ইচ্ছা অনুসারে তাঁর মরদেহটি সৎকার না করে মানব কল্যাণে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে দান করা হয়। মরণোত্তর দেহদানে অমর হয়ে “নিপীড়িত মানুষের শিল্পী” সুরেশ বিশ্বাস তাঁর মৃত্যুর পরেও অমৃতের সন্ধান দিয়ে গেছেন। তাঁর গানে গানে ছড়ানো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ গণমুক্তি সংগ্রামের অনির্বাণ দীপশিখা হয়ে বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আজও প্রজ্জ্বলিত।
সাহায্যসূত্র-
১) “জলার্ক” গণসংগীত সংখ্যা-১, (মাঘ ১৪০১ -আষাঢ় ১৪০২)-এ প্রকাশিত সুরেশ বিশ্বাসের সাক্ষাৎকার। ২) নকশাল বাড়ীর প্রভাবে শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র, সম্পাদনা- অমর ভট্টাচার্য, নয়া ইস্তেহার। ৩) ১৯৯৭ সাল থেকে সুরেশ বিশ্বাসের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় সূত্রে লেখকের আলাপচারিতা।